দুইটা পয়তাল্লিশ পর্ব ১১

0
270

গল্পঃ #দুইটা_পয়তাল্লিশ

‘আমি মারা যাব! তুমি কি সত্যি বলছ?’
শুভ্র নিঃসংকোচে গলায় বলল, ‘জ্বী ভাইয়া আমি ঠিক বলছি। আপনার মারা যাওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি।’
শুভ্রের কথা শুনে আমার মাথা ঘুরছিল। দেখে অবাক লাগছিল যে শুভ্র আমার মৃত্যুর সংবাদ কতটা অবলীলায় জানাল। তার মুখে ভাবনার কোন পরিবর্তন হলো না। সে একই ভঙ্গিতে কথা বলছিল। আমি নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে আগের চেয়ারটাতে ধপ করে বসে পড়লাম। শুভ্র আমাকে বলল, ‘আপনি ঠিক আছেন তো?’
আমি হাত নেড়ে বুঝিয়ে দিলাম ঠিক আছি।কিন্তু মনের ভেতরে ঝড় বইছিল। যে ঝড় থামবে কিনা জানি না। নওরিন তখন শুভ্রকে বলল, ‘এই তুমি কি বলছ এসব? তোমার মাথা ঠিক আছে তো? এসব উল্টাপাল্টা কথা বলছ কেন?’
শুভ্র নিস্তেজ গলায় বলল, ‘আমি ঠিকই বলছি। তুমি জানো আমি কখনো মিথ্যা কথা বলি না। আর যা বলি সেটাতে নিশ্চিত হয়েই বলি। আর আমি এখন যেটা বলছি সেটাও সত্য বলছি।’
শুভ্র তখন আমার দিকে মাথাটা ঘুরিয়ে আমার হাতটা আরেকটু শক্ত করে ধরে বলল, ‘ভাইয়া আমি সত্যিই দুঃখিত যে আমাকে এতোটা কঠিন একটা কথা বলতে হলো। যে মানুষটা আমার জীবন বাচালো আর আমি তারই মৃত্যুর সংবাদ দিতেছি। এটা যে কতটা হীন কাজ সেটা আমার থেকে ভালো আর কেউ বুঝতে পারবে না। কিন্তু আমার কিছু করার ছিল না।’
আমার কান দিয়ে যেন কোন কথা ঢুকছিল না। মৃত্যুর সংবাদটা যেন আমাকে একদম ভেতর থেকে ভেঙে দিয়েছিল। আমি নিজের মৃত্যুর সংবাদ শোনার পর এতোটা কষ্ট পাব সেটা কোনদিন ভাবতে পারিনি। জীবনে কত মানুষের মৃত্যুর সংবাদ আমি নিজে দিয়েছি তার হিসাব মনে আসছে না। ওটি থেকে বের হয়ে বলেছি যে পেশেন্টকে বাচাতে পারিনি। এমন ঘটনা অনেক বার ঘটেছে। এখন নিজে নিজের মৃত্যুর খবর পাচ্ছি। ভেতর থেকে সব কিছু ভেঙে চুড়ে যাচ্ছিল। মনে হচ্ছিল চারপাশের সব কিছু স্তব্ধ হয়ে গিয়েছে। আমি কোন এক গভীর আলোকিতময় অন্ধকারে ডুবে আছি। কিছু বুঝতে পারছিলাম না। শুভ্র বলল, ‘ভাইয়া! ভাইয়া! আপনি ঠিক আছেন তো?’
একটা ঘোরের মধ্যে চলে যাচ্ছিলাম। শুভ্রের ডাকে যেন ঘোরটা কেটে গেল। কিন্তু হৃদয়টা শান্ত হচ্ছিল না। আমি বললাম, ‘আচ্ছা আমার এমন হচ্ছে কেন? হৃদয়টা ভেঙে খন্ড খন্ড হয়ে যাচ্ছে। কেন এমন হচ্ছে?’
