দুইটা পয়তাল্লিশ পর্ব ৯

0
225

গল্পঃ #দুইটা_পয়তাল্লিশ
পর্বঃ ৮
লেখকঃ Parvez Rana

শুভ্রের অবস্থা আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাহিরে চলে যাচ্ছিল। ওটি রুমে থমথমে পরিবেশ বিরাজ করছিল। এমন অবস্থার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিলাম যার মধ্যে দিয়ে আগে কখনো যেতে হয়নি। আমি কিছু বুঝতে পারছিলাম না কি করতে হবে। শুধু আমি না রুমের কেউই বুঝতে পারছিল না কি হচ্ছে, আর কি হতে যাচ্ছে। আমাদের সবার মধ্যে এক ধরণের চাপা উত্তেজনা কাজ করছিল। জুনিয়র মেয়েটা শুভ্রের মধ্যে একটা চেতনানাশক ইনজেকশন পুশ করল৷ ইনজেকশনটা সাধারণত নার্ভ সিস্টেমকে ফ্রিজ করে দেয়। কিন্তু শুভ্রের ক্ষেত্রে এই ইনজেকশনটাও কোন কাজ করছিল না। আমরা একজন আরেকজনের মুখের দিকে চাওয়াচাওয়ি করছিলাম। হঠাৎ করে আকরাম স্যার চিৎকার দিয়ে বলে উঠল, ‘ওহ মাই গড!’
আমি দ্রুত স্যারের দিকে বিস্ময়ের দৃষ্টিতে তাকালাম। স্যার উত্তেজিত স্বরে বলল, ‘পেশেন্ট এর চোখের দিকে তাকাও। দেখো পেশেন্ট এর REM মানে Rapid Eye Movement হচ্ছে। এর মানে কি বুঝতে পারছ?’
আমি দ্রুত শুভ্রের চোখের দিকে তাকিয়ে দেখি শুভ্রের সত্যি সত্যি REM হচ্ছিল। আমি এবার আরও বেশি অবাক হয়ে যাই। কারণ আমার তিন চার বছরের ক্যারিয়ারে এমন কখনো দেখিনি। যে অপারেশন এর সময় কারও REM হয়। আমি বললাম, ‘স্যার পেশেন্ট স্বপ্ন দেখছে। তাই REM হচ্ছে। মানুষ ঘুমের মধ্যে স্বপ্নে দেখলে REM হয়। কিন্তু আজ পর্যন্ত আমি সার্জারি টেবিলে কোন পেশেন্টকে স্বপ্ন দেখতে দেখিনি। এই পেশেন্ট বিষয়ে আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।’
‘পেশেন্ট এর যা হচ্ছে সেটা হতে দাও। আর তুমি দ্রুত ব্লিডিং পয়েন্ট বন্ধ করে দাও। এই পেশেন্ট এর জন্য এটাই বেশি ভালো হবে।’
আমি মাথা নেড়ে সার্জারির দিকে মনযোগ দিলাম। আমি লক্ষ্য করলাম শুভ্র অনেকক্ষণ ধরে স্বপ্ন দেখছিল। আমার জানতে অনেক ইচ্ছা হচ্ছিল যে শুভ্র কি স্বপ্ন দেখছে। কিন্তু আমি নিশ্চিত ছিলাম না শুভ্র বাচবে কিনা। শেষ পর্যন্ত তাকে সুন্দর একটা জীবন দান করতে পারব কিনা। বুঝতে পারছিলাম না কোনদিন শুভ্রের সাথে কথা বলতে পারব কিনা। অনেকক্ষণ ধরে চেষ্টা করার পরও যখন আমি ব্লিডিং পয়েন্ট আটকাতে পারছিলাম না তখন আমি স্যারকে একটু হেল্প করতে বলি। স্যারও