তোর নামের রোদ্দুর২ পর্ব 7

0
1672

#তোর_নামের_রোদ্দুর-২
#লেখনিতে:মিথিলা মাশরেকা
পর্বঃ৭

সন্ধ্যার পর থেকেই দরজা লক করে রেখেছেন শুদ্ধ ভাইয়া।রাতে খেতেও আসেন নি উনি।এখনও অবদি দরজা লক তার।তখন ওভাবে তার গলা জরিয়ে ধরা নিয়ে ভয় পেয়েছিলাম খুব।হয়তো এ নিয়ে বড়সড় কোনো ঝামেলা হবে।কিন্তু উনি কিছুক্ষন অদ্ভুতভাবে আমার দিকে তাকিয়ে থেকে,কোনো কথা না বলে নিশব্দে মাথা নিচু করে রুমে চলে গেলেন।বাকিরা সবাই পরপরই স্বাভাবিক হলেও,আমি অপরাধবোধে ভুগেছি তারপর থেকে।আমার স্পর্শ চান নি উনি।তাই ওনার মন খারাপ।এতোটাই অযোগ্য আমি তার?যদি এসবই পাওনা আমার,তবে কেনো সেদিন জরিয়ে গিয়েছিলাম তার সাথে?কেনো?

চুপচাপ ডিনার শেষে যীনাত আপুর সাথে রুমে যাচ্ছিলাম।সবাই বলাবলি করছিলো শুদ্ধ ভাইয়ার কথা।দীদুন বলেছে বাজার থেকে ফিরেছে জন্য টায়ার্ড,পরে খাবে।আর কেউ কিছু বলেনি।তাপসী আপুর রুম পাশ কাটানোর সময় কানে এলো ইশান ভাইয়া বলছে,

-তোমার কি মনে হয় তাপসী?শুদ্ধ খেতে আসলো না কেনো?

আমি দাড়িয়ে গেলাম।যীনাত আপু মাথা নেড়ে বুঝালো থামলি কেনো।কিছু না বলে ওভাবেই দাড়িয়ে রইলাম।ভেতরে তাপসী আপু বললো,

-কেনো আবার?দীদুন বললো না?বাজার করে মহারাজ টায়ার্ড!ঠিকই আছে।এসবের অভ্যেস নেই তো ওর।

-কিন্তু আমার তো মনে হচ্ছে তখন ইনসিয়া যে ওকে…

-কি বলছো এসব তুমি ইশান?শুদ্ধ ইনসিয়াকে বকাবকি করতে পারে,কিন্তু শুধুমাত্র ওটুকোর জন্য এভাবে রিয়্যাক্ট কেনো করবে?ভুল ধারনা তোমার।

-হয়তো ওর পছন্দ হয়নি,ইনসিয়ার ওভাবে…

যীনাত আপু আধখোলা দরজায় একপলক তাকিয়ে আমার হাত ধরে টানলো।তবুও আমি দাড়িয়েই।ও ইশান ভাইয়াকে শেষ করতে না দিয়েই‌ জোরে বলে উঠলো,

-ইনসু!আজ যদি ইরামের উপর পা তুলে দিয়েছিস!আজ সাইডে ঘুমাবি তুই।মাঝে আমি ঘুমাবো।কতোবার বলবো বলতো তোকে?ও ঘুমোতে পারেনা ওভাবে।আমি সয়ে গেলেও ও সইবে কেনো?

আমি পাথরের মতো দাড়িয়ে রইলাম।বুক ভারি হয়ে এসেছে আমার।তাপসী আপু,ইশান ভাইয়া দুজনই বেরিয়েছে রুম থেকে।নিচদিক তাকিয়ে আছি।তাপসী আপু বললো,

-ইনসু আমি….

যীনাত আপু ওকে থামিয়ে দিয়ে বললো,

-থাক আপু।কিছু বলতে হবে না।ইনসু?চল!

ইশান ভাইয়া বললো,

-ওয়েট যীনাত!ইনসিয়া?আমি কিন্তু ওভাবে…

-ইনসু!