আমার চোখ দিয়ে পানি পড়ছিল। মনের মধ্যে হাহাকার অনুভূত হচ্ছিল। কিছু ভালো লাগছিল না৷ শুভ্র বলচল, ‘আপনি মৃত্যুকে ভয় পাচ্ছেন। সবাই মৃত্যুকে ভয় পায়। একটা মানুষ এক সময় মৃত্যুকে কাছে ডাকে। কিন্তু সময়ের পরিবর্তনে সেও ভয় পায়। আপনি জানতে চান না। কেন আপনার মৃত্যুর সম্ভাবনা আছে? আসলে আমার কারণে আপনার মৃত্যুর সম্ভাবনা আছে। আমাকে বাচানোর কারণে আপনার মৃত্যু ঝুকি বেড়েছে।’
শুভ্র আমার হাতটা ছেড়ে দিল৷ আমি কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। কারণ যাকে আমি বাচিয়েছি তার কারণে আমার মৃত্যু ঝুঁকি আছে এটা আমার মাথা ঢুকছিল না। বহু কষ্টে বাচিয়েছিলাম। আমার চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছিল। শুধু আমার না খেয়াল করে দেখি নওরিনেরও চোখ দিয়ে পানি পড়ছিল। আমি স্তব্ধতার পর্দার আড়ালে চলে যাচ্ছিলাম। সেখানে আর বসে থাকতে ইচ্ছা করছিল না। জানি না কেন মনে একটা অন্য রকম অনুভূতি হতে শুরু করেছিল। বুঝতে পারছিলাম না কি হবে আমার সাথে। আমি দাড়িয়ে গেলাম। তারপর বহু কষ্টে হাসিমুখে শুভ্রকে বললাম, ‘প্রতিটা মানুষকেই মারা যেতে হবে৷ কেউ অনন্তকাল বাচবে না। একদিন আগে বা একদিন পরে সবাইকেই মারা যেতে হবে। আমাকেও একদিন মারা যেতে হবে। আর তুমি যেহেতু বলছ যে আমার মৃত্যু অনেক কাছে আমি বুঝতে পারছি যে আমার সময়ও শেষ হয়ে আসছে। এখন উঠি। বুঝতেছি না তোমাকে ধন্যবাদ দিব কিনা। যতদিন বেচে আছি ততদিন নাহয় বেচে থাকার মতো করেই বাচি। এখন যাই পরে আবার এসে তোমার সাথে কথা বলব। এখন মনটা অস্থির হয়ে আছে। কারও সাথে কথা বলতে ইচ্ছা করছে না। আর তুমি ভেবো না আমি আমার মৃত্যু নিয়ে ভয় পাই না৷’
মিথ্যা বললাম শুভ্রকে যে আমি মৃত্যুকে ভয় পাই না। আসলে আমি অনেক বেশি ভয় পেতেছিলাম। বুঝতে পারছিলাম না শুভ্র আমার কথাগুলো মেনে নিয়েছে কিনা। কারণ ওর মুখে আগের মতোই কোন ভাবান্তর দেখা যাচ্ছিল না। আমি বেরিয়ে পড়লাম রুম থেকে। শুভ্র পেছন থেকে এবার ডাকল না। ভেবেছিলাম হয়তো ডাক দিয়ে হেসে বলবে যে ফাযলামি করছিল, ভয় দেখালো। কিন্তু এমন কিছু করল না। পা এগোতে চাইছিল না৷ মনের ভেতরে ঝড় বইছিল। যে ঝড় কখনো থামবে না। রাউন্ডে যেতে ইচ্ছা করছিল না। চেম্বারের দিকে হাটছিলাম। কিন্তু পা এগোচ্ছিল না। এক পা এগোচ্ছিল আর আবার থেমে যাচ্ছিলাম। অসম্ভব এক ক্লান্তি আমাকে গ্রাস করে ফেলছিল। সব কিছু ঘোলাটে হয়ে যাচ্ছিল। বারবার হসপিটালের দেয়াল ধরে দাড়িয়ে যাচ্ছিলাম। একজন সিস্টার আমাকে বলল, ‘স্যার আপনার কি কিছু হয়েছে? আপনাকে দেখে কেমন যেন অসুস্থ অসুস্থ বলে হচ্ছে।’