এসে কিছুক্ষণ ট্রাই করল কিন্তু স্যারও পারল না। শুভ্রের ব্রেইন প্যাটার্ন ছিল একদম এলোমেলো। যার কারণে অনেক বেশি কষ্ট হচ্ছিল। বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছিল। আমি আবার চেষ্টা করতে লাগলাম। বার বার চেষ্টার পরও যখন কোন সমাধান করা যাচ্ছিল না তখন সকলের কপালে চিন্তার ছাপ প্রসারিত হচ্ছিল। কোন কিছু বুঝতে পারছিলাম না। মনে হচ্ছিল যেন প্রকৃতি চায় না এই লোকটা বেচে যাক। প্রকৃতি শুভ্রের বাচার অধিকার দিতে চাইছিল না। তার কাছ থেকে এই পৃথিবীতে থাকার অধিকার ছিনিয়ে নিতে চাইছিল। চারদিকে স্তব্ধতা ছড়িয়ে ছিল। কেউ কিছু করার সাহস পাচ্ছিলাম না। অজানা কোন কারণে নিজেদের সকল সাহস স্তব্ধতার অতল গভীরে হারিয়ে যাচ্ছিল। শুভ্রের পালস রেট আর ব্লাড প্রেসার হঠাৎ করেই বেড়ে যাচ্ছিল আবার কিছু মূহুর্তের মধ্যে আবার স্বাভাবিক হয়ে যাচ্ছিল। আবার হঠাৎ করেই নেমে যাচ্ছিল। জীবনে কখনো এমন পরিস্থিতিতে পড়তে হয়নি৷ বিষয়টি শুরুতে যতটা কঠিন ভাবা হয়েছিল এখন তার চেয়ে হাজার গুণ কঠিন মনে হচ্ছে। এই অস্বাভাবিক পরিস্থিতির মধ্যে আমার হঠাৎ করেই প্রচন্ড ক্ষুধা অনুভূত হতে লাগল। অনেকক্ষণ ধরে না খেয়ে থাকার ফল ভোগ করতে হচ্ছিল। সব কিছু যেন আমার বিরুদ্ধে চলে যাচ্ছিল। আমাকে শুভ্রকে বাচানোর সুযোগটা দিতে চাইছিল না। মনে প্রাণে চাইছিলাম যেন কোন মিরাকল ঘটে। আর সব কিছু ঠিক হয়ে যায়৷ হয়তো আল্লাহ তায়ালা সাথে ছিল দেখে সেই মিরাকল ঘটে গেল। শুভ্রের ব্লিডিং পয়েন্ট বন্ধ করতে সক্ষম হয়ে গেলাম। অনেক প্রচেষ্টায় সেটা কোনরকমে করা গেল। ভাবতে পারছিলাম না যে পেরেছি। অসাধারণ এক আনন্দ পাচ্ছিলাম শুধু রক্ত ক্ষরণ বন্ধ করতে পেরেই। মনে হচ্ছিল যেন জীবনের সবচেয়ে কঠিন সার্জারিটা শেষ হতে যাচ্ছে। সবারই আতঙ্কিত ভাবটা কাটতে শুরু করছিল। ব্লিডিং পয়েন্ট বন্ধ করার এক ঘন্টা পরে সম্পূর্ণ সার্জারির সমাপ্তি ঘটল। মোট সাড়ে চার ঘন্টার প্রচেষ্টায় সার্জারিটা শেষ করতে সক্ষম। সার্জারিটা শেষ হলেও শুভ্র বাচবে কিনা তার নিশ্চয়তা তখনও দেয়া যাচ্ছিল না। এর জন্য অন্তত আটচল্লিশ ঘন্টা শুভ্রকে অবজারভেশনে রাখতে হবে। আর এই আটচল্লিশ ঘন্টার মাঝে যেকোন কিছু ঘটতে পারে। হয়তো শুভ্র মারা যাবে আর নাহয় সুস্থ হয়ে উঠবে। কিন্তু শুভ্রের অপারেশন এর পরও যে অবস্থা তাতে প্রথমটার সম্ভাবনাই বেশি।
