পারিজাত পর্ব ১০

0
931

#পারিজাত
#নুজহাত_আদিবা
পর্ব ১০

পারিজা বাড়ি ফিরে আসাতে সবচেয়ে অখুশি যে হয়েছিল। তিনি হচ্ছেন পারিজার শাশুড়ী সুগন্ধা মির্জা। তবুও তিনি হাল ছাড়েননি। একের পর এক মেয়ে দেখছিলেন। পারিজা সেই ব্যাপারে নিজের স্বামীর সঙ্গে কথা বলেনি। তবে, একটা কথা পরিস্কার জানিয়ে দিয়েছে। ঘরে যদি আরেকটা বউ আসে। তাহলে সেইদিনই পারিজার শেষ দিন এই বাড়িতে। ওয়াহেদ সেটা মোটেও চায় না। বিয়ের কথা তোলাতে বিরক্ত হয়েছে বারবার।

ভর দুপুরে পারিজা ছাঁদের কিনারে গিয়ে দাঁড়ালো। টপা এলো কাপড় তুলতে। পারিজা টপাকে দেখেই সেদিকে এগিয়ে গেল। টপা পারিজাকে দেখে বললো,
— ছোট ভাবী! কবে এলে তুমি?”

পারিজা হেসে বললো,
— এই তো কালই এলাম।”

টপা কাপড়ের বালতি নিচে রেখে বললো,
— আমি তো ভেবেছিলাম তুমি আর ফিরবে না।”

পারিজা তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বললো,
— আমিও তাই ভেবেছিলাম। কিন্তু, এই ফেরাটা আমার জন্য না। আমার আম্মার জন্য। ”

টপা জিজ্ঞাসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
— মানে?”

পারিজা হেসে বললো,
— এদিকে বসো;সবটা বলছি তোমায়।”

টপা পারিজার পাশে এসে বসতেই পারিজা বললো,
–আমার আম্মার স্বামী আমার আম্মাকে খারাপ লোকদের কাছে বিক্রি করে দিয়েছিলেন। তারপরই এক প্রকার অসহায়তা,অত্যাচারের শিকার হয়ে আম্মা পতিতাবৃত্তি বেছে নেন।”

টপা অবাক হয়ে বললো,
— বলো কী ভাবী! তোমার বাবা তোমার মাকে বিক্রি করে দিলো!”

পারিজা নিরশ গলায় বললো,
— উনি আমার আম্মার স্বামী। তবে, আমার বাবা নন। আমার বাবা কে তা প্রকৃতপক্ষে আমি কিংবা আম্মা কেউই জানেন না।”

টপা পারিজার কথা শুনে নিজেও খুব কষ্ট পেল। এভাবে তাঁর পারিজাকে প্রশ্ন করা ঠিক হয়নি। পারিজা টপার দিকে তাকিয়ে বললো,
— আট মাস আম্মা ওখানে কাজ করেছিলেন। এরপর খানিকটা শারীরিক দুর্বলতা অনুভব করতেই;তিনি বুঝতে পারলেন তিনি গর্ভবতী।আম্মা ভোরবেলা সবার অগোচরে সেখান থেকে অল্পকিছু টাকা নিয়ে পালিয়ে চলে এসেছিলেন। প্রচন্ড ঝুঁকি নিয়ে এই কাজটা করতে হয়েছিল। ধরা পরলে জীবন মৃত্যুর ব্যাপার।ওখানে সন্তান জন্ম দেওয়ার শর্ত ছিল দুটি।কোনো পতিতা যদি ছেলে সন্তান জন্ম দেয়।তবে, সেখানকার মানুষ বাচ্চাটিকে চড়া দামে বিক্রি করে দিবে। আর সন্তানটি যদি মেয়ে হয়। তাহলে,তাঁকেও বড় হয়ে পতিতার পেশা বেছে নিতে হবে। আম্মা সন্তানের চিন্তা করে জীবন বাজি রেখে পালিয়ে চলে এসেছিলেন। এরপর সেভাবেই আমার জন্ম।”

টপা প্রশ্নোতর দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
— তারপর কী হলো ছোট ভাবী?”