আমি মেয়েটার মুখের দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘না আমার কিছু হয় নি। আমি ঠিক আছি।’
আমার কিথা শুনে সিস্টার চলে গেল। নিজের পরিচিত রাস্তাটাও আমার কাছে অপরিচিত মনে হচ্ছিল। এই রাস্তা ধরে হাজারো বার চেম্বারে গিয়েছি। কিন্তু এবার এই রাস্তাই অচেনা মনে হচ্ছিল। শুধু হয়তো নিজের মৃত্যুর খবর জানতে পেরেছি তাই। বহু প্রচেষ্টায় নিজের রুমে চলে যাই। সেখানে গিয়ে ইজি চেয়ারটাতে ধপ করে বসে পড়ি। সব কিছু দেখে অন্ধকার অন্ধকার দেখছিলাম। হঠাৎ ক্রিস্টিনের কথা মনে পড়ে চোখ দিয়ে আবারও পানি চলে আসল। কারণ আমি ছাড়া এখানে ক্রিস্টিনের কেউ নেই। সে আমাকে ভালোবেসে নিজের পরিবার, দেশ এমনকি ধর্ম ত্যাগ করে আমার সাথে অচেনা এই বাংলাদেশ এ এসেছিল। আমি এখন চলে গেলে ক্রিস্টিনের আর আপন কেউ থাকবে না। বারবার ফোনে ক্রিস্টিনের ছবি দেখছিলাম। যেন মন ভরে ছবিটা দেখতে চাইছিলাম। ক্রিস্টিনকে দেখে যেন মন ভরছিল না। ইচ্ছা করছিল সরাসরি দেখা করি। তাই ক্রিস্টিনকে ফোন করলাম। নিজের আবেগটা লুকানোর চেষ্টা করছিলাম। ক্রিস্টিন কল রিসিভ করে বলল, ‘হ্যালো!’
ক্রিস্টিনের কন্ঠ শুনে নিজের মনে এক অজানা প্রশান্তি চলে আসছিল। মনে হচ্ছিল এমন অনুভূতি জীবনে কোনদিন পাইনি। চোখে পানি চলে আসছিল। বারবার রুমাল দিয়ে চোখ মুছতেছিলাম। কিছু বলতে পারছিলাম না। শুধু নীরবে কাদছিলাম। ক্রিস্টিন আবার বলল, ‘কি হলো কথা বলছ না কেন?’
নিজের সকল ইচ্ছাশক্তিকে এক জায়গা করে বললাম, ‘কি করছ তুমি? ক্লাসে আছো এখন?’
ক্রিস্টিন হাসি হাসি ভাব নিয়ে বলল, ‘না এখন অফিস রুমে আছি। একটু পরে যাব। জানো আজ না একটা মজার ঘটনা ঘটেছে তুমি শুনলে তোমার হাসতে পেট ব্যাথা হয়ে যাবে। তোমাকে পরে বলব ঠিক আছে?’
আমি চুপ করে ক্রিস্টিনের কথা শুনছিলাম। ক্রিস্টিনের কথা শেষ হওয়ার পরও কোন উত্তর দিলাম না। ক্রিস্টিন তখন বলল, ‘তুমি কি এখনই সেটা শুনতে চাও। শুনতে চাইলে আমি এখনই বলতে পারি। আমার এখনও হাসি পাচ্ছে। হিহি। শুনবে এখন?’
আমার কন্ঠ ভিজে আসছিল। ক্রিস্টিনকে কিছু বুঝতে দিতে চাইছিলাম না। কিন্তু নিজেকেও শান্ত করতে পারছিলাম না। আমি বললাম, ‘একটা কথা বলব তোমাকে?’
ক্রিস্টিন বলল, ‘একটা কেন দশটা বলো। আমার সাথে কথা বলবে এতে আবার পারমিশন নেয়ার কি আছে। নিজের বউয়ের সাথেই তো কথা বলবে। অন্যের বউয়ের সাথে তো বলবে না। হিহি।’
আমি কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর বললাম, ‘একটা রিকুয়েস্ট ছিল আরকি। সেটা হচ্ছে তুমি কি একটু হসপিটালে এসে আমার সাথে দেখা করবে?’
