#তোর_নামের_রোদ্দুর-২
#লেখনিতে:মিথিলা মাশরেকা
পর্বঃ৯
টেবিলের উপরে বাবু হয়ে বসে সামনে দুটো বড়বড় বোলে পানিতে দুহাত চুবিয়ে রেখেছে আলিফ।চোখ খিচে বন্ধ করছে একবার,হাত তুলে ফু দিচ্ছে,আমার দিকে মনভাঙা চেহারায় তাকাচ্ছে একবার,তো আবার শুদ্ধ ভাইয়ার দিকে তাকিয়েই চোখ নামিয়ে নিচ্ছে।আমি দম মেরে দাড়িয়ে আছি।শুদ্ধ ভাইয়া পকেটে দুহাত গুজে পাশের টেবিলে ঠেস দিয়ে দাড়িয়ে।যীনাত আপু মাথায় হাত দিয়ে বিরক্তি নিয়ে চেয়ারে বসে আছে।আর বাকিসব আগ্রহ নিয়ে কি হয়েছে তা বোঝার চেষ্টা করছে।
-দুহাত ভেজাচ্ছো কেনো আলিফ?কাজ তো শুধু ডানহাতে করেছো!
আলিফ তাড়াতাড়ি বা হাত পানি থেকে বের করলো।তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে শুদ্ধ ভাইয়ার দিকে তাকালাম।এতো স্বাভাবিকভাবে কথা বলছেন উনি যেনো খুব ভালো কাজ করিয়েছেন উনি আলিফকে দিয়ে।অবশ্য ওনার মধ্যে তো এতোটুকো গিল্টি ফিল দেখছি না আমি।কতো সুন্দরভাবে দাড়িয়ে দেখছেন আলিফকে কষ্ট পেতে।তখন আমার সামনেই ওভাবে আলিফের হাত ধরে রেখে শান্তভাবে বলে উঠলেন,
-কে তুমি?
আলিফ জোর করে হেসে বললো,
-ইয়ে ভাইয়া,আমি এইযে ডিকিউ,আইমিন ইনসিয়ার ফ্রেন্ড।সিফাত ভাইয়ার ছোটভাই রিফাতও আমার খুব ভালো বন্ধু।
-ও।ইনভিটিশনে এসেছো তারমানে?
আমি একটু এগিয়ে বললাম,
-তাতে আপনার কি?নিজের কাজ করুন গিয়ে!
উনি রাগী চেহারা করে তাকালেন আমার দিকে।চোয়াল শক্ত করে বললেন,
-আমার কাজ কি সেটা তোকে বলতে হবে না।আই নো দ্যাট ভেরি ওয়েল!স্টে আউট অফ ইট!
পরপরই আলিফের দিকে ফিরে স্বাভাবিক গলায় বললেন,
-হ্যাঁ।তুমি বলো।ইনভিটিশনে এসেছো তাইনা?
রাগ হলো আমার।আলিফের সাথে যেনো মুখে চিনি মিশিয়ে কথা বলছে আর আমার সাথে ওভাবে কথা বলছেন উনি।আলিফ বললো,
-জ্বী না ভাইয়া।এ বাসার সবাই তো আমাকে এ বাসার ছেলে হিসেবেই দেখে।আমি তো….
-ওওওও!ছেলে হিসেবে?ইউ মিন এজ আ ফ্যামিলি মেম্বার?
-স্ সেরকমই ক্…
-বেশ তো!তবে চলো।আমাদের কাজেও হাত লাগাও কিছুটা?
-ও কেনো কাজ করবে?ও দাওয়াতে এসেছে,খাবে দাবে মজা করবে।কাজ কেনো করবে?
আমার কথায় শুদ্ধ ভাইয়া আমার দিকে ফিরলেন।ঘাড় বাকিয়ে বললেন,
-একটু বেশিই কেয়ার করিস দেখছি তোর ফ্রেন্ডের?
-স্বাভাবিক।আমার লাইফের বেস্ট…
আলিফ কথা শেষ করতে না দিয়েই বললো,
-তুই থাম ডিকিউ!এই ভাইয়াকে আলিফের ভাল্লাগছে।কোনোদিন দেখিনি তো কি হইছে,এর পারসোনালিটি জোশ!এতোদিনে তর বাসায় আমার সাথে মানানসই কাউরে পাইছি ডিকিউ!ভাইয়া আপনি….