পারিজা আবার বলতে শুরু করলো,
— আমার আম্মা প্রথমে একটি বাড়িতে বেশ কয়েক বছর ঝি এর কাজ করেছেন। তারপর একটু একটু করে সঞ্চয় করা টাকা থেকে একটা দোকান ভাড়া নিয়েছিলেন। কাপড়ের দোকান ছিল সেটা। প্রথম প্রথম দোকানটা তেমন চলতো না। আম্মা আমাকে নিয়ে দূর দূরান্ত থেকে সুন্দর কাপড় নিয়ে আসতেন। এরপর আস্তে আস্তে দোকানের নাম হয়;ক্ষ্যাতি হয়। এরপর আস্তে আস্তে আম্মা আবারও দোকান ভাড়া নিতে শুরু করলেন। এই একটু একটু করে শেষে আমাদের দোকানের সংখ্যা দাঁড়ালো সাতটি। আলাদা আলাদা পাড়ায় আমাদের সাতটা দোকান ছিল। খুব দূর্লভ,সুন্দর, টেকসই মানের কাপড় সংগ্রহ করতেন আম্মা। বাড়িতে সুই,সুতা দিয়ে নকশা করা জামাও বিক্রি করতেন। তখন ওখানে কেউ জানতো না আম্মা পূর্বে পতিতা ছিলেন। তারপর আমাদের অবস্থার উন্নতি হলো। আগে ছোট্ট ভাড়া বাড়িতে থাকতাম। তারপর নিজেদের বাড়ি হলো। বাড়িতে দু’বেলা ঝি আসতো। আমার যখন তেরো বছর আমরা তখন আমাদের নতুন বাড়িতে উঠি। আমি আম্মার সাথে মাঝেমধ্যে দোকানে ঘুরতে যেতাম। বাইরে মিষ্টি সন্দেশ কিনে দেওয়ার জন্য বায়না ধরতাম। আম্মা চুলে তেল দিয়ে দিতেন। কত সুন্দর ছিল দিনগুলো! আম্মা পতিতাপল্লি থেকে পালানোর সময় হাতে একটা জায়গায় এত আঘাত পেয়েছিলেন যে এখনও দাগ রয়ে গেছে। আমি আমার আম্মাকে কখনো ঘৃণা করতে পারিনি। আমার মনে কখনো সেরকম কিছু কাজও করেনি। আম্মা আমার জন্য অনেক কষ্ট সহ্য করেছেন। আমি ছাড়া পৃথিবীতে আম্মার কেউ নেই। পতিতা হিসেবে হয়তোবা আমি তাঁকে ঘৃণা করতেই পারি। মা হিসেবে কী করে করি? জন্মদাত্রী হিসেবে কী করে করি? আম্মা বলতেন বাইরের দুনিয়া খুব কঠিন। আগে বুঝিনি;তবে এখন বুঝি। আম্মা ঠিক বলতেন। দুনিয়াটা খুব কঠিন আর নিষ্ঠুর। আমাকে আম্মাকে এক হতে দেয় না। আমাদের মাঝে জাতের দেয়াল তৈরি করে দেয়। মানুষ তো মানুষই তাঁর প্রতি এত ঘৃনা কীসের?”

টপা তখন অশ্রুশিক্ত। ভেজা ভেজা গলায় পারিজাকে বললো,
— তোমার আম্মা সত্যিই খুব ভালো মানুষ। তোমার নামটাও কত সুন্দর ছোট ভাবী। পারিজা!”

পারিজা মুচকি হেসে বললো,
— আমার নামটা পারিজা না। আমার নাম পারিজাত। আমার আম্মাই শুধুমাত্র আমাকে এই নামে ডাকেন। জানো, আমি একবার ছোটবেলায় আম্মার আঁচল জরিয়ে ধরে বলেছিলাম আম্মা আমার নাম পারিজাত কেন রেখেছো? আম্মা আমার দুই গালে চুমু খেয়ে বলেছিলেন তুমি যে পরীর জাত।তাই!”