ক্রিস্টিন বলল, ‘এখনই আসতে হবে? ছুটির পর আসলে হয় না? ক্লাস নিতে হবে তো।’
‘এখন একটু আসো না। আমার তোমাকে এখন অনেক দেখতে ইচ্ছা করছে।’
‘সকালেই তো আমাকে দেখলে এখন আবার দেখতে ইচ্ছা করছে? তোমার সাথে আবার দেখা হবেই। এমন তো না যে আমি কোথাও চলে যাচ্ছি।’
আমি অনুরোধ করার ভঙ্গিতে বললাম, ‘এখনই আসো না প্লিজ। আমার এখন কিছুই ভালো লাগছে না৷ তোমাকে কাছে পেতে ইচ্ছা করছে। তোমাকে দেখতে ইচ্ছা করছে। শুধু আজকের জন্য নাহয় আমার খাতিরে চলে আসলে। জাস্ট ফর টুডে। প্লিজ কাম হেয়ার।’
আর নিজের আবেগকে ধরে রাখতে পারলাম না। আওয়াজ করেই কেদে ফেললাম। ক্রিস্টিনের কন্ঠ কিছুটা বিচলিত হয়ে গেল। ক্রিস্টিন বলল, ‘কি হয়েছে তোমার? তুমি কাদছ কেন? তুমি ঠিক আছো তো? আমার কিন্তু ভালো লাগছে না। তুমি সুস্থ আছো তো?’
আমি কাদতে কাদতে বললাম, ‘তুমি প্লিজ আসো।’
ক্রিস্টিন বলল, ‘আচ্ছা এখনই আসছি। তোমার হসপিটালেই আসছি।’
আমি বললাম, ‘আই লাভ ইউ। আই লাভ ইউ।’
বলে ফোনে একটা চুমু খেলাম। ক্রিস্টিন তখন বলল, ‘আই লাভ ইউ টু। তুমি প্লিজ ওয়েট করো। আমি দ্রুত চলে আসছি।’
ক্রিস্টিন ফোন রেখে দিল। এক অসহ্যকর বেদনা আমাকে গ্রাস করছিল। বহুদিন পর এতোটা কান্না আসছিল। না কাদতে কাদতে যেন কান্না কিভাবে করে সেটাই ভুলে গেছিলাম। আর সেই স্মৃতি যেন হঠাৎ মনে পড়ে গেছে। নিজের মৃত্যুর খবর পেলে কি সবারই এমন অবস্থা হয়। নাকি শুধু ক্রিস্টিনের জন্য সব কিছু এমন লাগছে। সব কিছু এলোমেলো হয়ে যাচ্ছিল।
রিসিপশনে ফোন দিয়ে বলে দিলাম যে আমি মর্নিং রাউন্ডে যেতে পারছি না। অন্য কাউকে পাঠাতে বলে দিলাম। এরপর ইজি চেয়ারে আধ শোয়া অবস্থা চোখ বন্ধ করে থাকলাম। চোখ বন্ধ করায় যেন জীবনের সব স্মৃতি মনে পড়ে যাচ্ছিল। আব্বুর কথা মনে পড়ছিল। নাবিলা আর শ্রেয়ানের কথা মনে পড়ছিল। সেই ক্লাবটার কথা মনে পড়ছিল। আজব ব্যাপার হচ্ছে আজ আরেকটা নাবিলার সাথে দেখা হয়ে গেল। সে আবার আমার পেশেন্ট নাবিলা না৷ সে নওরিনের বান্ধবী নাবিলা৷ সব কিছু যেন গোলক ধাধায় ঘুরছিল। দুজন নাবিলাই একদম আলাদা। একজন একটু বেশি সুন্দরী ছিল। আর নওরিনের বান্ধবী একটু কম। উল্টাপাল্টা চিন্তায় মাথা ঘুরপাক খাচ্ছিলো। ইচ্ছা করছিল ক্রিস্টিনের কথা ভাবি। কিন্তু পারছিলাম না। এলোমেলো হয়ে আসছিল। কি চিন্তা করছি সেটাও এক পর্যায়ে বুঝতে পারছিলাম না৷ চারপাশে সব কিছু ঘুরপাক খাচ্ছিলো। ঠিক তখন একটা অস্পষ্ট আওয়াজ কানের ভেতরে শুনতে পেলাম। একবার চোখ খুলে এদিক ওদিক তাকিয়ে নিলাম। কিন্তু কাউকে দেখতে পেলাম না। আবার চোঝ বন্ধ করে ফেললাম। চোখ বন্ধ করে থাকতেই বেশি ভালো লাগছিল। মারা গেলেও তো চোখ বন্ধ হয়ে যাবে। তখনও কি চোখ বন্ধ করে থাকতে ভালো লাগবে। এই চিন্তাটাও মাথায় ঘুরছিল। এতো চিন্তা ভাবনা করছিলাম কিন্তু সময় এগোচ্ছিল না। কারণ এতো কিছু চিন্তা করলাম কিন্তু ক্রিস্টিনের সাথে কথা শেষ হয়েছে মাত্র দুই মিনিট আগে। সময় যেন থমকে গিয়েছিল। আবারও অস্পষ্ট আওয়াজ শুনতে পেলাম৷ একবার ভাবলাম বেশি টেনশন এর কারণে এমন হচ্ছে। কিন্তু হঠাৎ করেই স্পষ্ট আওয়াজ শুনতে পেলাম৷ শুভ্রের আওয়াজ। দ্রুত চোখ খুলে আবার এদিক ওদিক তাকালাম। আবারও কাউকে দেখতে পেলাম না। কোন এক অজানা উৎস থেকে থেকে শুভ্রের কন্ঠের আওয়াজ পাচ্ছিলাম। শুভ্র বলছিল, ‘ভাইয়া আপনি কি আমার কথা শুনতে পাচ্ছেন?’