সার্জারির পর আকরাম স্যার আমাকে পেশেন্ট এর বাড়ির লোকের সঙ্গে কথা বলার জন্য বলল। তাই কথা বলতে যেতে হলো। রুম থেকে বের হয়ে দেখি নওরিন এর চোখে মুখে ভয় আর দুশ্চিন্তার ছাপ। নওরিনের মুখ একদম চুপসে ছিল। নওরিন আমাকে দেখে এগিয়ে আসে। ভাবছিলাম আমাকে হয়তো অপারেশন কেমন হয়েছে সেটা জিজ্ঞাসা করবে৷ আমি অনেকটা অবাক হয়ে গেলাম কারণ নওরিন আমাকে কিছু জিজ্ঞাসা করছিল না। শুধু আমার দিকে প্রশ্নবোধক চাহনিতে তাকিয়ে ছিল। সেখানে নওরিনের বাবাও ছিল সেও কিছু বলছিল না। আমি কিছু হেজিটেশনে পড়ে যাই। কারণ সব সময় আমি যখন ওটি থেকে বের হয়েছি পেশেন্ট বাড়ির লোক আমাকে কিছু না কিছু জিজ্ঞাসা করেছে কিন্তু এনারা দুই জনের একজনও করছে না। আমি নিজে থেকে একটু ইতস্তত ভঙ্গিতে বললাম, ‘অপারেশন শেষ হয়েছে।’
আরো কিছু বলতে যাব তখনই মনে হলো নওরিনের যেন হুশ ফিরেছে। নওরিন আমাকে আটকে দিয়ে দ্রুত গতিতে বলল, ‘অপারেশন শেষ হয়েছে! শুভ্রের এখন কি অবস্থা? আমার শুভ্র ভালো আছে তো? ও সুস্থ হয়ে গেছে তো?’
তখন সাদ্দাম সাহেব আমাকে হবে বলল, ‘অপারেশন সাকসেসফুল হয়েছো তো, ডাক্তার সাহেব?’
আমি একটু আমতা আমতা করে বললাম, ‘সাকসেসফুল হয়েছে কিনা এখনই বলতে পারছি না। কারণ পেশেন্ট এর অবস্থা অনেক বেশি ক্রিটিকাল ছিল। আটচল্লিশ ঘন্টার আগে কিছু বলা যাচ্ছে না।’
নওরিনের দিকে খেয়াল করে দেখলাম নওরিনের মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। শুধু নওরিনের না ওর বাবার মুখও ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েছিল। নওরিন এর কন্ঠ ভিজে আসছিল। দেখে মনে হচ্ছিল কেদে ফেলবে। ভেজা ভেজা কন্ঠে বলল, ‘কি বলছেন আপনি! আটচল্লিশ ঘন্টার মধ্যে কিছু বলা যাচ্ছে না এর মানে কি?’
আমি কঠিন কথাটা বলার জন্য কিছুক্ষণ সময় নিয়ে প্রস্তুতি নিয়ে নিলাম। তারপর আবেগকে বিসর্জন দিয়ে বললাম, ‘যদি পেশেন্ট বাচে তবে তবে সেটা আটচল্লিশ ঘন্টার মধ্যে জানা যাবে আর যদি মারা যায় তবে সেটাও আটচল্লিশ ঘন্টার মধ্যেই জানা যাবে। তবে বাচার সম্ভাবনা এখনো একদম ক্ষীণ। আমরা আমাদের যথাসম্ভব চেষ্টা চালিয়েছিলাম।’
নওরিন আমার কথা শুনে পুরোপুরি কেদে ফেলল। কাদতে কাদতে তার কন্ঠে কাঠিন্য এনে বলল, ‘আপনারা যদি আপনাদের যথাযথ চেষ্টা করেন তাহলে আমার শুভ্র বেচে যাবে। কিন্তু আপনারা তো সেই চেষ্টা করেননি। তাই আমার শুভ্রের অবস্থা এখনও ক্রিটিকাল। আমার শুভ্রের কিছু হয়ে গেলে আমি আপনাদের কাউকে ছাড়ব না।’