টপা কান্নামাখা গলায় বললো,
— ছোট ভাবী তুমিই সত্যিই একটা পরী। ছোট ভাইয়ের পরী কিনা জানি না। কিন্তু, তুমি তোমার আম্মার পরী ছোট ভাবী। তোমার মতো সন্তান সব মায়ের কোলে কোলে জন্মাক। অন্যকেউ হলে সত্যিই মায়ের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতো না। তুমি তোমার আম্মাকে বুঝতে পেরেছো। তোমার আম্মা সত্যিই ভাগ্যবান”

পারিজা স্থির হেসে বললো,
— ভুল বলেছো টপা দিদি। আমি আম্মাকে পেয়ে ভাগ্যবতী!”

দিন কয়েক পরের কথা। সকালে বাড়ির পত্রিকার সঙ্গে পারিজার নামে একটি চিঠি এলো। টপা সুযোগ বুঝে চিঠিটি সরিয়ে রাখলো। কারো হাতে পরলে পারিজার যদি বিপদ হয়? পারিজা সকালে ঘর থেকে বের হতেই হঠাৎ টপা দৌড়ে এসে পারিজার হাতে চিঠিটা দিয়ে বললো,
— ছোট ভাবী তোমার কথা বলে এটা একজন দিয়ে গেছে।”

পারিজা চিঠির খামটা দেখেই হাতে নিয়ে ঘরে গিয়ে দোর দিলো। খামটস খুলতেই আঁকাবাঁকা হাতের লিখার একটি চিঠি বেরিয়ে এলো। পারিজা লিখাগুলো দেখে হাসলো। লিখাগুলো তাঁর মা তৃণমালার। পারিজা নিজে লিখতে শিখিয়ে ছিল তাঁর মাকে। একারণেই এমন আঁকাবাঁকা হাতের লিখা। পারিজা চিঠিটা এবার পড়তে শুরু করলো,

” আমার পারিজাত। তোমার চেয়ে দামী আমার আর কিছু নেই। তোমাকে আমি অনেক অনেক ভালোবাসি আমার মা। মায়েরা চাইলেও মেয়েদের সঙ্গে বিয়ের পরে এত যোগাযোগ করতে পারে না। তুমি সংসারে মন দাও মা। আমি যতদিন বেঁচে আছি ততদিন অবধি তোমার সঙ্গে আছি। তুমি স্বামী সংসার নিয়ে সুখে থাকো। সৃষ্টিকর্তা তোমাকে সব সুখ দিক।”

পারিজা চিঠিটা পরে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কেঁদে ফেললো। মনে মনে বললো,
— আম্মা আমি একটুও ভালো নেই। আমার সংসারে সুখের ছিটেফোঁটাও নেই। আমি ভালো নেই আম্মা!”

পারিজা নিচে নেমে দেখলো সুগন্ধা একজন লোকের সঙ্গে কথা বলছেন। লোকটি সুগন্ধাকে বলছে,
— তাহলে, দিনক্ষন তাই রইলো বেয়াইন। পাকা কথা সেরেই গেলাম আজকে।”

পারিজা কথা শুনেই বুঝতে পারলো। কীসের কথা চলছে এখানে। লোকটি চলে যেতেই পারিজা নিজের শাশুড়ীকে গিয়ে বললো,
— ঘরে বউ থাকতে আপনি ছেলের আবার বিয়ে দেবেন?”

