গল্পঃ #দুইটা_পয়তাল্লিশ
#অন্তিম_থেকে_নতুন_সূচনা
লেখকঃ Parvez Rana
পর্বঃ ৭
নওরিন সারাটা রাস্তায় নীরবে কান্না করতে থাকে। নওরিনের চোখে পানি দেখে নওরিনের বাবা সাদ্দাম সাহেব কয়েকবার নওরিনের মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। নওরিনের মন অস্থির হয়ে ছিল। কারণ সে শুভ্রের অবস্থা সম্পর্কে কিছু জানে না। কয়েকবার ফোন দিয়েছে কিন্তু শুভ্র ফোন তুলে নি। এম্বুলেন্স এর ড্রাইভার এর কাছে ফোন দিয়ে জানতে পারে যে এম্বুলেন্স তখনও শুভ্রের বাড়িতে পৌছায় নি। প্রায় আধা ঘণ্টা পর শুভ্রের দেয়া ঠিকানায় নওরিন পৌঁছে যায়। নওরিন পৌছে দেখে এম্বুলেন্স তখনও এসে পৌছায় নাই। নওরিন দেখল শুভ্রের বাড়িটা আসলেই রাজবাড়ির মতো যেমন শুভ্র টেলিপ্যাথির মাধ্যমে তার বর্ণনায় নওরিনকে বলেছিল। বাড়িটার সামনে সুন্দর একটা বাগান আছে। নওরিন গাড়ি থেকে নেমেই শুভ্রদের বাড়ির সামনে চলে যায়। গিয়ে দেখল বাড়িতে কোন দারোয়ান নেই। বাড়ির সদর দরজার সামনে গিয়ে দেখল সদর দরজাও খোলা। নওরিন বাড়ির ভেতরে ঢুকে যায়। নওরিনের পেছনে নওরিনের বাবাও বাড়ির ভেতরে আসে। নওরিন বাড়িতে ঢুকে দেখে বাড়ির ভেতর কিছুটা ভৌতিক পরিবেশ। কোন লোক নাই, কোন আওয়াজ সম্পূর্ণ স্তব্ধ একটা বাড়ি। সিড়ি বেয়ে দ্রুত দোতলায় উঠে যায়। দোতলার দিকে তাকিয়ে লক্ষ্য করে সব রুম আটকানো আর শুধু একটা রুম খোলা। তার মন বারবার মন বলছিল হয়তো এমন হবে যে শুভ্র হঠাৎ করেই তাকে ভয় দেখাবে। ভয় দেখিয়ে সে হাসবে। কোন ভয়ঙ্কর ভঙ্গিতে না তার সেই অপরূপ হাসির ভঙ্গিতে। তাই দশ সেকেন্ড এর মতো সময় নিয়ে শান্ত হয়ে খোলা রুমটার দিকে এগিয়ে যায়। কিছুটা শান্ত হওয়ার চেষ্টা করছিল কিন্তু পারছিল না। নওরিন দ্রুত পা ফেলে এগিয়ে যায়। নওরিনের মন বারবার চাইছিল যেন শুভ্র তাকে ভয় দেখাক। শুভ্রের যেন কিছু নাহয়। শুভ্র যেন শুধু তাকে এই বাড়িতে আনার জন্য নওরিনকে বলেছে যে সে মারা যাচ্ছে। হাজারো যদির মধ্য দিয়ে নওরিন এক পর্যায়ে দরজার সামনে গিয়ে দাড়ায়। সেখানে সে দাড়িয়ে স্তব্ধ হয়ে যায়। নওরিন প্রথম বারের মতো শুভ্রকে সামনে থেকে সরাসরি দেখে। সেই আগের অপরূপ ফর্সা চেহারা। মুখে কিছুটা হাসি। চোখ খুলে আধ শোয়া অবস্থায় খাটে হেলান দিয়ে সামনের দিকে তাকিয়ে আছে। নওরিন তখন নিজের ভেতর আটকে রাখা দীর্ঘশ্বাসটা ছেড়ে দেয়। নওরিন ভাবছিল সব কিছু স্বাভাবিক। তাই দ্রুত গিয়ে শুভ্রকে জড়িয়ে ধরে কেদে ফেলে। কিন্তু হঠাৎ একটা অস্বাভাবিক বিষয় নওরিন খেয়াল করল। সেটা হচ্ছে শুভ্রের শরীর স্তব্ধ হয়ে আছে। শুভ্রের নড়াচড়া করছিল না। তার শরীর অনেকটা ঠান্ডা ছিল। প্রথমে নওরিন শুভ্রের মুখের দিকে না তাকিয়েই শুভ্রকে জড়িয়ে ধরে। নওরিন শুভ্রের মুখের দিকে তাকিয়ে লক্ষ্য করে শুভ্রের নাক দিয়ে কিছুটা রক্ত রের হচ্ছিল। নওরিন এটা দেখে জোড়ে একটা চিৎকার দিয়ে কেদে ফেলে। তারপর নওরিন শুভ্রের মুখে হাত দিয়ে বারবার মুখ ঝাকিয়ে বলে, ‘কথা বলো শুভ্র, কথা বলো। দেখো তোমার নওরিন তোমার কাছে চলে এসেছে। কথা বলো প্লিজ।’