-আমি সিয়ার…
শুদ্ধ ভাইয়াকে বলতে না দিয়ে আমিই বললাম,
-আ্ আমার কাজিন।ভাইয়া হয়!সেজোকাকুর ছেলে।ওনারা ঢাকায় সেটেল্ড,তাই কোনোদিন দেখিসনি তুই।
আমার দিকে রক্তচক্ষু করে তাকালেন শুদ্ধ ভাইয়া।বললেন,
-নেক্সট টাইম আমার ইন্ট্রো আমিই দেবো।এন্ড ট্রাস্ট মি,সেদিন তুই মুখ দিয়ে টু শব্দটা বের করলে আগুন লাগিয়ে দেবো!
আমি ভরকে গেলাম।এতোটা রাগ?সম্পর্কটা তো এটাই।ওনারও এইটাই মানার কথা।একটা শুকনো ঢোক গিলে জবাবটা দিতে যাবো আলিফ মাঝখান থেকে বললো,
-আরে ভাইয়া,চলেন তো।আমরা আমাদের কাজ করি।ওর কথা বাদ দেন।চলেন,চলেন।
শুদ্ধ ভাইয়া বাকা হাসলেন।যেটা মোটেও ভালো লাগে নি আমার।হনহন করে চলে এলাম ওখান থেকে।ফ্যানের সামনে দাড়িয়ে ঠান্ডা হওয়ার চেষ্টায় ছিলাম।মিনিট পনেরো পর মৌনতা হাপাতে হাপাতে এসে বললো,
-ইনসু?আলিফের হাতের অবস্থা খুব খারাপ রে!
আতকে উঠে বললাম,
-কি?কেনো?কি হয়েছে?
-তোর মেজোমা নাকি ওকে নাকি মাংস নুনহলুদ দিয়ে ম্যারিনেট করতে দিয়েছিলো।ও বেচারা খেয়াল করেনি নিচে মরিচের গুড়োও ছিলো।বড় সসপ্যানটায় হাত ডুবিয়ে মাখিয়েছে সবটা।এখন ওর হাত নাকি খুব জ্বলছে।অস্থির হয়ে গেছে একদম।তুই চল তাড়াতাড়ি!
কপাল চাপড়ে দৌড় লাগালাম আমি।এসে দেখি আলিফের হাত পানিতে চুবানো।চোখমুখ লাল হয়ে গেছে একদম।এগিয়ে যাবো,কেউ হাত টেনে ধরলো আমার।পিছন ফিরে দেখি শুদ্ধ ভাইয়া।উনি বললেন,
-ওভাবে দৌড়াচ্ছিস কেনো?যেনো তোর ননির পুতুল ফ্রেন্ডকে কেউ খেয়ে নিচ্ছে!
-হাত ছাড়ুন!মেজোমা ছেলেটাকে এই কাজ কেনো করতে বলেছে?এভাবে…
-আমি বলেছিলাম মেজোমাকে তাই।
নড়াচড়া থামিয়ে বিস্ফোরিত চোখে তাকালাম তারদিক।উনি নির্বিকারচিত্ত্বে বললেন,
-এজন্য কোনো জিনিসের প্রতি হাত বাড়ানোর আগে তা কি,কার,কোন দশায় আছে,হাত বাড়ানো যাবে কি না,না গেলে কেনো হাত বাড়ানো যাবে না সবটা জেনে নিতে হয়।তোর এই ফ্রেন্ডটা একটু বেশিই ডেস্পারেট সিয়া!
-আপনি…
-হোয়াট?বেশি কেয়ারিং দেখাতে যাস না।তোর শাস্তির লিস্টটা বাড়ছে।একদম সুদে আসলে বুঝিয়ে দেবো ঠিক সময়মতো!
হাত ছাড়িয়ে আলিফের কাছে আসলাম।ওকে দেখে আমারই কষ্ট হচ্ছে।তাপসী আপু বললো,
-তুমি ভাই কেনো গেলে হাত লাগাতে?