কিছুটা আমার গা ছমছম করছিল। কিছুটা ভয় পাচ্ছিলাম। কারণ শুভ্রের আওয়াজ সরাসরি আমার কানে আসছিল। কিন্তু আমি শুভ্রকে দেখতে পাচ্ছিলাম না। আমি বললাম, ‘হ্যা শুনতে পাচ্ছি কিন্তু তোমাকে দেখতে পাচ্ছি না।’
শুভ্র হেসে বলল, ‘দেখতে পাবেন কিভাবে আমি তো আমার কেবিনে আছি। আর সেখান থেকে কথা বলছি। বলুন তো কিভাবে কথা বলছি। আপনি তো ডাক্তার সহজেই ধরে ফেলতে পারবেন।’
আমি নিস্তেজ গলায় বললাম, ‘আমি বুঝতে পারছি না। তবে মনে হচ্ছে টেলিপ্যাথির মতো কোনকিছু। তুমি এটা যে পার আমি জানতাম না।’
শুভ্র কিছুক্ষণ হাসল। আমি সেই হাসির আওয়াজ স্পষ্ট পাচ্ছিলাম। যেন সামনে বসে হাসছে। কিন্তু আমার বিরক্ত লাগছিল। কিছু ভালো লাগছিল না৷ শুভ্রের সাথে কথা বলতেও ভালো লাগছিল না। শুভ্র বলল, ‘আপনি ঠিক বলেছেন। আমি টেলিপ্যাথি পারি। কারণ আমি একটা ভিন্ন ধর্মী মানুষ। আপনি তো দেখেছিলেন আমার মস্তিষ্ক কেমন। আমি যে শুধু টেলিপ্যাথি পারি সেটা কিন্তু না। আমি দূর থেকেও মানুষের মাইন্ড রিড করতে পারি। অন্যজন স্বপ্নের মধ্যে কি দেখছে সেটা দেখতে পারি। আরেকজনের স্বপ্ন নিয়ন্ত্রণ করতে পারি। পরিবর্তন করতে পারি। আপনি কি আমার শক্তির কথা জানতে পেরে অবাক হচ্ছেন?’
আমি চোখ বন্ধ রেখেই বললাম, ‘এখন অবাক হচ্ছি না। যদি অন্য কোন সময় শুনতাম তাহলে অবশ্যই অবাক হতাম। কিন্তু এখন মনের অবস্থা ভালো না। কিছু ভালো লাগছে না। সব কিছু এলোমেলো হয়ে আছে। গোলমাল হয়ে আছে সব কিছু।’
‘আপনি কি নিজের মৃত্যুর খবর পেয়ে ভয় পাচ্ছেন?’
আমি চোখ খুলে ফেললাম। এক গ্লাস পানি খেয়ে ফেললাম। তারপর বললাম, ‘হ্যা ভয় পাচ্ছি। আমি অনেক বেশি ভয় পাই। কেন এতো ভয় পাচ্ছি?’