নওরিন অঝোরে কেদে ফেলে। নওরিন নিজের ওড়না দিয়ে শুভ্রের নাকের রক্ত মুছে দেয়। আর কাদতে কাদতে বলে, ‘প্লিজ কথা বলো না প্লিজ। আমার সাথে প্লিজ কথা বলো। আমি এই দেখো এসেছি। আমাকে একবার ভয় দেখাও না। যেভাবে প্রথম ভয় দেখাতে। কথা বলো না। তোমার কাছে অদিতির ভালোবাসাই বেশি হয়ে গেছে। তাই ওর কাছে চলে যাচ্ছো। আমার ভালোবাসার কি কোন দাম নেই।’
নওরিনের চিৎকার শুনে সাদ্দাম সাহেব দোতলায় চলে আসে। দেখে নওরিন কাদছে। আর নওরিন শুভ্রকে কেদে কেদে বলছে, ‘কথা বলো না। প্লিজ। সরাসরি কোনদিন তো কথা বললে না। এখন সামনাসামনি এসেছি বলো না। এভাবে রেখে যেও না আমাকে। প্লিজ কথা বলো।’
নওরিন কাদছিল। এই অবস্থা দেখে সাদ্দাম সাহেবেরও চোখ দিয়ে পানি চলে এসে গেছিল। সে বুঝতেছিল যে নওরিন শুভ্রকে অনেক বেশি ভালোবেসে ফেলেছে। নওরিন কাদছিল। তার কান্নার বাধ ভেঙে গিয়েছিল। নওরিন বলছিল, ‘কথা বলো না প্লিজ। এই দেখো আমি তোমাকে জড়িয়ে ধরেছি। তুমিও তোমার হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরো না। স্বপ্নে তো কখনো তোমাকে স্পর্শ করতে দিলে না। এখন তো একটু করেছি। তুমিও একটু কথা বলো না। একটু আমার দিকে তাকিয়ে ভালোভাবে কথা বলো।’
নওরিন ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাদছিল। কিন্তু শুভ্রের কোন সারা পাওয়া যাচ্ছিল না। শুভ্রের শরীর আগের মতোই স্তব্ধ হয়েছিল। নওরিনের কান্না থামছিল না। নওরিনের বাবাও দরজার সামনে দাড়িয়ে চোখের পানি ফেলছিল। আর নিজের মেয়েকে দেখছিল। নওরিন শুভ্রের বুকে মাথা লাগিয়ে বলতে থাকে, ‘শুভ্র কথা বলো। প্লিজ কথা বলো। আমাকে একটু ভালোবাসো না। আমাকে নাহয় একটু ভয় দেখাও। তবুও একটু কথা বলো। আমার ভালোবাসার তো অনেক পরীক্ষাই নিলে। এখন একটু তার প্রতিদান দাও না প্লিজ। আমাকে ছেড়ে যেও না প্লিজ। আমি যে তোমাকে ছাড়া বাচব না। শুভ্র! শুভ্র।’
কিছুক্ষণের মধ্যে এম্বুলেন্সও পৌছে যায়। এম্বুলেন্স এর সাথে একজন ডাক্তারও এসেছে। এম্বুলেন্স এর লোকজন শুভ্রকে নিয়ে এম্বুলেন্স এ তোলে। ডাক্তার পালস রেট দেখে বলল, ‘পেশেন্ট এখনও জীবিত আছে। কিন্তু অবস্থা একদম ক্রিটিকাল। বাচার সম্ভাবনা একদম ক্ষীণ। আর নাক দিয়ে যেভাবে রক্ত পড়ছে তাতে মনে হয় না বাচবে।’
নওরিন এম্বুলেন্স এ শুভ্রের মুখের পাশে বসে। নওরিনের চোখ দিয়ে অঝোরে পানি পড়তেছিল। এম্বুলেন্স হসপিটালের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। আর নওরিনের বাবা সাদ্দাম সাহেব নিজেদের গাড়িতে হসপিটালের উদ্দেশ্যে যেতে থাকে। এম্বুলেন্স দ্রুত গতিতে তার লাল নীল লাইট জ্বালিয়ে দ্রুত বেগে যাচ্ছিল হসপিটালের দিকে। আর নওরিন পুরো রাস্তা শুভ্রের হাত ধরেছিল। আর চোখ থেকে পানি বের হচ্ছিল।
সেদিন সকাল বেলায় হসপিটালের রিসিপশন থেকে আমার ফোন আসে৷ আমি তখন হসপিটালে যাওয়ার জন্য রেডি হচ্ছিলাম। ক্রিস্টিন বলল, ‘তোমার ফোন এসেছে হসপিটাল থেকে।’
আমি গিয়ে ফোনটা নিয়ে বললাম, ‘আসসালামু আলাইকুম, হ্যালো!’