‘আমরা আমাদের যথাযথ চেষ্টাই করেছি। তবে অপারেশন এর সময় যেসব প্রবলেম ফেস করতে হয়েছে সেগুলো কল্পনাতীত। কারণ পেশেন্ট এর বার বার সেন্স ফিরে আসছিল। আর সবচেয়ে আশ্চর্যজনক বিষয় হচ্ছে পেশেন্ট সার্জারির সময় স্বপ্ন দেখছিল যখন আমরা পেশেন্ট এর ব্রেইন কাটাকাটি করছিলাম। বুঝতে পারছি না এটা তার ব্রেইনে কোন ইম্প্যাক্ট ফেলবে কিনা।’
‘আমি কিছু বুঝতে চাই না। আমি শুধু আমার শুভ্রকে চাই। জানিনা সে কিভাবে আমার ফিরে আসবে। আর যদি ফিরে না আসে তাহলে আমি আপনাদের সবাইকে অপরাধীর কাঠগড়ায় দাড় করাব। আর আপনাকে এক নাম্বার অপরাধী বানাব।’
‘আল্লাহর উপর ভরসা রাখুন। যদি আল্লাহ চায় তাহলে নাহয় আমি অপরাধী হব। কিন্তু আমি সর্বাত্মক চেষ্টা করেছি। এটা আমি জানি। আপনি পেশেন্ট এর জন্য দোয়া করুন। আমি আসি৷’
নওরিন আরও কিছু বলতে যাবে আমি সেদিকে মনযোগ না দিয়ে চলে আসলাম। চেম্বারে এসে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি প্রায় তিনটা বাজে। আর এতক্ষণ না খেয়ে থাকতে হয়েছে। অনেকদিন পর এতোক্ষণ অনাহারে থাকতে হয়েছে। জানিনা এর ফল পাব কিনা। তিনটা বাজে ক্রিস্টিনকে ফোন দিলাম৷ ক্রিস্টিন ফোন তুলে বলল, ‘হ্যালো!’
ক্রিস্টিন এর কন্ঠ শোনার সাথে সাথে মনের মধ্যে একটা প্রশান্তি চলে আসল। এতোবছর একসাথে আছি কিন্তু এখনো একটু ভালোবাসা কমেনি। আর তার কন্ঠ শুনলে এখনো সেই প্রশান্তি ফিরে আসে যেমন প্রথম জীবনে আসত। আমি বললাম, ‘স্কুল থেকে বাসায় পৌছেছ?’
ক্রিস্টিন ওপাশ থেকে জবাব দিল, ‘অনেকক্ষণ আগেই এসেছি। তুমি কি খাওয়া দাওয়া করেছো?’
‘না। এখনো করিনি।’
ক্রিস্টিন রাগী কন্ঠে বলল, ‘তুমি এখনো খাওনি! জানো এখন কয়টা বাজে? এতোক্ষণ কেউ না খেয়ে থাকে? তাড়াতাড়ি যাও।’
আমি একটু মৃদু হাসি মুখে বললাম, ‘এখন যাব ক্যান্টিনে। তার আগে ভাবলাম তোমার সাথে একটু কথা বলে নেই। এতোক্ষণ যখন ওয়েট করেছি তোমার সাথে কথা বলা পর্যন্ত আরেকটু ওয়েট করতেই পারব?’
ক্রিস্টিনের কন্ঠে সেই রাগি ভাবটা ছিল। ক্রিস্টিন বলল, ‘তোমাকে আমার সাথে কথা বলতে কে বলেছে তুমি আগে গিয়ে খাওয়া দাওয়া করে নাও। আমি কুইন এলিজাবেথ না যে আমার সাথে কথা বলার পর তোমাকে খেতে যেতে হবে?’
