দৃষ্টিনন্দনে তুমি পর্ব ১৬

0
417

#দৃষ্টিনন্দনে_তুমি
কলমে:লাবণ‍্য ইয়াসমিন
পর্ব:১৬

ক্লিনিকের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে আরাফাত। অরিনের অবস্থা মোটামুটি ভালো। শরবতের সঙ্গে বিষাক্ত কিছু মিশিয়ে দেওয়া হয়েছিল সেটা খেয়েই এই অবস্থা। আরাফাত বুঝতে পারছে না বাড়ির মেয়েকে মারার জন্য ওরা বিষ কিভাবে দিতে পারলো। প্রশ্ন জাগলো এতো ভালোবাসা সবকি তাহলে লোক দেখানো? নাকি অন‍্য কাউকে মারতে গিয়ে এমন হলো আরাফাত ভাবতে পারছে না। অরিনকে বেডে পাঠিয়ে আবির বাড়িতে ছুটেছে। ওর মাথায় আগুন জ্বলছে। সব কিছুর একটা লিমিট থাকে। কে এই জঘন্য কাজটা করেছে তাঁকে ও খুন করবে। বাড়িতে অরিনের মা কান্নাকাটি করছেন। আবির সবাইকে নিষেধ করেছিল তাই কেউ হাসপাতালে আসেনি। বাড়িতে রেষারেষি চলছে। জুলেখা কাজী গলা বাজি করছে। উনি সম্পূর্ণ অস্বীকার করেছেন। সব দোষ গিয়ে পড়েছে আবিরের মায়ের উপরে। উনি কান্নাকাটি করছেন। বারবার বলছেন উনি কিছু করেননি। হৈমন্তী শাশুড়িকে সাপোর্ট করছে। ওর বিশ্বাস হয়নি উনি এধরনের কাজ করতে পারে। অরিনের মা ছিল রান্নাঘরে উনি জানেন এটা উনার ননদের কাজ কিন্তু প্রামাণ নেই। ভদ্রমহিলা ঝগড়া ঝামেলা করে বাড়ি মাথায় তুলছে। কারো ক্ষমতা হচ্ছে না উনাকে কিছু বলার। সেই সঙ্গে জুটেছে রাসেল। ও নিজের মায়ের সঙ্গে সঙ্গ দিচ্ছে। এমন সময় আবির বাড়িতে প্রবেশ করলো। থমথমে মুখ নিয়ে সবাইকে ডাইনিং রুমে ডেকে নিয়ে চিৎকার করে বলল,

> অরিনকে কে শরবত দিয়েছে?

কারো কিছু বলার আগেই ওর ফুপি বলে দিল,

> তোমার মা দিয়েছে। ওটা হৈমন্তীর জন্য নিয়ে গিয়েছিল মাঝখানে অরিন খেয়ে নিয়েছে। তোমার মায়ের কাছে শুনো শরবতের মধ্যে বিষ কেনো মিশিয়েছে?

উনি একদমে কথাগুলো বলে থামলেন। আবির ভ্রু কচকে আছে। আজ অরিনের জায়গাই হৈমন্তীর থাকার কথা ছিল ভেবেই শিউরে উঠলো। হৈমন্তীর শরীর এমনিতেই দুর্বল এই শরবত খেলে কিছুতেই বাঁচানো যেতো না। কথাটা ভেবে আসমা বেগমের দিকে তাঁকিয়ে বলল,

> আম্মা তুমি নিজে থেকে শরবত তৈরি করেছো নাকি কেউ তোমাকে সাহায্য করেছে?