রিসিপশনিস্ট বলল, ‘ওয়ালাইকুম সালাম, স্যার! আপনাকে একটু দ্রুত হসপিটালে আসতে হবে। একটা ইমার্জেন্সি এসেছে। একজনের অবস্থা অনেক বেশি ক্রিটিকাল। আমরা কিছু বুঝতে পারছি না।’
‘খাওয়া দাওয়া করার পর আসছি। কিছুক্ষণ ওয়েট করা যাবে না?’
‘না, স্যার। পেশেন্ট এর অবস্থা অনেক বেশি খারাপ। পেশেন্ট এর সাথে যে এসেছে সে বলেছে যে পেশেন্ট এর নাকি স্ট্রোক টাইপ কিছু হয়েছে। কিন্তু পেশেন্ট এর নাক দিয়ে রক্ত বের হচ্ছে। থামছে না। আকরাম স্যার আপনাকে দ্রুত আসতে বলছে। আকরাম স্যার ও পেশেন্ট এর কন্ডিশন বুঝতে পারছে না।’
‘আচ্ছা রাখো। আমি আসছি পনের মিনিটের মধ্যে।’
আমি ফোনটা রেখে দিয়ে ক্রিস্টিনের কাছে গেলাম। ক্রিস্টিন বলল, ‘তোমাকে এখনই হসপিটালে যেতে হবে?’
‘হুম। একটু ইমার্জেন্সি এসে গেছে। তুমি স্কুলে চলে যেও। আর খাওয়া দাওয়া করে যেও। আমি যাই। রাতে আসব। আর আমি একটু পর ফোন দিয়ে কথা বলব নে।’
ক্রিস্টিন আমার দিকে একটু এগিয়ে এসে টাই একটু ভালোমতো টাইট করে দিয়ে বলল, ‘ঠিক আছে। যাও। নিজের খেয়াল রেখো। আর যদি কোন অপারেশন করতে হয় তবে একটু ভালোভাবে করো। আর সার্জারি শুরু করার আগে কিছু খেয়ে নিও। তুমি তো আবার সার্জারির সময় কিছু খাও না।’
‘ঠিক আছে।’
আমি ক্রিস্টিনের কপালে একটা চুমু দিয়ে হসপিটালের দিকে বেরিয়ে পড়লাম। গাড়ি নিয়ে বের হয়ে রাস্তায় এসে দেখি রাস্তায় কিছুটা জ্যাম পড়েছে। ঢাকার শহরের জ্যাম একবার ধরলে আর ছাড়ার মতো না। কিন্তু দেখলাম দুই মিনিটের মধ্যে জ্যাম ছেড়ে দিল। বুঝলাম ভাগ্য সাথে আছে। হসপিটালে পৌছাতে বিশ মিনিটের মতো লেগে গেল। হসপিটালে এসে খেয়াল হলো তাড়াতাড়ি আসতে গিয়ে এপ্রোন বাসায় রেখে এসেছি। সেদিকে মনযোগ না দিয়ে দ্রুত হসপিটালে ঢুকে গেলাম। ঢোকার পর খেয়াল করলাম রিসিপশনিস্ট আমাকে দেখিয়ে বলল, ‘ওই দেখুন, নিখিল স্যার চলে এসে গেছে।’
মেয়েটা ছিল নওরিন। নওরিন আমার সামনে আসে। দেখলাম ওর চোখে পানি। সেবারই নওরিন কে প্রথম দেখি। দেখেই কেমন যেন একটা মায়া লেগে গেল। নওরিন কাদতে কাদতে বলল, ‘আপনার কি মিনিমাম সেন্স নাই? এতো দেরি করে কেউ? আপনি জানেন শুভ্রের অবস্থা কতটা ক্রিটিকাল?’