এতোক্ষন কিছু না বললেও দীদুনের গলা শুনে পাশে তাকালাম।চোখ আবারো চুলকাচ্ছে।জিভ দিয়ে ঠোট ভিজিয়ে একদম ধীর গলায় বললাম,

-হ্ হ্যাঁ দীদুন।বলো?

-আমার রুমে চল তো!ওষুধ পাচ্ছি না একটা।

সবার দিকে তাকালাম।তাপসী আপু,ইশান ভাইয়া চুপ।যীনাত আপু মাথা দুলিয়ে দীদুনের সাথে যেতে বললো।চলে আসলাম ওখান থেকে।এই পরিবারের লোকজনই এভাবেই আঘাত করেছিলো এর আগে আমাকে,ঠিক তখন এরাই ঢাল হয়ে দাড়িয়েছিলো আমার।অন্য কাউকেই চাইনা।কাউকেই না!

দীদুনের সাথে আসছিলাম।কিন্তু দীদুন নিজের রুমে না ঢুকে বললো,

-তোর সেজোমাকে ডেকে আন তো!

-রাত অনেক হয়েছে দীদুন।এখন সেজোমা কেনো?কি লাগবে তোমার?আমাকে‌ বলো না?

-সেজোমাকেই‌ লাগবে আমার।

-কিন্তু দীদুন…

-সেজোকাকু ঘরে নেই।বাইরে তোর বড়কাকুর সাথে কথা বলছে।

আর কথা বাড়াই নি।সেজোমার ঘরে এসে দেখি সে দরজার কাছেই রয়েছে।আমাকে দেখে বড়সর হাসি দিলো।যেনো সে আমার অপেক্ষাতেই ছিলো।হুইলচেয়ারটা ঠেলে আবারো দীদুনের রুমের সামনে আসলাম।দীদুন বললো,

-চলো তো সেজোবউমা,দেখি শুদ্ধ দাদুভাই খাবে না কেনো!

তারমানে দুজন মিলে এখন তার রুমে যাবে।আমি যাবো না।যদি আমার দোষ এটুকো হয়ে থাকে,অজান্তে স্পর্শ করেছি তাকে,তবে কেনো যাবো আমি?আমার উপস্থিতিও তবে বিষাক্ত লাগবে তার।

-দীদুন।আমার ঘুম পাচ্ছে।আমি…

-এখানেই দাড়া!

-কেনো?

-তোর মনে হয় দোষটা তোর?

-দীদুন?

-যদি মনে হয়,দোষটা তোর,তবে সরি বলবি চল!আর একটা কথা না!

ছোটখাটো আদেশ!যেহেতু সত্যিই নিজেকে দোষী‌ মনে করছি,তার আদেশ মানা উচিত আমার।সেজোমাকে নিয়ে হাটা লাগালাম শুদ্ধ ভাইয়ার রুমের দিক।রুমের সামনে দাড়িয়ে দীদুন বললো,

-ডাক শুদ্ধকে!

-আমি?

-হ্যাঁ।তুই।ডাক!

-দীদুন…

-ডাক!দরজা খুলতে বল।

আজ দীদুনের কথার উপর কথা বলতে পারছি না।নাকি চাইছিই না?নিজেও জানি না।ইতস্তত করে দরজায় দুবার টোকা মারলাম।ক্ষীণ কন্ঠে বললাম,

-শ্ শুদ্ধ ভ্…

-চলে যা!

ভেতর থেকে একদম শান্ত জবাব।দীদুন সেজোমার দিকে তাকিয়ে আবারো ডাক দিলাম,

-শুদ্…

-বললাম চলে যেতে!

না।আর ডাকবো না।পারবো না আর ডাকতে।আরো কতোবার আত্মসম্মান জলান্জলি দেবো আমি?পিছিয়ে দাড়ালাম।দীদুন দরজা ধাক্কিয়ে বললো,

-দাদুভাই?দরজা খোলো?

-চলে যাও দীদুন।একা থাকতে চাই কিছুক্ষন।

-দাদুভাই?রাতের খাবারটা খাও নি তুমি।কিছু….

