#ধূসর_শ্রাবণ?
#লেখিকা:#তানজিল_মীম?
#পর্ব-১৩
________________
আতংকিত চেহারা নিয়ে বসে আছে বর্ষা শুভ্রের পাশে। কি করবে না করবে কিছুই যেন বুঝতে পারছে না সে। এত রাতে কাউকে ডেকে হেল্প চাইবে তাও পারছে না। বর্ষা এইসব বিষয়ে বরাবরই ভিতু টাইপের। এর আগেও বাংলাদেশে বসে শুভ্রের জ্বর এসেছিল। দু’দিন তো শুভ্রের হুসই ছিল না। বর্ষাসহ বাড়ির সবাই আতংকিত ছিল তখন। কিন্তু বর্ষার মা, শুভ্রের মায়ের সেবায় সেবার ঠিক হয়ে গিয়েছিল শুভ্র। বর্ষা শুধু দূর থেকেই সেগুলো দেখেছিল। বর্ষা কিছুক্ষন চুপ থেকে শুভ্রের কপালে হাত রাখলো, আগের চেয়েও গরম লাগছে বেশি। বর্ষা আর দেরি না করে চটজলদি চলে যায় ওয়াশরুমের দিকে। তারপর বালতি আর মগ নিয়ে এসে শুভ্রকে সুন্দর মতো শুয়ে দিয়ে পানি দিতে লাগলো মাথায়। ঘড়ির কাঁটায় তখন প্রায় আড়াইটে ছাঁড়িয়ে তিনটের কাছাকাছি। আজ রাতে আর খাওয়া হবে না হয়তো কারো। বাহির এখনো মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে মনে হয় না আজ রাতে আর থামবে।’
”
সূর্য্যিমামার তীব্র আলো তখন। রাত ফুঁড়িয়ে সকাল হয়ে গেছে অনেক আগেই। জানালার কার্নিশ বেয়ে সাদা পর্দা ভেদ করে আসছে সূর্য্যিমামার তীব্র আলো। সেই আলো এসে পড়ছে বর্ষার মুখে। সারারাত শুভ্রের মাথায় পানি আর জলপট্টি দিয়ে প্রায় সকাল সকাল হওয়া ভাব এমন সময় ঘুমিয়েছে সে। তাও বিছানায় নয় খাটে মাথা দিয়ে নিচে বসে বসে। তার পাশেই কাঁথা মুড়ি দিয়ে বেঘোরে ঘুমিয়ে আছে শুভ্র। জ্বরের ঘোরে সে হয়তো বুঝতেও পারে নি কেউ তাঁর জন্য সারারাত জেগে ছিল। আচমকাই এলার্ম-ঘড়িটার ঝনঝন শব্দে বেজে উঠতেই ঘুম ভাঙলো বর্ষার। তক্ষৎনাত এলার্ম ঘড়িটা হাতে নিয়ে বন্ধ করে দিলো। তারপর তাকালো সে আশেপাশে। চোখ দুটো জ্বলছে অল্প স্বল্প। বর্ষা কিছুক্ষন চুপচাপ বসে থেকে তাকালো শুভ্রের মুখের দিকে। ফর্সা মুখটা লালচে হয়ে আছে। শুভ্র বর্ষার চেয়ে ফর্সা। চুলগুলোও অসম্ভব সুন্দর আর সিল্কি। শুভ্রের চোখ দুটোকে ভীষণ ভালো লাগে বর্ষার কখনো প্রকাশ করা হয় নি। কিন্তু লাগে। মাঝে মাঝে তো শুভ্রকে বলতে ইচ্ছে করে বর্ষার,
‘ আপনার চোখ দুটো এত সুন্দর কেন বলুন তো আমি বারে বারে প্রেমে পড়ে যাই।’
বর্ষা চাইলেও এই কথাগুলো বলে উঠতে পারে না শুভ্রকে। কেন পারে না এটা সে নিজেও জানে না। এখন তো তারা বিবাহিত এখন তো পারা উচিত। কিন্তু পারে না ভীষণ ভয় হয় বর্ষার। যদি বকে তখন। তপ্ত নিশ্বাস ফেলে শুভ্রের কপালে হাত রাখলো বর্ষা না জ্বর এখনও কমে নি। বর্ষা চটজলদি চলে যায় নিচের রুমে ডাক্তারকে কল করতে হবে। কাল অনেক রাত সাথে বৃষ্টি থাকায় কল করা হয় নি আর কিন্তু এখন করবে সে।’