আসমা বেগম উত্তর দিলেন না। উনার অপমানিত বোধ হচ্ছে। উনাকে চুপচাপ দেখে অরিনের মা উত্তর দিল,

> আবির ওটা তোমার মা না তোমার ফুপি তৈরী করেছে। বুবুকে হঠাৎ রান্নাঘরে দেখে আমি প্রথমেই অবাক হয়েছিলাম। উনি তো রান্নাঘরের ধারেকাছেও ঘেঁষে না। তারপর ভাবলাম হয়তো সাহায্য করতে চাইছে তাই চুপচাপ ছিলাম। উনি শরবত তৈরী করে তোমার মায়ের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন হৈমন্তীর জন্য নিয়ে যেতে। মাঝখানে অরিন ওটা খেয়ে ফেলেছে। এখন গালাবাজি করে অন‍্যের উপরে দোষ দিতে চাইছে।

আবির চাচি আম্মার কথা মনোযোগ সহকারে শুনে শান্ত চোখে গোলনাহার বানুকে বলল,

> দাদিজান আপনার মেয়ে আর আপনি আজকের মধ্যে দেশে ফিরে যাবেন। আপনারা আমার বাড়িতে এসেছেন আমার বোন আর বউকে খুন করে আমার মাকে খুনী প্রামাণ করতে? কি চাইছেন একটু বলবেন?

আবির চিৎকার দিয়ে কথাগুলো বলতেই গোলনাহার বানু ফ‍্যাচ ফ‍্যাচ করে কেঁদে ফেললেন। উনি বড় ছেলে দেলোয়ার কাজীর কাছে বললেন,

> দেখলি বাবা আমাকে কিভাবে অপমান করছে? আমি তোমাদের মা আর ওর দাদিজান এই কথাটা ও ভূলে গেছে। বোনের খুনীদের সঙ্গে ভাব জমিয়েছে।এখনো কিন্তু আমার নামে চল্লিশ বিঘা জমি আর একটা বাড়ি আছে। এতো অর্থসম্পদ থাকার পরেও তোমাদের কাছে আমার কোনো গুরুত্ব নেই। তাহলে কি আমি তোমাদের বোনকে সব দিয়ে দিব?

দেলোয়ার কাজী মায়ের কথা শুনে বিরক্ত হলেন। বোন উনার মেয়েকে হত্যার চেষ্টা করেছে সেসব কিছু না বলে এখন উনি অর্থসম্পদের ভাগাভাগি করছেন। মা যে কখনও বোনের দোষ ধরবেন না এটা উনার অজানা ছিল না। পাশ থেকে আবির দাঁতে দাঁত চেপে উত্তর দিল,

> রাখুন আপনার জমি। যাকে পারেন দিয়ে দিন। তাঁর আগে বলে দিন এই জঘণ্য কাজের জন্য আপনার মেয়েকে আমি কি শাস্তি দিব? পুলিশ ডাকি কি বলেন? সাংবাদিক ডেকে আগে একটা ছবি তোলার ব‍্যবস্থা করি।

আবিরের চিৎকার শুনে উপস্থিত সবাই চুপ হয়ে গেলো। জুলেখা কাজী ভয় পাচ্ছেন। কি বলবেন বুঝে উঠে পারছেন না। কিন্তু দেলোয়ার কাজী মিনমিনে কন্ঠে বললেন,

> দেখ বাবা যা হওয়ার হয়েছে এখন লোকজন জানাজানি হলে আমাদের সম্মান নষ্ট হবে। তাছাড়া তোর ফুপির শশুর বাড়িতেও ঝামেলা হতে পারে। যা হওয়ার হয়েছে এসব ছাড়। অরিন ঠিক আছে এতেই হবে।

চাচার কথা শুনে আবির ভ্রু কুচকে ফেলল। এতবড় একটা অন‍্যায়ের পরেও কিভাবে এরা এসব বলতে পারে। ও আর অপেক্ষা করলো না। দ্রুত নিজের রুমে গিয়ে আলমারি খুলে হৈমন্তীর দরকারি কাপড় আর ওষুধপত্র সব লাগেজে পুরে হৈমন্তীর হাত ধরে বিছানা থেকে নামতে ইশারা করে বলল,

> চলো তোমাকে বাড়িতে রেখে আসবো।

হৈমন্তী চোখ বড়বড় করে তাঁকালো। ওর বিশ্বাস হচ্ছে না আবির ওকে রেখে আসার কথা বলছে। ও অবিশ্বাস্যের সুরে বলল,

> কোন বাড়িতে?
আবির বিরক্ত হয়ে উত্তর দিল,

> তোমার বাড়িতে। যেখানে তুমি নিরাপদ থাকবে। এখানে থাকলে তোমাকে বাঁচিয়ে রাখা কষ্ট হয়ে যাবে। হাটতে পারবে নাকি কোলে নিতে হবে?