-একবেলা না খেলে কেউ মরে না।আর আমি তো বরং আরো বাচার উদ্দেশ্য খুজে পেয়েছি আজ আবারো।চলে যাও।

মরা বাচা!এইসব বলা কি খুব জরুরি?শক্ত করে হুইলচেয়ারটা ধরলাম।দীদুন সরে দাড়ালে সেজোমা এগুলো।আদুরে গলায় বললো,

-শুদ্ধ?দরজা খোল বাবা?

দু সেকেন্ডের মধ্যে দরজাটা খুলে গেলো।সেজোমার এক ডাকে দরজা খুলে দিলো?তাহলে আমার আর দীদুনের আসার তো কোনো দরকারই ছিলো না।সেজোমা মুচকি হেসে আমার হাত ধরে ভেতরে নিয়ে যেয়ে ইশারা করলো।রুমে ঢুকলাম সবাই।শুদ্ধ ভাইয়া ব্যালকনির কাছে পকেটে দুহাত গুজে উল্টোপাশ হয়ে দাড়িয়ে।গায়ে সেই নীল শার্টটাই।চেন্জ করেননি এখনো উনি?তাতে তোর কি ইনসু?প্রশ্নটা মাথায় আসতেই চোখ নামিয়ে নিলাম।দীদুন বললো,

-মুখ ফিরিয়ে রেখেছো কেনো দাদুভাই?

-ভালো লাগছে না দীদুন।

-কেনো?

-কোনো কিছুতে আটকে আছি এখনো।অন্য কিছু ভাবতে পারছি না।

দীদুন মুচকি হেসে আমার দিকে তাকিয়ে বললো,

-কিছু বলবি?

মিনমিনে গলায় নিচদিক তাকিয়ে বললাম,

-সরি।

দীদুন মাথা ঝাকিয়ে হাসলো কিছুক্ষন।সেজোমাও হাসছে।শুদ্ধ ভাইয়া তখনও উল্টোদিক ঘুরে সেভাবেই দাড়িয়ে।সেজোমা এগোলো তার দিকে।সরি বলা শেষ,আর কেনো থাকবো এখানে আমি?চলে আসবো বলে পা বাড়ালাম।কিন্তু দীদুন হাত ধরে আটকে দিলো।সেজোমা শুদ্ধ ভাইয়ার হাত ধরতেই সে পিছন ফিরে তার কোলে মাথা রেখে হাটুতে ভর করে বসলো।সেজোমা বললো,

-কেদেকেদে চেহারার এ কি হাল বানিয়েছিস শুদ্ধ?কবে বড় হবি তুই?

আমি একপলক তাকালাম তার দিকে এবার।কি বললো সেজোমা?কেদেকেদে মানে?শুদ্ধ ভাইয়া মাথা ঘুরিয়ে আমার দিকে মুখ করলেন।চোখ,নাক লাল হয়ে গেছে তার।কিন্তু ঠোটে সেই অমায়িক হাসি।কেদেছেন সত্যিই।চেহারায় স্পষ্ট।তবে হাসছেন কেনো ওভাবে?

-তোমার থেকে কিছুই লুকোতে পারি না আম্মু।

চোখ সরিয়ে নিলাম আমি।আমার দিকে তাকিয়েই কথাটা বললেন উনি।সেজোমা হেসে দিয়ে বললো,

-আম্মু হই তোর।যাই হোক,খুশিতে সবাই হাসে,আমার বোকা ছেলে কাদে।এই দুঃখ কোথায় রাখবো বলতো আমি?

-কে বলেছে তোমাকে?খুশিতে কেদেছি?

-শেহনাজ মন্জিলে তুমি।এটুকো আমিও বুঝি শুদ্ধ।

শুদ্ধ ভাইয়া লাজুক হেসে মাথা চুলকালেন।দীদুন হাসছে।সবাই সবটা বুঝছে।আর আমি হতভম্ব হয়ে সবার দিকে হা করে তাকিয়ে।

-দাদুভাই?কি খাবে?