আমি চেম্বার থেকে বের হয়ে ক্যান্টিনের দিকে এগোতে এগোতে বললাম, ‘আমি জানি তুমি কুইন এলিজাবেথ না। কিন্তু তুমি কুইন ক্রিস্টিন তাই তোমার সাথে কথা না বললে আমার ভালো লাগে না।’
‘হয়েছে এখন আর ভালোবাসা দেখাতে হবে না। আগে নিজের যত্ন নাও আর খাওয়া দাওয়া করে নাও। আর খাওয়া দাওয়ার পর আমাকে ফোন করে জানিও। আর হ্যা আজ রাতে তোমার ফেভারিট ইলিশ মাছ রান্না হচ্ছে।’
আমি একটু উৎফুল্ল কন্ঠে বললাম, ‘সত্যি! থ্যাংক ইউ সো মাচ। দ্যাটস হোয়াই আই লাভ ইউ সো মাচ।’
ক্রিস্টিন ওপাশ থেকে হেসে ফেলল৷ তারপর বলল, ‘তাড়াতাড়ি বাসায় আসো একসাথে খাওয়া দাওয়া করব। তুমি অনেকক্ষণ না খেয়ে থাকতে পারো কিন্তু আমি পারিনা।’
‘আচ্ছা ঠিক আছে। বাই।’
‘ওকে বাই।’
ক্যান্টিনে যাওয়ার পথে আকরাম স্যারের দেখা। দেখলাম স্যার হাতে একটা টিফিন বক্স নিয়ে এগিয়ে আসছে। হয়তো নিজের র‍্যমে যাচ্ছে। আমাকে দেখে বলল, ‘নিখিল খাওয়া দাওয়া করেছো?’
‘না স্যার। এখন যাচ্ছি।’
‘এখনও করোনি!’
আমি বললাম, ‘স্যার আমি সকালের খাওয়া দাওয়াও করিনি এখন করব।’
আমার কথা শুনে স্যারের চোখ যেন কপালে উঠে গেল। স্যার বলল, ‘কিহ! এখনো ব্রেকফাস্টই করোনি। আসলে তোমাকে যে কি করতে হবে বুঝি না। তুমি এতোক্ষণ না খেয়ে সার্জারি করেছো। তোমাকে ধরে আসলে…. থাক তোমাকে বলে কোন লাভ নেই। এখন চলো আমার সাথে খাবে৷ আমার বাসা থেকে খাবার পাঠিয়েছে। আমি ক্যান্টিনে ছিলাম সেখানে দিয়ে গেল। চলো এখন আমার সাথে খাবে৷’
‘স্যার। আপনি যান আমি ক্যান্টিন থেকে খেয়ে নিব। আপনার আবার কম পড়ে যেতে পারে।’
স্যার আমার দিকে চোখ বড় বড় করে তাকালো। তারপর বলল, ‘আমি কোন রাক্ষস না যে এতো খাবার একা খেয়ে ফেলব। প্রতিদিন আমাকে বাসায় খাবার ফিরিয়ে নিয়ে যেতে হয়। এখন চলো।’
বলেই আমার আমার হাত ধরে টেনে তার চেম্বারে নিয়ে গেল। সেখানে তার সাথে খাওয়া দাওয়া করা হলো রুই মাছ দিয়ে। খাওয়া দাওয়া করে চেম্বারে গিয়ে রেস্ট নিলাম। ঘুম ধরছিল অনেক। ইচ্ছা করছিল ইজিচেয়ার এ ঘুমিয়ে যাই। কিন্তু সেই সুযোগ ছিল না। কারণ চারটা থেকে কয়েকজন রোগীর এপোয়েন্টমেন্ট দেয়া আছে। তাদেকে দেখতে হবে। কিছুক্ষণ সময় কাটানোর জন্য কি করব ভাবছিলাম তখন ক্রিস্টিনের আবার ফোন আসে৷ ক্রিস্টিন জিজ্ঞাসা করল৷ ক্রিস্টিনের সাথে কিছুক্ষণ কথা বলার শুভ্রকে দেখতে গেলাম। দেখলাম শুভ্রকে অক্সিজেন দিয়ে রাখা হয়েছে। আর মোটামুটি সব কিছু এখন পর্যন্ত নরমাল। একটু স্বস্তির