সকাল প্রায় সাড়ে দশটার কাছাকাছি। ডাক্তার শুভ্রকে দেখছে, এই ডাক্তার শুভ্রের পূর্ব পরিচিত। শুভ্র কখনো অসুস্থ হলে একেই দেখায়। বর্ষা জানতো না কিন্তু ডাইরিতে ডাক্তার আক্কেল লেখা নাম্বার দেখে চটজলদি কল করে ফেলে সে। কাল কাজ করার সময় এই ডাইরি আর নাম্বারটা দেখছিল বর্ষা। তবে সে ভাবে নি আজ সকালেই কাজে লেগে যাবে তাঁর। ডাক্তার কিছুক্ষন শুভ্রকে দেখে কিছু ঔষধের নাম লিখে চলে যায়। বর্ষাও এগিয়ে দেয় ডাক্তারকে। শুভ্র তখন চুপচাপ বসে ছিল মাত্র। তেমন কোনো কথা বলে নি। ডাক্তার যেতেই আবারো কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়ে শুভ্র। বড্ড খারাপ লাগছে শরীর। বর্ষা তাদের বাড়ির দারোয়ানের হাতে ঔষধ লেখা কাগজটা গচিয়ে চটজলদি চলে আসে রুমে। শুভ্রের জন্য সুপ বানাতে হবে।’
যেই ভাবা সেই কাজ। কয়েক মিনিটের মধ্যে গরম গরম সুপ তৈরি করে বাটিতে নিয়ে এগিয়ে চললো বর্ষা শুভ্রের রুমের দিকে। এরই মাঝে কলিংবেলটা বেজে উঠল বর্ষা বুঝতে পেরেছে দারোয়ান ঔষধ নিয়ে এসেছে। বর্ষা সুপের বাটিটাকে টি-টেবিলের ওপর রেখে এগিয়ে যায় দরজার দিকে। তারপর সত্যি সত্যি দারোয়ানকে দেখে মুচকি হেঁসে ঔষধগুলো নিয়ে ‘ধন্যবাদ’ জানিয়ে দরজা আঁটকে দিলো আবার।’
তারপর সুপ আর ঔষধের প্যাকেটটা নিয়ে এগিয়ে চললো সে শুভ্রের রুমের দিকে। শুভ্র চুপচাপ শুয়ে ছিল তখন হঠাৎই বর্ষার ভয়েস ভেসে আসলো কানে সে বললো,
‘ শুনছেন এই সুপটা খেয়ে নিন, তারপর ঔষধও তো খেতে হবে।’
শুভ্র শুনলো ঠিকই কিন্তু শরীর নাড়িয়ে ঘুরতে ইচ্ছে করছে না মোটেও। শুভ্রের হেলদোল না দেখে আবারো বললো বর্ষা,
‘ আমার কথা কি আপনি শুনতে পাচ্ছেন?’
এবার বিরক্ত হলো শুভ্র। ইচ্ছে না থাকা সত্বেও ঘুরলো সে। হাল্কা জড়ালো গলায় বললো,
‘ আমার খেতে ইচ্ছে করছে না, বর্ষা?
‘ এভাবে বলবেন না, না খেলে ঔষধ কি করে খাবেন বলুন।’
উওরে কিছুক্ষন চুপ থাকলো শুভ্র। তারপর আস্তে আস্তে শোয়া থেকে উঠে বসলো সে। কিন্তু বসতেই মাথাটা যেন ঘুরে উঠলো তাঁর। যা দেখে শুভ্রের পিঠের পিছনে বালিশ দিয়ে আধশোয়া হয়ে বসালো বর্ষা। তারপর বললো,
‘ এভাবে বসলে আপনার খারাপ লাগবে না।’
প্রতি উওরে কিছু বলে না শুভ্র শুধু চেয়ে রয় বর্ষার পানে। বর্ষা এগিয়ে দেয় সুপের বাটিটা যদিও তার ইচ্ছে ছিল শুভ্রকে খাইয়ে দেয়ার কিন্তু সাহসে কুলাচ্ছে না। শুভ্র সুপের বাটিটা হাতে নেয় ঠিকই কিন্তু চামচ ধরে খেয়ে পারছে না। শরীরের সমস্ত শক্তি যেন কোথায় হারিয়ে গেছে তাঁর। শুভ্রের কাজ দেখে বর্ষা কিছুক্ষন চুপ থেকে একবুক সাহস নিয়ে বলে,
‘ আমি কি আপনায় খাইয়ে দিবো?’