শুভ্রের কন্ঠের হাসি হাসি ভাব শোনা যাচ্ছিল। শুভ্র বলল, ‘আপনি ভয় পাচ্ছেন আপনার স্ত্রীর জন্য। আপনার ধারণ আপনি ছাড়া তার আর কেউ নেই। কিন্তু তার পরিবার আছে। তারা এখনও লন্ডনে আছে। আপনার আর মিল কোথায় জানেন? আমি আপনি দুজনেই সবাইকে হারিয়ে একজনকে আকড়ে ধরে আছি। আপনি ধরে আছেন ক্রিস্টিনকে আর আমি ধরে আছি নওরিনকে।’
আমার গলা আবার ভিজে এলো। চোখ দিয়ে পানি বেরিয়ে আসল। শুভ্র বলল, ‘আপনি আপনার ওয়াইফকে অনেক বেশি ভালোবাসেন। আপনার ওয়াইফও আপনাকে অনেক বেশি ভালোবাসেন এতে কোন সন্দেহ নাই। মানুষ কখনো নিজের জন্য মৃত্যুকে ভয় পায় না। শুধু ভালোবাসার মানুষের জন্য ভয় পায়।’
‘হুম। আমাকে প্লিজ একটু একা থাকতে দাও। তবে তার আগে একটা কথা বল তুমি কি সত্য বলছিলে যে মৃত্যু নিকটবর্তী?’
শুভ্র কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। আমি শুভ্রের উত্তরের অপেক্ষা করছিলাম। শুনতে চাইছিলাম ও বলুক যে এমন কোন সম্ভাবনা নেই। কিন্তু শুভ্র কিছু বলছিল না৷ একটু পর শুভ্র বলল, ‘আমি কখনো মিথ্যা বলি না। আপনার মৃত্যু সম্ভাবনা আছে। শুধুমাত্র আমাকে বাচানোর জন্য। কারণ তারা আপনার উপর এর প্রতিশোধ নিবে। তাদের উদ্দেশ্য ছিল আমাকে মেরে ফেলা। কিন্তু আপনি আমাকে বাচিয়ে তুলেছেন। তাই এর প্রতিশোধ তার নিবেই। তবে এখান থেকে বের হওয়ার উপায় আছে। আমি আপনাকে সাহায্য করব। তবে এর জন্য আপনাকেও আমাকে সাহায্য করতে হবে।’
আমি আবার স্তব্ধ হয়ে গেলাম। কিছু বুঝতে পারছিলাম না। আমি উত্তেজিত স্বরে বললাম, ‘কারা প্রতিশোধ নিবে? কারাই বা তোমাকে মারতে চেয়েছিল আমি বাচিয়ে তুলেছি? আর তুমি একদিনের মধ্যে পুরো সুস্থ হয়ে গেলে কিভাবে? এই সব প্রশ্নের উত্তরগুলো দাও প্লিজ। প্লিজ প্লিজ।’
আমি কেদে ফেললাম। একজন পুরুষ মানুষ হিসেবে আমি এতো কাদতে পারি সেটা জানা ছিল না। শুভ্রের কোন আওয়াজ পাওয়া গেলো না। হয়তো আর কথা বলতে চায় না।
প্রায় আধা ঘন্টা পরে ক্রিস্টিন হসপিটালে আসল। এই আধা ঘন্টা আমার কাছে আধা জীবনের মতো লাগছিল। এই সময়টা যেতে চাইছিল না। ক্রিস্টিন যখন আমার চেম্বারে ঢুকল আমি ক্রিস্টিনের কাছে গিয়ে ক্রিস্টিনকে জড়িয়ে ধরলাম। তারপর গালে, মুখে, কপালে, ঠোটে চুমু খেতে লাগলাম। নিজের উপর যেন নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারছিলাম না। আমার চোখ দিয়ে পানি পড়ছিল। আমি কাদছিলাম। ক্রিস্টিনের চোখও ছলছল করছিল। ক্রিস্টিন দুই একবার বলল, ‘কি হয়েছে তোমার? এমন করছ কেন? প্লিজ বলো আমাকে?’