-ওর খুব শখ হয়েছিলো কিনা!শুদ্ধর জিনিসে হাত বাড়ায়!যাই হোক,ও বাসা থেকে সবাই আসছে,এবার এখানে জটলা না করি আমরা।আলিফ?আই হোপ এখন তুমি খানিকটা বুঝে,শুনে,সুস্থ্য হয়ে গেছো?
-জ্বী,জ্বী ভাইয়া,আমি ঠিকাছি।একদম ঠিকাছি।ইনফ্যাক্ট বেটার আছি।আপনারা আমাকে নিয়ে ব্যস্ত হবেন না।ওই ডিক্,মানে ইনসিয়া,তুই যা না!তর কামে যা!আমি ঠিকাছি।
-আলিফ,তুই…
-যা না বইন!যা তুই!
নাটকের সমাপ্তি ঘটলো।ইতিমধ্যেই সীমা ভাবির বাসার লোকজন চলে এসেছে।পার্লার থেকে আসা কয়েকটা আপু ওকে এতোক্ষন সাজাচ্ছিলো।আমরা কয়জন মিলে নিয়ে এসে বসালাম ওকে।খাওয়াদাওয়ার পর্ব শেষে খুব সুন্দরমতো সিফাত ভাইয়া,সীমা ভাবিকে নিয়ে চলে গেলেন ওনারা।
_____________
সন্ধ্যার আগেই সিফাত ভাইয়া আর সীমা ভাবি ওর বাবার বাসায় চলে গেছে আত্মীয়স্বজনদের সাথে।ওদের গাড়িতে তুলে দিয়ে রুমে ঢুকে একটু ফ্রেশ হয়ে বিছানায় সবে গা এলিয়ে দিয়েছি,ইরাম এসে আমার মিনি অডিও স্পিকারটা হাতে নিয়ে বললো,
-চলো বাগানে।ডাকছে সবাই।
একটা জোরে শ্বাস ফেললাম।সবাই মানে শুদ্ধ ভাইয়াও আছেন ওখানে।উনি এসে সবটা এলোমেলো হয়ে গেছে।না বুকভরে শ্বাস নিতে পারছি,না ফ্যামিলি আড্ডায় ঠিকমতো থাকতে পারছি।কতো প্লান ছিলো আমার এই সিফাত ভাইয়ার বিয়েটাকে ঘিরে।আর হলোটা কি?এই এংরি বার্ড এন্ট্রি নিয়ে,বারোটা বাজিয়ে দিলো সবটার।ইরাম তুড়ি বাজিয়ে বললো,
-কোথায় আপনি?
-অব্ তুই যা।আ্ আমি যাবোনা বাগানে।টায়ার্ড লাগছে।
-ওকে।
সুন্দরমতো কথাটা বলে টেবিলে রাখা ওষুধের বক্সটা হাতে নিলো ও।ভ্রুকুচকে বললাম,
-ওটা কেনো নিচ্ছিস আবার?
-শুদ্ধ ভাইয়া বললো ওর নাকি প্রচন্ড টায়ার্ড লাগছে আর ঘুমও পাচ্ছে।আমি ভাবলাম যদি হেডেক থাকে,তাই মাথাব্যাথার ওষুধ দিয়ে আসতে চাইলাম।
হাসি ফুটলো মুখে।যাক।ভালোই হয়েছে।উনি ঘুমোবেন,আমি তাহলে যাই।আড্ডা দিয়ে আসি।উঠে আসছিলাম ইরাম বললো,
-কই যাও?
-বাগানে।
-এই না বললে টায়ার্ড লাগছে?
-এখন লাগছে না।তোর খুব সমস্যা?