হৈমন্তী দ্রুত বিছানা থেকে নেমে পড়লো। মাথাটা হালকা ঘুরছে তবে হাটতে পারবে। ও নামতেই আবির ওর হাতটা আরও শক্ত করে ধরে বাইরে নিয়ে গিয়ে সকলের সামনে চিৎকার করে বলল,

> আজ থেকে হৈমী এই বাড়িতে আর থাকবে না। যখন বাড়িটা ওর জন্য নিরাপদ হবে তখন ফিরিয়ে আনবো। বউয়ের উপরে ছাড়া কারো উপরে আমার কোনো অধিকার নেই। থাকলে বের করে দিতে দুবার ভাবতাম না। যাইহোক আমি আসছি।

আসমা বেগম দ্রুত এগিয়ে এসে হৈমন্তীর হাতটা ধরে কেঁদে ফেললেন। হৈমন্তী শাশুড়ির চোখের পানি মুছিয়ে দিয়ে ফিসফিস করে বলল,

> আম্মা,আমি আবার ফিরে আসব তুমি একদম কাঁদবে না। নিয়মিত যোগাযোগ রাখবো।

> অধির আগ্রহে অপেক্ষা করবো তোমার জন্য। তুমি আমার মেয়ে। তোমার ক্ষতি আমি কিভাবে চাইবো? আল্লাহ তার আগেই যেনো আমার মৃত্যু দেন।

> আমি বিশ্বাস করি আপনি এসব করেননি। সাবধানে থাকবেন আশেপাশের লোকজনের থেকে।

হৈমন্তীর কথা শেষ হতেই আবির ওকে টেন নিয়ে বেরিয়ে গেলো। ওরা বাইরে যেতেই আবারও শুরু হয়ে গেলো ঝগড়া ঝামেলা। রাসেল দোতলা থেকে সব লক্ষ্য করলো। মহিত ভাঙা হাত নিয়ে ফুলছে। মায়ের উপরে ও বিরক্ত হচ্ছে। কি দরকার ছিল এতো তাড়াতাড়ি ঝামেলা পাকানোর কে জানে। খেলা ঘুরিয়ে দিলো এখন কিভাবে কি হবে ভেবেই আক্রোশে ফেঁটে যাচ্ছে।

______________
অরিনের পাশে বসে আছে আরাফাত। মেয়েটার জ্ঞান ফিরেছে কিন্তু চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে। মেয়েটার পাশে বসতে ওর কেমন জানি অস্বস্তি লাগছে। তবুও অসুস্থ বলে বসতে হলো। কিভাবে ওর সঙ্গে সংসার করবে ভেবেই কেমন জানি হচ্ছে। ভুল হয়ে গেছে। নিজের বোনকে বাঁচাতে পরের বোনের উপরে অন‍্যায় করে ফেলল। এখন কি করবে ভেবেই প্রাণ যাবার জোগাড়। ওর ভাবনার অবসান ঘটলো ফোনের শব্দ শুনে। ও দ্রুত ফোন রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে আবির হড়বড় করে বলে দিল,

> আমি হৈমীকে নিয়ে তোমাদের বাড়িতে যাচ্ছি। তুমি অরিনকে নিজের বাড়িতে নিবে কি আমার বোনকে আমার বাড়িতে পাঠাবে একান্ত তোমার ব‍্যাপার। আমি কোনো ঝামেলা করব না। এইটুকু একটা বোনকে সারাজীবন পালার ক্ষমতা আমার আছে। আমি চাইনা রেষারেষির মধ্যে পড়ে আমার বোনটা কষ্ট পাক।

আবির কথা শেষ করে উত্তরের আশা করলো না। ফোন রেখে দিলো। আরাফাত ভ্রু কুচকে আছে। বাড়িতে যে অশান্তি হয়েছে সেটা বুঝতে পারছে। বোনকে পেয়ে গেছে ভাবতেই মনটা আনন্দে ভরে গেলো কিন্তু পরক্ষণেই চিন্তা হচ্ছে অরিনের জন্য।