আমি ক্রিস্টিনকে জড়িয়ে ধরে রেখে শুধু কাদছিলাম। কোন উত্তর দিতেছিলাম না। এভাবে ওকে বুকে আকড়ে রাখতে ইচ্ছা করছিল। ওর সাথে সারাজীবন থাকতে ইচ্ছা করছে। বৃদ্ধ বয়স পর্যন্ত এক সাথে থাকতে ইচ্ছা করছে। কিন্তু নিশ্চিত না পারব কিনা। ক্রিস্টিন আমার বাহু থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে প্রথমে আমার মুখে হাত দিল। আমি ক্রিস্টিনের মুখ দেখলাম ভালোভাবে। খেয়াল করলাম ক্রিস্টিনও কাদছে। তারপর ও একবার কপালে চুমু খেল। ক্রিস্টিন আমার গাল হাত দিয়ে ধরে বলল, ‘একটু শান্ত হও। তোমাকে এই অবস্থায় দেখে আমার যে কি কষ্ট হচ্ছে আমি তোমাকে বলে বুঝাতে পারব না। প্লিজ একটু শান্ত হও। শুধু আমার জন্য শান্ত হও। প্লিজ।’
ক্রিস্টিন কাদছিল৷ দুজনেই তখন কাদছিলাম। নিজের থেকে বেশি ক্রিস্টিনের জন্য খারাপ লাগছিল। ক্রিস্টিন টেবিলের কাছে গিয়ে একগ্লাস পানি ভরে আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে খেতে বলল। আমি খেয়ে নিলাম। পানি খেয়ে কিছুটা শান্ত হয়ে গেলাম। তারপর ক্রিস্টিনকে চেয়ারে বসিয়ে আমি ক্রিস্টিনের আমি ক্রিস্টিনের পায়ের কাছে বসলাম। তারপর ক্রিস্টিনের কোলের উপর মাথা রেখে সকালের প্রতিটা কাহিনী বলতে শুরু করলাম। শুভ্রের কথা বললাম। শুভ্রের হঠাৎ করেই সুস্থ হয়ে যাওয়ার কথা বললাম। ওর টেলিপ্যাথির কথা বললাম। সব কিছু খুলে বললাম। ক্রিস্টিন মনযোগ দিয়ে সব কিছু শুনছিল। ওর সাথে কথা বলে মনটা অনেক হালকা লাগছিল। ভালো লাগছিল একটু। যেন সব বেদনা দূর হয়ে যাচ্ছিল। ক্রিস্টিন সব কিছু শোনার পর একটু গম্ভীর ভঙ্গিতে বলল, ‘তুমি সব কিছু এতো দ্রুত বিশ্বাস করে নিলে? ডাক্তার হিসেবে অন্তত উচিৎ ছিল না। তোমার অবস্থা দেখে আমার কিছুটা হাসি পাচ্ছে।’
ক্রিস্টিন কিছুক্ষণ হাসল। আমি সরু দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলাম। কিন্তু অজানা কারণে ক্রিস্টিনকে হাসতে দেখে ভালো লাগছিল। ক্রিস্টিন বলল, ‘তুমি জানো না কেউ কারও মৃত্যু সম্পর্কে আগাম কিছু বলতে পারে না। তুমি হয়তো ওর সার্জারির সময় ওর মাথার কোন তার ছিড়ে ফেলছ। তাই ও পাগল হয়ে গেছে। আর পাগলের মতো কথা বলছে।’
আমি চুপ করে রইলাম। কিছু বলার ছিল না। কিছুক্ষণ পর বললাম, ‘তুমি কি ওর সাথে কথা বলবে?’
ক্রিস্টিন বলল, ‘হুম। কিন্তু এখন না। পরে কথা বলব আর জিজ্ঞাসা করব তোমাকে এতো ভয় দেখালো কেন। চলো আমরা এখন বাইরে ঘুরতে যাই। অনেকদিন দুজন এক সাথে কোথাও ঘুরতে যাই না। আজ চলো। বাহিরে গেলে তোমার মনটা ভালো হয়ে যাবে।’
ইচ্ছা করছিল না যেতে তবুও রাজি হয়ে গেলাম। আমি বললাম, ‘ঠিক আছে। কোথায় যাবে তাহলে?’
ক্রিস্টিন ওর হাত দিয়ে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল, ‘চলো সেই ক্লাবটাতে যাই। সেটাতে এখন একটা স্কুলও আছে। সেখানে বাচ্চাদের সাথে সময় কাটালে তোমার ভালো লাগবে। আর তোমাকে দেখলে ওদেরও ভালো লাগবে। তোমার মনে আছে ওরা কত ভালোবাসত? তারপর সেখান থেকে আসার সময় কোন এক রেস্টুরেন্টে লাঞ্চ করে আবার হসপিটালের এসে সেই পেশেন্ট এর সাথে আমি কথা বলব। ঠিক আছে?’