উনি আমার দিকে তাকিয়েই বললেন,

-একদম ফুলপেট আমার দীদুন।আরো বছর পাঁচ মনে হচ্ছে না খেয়ে থাকতে পারবো।

আবারো হাসলো দীদুন।সেজোমা বললো,

-খেতে তো হবেই তোমাকে।নইলে সবাইকে বলে দেবো,এর আগে ঠিক কি কি কারনে,কতোবার এভাবে কেদেছো তুমি।

শুদ্ধ ভাইয়া মাথা তুলে চোখ ছোটছোট করে সেজোমার দিকে তাকিয়ে বললেন,

-থ্রেট দিচ্ছো?

সেজোমা ভাব নিয়ে বললো,

-হুম।সেরকমই মনে করো।

কিছু না বুঝেও ভেবেছিলাম থ্রেট নামক শব্দটায় ভয় পাওয়া বিষয়টা ইরহাম আজাদ শুদ্ধের জন্য প্রযোজ্য না।সে নির্ঘাত বলবে যা খুশি করো।আমাকে ভুলের সমুদ্রে চুবাতে সে সেজোমাকে জরিয়ে ধরে বললো,

-প্লিজ প্লিজ আম্মু!এটা করো না!দরকার পরলে আজ ডাইনিংয়ে পরে থাকা এটোসমেত সবটা খেয়ে নেবো,তবুও এটা করো না!

চোখ বেরিয়ে আসার উপক্রম আমার।সেজোমা,দীদুন হাসছে।শুদ্ধ ভাইয়া এবার উঠে দাড়ালেন।বাকা হেসে এগোতে লাগলেন আমার দিকে।দীদুনের হাত ধরে তার আড়ালে গিয়ে মাথা নিচু করে দাড়ালাম।উনি বললেন,

-দীদুন?তোমার লেটেস্ট ভার্সন এখানে কেনো?

দীদুন হাসতে হাসতেই বললো,

-সরি বলতে এসেছিলো।

শুদ্ধ ভাইয়া থুতনিতে হাত দিয়ে খানিকটা ঝুকে বললেন,

-তা তো শুনলামই।কিন্তু কেনো?

-অপরাধবোধ।খাওনি তুমি এখনো।

-ওওও!আচ্ছা খেয়ে নেবো।আর এইযে আপনি,আজকের ডোজটা এমনিতেও বেশি হয়ে গেছে।অনুগ্রহপুর্বক এইমুহুর্তে বিদেয় হন এই রুম থেকে।নইলে এরা দুজন মিলে আবার অন্য প্লান না করে ফেলে!

স্লো মোশনে তিনজনের দিকেই ড্যাবড্যাব করে তাকালাম।সবাই কি রকম করে যেনো হাসছে।শুদ্ধ ভাইয়া আপনি করে বললেন কেনো আমাকে?সেদিন বিয়ের দিন অন্ধকারেও আপনি করে বলেছিলেন উনি আমাকে।এরকম তো তখন বলেছিলেন,রেগে ছিলেন বলে।এখনও রেগে আছেন?সরি বললাম তবুও?আর অন্য কিছুর প্লান মানে?সরি তো বললামই।আর কি?হাতে পায়ে ধরাবে নাকি?পারবো না!এটুকোর জন্য আর কিছুই করতে পারবো না।দীদুনকে ছেড়ে দিয়ে একছুটে রুমে চলে আসলাম।

#চলবে…

[আসসালামু আলাইকুম।
আসলে আমি একজন এডমিশন সিকার।ব্যস্ততার কারনে তাই পার্টগুলো ছোট হয়ে যাচ্ছে আগের চেয়ে।আমি নিজেও সেটা অনুধাবন করেছি।তবুও রেগুলার দেওয়ার চেষ্টা করছি।আশা করি বিষয়টা বুঝবেন।?

অনেকেই কমেন্টে ফ্লাশব্যাক জানানোর জন্য বলেছেন।আর কিছু পর্ব পর ইনশাল্লাহ ক্লিয়ার করবো সবটা।এখন লিখলে সেটা খাপছাড়া হয়ে যাবে গল্পের জন্য।তদোবদি অনুরোধ রইলো পাশে থাকার।ভুলত্রুটি মাফ করবেন।
হ্যাপি রিডিং?]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here