আমি কিছুটা স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বললাম,‘আপু আমি যখনই শুনতে পেয়েছি হসপিটালে ইমার্জেন্সি এসেছে আমি সরাসরি চলে এসেছি। আর নরমাল টাইমে আমার হসপিটালে আসা হয় সাড়ে নয়টায়। এখন বাজে আটটা। দের ঘন্টা আগেই এসেছি। যদিও একটু লেট হয়ে গেছে তার জন্য সরি। আমি দেখছি পেশেন্ট এর কি হয়েছে।’
আমি সরাসরি এমআরআই রুমে চলে গেলাম। শুভ্রকে নাকি এমআরআই করানোর জন্য সেখানে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। আমি সেখানে গিয়ে দেখি আকরাম স্যার সেখানে আছে। আকরাম স্যার নিউরোলজি ডিপার্টমেন্ট এর হেড। আমাকে দেখে স্যার বলল, ‘নিখিল এসেছো? তাড়াতাড়ি ভেতরে আসো। দেখো এই পেশেন্টকে। তুমি দেখলে অবাক হয়ে যাবে।’
আমি শুভ্রের কাছে গেলাম। শুভ্রকে দেখে অবাক হওয়ার মতো তেমন কিছু পেলাম না৷ যে জিনিসটা দৃষ্টিগোচর হয়েছিল সেটা হচ্ছে শুভ্র একটু বেশিই ফর্সা। আর তার সেন্সলেস অবস্থায়ও মুখে কিছুটা হাসি দেখা যাচ্ছিল। এ বিষয়টা তেমন একটা অবাক করেনি। আমি স্যারকে বললাম, ‘স্যার কি দেখে অবাক হব? বুঝলাম না।’
‘আরে আমি কি তোমাকে পেশেন্ট এর চেহারা দেখে অবাক হতে বলেছি। কোন মেয়ে ডাক্তার হলে নাহয় এর চেহারা দেখতে বললাম। কারণ পেশেন্টের চেহারা যতটা সুন্দর তাতে যেকোন মেয়ে প্রেমে পড়ে যাবে। তুমি পেশেন্ট এর এমআরআই রিপোর্ট দেখো৷’
আমি এমআরআই রিপোর্ট দেখলাম। রিপোর্ট দেখে কপালে কিছুটা ঘাম জমে গেল। কারণ আমি এমন রিপোর্ট কখনো দেখিনি। স্যার বললেন, ‘দেখেছো! কি বুঝলে? আমি কিন্তু ভালোভাবে কিছুই বুঝিনি।’
আমি কি বলব বুঝতে পারছিলাম না। কারণ শুভ্রের মস্তিষ্কের প্যাটার্ন আসলেই সকলের থেকে আলাদা ছিল। আমি এতোটা আলাদা কারো দেখিনি। বলতে গেলে কিছুটা মিরর ইমেজের মতো৷ সেটাও অসম্পূর্ণ ভাবে। ডান মস্তিষ্ক সাধারণ মানুষের থেকে অনেক বেশি আলাদা। ভালোভাবে ততটা বুঝছিলাম না। আর একটা বিষয় হচ্ছে শুভ্রের মস্তিষ্কের একটা শিরা ছিরে যাওয়ায় রক্তক্ষরণ হচ্ছিল। স্ট্রোক বলা যায়। কিন্তু আবার নাক দিয়ে রক্ত বের হচ্ছিল। এটা বিষয়টা ঘোলাটে করে দিচ্ছে। দেখে মনে হচ্ছিল অনেকক্ষণ ধরেই রক্তক্ষরণ ঘটছে। এতোক্ষণে মারা যাবার কথা। কিন্তু শুভ্র সারভাইভ করছে। ব্যাপারগুলো আমাকে অনেক বেশি অবাক করছিল। স্টুডেন্ট লাইফের একটা কেইস এর কথা মনে করিয়ে দিল শুভ্রের কেইসটা। যখন লন্ডনে ছিলাম তখন এমন একজনকে আমাদের হসপিটালে আনা হয়েছিল। কিন্তু তার অবস্থা এতোটা সিরিয়াস ছিল না। কিন্তু তাকেও শেষ পর্যন্ত বাচাতে পারেনি আমার সিনিয়ররা। বুঝতে পারছিলাম না কি করতে হবে। আমি স্যারের দিকে তাকিয়ে দেখলাম স্যারের কপালে কিছুটা ঘাম জমেছিল। স্যার আমাকে বলল, ‘কি করব পেশেন্টকে? ফিরিয়ে দিব? আমি কিন্তু কিছু আসলেই বুঝতেছি না। তুমি তো অনেক দিনের মতো লন্ডনে ছিলে সেখানে কি এমন কোন সিরিয়াস কেইস দেখোনি?’