সুগন্ধা পারিজার দিকে তাকিয়ে বললো,
— আলবাত দেবো। প্রথমবারে ছেলের কপাল যদি মন্দ হয়। তাহলে,দ্বিতীয় বিয়েতো দিতেই হয়।”

পারিজা সুগন্ধার দিকে তাকিয়ে বললো,
— এটার ফল কখনো ভালো হবে না আম্মা। আপনি যদি আপনার ছেলের দ্বিতীয় বিয়ে দিতে চান। তাহলে,সবার আগে আপনার ছেলেকে বলবেন আমাকে তালাক দিয়ে দিতে। আমার নিজের কোনো দিক থেকে কমতি নেই। সম্পদ, ধনদৌলত সব আছে। আমি কখনোই সতীনের সংসার করবো না। আপনার ছেলে যেন আমাকে তালাক দিয়ে দেয়।”

সুগন্ধা গটমট করতে করতে পারিজাকে বললেন,
— তুমি আমাকে সম্পত্তির দেমাগ দেখাচ্ছো? তা আমাদের কী কম আছে? আমরা তো বংশগত বড়লোক। তোমার মা তো বাদী থেকে বেগম হয়েছে। আগে ছিল পতিতা। এখন রাজরানীর মতো জীবন!”

পারিজা হেসে বললো,
— আমার আম্মা যতটুকু করেছেন। নিজের যোগ্যতা নিজের শ্রমে করেছেন। আপনি তো সেটাও পারেননি। আজ যদি আপনাকে বাবা আপনাকে বাড়ি থেকে বের করে দেন তাহলে কোথায় যাবেন? সেটা কী একবার ভেবেছেন? আমি যদি আজ সংসার ছাড়াও হই। তবে,আমার নিজের একটা গতি আছে। বেঁচে থাকার রাস্তা আছে। যেটা আপনার নেই। কখনোই কোনো মানুষকে তুচ্ছ করবেন না আম্মা। হয়তোবা সে আপনার চেয়েও যোগ্যতাবান।”

পারিজা চুপচাপ ওপরে চলে গেল। সুগন্ধা রাগে অগ্নির কুন্ডতে পরিণত হলেন।

সন্ধ্যায় ওয়াহেদ বাড়ি ফিরতেই সুগন্ধা নিজের ছেলের কান বোঝাই করলেন। ওয়াহেদ ক্রোধিত হয়ে পারিজার কাছে গিয়ে বললো,
— তুমি নাকি আমার মাকে বাড়ি থেকে বের করে দেবে বলেছো? সঙ্গে নাকি এটাও বলেছো মা বাসায় বসে বসে অন্নধ্বংস করছে?তোমাকে এইসব শোভা দেয় পারিজা!”

পারিজা ওয়াহেদের দিকে তাকিয়ে বললো,– আম্মাকে আমি এসব কিছুই বলিনি। উনি আমার আম্মাকে যা বলেছেন। আমি শুধু সেটার জবাব দিয়েছি। এর বেশি একটা কথাও আমি বলিনি।”

ওয়াহেদ পারিজার কথার জবাবে বললো,
— তুমি মিথ্যা বলছো পারিজা। তুমি মাকে এসব বলোনি?”

পারিজা ওয়াহেদকে শক্ত গলায় বললো,
— আমি এসব কিছুই বলিনি! তোমার মা কী করছেন সেটা ওনাকে জিজ্ঞেস করো! উনি তোমার বিয়ের দিন তারিখ ঠিক করেছেন। পাত্রী পছন্দ করা শেষ। তুমি যদি বিয়ে করো। তাহলে যেন আমাকে তালাক দিয়ে তারপর করো। আমি আম্মাকে এতটুকুই বলেছি। এর বেশি আমি কিছুই বলিনি।”

ওয়াহেদ পারিজার দিকে এগিয়ে এসে বললো,
— তোমাকে আগের মতো আর নিষ্পাপ লাগে না পারিজা। প্রথম দিনের মতো নরম আচরণটাও আর নেই। তুমি এমন কেন হয়ে যাচ্ছো পারিজা?”

পারিজা ওয়াহেদের দিকে তাকিয়ে শক্ত গলায় বললো,
— এমন তো হতেই হতো। তোমার পরিবার ঘুমন্ত সিংহীকে জাগ্রত করেছে। এর ফল তো পেতেই হতো।”

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here