বর্ষার কথা শুনে শুভ্রও মাথা নাড়ায় যা দেখে বর্ষা খুশি হয়ে সুপের বাটিটা হাতে নিয়ে ফু দিয়ে খাওয়াতে থাকে শুভ্রকে। শুভ্রও বর্ষার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে আস্তে আস্তে খেতে থাকে সুপটা। বর্ষার ভিতর থেকে একটা ভালো লাগা কাজ করছে, জীবনে প্রথমবার শুভ্রের সেবা করার সুযোগ পেয়েছে, নিজ হাতে খাইয়ে দিচ্ছে বিষয়টা সত্যি আকাশের চাঁদ পাওয়ার মতো আনন্দ দিচ্ছে বর্ষাকে। আনমনেই ঠোঁটের কোনে হাসি জমলো বর্ষার। বর্ষার মিটমিটে হাসি দেখে বলে উঠল শুভ্র,
‘ তুমি হাসছো কেন?’
সাথে সাথে চমকে উঠলো বর্ষা। হাল্কা থমকানো ভাব আসলো চেহারায়। বর্ষা সেই থমকানো ভাব নিয়ে বললো,
‘ কই না তো।’
প্রতি উওরে পাল্টা আর কিছু বললো না শুভ্র। অন্যসময় হলে হয়তো বলতো কিন্তু এখন ভালো লাগছে না।’
কিছুক্ষনের মধ্যেই শুভ্রকে অর্ধেকের বেশি সুপ খাইয়ে ঔষধ খাইয়ে দিলো বর্ষা। আরো খাওয়াতে চেয়েছিল কিন্তু শুভ্র খেতে চাই নি। বর্ষাও আর জোর করে নি।’
সারাদিনের মতো খুঁটিনাটি কাজ আর শুভ্রের সেবা করেই কেটে গেল বর্ষার।’
রাত প্রায় বারোটার কাছাকাছি। আজ আবারো লন্ডনের শহর কাঁপিয়ে বৃষ্টি নেমেছে। বিদুৎ চমকাচ্ছে ঘন ঘন। যার দরুন ভীষণই ভয় লাগছে বর্ষার। তারওপর শুভ্রের জ্বর। সব মিলিয়ে বিচ্ছিরি একটা পরিস্থিতি। ভয়ের চোটে ঠিকভাবে রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না বর্ষা। এত ভয় কেন হচ্ছে এটাই যেন বুঝতে পারছে না বর্ষা। এতবড় বাড়িতে শুধুমাত্র সে আর শুভ্র থাকে। আর এখন তো শুভ্র উপরের রুমে আর বর্ষা নিচের রুমে। শুভ্রকে খাইয়ে ঔষধ দিয়েছে অনেক আগেই। এখন শুধু এটো বাসনগুলো ধুতে এসেছিল বর্ষা। হয়তো এত রাতে এসে ভুলই করেছে। যদিও খুব বেশি বাসন নয়। এমন সময় হঠাৎই বিকট শব্দে বিদুৎ চমকালো সাথে সাথে রুহু সমেত কেঁপে উঠল বর্ষার। বর্ষা তাড়াতাড়ি তাঁর কাজ শেষ করে এক প্রকার দৌড়ে চলে গেল শুভ্রের রুমে। শুভ্র তখন ঘুমিয়ে ছিল। জ্বর কমে ছিল একটু। বর্ষা জোরে জোরে নিশ্বাস ফেলে তাকিয়ে রইলো শুভ্রের মুখের দিকে। ভাগ্যিস ঘুমিয়ে আছে না হলে তাঁর মতো এত বড় ডিঙ্গি মেয়েকে দৌড়াতে দেখে হাসিতে হাসিতে লুটিয়ে পড়তো যেন। বর্ষা চুপচাপ গিয়ে শুয়ে পড়লো শুভ্রের পাশ দিয়ে। আজ খুব ভয় লাগছে তাঁর। নিজের বাড়ি থাকলে এতক্ষণে মাকে জড়িয়ে ধরে চিটপটাং হয়ে ঘুমিয়ে পড়তো বর্ষা কিন্তু এখন?’ শুভ্রকে জড়িয়ে ধরা আর ক্যারেন্টের সুইচের ভিতর যেচে আঙুল ঢুকিয়ে দেওয়া যেন একই বিষয়। বিছানায় কিছুক্ষন এপাশ ওপাশ করে চোখ বুঁজিয়ে ফেললো বর্ষা। এরই মধ্যে আবারো আকাশ পথ বেয়ে বিদ্যুৎ চমকালো, সাথে বিকট শব্দ আসতেই ভয়ে শোয়া থেকে উঠে বসলো বর্ষা। কাঁদো কাঁদো ফেস নিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে বললো সে,
‘ এমন করো কেন দেখো না আমি ভয় পাই।’
প্রতি উওরে আকাশ মামা আবারো চেঁচিয়ে উঠলো। যার দরুন কান চেপে ধরলো বর্ষা। ভীষণভাবে কান্না পাচ্ছে তাঁর। বর্ষা ছলছল চোখে শুভ্রের দিকে তাকালো। ভীষনভাবে চেঁচিয়ে বলতে ইচ্ছে করছে তার,
‘ শুনছেন আমার ভীষণ ভয় লাগছে, আমি আপনায় জড়িয়ে ধরে ঘুমাতে চাই।’
কিন্তু কথাগুলো মুখ দিয়ে আর বের হয় না বর্ষার। ঠোঁট পর্যন্তই আঁটকে রয়। আর শুভ্র সে তো জ্বরের চাপে চুপচাপ ঘুমিয়ে থাকে মাত্র।’
______
আজ আবার পাত্রপক্ষ দেখতে এসেছে হিয়াকে। তবে আগের বার যারা আসতে চেয়েছিল তাঁরা নয় অন্য কেউ। আজও লাল টুকটুকে রঙের শাড়ি পড়ে বসে আছে হিয়া। বিরক্ত লাগছে তাঁর। তাঁর সামনেই একজন ভদ্রলোক আর একজন ভদ্রমহিলা বসে আছে। আর ওদের দুজনের মাঝখানে বসে আছে দাঁত উঁচা ভুড়িওয়ালা একটা ছেলে। মিটমিটে হাসছে ছেলেটা। হিয়ার ইচ্ছে করছে ছেলেটার দাঁতের মধ্যে গুঁড়ো মরিচ দিয়ে দিতে। ভুতুম একটা। হিয়া শুরুতে ভেবেছিল আজও হয়তো নির্মল কোনোভাবে এই পাত্রপক্ষের আসা আটকাবে। কিন্তু আটকায় নি। এতে যেন অবাকের পাশাপাশি খারাপও লেগেছে হিয়ার। হঠাৎই সামনে বসে থাকা ভদ্রমহিলা বলে উঠল,
‘ আমার ছেলে কিন্তু খুব ভালো একদম মা পাগলা মা যা বলে তাই শোনে।’
উওরে হাসে হিয়ার বাবা আর হিয়া মনে মনে বলে,
‘ এতই যখন মা পাগল তাহলে বিয়ের করার কি দরকার মায়ের আঁচল ধরে বসে থাকলেই তো হয়। ‘যত্তসব আজাইরা লোকজন’
আচমকাই হিয়ার ভাবনার মাঝে ছেলের মা প্রশ্ন করে বসলো হিয়াকে,
‘ তা মা তুমি রান্নাবান্না করতে পারো তো?’
এমন সময় এন্ট্রি মারলো আমাদের গল্পের হিরো নির্মল। চোখের চশমাকে খুব স্টাইল মেরে ঠিক করে এগিয়ে আসতে আসতে বলে উঠল সে,
‘ কেন বিয়ের পর বউকে দিয়ে রেস্টুরেন্ট চালানোর ইচ্ছে আছে নাকি?’
সাথে সাথে উপস্থিত সবাই পিছন ঘুরে তাকালো। আর হিয়ার তো চক্ষু বেরিয়ে আসার উপক্রম। অবাক হয়েই বললো সে,
‘ এ, এখানে কেন এসেছে?’?
#চলবে…..
[ভুল-ত্রুটি ক্ষমার সাপেক্ষ। আর গল্প কেমন লাগলো অবশ্যই কমেন্ট করে জানাবে।]
#TanjiL_Mim♥️