আমি আমতা আমতা করে বললাম, ‘স্যার আমিও এটা প্রথম দেখছি। তবে কিছুটা কাছাকাছি একটা কেইস এসেছিল। ওটি রুম থেকে আর তাকে বাচানো যায় নি। কিন্তু ওই লোকটার ব্রেইন স্ট্রাকচার এতোটা ভিন্ন ছিল না। এ এর তো একদম আলাদা।’
দেখলাম স্যার একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে দিল। কিছুটা বিচলিত দেখাচ্ছিল। স্যার আবার বলল, ‘তাহলে কি পেশেন্ট এর বাড়ির লোককে পেশেন্টকে অন্য কোথাও নিয়ে যেতে বলব?’
আমি কিছুক্ষণ চুপ করে রইলাম। তারপর বললাম, ‘স্যার আমার মনে হয় না ফিরিয়ে দেয়াটা ঠিক হবে। আর আমরা যেটা পারছিনা সেটা মনে হয় না অন্য কেউ আরো ভালোভাবে পারবে। আমাদের একটা রিস্ক নেয়া উচিৎ। আমার যতদূর মনে হচ্ছে ব্লিডিং পয়েন্ট অপারেশন করে বন্ধ করে দিলে পেশেন্ট বাচলেও বাচতে পারে।’
স্যার হতাশ ভঙ্গিতে বলল, ‘তুমি শিওর না পেশেন্ট বাচবে কিনা?’
আমি বললাম, ‘স্যার বাচা-মরা তো সব আল্লাহর হাতে। আমরা শুধু নিজেরা যতটুকু পারি সেটা চেষ্টা করি। এতে যদি বেচে যায় তাহলে তো ভালোই৷’
আমার জুনিয়র ডাক্তার বলল, ‘নিখিল স্যারের কথা আমার কাছেও যুক্তিযুক্ত মনে হচ্ছে। আমাদের রিস্ক নেয়া উচিৎ। এতে যদি পেশেন্ট বেচে যায় তাহলে তো ভালোই হবে।’
স্যার নিরাশ ভঙ্গিতে বলল, ‘ঠিক আছে। নিখিল তুমি গিয়ে পেশেন্ট এর বাড়ির লোকদের সাথে কথা বলো। আর ওনাদেরকে রিস্কের ব্যাপারটা জানিও। আর তারপর মিটিং রুমে আসবে। সেখানে অন্যান্য ডক্টরদের সাথে আলোচনা করে অপারেশন এর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।’
আমি মাথা নেড়ে বের হয়ে গেলাম। বাহিরে এসে দেখলাম নওরিন দাড়িয়ে আছে। নওরিনের বাবা পাশে বসেছিল। আর নাবিলাও এসেছিল। যদিও তখন কাউকে চিনতাম না। পরে পরিচয় হয়েছিল। আমাকে বের হতে দেখে নওরিন আমার দিকে এগিয়ে এসে আমাকে বলল, ‘শুভ্রের এখন কি অবস্থা? ও ঠিক হয়ে যাবে তো? ওর কিছু হবে না তো?’
বলেই নওরিন কেদে ফেলল। নাবিলা ওকে সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা করছিল। আমি বললাম, ‘পেশেন্ট এর কেইসটা একটু বেশিই ক্রিটিকাল। এমন হুবহু কেইস আমার ক্যারিয়ারে দেখিনি। ওর ব্রেইন স্ট্রাকচার একদম ভিন্ন। মস্তিষ্কের ডান পাশটা সাধারণ মানুষ থেকে একদম আলাদা। আলাদা মানে অনেকটা উন্নত টাইপের। আর ডান পাশ আলাদা হওয়া মানে হচ্ছে পেশেন্টের কল্পনা শক্তি অত্যন্ত প্রখর ছিল বলে ধারণা করতেছি। কারণ মানুষের কল্পনা মস্তিষ্কের ডান পাশটা নিয়ন্ত্রণ করে। আপনাকে বুঝাতে গেলেও বুঝবেন না। আমরা অপারেশন এর প্রাথমিক সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’
নওরিন কাদতে কাদতে বলল, ‘তো করুন অপারেশন। আমার শুভ্রকে প্লিজ বাচিয়ে তুলুন। শুভ্রকে ছাড়া আমি বাচব না।’
নওরিনের কান্না দেখে নিজের কথা হারিয়ে ফেলছিলাম। আমতা আমতা করে বললাম, ‘কিন্তু একটা সমস্যা আছে। সেটা হচ্ছে পেশেন্টকে অপারেশন এ বাচানোর সম্ভাবনা একদম কম। অপারেশন এর পর বাচবে কিনা সেটা নিয়ে সন্দেহ আছে।’
নওরিন কান্না কিছুটা থামিয়ে ফেলল। তারপর বলল, ‘কি বলছেন আপনি? শুভ্র আপনারা শুভ্রকে বাচাতে পারবেন না? যদি না পারেন বলেন আমরা অন্য হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছি।’
নওরিনের কথাগুলো শুনে নিজের কথাগুলো গুছাতে পারছিলাম না। এমন কখনো ঘটেনি। কিমতু নওরিনকে দেখে সবকিছু পেচিয়ে যাচ্ছিল। আমি বললাম, ‘অন্য জায়গায় নিয়ে গেলেও যে পেশেন্টকে বাচানো যাবে সেটার সম্ভাবনাও তেমন একটা নাই৷ কারণ অন্যরাও আমাদের মতোই বলবে। আমরা একটা রিস্ক নিতে পারি। এর যদিও আমি এমন একটা কেইস লন্ডনে থাকতে দেখেছিলাম। কিন্তু সেটা এতোটাও সিরিয়াস ছিল না।’
সাদ্দাম সাহেব বলল, ‘আপনি কি বলছেন যে ছেলেটাকে বাচানোর কোন উপায় নেই?’