আমি মাথা নাড়লাম। ক্রিস্টিন কিছুক্ষণ আমার মাথায় বিলি কেটে দিল। তারপর আমি উঠে দাড়ালাম। এরপর ক্রিস্টিনের সাথে বেরিয়ে পড়লাম।

দুজন নাবিলা আর শেয়ানের নামে খোলা সেই ক্লাবটাতে পৌছালাম৷ এখানে এসে নাবিলা নামটা দেখে নওরিনের বান্ধবী নাবিলার কথা মনে পড়ছিল। বহুদিন পর এখানে আসা। সব কিছু নতুন নতুন মনে হচ্ছিল। স্কুলটা নতুন করেই বানানো হয়েছে। পুরো ফান্ডিং শ্রেয়ানের বাবা করেছে। শ্রেয়ানের বাবার সাথে দেখা করা দরকার কিন্তু করতে পারছি না। ক্রিস্টিন যা বলেছিল ঠিক তাই হলো সব ছেলে মেয়েরা আমাকে দেখে আসলেই অনেক খুশি। কত স্মৃতি জড়িয়ে আছে এই ক্লাবটার সাথে। এই ছোট ছোট ছেলে মেয়েদের সাথে। আমার মন অনেকটাই ভালো হয়ে গেল। সেখানে তিনটা পর্যন্ত সময় কাটালাম। এতোক্ষণ সময় কাটানো তে মনের দুঃখ আর বেদনা যেন একদম কেটে যাচ্ছিল। নিজের মৃত্যুর ভয়টা অনেক অংশে কমে যাচ্ছিল। ক্রিস্টিনকেও অনেক খুশি মনে হচ্ছিল। মনের ভেতর থেকে মৃত্যুর ভয় অনেকটাই কমে গেল।
সেখান থেকে বেরিয়ে একটা রেস্টুরেন্ট এ লাঞ্চ করলাম। তার হসপিটালে ফিরে এলাম। ফিরে এসে অনেক বড় একটা ধাক্কা খেলাম যে ধাক্কাটাকে সামলাতে পারছিলাম না। সব কিছু আবার ওলট পালট লাগছিল। কারণ হসপিটালে এসে দেখি শুভ্র আর নওরিন নেই। দুজনে হসপিটাল থেকে চলে গেছে। আরেকটা অস্বাভাবিকতা হচ্ছে ওদের ঠিকানাও নেই। যে সব জায়গায় ওদের ঠিকানা লেখা ছিল সেগুলো সব মুছে গেছে৷ শুধু একটা ডায়েরি ছিল। আর ডায়েরির ভেতর একটা চিরকুট এ লেখা ছিল

‘ভাইয়া সাবধানে থাকবেন। আমি আসলেই যা বলেছি সেগুলো সব কিছু সত্য বলেছি। আপনি সাবধানে থাকবেন। কারণ আপনাকে আমার অনেক প্রয়োজন আছে। এই ডায়েরিটা রেখে যাচ্ছি এখানে আমার আর নওরিনের কিভাবে দেখা হয়েছিল। কিভাবে পরিচয় হয়েছিল। কেন এতো ভালোবাসি দুজনকে সেটা লেখা আছে। আর নিজের ঠিকানাটা আমি নিজের সাথেই নিয়ে গেলাম। যখন আমার প্রয়োজন হবে আমি নিজে আপনার সাথে যোগাযোগ করব। ততদিনে আপনি কাইন্ডলি আমার ক্ষমতাগুলোর রহস্য বের করবেন। গুড বাই।’

আমার কাছে আবার সব কিছু ঘোলাটে হতে শুরু করল। সব কিছু অন্ধকার দেখছিলাম৷ মাথা ঘুরছিল। শরীর এর উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলছিলাম। মনে হচ্ছিল যেন আসলেই সময় শেষ হয়ে আসছে। পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে হবে৷

চলবে…
পর্বঃ ১১

লেখকঃ Parvez Rana

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here