আবির হৈমন্তীকে নিয়ে সোজাসুজি মির্জা বাড়িতে ঢুকে গেলো। চয়নিকা ছেলেকে নিয়ে বসে ছিল হঠাৎ আবির আর হৈমীকে দেখে উঠে আসলো। হৈমন্তীর হঠাৎ কেনো জানি খারাপ লাগছে। কতদিন পরে সবাইকে দেখছে তবুও খুশী হতে পারছে না। আবির হৈমন্তীকে সোফায় বসিয়ে দিয়ে হৈমীর মাকে সালাম দিয়ে ফিসফিস করে চয়নিকাকে বলল,

> ভাবি রেখে গেলাম। পরিস্থিতি ঠিক হলে নিয়ে যাবো। একটু দেখে রাখবেন প্লিজ।

চয়নিকা মজা পেল আবিরের কথা শুনে। বাড়ির মেয়েকে বাড়িতে রেখে যাচ্ছে মনে হচ্ছে পরের কাছে রাখছে। কথাটা ভেবে ও ফোড়ন কেঁটে ফিসফিস করে বলল,

> দেখে রাখতে পারবো না। তুমি থেকে যাওনা বাপু নিজের বউয়ের সেবাযত্ন করতে।

চয়নিকার কথা শুনে আবির মাথায় চুলকে বলল,

> থাকতেই পারি বউ যদি বলে। লজ্জা টজ্জা আমার আবার কমকম। আসছি আমি।

আবির কথা শেষ করে দ্রুত বেরিয়ে আসলো। হৈমন্তী ওর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘনিশ্বাস ফেলল। রাজীব বাড়িতে নেই। মাসুদ গার্লফ্রেন্ডের সঙ্গে দেখা করতে গেছে। হৈমন্তীর মায়ের পায়ের উপরে গিয়ে শুয়ে পড়লো। আমেনা বেগম পরম যত্নে মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। পৃথিবীর সকল প্রশান্তি মায়ের আচলেই নিহিত থাকে।
______________________
এভাবেই দুদিন পার হলো। অরিন মোটামুটি সুস্থ। আরাফাত ওকে নিজের সঙ্গে নিয়ে এসেছে। কাজীদের বাড়ি থেকে বাধা দিতে চেয়েছিল ও শুনেনি। তাছাড়া ও হুমকি দিয়েছে ওকে বাধা দিলে পুলিশ ডেকে সব বলে দিবে তাই কেউ আর কোনো ঝামেলা করতে পারেনি। আরাফাত সিদ্ধান্ত নিয়েছে হৈমীকে ওই বাড়িতে আর পাঠাবে না। ওরা আপন পর বাছ বিচার করেনা। মায়া মমতা বলতে কাজীদের কিছু নেই। হৈমন্তী বাড়িতে ফিরেছে দেখে সকলেই খুশী। আমেনা বেগম এই খুশীতে মাসুদের বিয়ের দিন তারিখ ঠিক করে ফেললেন। বিয়ে ঢাকাতে হবে। কারণ মাসুদের শশুর বাড়ি এখানে। লোকজন নিয়ে যাওয়া আসা ঝামেলা হবে ভেবে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া। হৈমন্তীর সব শরীর খারাপ ভাইয়ের বিয়ের আনন্দে একেবারে উবে গেলো কিন্তু মন বলে একটা অদৃশ্য বস্তু আছে। আবিরের জন্য মন খারাপ হচ্ছে।। দুটোদিন লোকটার খোঁজ নেই। যাওয়ার আগে ফোন নাম্বারটা পযর্ন্ত নেওয়া হয়নি। আরাফাতের কাছে আছে কিন্তু হৈমী লজ্জায় বলতে পারলো না। এভাবে আরও একদিন পর হলো তবুও আবিরের খোঁজ পাওয়া গেল না। শেষমেশ হৈমী আবিরের উপরে ভয়ানক রাগ করলো। ভাবলো ওই বদ লোকটার কথা ও আর কখনও চিন্তা করবে না।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here