‘উপায় নেই সেটা বলব না। কারণ অপারেশন এর মাধ্যমে বাচানো যেতে পারে। আমরা শুধু রিস্ক নিয়ে ভয় পাচ্ছি। আমাদের হাতে তো বাচানোর ক্ষমতা নেই। সেটা তো আল্লাহর হাতে। আমরা আমাদের মতো চেষ্টা করব। বাকিটা নাহয় আল্লাহ তায়ালা দেখবেন।’
নওরিনের বাবা নওরিনের কাধে হাত দিয়ে বলল, ‘এনাদেরকে একটা সুযোগ দেয়া উচিৎ। আল্লাহর উপর ভরসা রাখ।’
নওরিন কাদছিল। নওরিন বলল, ‘আমি কিচ্ছু বুঝতেছি না৷’
নওরিন বাবা আমাকে বলল, ‘আপনারা অপারেশন এর ব্যবস্থা করুন। আর দেখবেন ছেলেটাকে যেন যেকোন মতে বাচানো যায়।’
‘আচ্ছা ঠিক আছে। আমরা আরেকটা ছোট্ট মিটিং করব। তারপর আপনাদের আমাদের চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের কথা জানাব। বেশিক্ষণ লাগবে না মিটিং করতে।’
‘ঠিক আছে।’
নওরিন নিজের চোখ মুছতে মুছতে বলল, ‘আমি কি একটু শুভ্রকে দেখতে পারি?’
‘উম! এখন তো পারবে না। সরি তুমি করে বলে ফেললাম। এখন কাউকে এলাউ করা হচ্ছে না। পেশেন্ট এর অবস্থা অনেক বেশি ক্রিটিকাল।’
নওরিন আমার কথা শুনে আবার কেদে ফেলল। আমি একটু ভড়কে গেলাম। সেদিকে মনোযোগ না দিয়ে আমি সেখান থেকে চলে গেলাম। দেখলাম আমার যাওয়ার আগেই মিটিং শুরু হয়ে গিয়েছিল। প্রায় আধা ঘণ্টা ধরে মিটিং চলল। কয়েকজন বিখ্যাত নিউরোলজিস্ট এর সাথে ভিডিও কলে কথা বললাম। বেশিরভাগই আমার লন্ডনের প্রফেসর ছিল। একজন তারাও শুভ্রের কেইসটা দেখে অনেকটা অবাক হয়ে গিয়েছিল। শেষমেষ মিটিং এ অপারেশন করার সিদ্ধান্ত নেয়া হলো। আমার প্রফেসর কয়েকটা দিকনির্দেশনা দিল। মিটিং শেষ করে আকরাম স্যার নওরিনদের সাথে কথা বলতে গেল। আমি তখন চেম্বারে যাই কিছুটা প্রস্তুতি নেয়ার জন্য। চেম্বারে যাওয়ার পর ক্রিস্টিনের ফোন আসে৷ ফোন রিসিভ করার সাথে সাথে ক্রিস্টিন বলল, ‘তুমি খাওয়া দাওয়া করেছো?’