নিশ্বাস ফেললাম। আরেকটা জিনিস খেয়াল করলাম সেটা হচ্ছে নওরিন শুভ্রের পাশে বসে আছে। যদিও এলাউ করার কথা না তবুও ও পাশে আছে। আমার দিকে শুধু একনজরে তাকিয়ে আছে। কিছু না বলেই বেরিয়ে এলাম। তারপর চেম্বারে গিয়ে যাদের এপোয়েন্টমেন্ট ছিল তাদের কে দেখতে শুরু করলাম৷ ভেবেছিলাম কয়েকজন কিন্তু সিরিয়ালটা অনেক লম্বা ছিল। সিরিয়াল একদম শেষ হলো সাতটায়। একটানা তিন ঘন্টা দেখতে হলো৷ তারপর একবার হসপিটালের রুটিন রাউন্ডে যেতে হলো। তারপর আটটার দিকে বাসায় যাওয়ার জন্য রওনা দিলাম। একটু তাড়াতাড়িই বেরিয়ে পড়লাম। কারণ শরীর আর সহ্য করতে পারছিল না৷ সারাদিন অনেক পরিশ্রম করতে হয়েছে৷ বাসায় পৌছাতে পৌছাতে সাড়ে আটটা বেজে গেল। গিয়ে দেখালাম ক্রিস্টিনের রান্না শেষ। সব কিছু গোছাচ্ছে৷ ক্রিস্টিন আমাকে গোসল করে এসে খেতে বসতে বলল৷ গোসল করতে যাওয়ার আগে একবার ডাইনিং টেবিলের দিকে তাকিয়ে দেখলাম শুধু ইলিশ মাছ রান্না করেনি। আরও অনেক কিছুই রান্না করেছে৷ কিছু না বলেই গোসল করতে চলে গেলাম। ভাবলাম খাওয়ার সময় ক্রিস্টিনের সাথে এব্যাপারে কথা বলা বলা যাবে৷ ওকে বলেছিলাম শুধু ভালো কিছু রান্না করতে। আর ক্রিস্টিন একবারে অনেক বেশিই রান্না করেছে। ভেবেছে সারাদিন খাইনি দেখে হয়তো এখন একেবারে রাক্ষসের মতো খাব৷ তাই এতো কিছু রান্না। আবার অব্য দিক দিয়ে একটা আনন্দও হচ্ছিল৷ ওর রান্না এতো ভালো হয় যে হয়তো আসলেই সব কিছু রাক্ষসের মতো খেয়ে ফেলতে পারি। এই ভাবতে ভাবতে বাথরুমে চলে গেলাম৷ স্বাভাবিক এর চেয়ে একটু বেশি সময় নিয়ে গোসল করলাম। গোসল করে বের হয়ে কিছুক্ষণ টিভি দেখলাম। ক্রিস্টিন ততক্ষণে নিজের একটা কাজ কিরে নিল। তারপর দুজনে ডাইনিং টেবিলে গিয়ে বসলাম। একটা জিনিস খেয়াল করলাম সেটা হচ্ছে ক্রিস্টিনকে কেন জানিনা একটু বেশি সুন্দরী লাগছিল। আর একটা বাঙালি মেয়ে মেয়ে ভাব দেখা যাচ্ছিল। মাঝে মাঝেই এমন আমার মনে হয়। তবে এবারে অনুভূতিটা একটু অন্যরকম ছিল। ক্রিস্টিন যখন সব কিছু আমার প্লেটে তুলে দিচ্ছিল তখন আমার ফোনে একটা কল আসে। কলটা হসপিটাল থেকে আসে। রিসিভ করার সাথে সাথে বিচলিত কন্ঠের একজনের আওয়াজ শুনতে পাই। সে বলছে, ‘স্যার একটু তাড়াতাড়ি হসপিটালে আসুন। সকালে যার সার্জারি করা হয়েছে তার পরিস্থিতি নিচের দিকে যাচ্ছে।’
কথাটা শুনে আমার হৃদয়টা হঠাৎ করেই কেপে উঠে। আমি একটু বিচলিত কন্ঠে বললাম, ‘কি হয়েছে পেশেন্টের? এখন তার অবস্থা কি?’