ও কিছু না বলে মুখ বাকিয়ে বিরক্তি নিয়ে মাথা নাড়তে নাড়তে বেরিয়ে গেলো।ফুরফুরে মেজাজ নিয়ে আমিও বাগানে চলে আসলাম।উকিঝুকি দিয়ে দেখলাম ইমরোজ ভাইয়া,তাপসী আপু,তামিম ভাইয়া ওরা তিনভাইবোনই আছে।ইশান ভাইয়া,রিফাত ভাইয়া,যীনাত আপুও আছে।শুধু শুদ্ধ ভাইয়া নেই ওখানে।ঠোটে বড়সর একটা হাসি টেনে এগিয়ে গেলাম ওখানে।
আকাশে রুপালি থালার মতো পূর্নচাঁদ।ঝলমল করছে চারপাশ চাদের আলোতে।বাসার ব্যালকনি আর রুমগুলো থেকে আসা একটুআধটু আলো,বাগানের উচু উচু গোল পিলারের উপরে জ্বলতে থাকা লাইটের টিমটিমে আলো,চাঁদের আলো।মৃদ্যু বাতাসের শো শো আওয়াজ,দু চারটে জোনাকি,হাসনাহেনা ফুলগাছটা থেকে আসা তীব্র ঘ্রান,সবটা মিলিয়ে সত্যিই উপভোগ্য পরিবেশ।
সবাই হাসিঠাট্টায় মেতেছে।তামিম ভাইয়া ওর গিটারটা কোলে জরিয়ে বসে।যীনাত আপু বললো,
-কিরে তামিম?গিটারটা কি কোলেই রাখবি?কাজে লাগাবি না?
-তোমরা কথা বলো,আমি তাতে টুংটাং জুরে দিচ্ছি!
ইমরোজ ভাইয়া বললো,
-থাক।বহুত করিয়াছেন।ইনসু?ওটা নে তো!
ভ্রুকুচকে বললাম,
-আমি কেনো নেবো?
-বাজিয়ে গান গাইবি তাই!
তাপসী আপুর কথায় বড়বড় হয়ে গেলো আমার চোখ।নিজেকে সামলে বললাম,
-ক্ কিসের গান?কোনো গানটান গাইবো না আমি।
-হু।তা কেনো গাবে তুমি?তার থেকে বাথরুম সিঙ্গার হয়ে কানের পোকা বের করাটাই বেশি প্রেফার করবে তুমি।কিরে এটা জানিস না তোরা?
সরু চোখে তাকালাম যীনাত আপুর দিকে।একটামাত্র ফুপাতো বোন আমার,কতো ভালোবাসি ওকে।আর ও?এমন বিহেভ করে যেনো সবখানে পচাতে পেরে শান্তি লাগে ওর।ইরাম বললো,
-আহা!মনের কথা!
ইশান ভাইয়া বললো,
-সত্যি ইনসিয়া?তুমি বাথরুম সিঙ্গার?থাক!তাহলে গাইতে হবে না।না জানি আমারও কর্নকুহরটার বারোটা বাজিয়ে দাও!
সবাই জোরে হেসে দিলো।আমি ফুসে উঠে তামিম ভাইয়ার কোল থেকে গিটারটা কেড়ে নিলাম।এদের একমাত্র গান দিয়েই উত্তর দেওয়া যাবে।আজ এতো ভালো গাইবো,এতো ভালো গাইবো,যদি দৃষ্টি আনাম লাইট উপাধী না নিয়েছি এদের কাছ থেকে তো আমিও ইনসিয়া সারাহ্ নই!
আমাকে গিটার কাড়তে দেখে ইরাম বললো,
-ওই দেখো!ক্ষেপেছে।কানে আঙুল দাও সব!
একপলক ওরদিক অগ্নিদৃষ্টি ছুড়ে দিলাম।একটা জোরে শ্বাস নিয়ে নিজেকে শান্ত করে গিটারটা বাজিয়ে গাইতে লাগলাম,
” হৃদয়ে,জ্বলছে যে বহ্নি
তা একদিন তারা হয়ে জ্বলবে,
জোসনায়,স্নান হবে ওমনি
সে আলোর পথ ধরে চলবে
সে ভাবনায়,কেনো হায়,
ভয় হয়,নিশিদিন….
আগুনের দিন শেষ হবে একদিন
ঝর্নার সাথে গান হবে একদিন
এ পৃথিবী ছ্…..
কেউ একজন পিছন থেকে গিটারটা ছিনিয়ে নিলো আমার থেকে।গান গাওয়া বাদ দিয়ে পিছনে তাকালাম।শুদ্ধ ভাইয়া!চাঁদের আলোটা মুখে পরেছে একদম তার।হাত মুঠো করে দাড়িয়ে আছেন উনি।চেহারায় অতিরিক্ত রাগ ফুটে উঠেছে।উনি এখানে কেনো?কখন আসলেন?গিটারটা কেড়ে নিলেন কেনো আমার কাছ থেকে?আর রেগেই বা আছেন কেনো এভাবে?
#চলবে…