‘না। যে পেশেন্ট আসছে তার অবস্থা অনেক বেশি ক্রিটিকাল। কখন যেন মারা যায় এই অবস্থা। জানো এমন পেশেন্ট আমি জীবনে দেখিনি। অবাক করার ব্যাপার হচ্ছে এর ব্রেইন প্যাটার্ন একদম তোমার আমার ব্রেইন প্যাটার্ন থেকে একদম ভিন্ন। বাসায় এসে তোমাকে বুঝাব নে। এখন অপারেশন করতে হবে। একবারে অপারেশন এর পর খাওয়া দাওয়া করব।’
ক্রিস্টিন বিস্ময়ের কন্ঠে বলল, ‘তুমি এতোক্ষণ না খেয়ে থাকবে। খেয়ে নাও না। অপারেশন কি এখন কি করতে হবে?’
‘হ্যা। আর দশ মিনিট পর শুরু হবে। এখন ওটি ড্রেস পরার জন্য আসছি। আর জানো আমি আমার এপ্রোন বাসায় রেখে আসছি। এখন হসপিটাল এ যেটা আছে সেটা দিয়ে কাজ চালাতে হবে।’
‘হুম। দেখেছি। আচ্ছা এখন রাখি। আমার ক্লাস আছে। ক্লাস এ যেতে হবে।’
‘ওকে বাই। আর আজ রাতে ভালো কিছু রান্না করো। সারাদিন না খেয়ে আছি বুঝতেই তো পারছ কতটা ক্ষুদার্ত থাকব।’
ক্রিস্টিন হেসে বলল, ‘আচ্ছা ঠিক আছে তোমার পছন্দের খাবার রান্না করে রাখব। আর ইউরোপিয়ান ডিস খাবে নাকি বাঙালি?’
‘যেটা ভালোভাবে রাধতে পারবে সেটাই খাব। এখন রাখো। আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে। আর তুমি টেনশন করো না। আমি সার্জারি শেষ হলে হসপিটালের ক্যান্টিন থেকে খেয়ে নিব।’
‘ওকে বাই৷’
ক্রিস্টিন ফোন রেখে দিল। আমি পেছনে দিকে তাকিয়ে দেখি আকরাম স্যার দাড়িয়ে আছে। আমি তার দিকে তাকালে স্যার বলল, ‘তোমার ওয়াইফের সাথে কথা বলছিলে?’
আমি মুচকি হেসে বললাম, ‘জ্বী স্যার। আমার আর কথা বলার কে আছে।’
স্যার বলল, ‘তুমি তো দেখলাম বাংলাতেই কথা বলতেছিলে। তোমার ওয়াইফ কি এখন পুরোপুরি বাংলা বলতে পারে? তোমার ওয়াইফ না ইংল্যান্ডের মেয়ে?’
আমি আরেকবার হাসি মুখে বললাম, ‘ জ্বী স্যার ওর বাবা মা সবাই ব্রিটিশ সিটিজেন। আর স্যার, ও বাংলা শিখে ফেলেছে। এখন তো আমার থেকেও ভালো বাংলা বলতে পারে। আর বাঙালি রান্না যা করে আপনি খাওয়ার পর বিশ্বাসই করবেন না। একজন অবাঙালি এতোটা ভালো বাঙালি রান্না করতে পারে। আপনি আসবেন একদিন বাসায় আপনাকে ক্রিস্টিন রান্না করে খাওয়াবে।’
স্যার হেসে বলল, ‘আচ্ছা ঠিক আছে। এখন আসো ওটি রুমের দিকে যাই। যেতে যেতে কথা বলি।’
আমি ওটি ড্রেস হাতে নিয়ে আমি আর স্যার হাটতে হাটতে ওটি রুমের দিকে যেতে শুরু করলাম। স্যার হাটার সময় বলল, ‘আচ্ছা তোমার ওয়াইফের নাম ক্রিস্টিন না?’
‘স্যার ক্রিস্টিন ওর নাম ছিল। কিন্তু মুসলমান হওয়ার নাম চেঞ্জ করছে। কিন্তু আমি এখনও আগের মতো ক্রিস্টিন বলি।’
‘মেয়েটা তোমাকে অনেক ভালোবাসে এটা বুঝা যাচ্ছে। নাহলে কেউ কারও জন্য নিজের দেশ আর ধর্ম ছেড়ে চলে আসে না৷’
‘জ্বী স্যার। আমার তো নিজেকে অনেক ভাগ্যবান মনে হয় ক্রিস্টিনের মতো মেয়েকে নিজের জীবনে পাওয়ায়।’
‘আচ্ছা তোমার কি মনে হয় আজকের পেশেন্টকে অপারেশন থিয়েটারে বাচানো যাবে?’