মেয়েটা দ্রুত বলল, ‘স্যার পেশেন্ট এর ব্লাড প্রেসার আর পালস রেট অনেক বেশি। আর আবার আগের মতো নাক দিয়ে রক্ত বের হচ্ছে। আমরা কেউ কিছু বুঝতে পারছি না। আপনি প্লিজ একটু দ্রুত আসুন।’
আমি নিস্তেজ গলায় বললাম, ‘আচ্ছা আমি আসছি৷’
‘ঠিক আছে।’
মেয়েটা ফোন কেটে দিল। আমি ক্রিস্টিনের দিকে তাকালাম। দেখি ক্রিস্টিনের মুখটা একদম ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। আমার নিজেরই অনেক খারাপ লাগছে কারণ ক্রিস্টিন অনেক কষ্ট করে এতোকিছু রান্না করেছে আর আমি সেগুলো একবার মুখে দেয়ারও সময় হয়তো পাব না। নিজেকে অনেকটা অপরাধী মনে হচ্ছিল। আমি ক্রিস্টিনকে লজ্জিত স্বরে বললাম, ‘আই এম সরি। আমাকে এক্ষুনি যেতে হবে।’
ক্রিস্টিন নিজের আবেগকে চাপা দিয়ে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলল, ‘ঠিক আছে যাও। যখন একজনের জীবন বাচাতে যেতে হবে তাহলে দেরি করে কাজ নেই। শুধু অল্প একটু মুখে দিয়ে যাও।’
আমি বুঝতে পারছিলাম ক্রিস্টিন অনেকটাই কষ্ট পেয়েছে। কিন্তু কিছু করার ছিল না। তখন ক্রিস্টিনের মন রক্ষার্থে বললাম, ‘আচ্ছা ঠিক আছে। আমি যতক্ষণ ড্রেস চেঞ্জ করছি ততক্ষণে তুমি কয়েকবার আমার মুখে তুলে দাও। এতে একসাথে দুই কাজ হয়ে যাবে।’
আমার কথাটা শোনার সাথে সাথে দেখলাম ক্রিস্টিনের মুখের একটা উজ্জ্বলতা চলে এসেছে। মনের মধ্যে একটা শান্তির ভাব চলে আসে। ক্রিস্টিনকে খুশি দেখে নিজেরও অনেকটা খুশি লাগছিল৷ কিন্তু মনের মধ্যে শুভ্রের জন্য দুশ্চিন্তা হচ্ছিল। আমি শার্ট গায়ে দিতে দিতে ক্রিস্টিন দু তিন বার আমার মুখে ভাত তুলে দিল। মনে হচ্ছিল ওর হাতে খাওয়ায় খাবারের স্বাদটা আরো কয়েক গুণ বেড়ে গেছে। চার পাঁচ বার ভাত মুখে দেয়ার পরই সম্পূর্ণ রেডি হয়ে গেলাম। তারপর বললাম, ‘এখনকার মতো থাক। পরে আবার খাব। জানো তুমি খাইয়ে দেয়ায় খাবারের স্বাদ আরো বেড়ে যায়।’
‘হুম বুঝলাম।’
আমি ক্রিস্টিনের কাছে গিয়ে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে বললাম, ‘এখন যাই। আজ রাতে বাসায় আসতে পারব কিনা জানি না৷ তুমি ঘুমিয়ে যেও। আমার জন্য বেশি অপেক্ষা করে আবার সারারাত জেগে থেকো না। কাল তোমার স্কুল আছে। না ঘুমালে আবার তোমার স্টুডেন্টদের ভালোভাবে পড়াতে পারবে না।ঠিক আছে?’
‘হুম। ঠিক আছে।’
‘ওকে৷ লাভ ইউ বাই।’
‘লাভ ইউ টু।’
আমি হসপিটাল এর উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লাম। গাড়িতে আরেকবার ফোন আসল। হসপিটাল থেকে আবার ফোন আসে। আর বলল যে শুভ্রের অবস্থা নাকি আগের থেকেও বেশি ক্রিটিকাল হয়ে গেছে। জানিনা কেন আমার হঠাৎ ভয় করতে লাগল। বার বার মনে হচ্ছিল যে হসপিটালে পৌছে দেখব শুভ্র আর বেচে নেই৷ সবাইকে ছেড়ে চলে গেছে অজানা দেশে।

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here