‘জানি না স্যার। তবে ছেলেটাকে যেভাবেই হোক বাচাতে হবে। কারণ আমার ছেলেটার সাথে কথা বলার অনেক ইচ্ছা আছে। আর আমার মনে হয় এই ছেলেটা সবার থেকে আলাদা। আরেকটা জিনিস খেয়াল করেছেন ছেলেটা অজ্ঞান হয়ে থাকলেও এখনও তার মুখে অনেক সুন্দর একটা হাসি আছে।’
স্যার দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, ‘হু। কি ফুটফুটে একটা ছেলের কি অবস্থা। বাচাতে পারলে লাইফের সবচেয়ে বড় একটা সাকসেস হিসেবে গণনা করব এইটা তাড়াতাড়ি চলো।’
অপারেশন থিয়েটারে যাওয়ার পথে কোন কথা বললাম না। সরাসরি অপারেশন থিয়েটারে চলে গেলাম। মাঝে নওরিন আমার সাথে কিছু বলতে এসেছিল কিন্তু আমি সেটা না শুনেই অপারেশন থিয়েটারে ঢুকে যাই। কারণ খেয়াল করেছিলাম ওর চোখ ছলছল করতেছিল। জানতাম আমার সাথে কথা বলতে এলেই কেদে ফেলবে। এর চেয়ে আমার কাছে ওটিতে ঢুকে যাওয়াই বেশি ভালো মনে হলো। আমি ওটিতে ঢোকার প্রায় দশ মিনিট পর সার্জারী শুরু করি। সব সময়ের মতো মূল দায়িত্বটা পড়ল আমার ঘাড়ে। আর হেল্প করবে আকরাম স্যার। সাথে দুইজন জুনিয়র ডাক্তার। একজন মেয়ে আর একজন ছেলে। জুনিয়র দুইজন একেবারে নতুন। টানা দুই ঘন্টা পয়তাল্লিশ মিনিট প্রচেষ্টার পর ব্রেইনের যে জায়গা থেকে রক্তক্ষরণ ঘটছিল সেখানে পৌছাতে পারি। এখানেও শুভ্রের দুইটা পয়তাল্লিশ আমাকে হেল্প করে। শুভ্রের মাথার ডিজাইন এমন ছিল যে বুঝা কষ্টের হচ্ছিল কিভাবে শুরু করব। আরেকটা বিষয় সার্জারির সময় লক্ষ্য করলাম সেটা হচ্ছে শুভ্রের স্কাল্প ডেনসিটিও সাধারণের চেয়ে একটু বেশি। যার কারণে সেটাকে ভেদ করতেও সময় বেশি লেগে যায়। সাধারণ মস্তিষ্ক সার্জারি করতে করতে আমার প্রায় মুখস্ত হয়ে গেছে। কিন্তু এই মস্তিষ্কটা একদম আলাদা। মনে হচ্ছিল এই আমি বোধহয় মস্তিষ্ক বিষয়ে কিছু জানিই না। ঠিক তখন একটা অবাক করার বিষয় ঘটে। আর সেটা হচ্ছে শুভ্র হঠাৎ রেসপন্স করতে শুরু করে। যেটা ছিল অত্যন্ত ভয়ংকর। হঠাৎ করেই ব্রেইন এর সিগন্যাল পাঠানো শুরু হয়। জুনিয়র মেয়েটা বলল, ‘স্যার পেশেন্ট তো রেসপন্স করছে। এখন রেসপন্স করা তো মারাত্মক ব্যাপার। পেশেন্ট কোমাতেও চলে যেতে পারে।’
আমার কপালে ঘাম জমে গিয়েছিল। বুঝতেছিলাম না কি ঘটছে। আকরাম স্যার আমাকে বলল, ‘কি হলো নিখিল! কি হচ্ছে এসব। পেশেন্ট কি আর বাচানো যাচ্ছে না?’
হঠাৎ করেই আমার হাত কাপছিল। এই প্রথম ওটি টেবিলে আমার হাত কাপছিল। এর আগে বহু সার্জারি করেছি কিন্তু হাত কাপেনি। আমি ভয় পেয়ে যাচ্ছিলাম। সবার মধ্যেই চাপা উত্তেজনা কাজ করছিল। সবাই কিছুটা আতঙ্কের মধ্যে ছিল। আমি আকরাম স্যারকে বললাম, ‘স্যার আমরা বোধহয় পেশেন্টকে আর বাচাতে পারছিনা। পেশেন্টকে হয়তো আর বাচানো যাবে না। কারণ ও রেসপন্স করলে কোমায় যাবে না। সরাসরি মারা যেতে পারে।’
চলবে….
পরিশিষ্টঃ কিছু বলার নেই। শুধু নতুন ভাবে শুরু করায় কিছুটা এলোমেলো মনে হতে পারে। পরবর্তীতে আরও ভালো কিছু দেয়ার চেষ্টা করব।
ধন্যবাদ