তোর নামের রোদ্দুর২ পর্ব 6

0
1707

#তোর_নামের_রোদ্দুর-২
#লেখনিতে:মিথিলা মাশরেকা
পর্বঃ৬

পানির ফিল্টারের কাছে বোতল হাতে দাড়িয়ে তীক্ষ্মচোখে শুদ্ধ ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে আছি।সেও বোতল হাতে দাড়িয়ে।বিরক্তি নিয়ে।ব্রেকফাস্ট শেষে আমার রুমে গিয়েই সবাই বসে কথা বলছে।বড়রা ড্রয়িংয়ে।ডাইনিংয়ের কোনে রাখা ওয়াটার পিউরিফায়ারের কাছে মোটামুটি ফায়ার হয়েই দাড়িয়ে আছি আমি।রাগ মিটছে না কিছুতেই কেনো যেনো।শক্ত করে শুধু বোতলটা ধরে আছি।শুদ্ধ ভাইয়া বিরক্তি নিয়ে বললেন,

-হোয়াট?

….

-এভাবে মুর্তির কেনো দাড়িয়ে আছিস?আবার ওভাবে তাকিয়ে কি দেখছিস?

-আমার ইচ্ছা।যেভাবে খুশি দাড়িয়ে থাকবো,যেদিক খুশি তাকিয়ে থাকবো!

উনি বিস্ময়ে খানিকটা বড়বড় করে তাকালেন আমার দিকে।তারপর নিজেকে সামলে আবারো বললেন,

-সর!পানি নিতে দে!

-আমি আগে এসেছি!আমি আগে নেবো!

-তো নিয়ে বিদেয় হ!দাড়িয়ে আছিস কেনো?

-আমার যখন খুশি তখন নেবো!ইচ্ছে হলে দাড়িয়ে থাকবো,নইলে বসে থাকবো,নইলে শুয়েও থাকবো!আমার বাসা এটা!

-এটা আমারও দাদুবাড়ি!

-হু।তবে এখানে তো থাকেন না।আপনার বাসা তো আজাদ ম্যানশন।এই শেহনাজ মন্জিল তো….

-এতো কথা বলতে শিখলি কবে থেকে তুই?

-তো কি ভেবেছেন?আপনার ভয়ে আজীবন চুপসে থাকবো?

-আজীবন?

থেমে গেলাম।কথা বলাটা বেশিই হয়ে গেলো বোধহয়।ইমরোজ ডাইনিং টেবিলটায় রাখা একটা আপেল নিয়ে কামড় বসিয়ে বললো,

-কিরে?টম এন্ড জেরি লাইট!শুদ্ধ?তুই এখানে দাড়িয়ে?ওদিকে তাহমিনার আম্মু….

এই মেয়েটা!ওকে তো….এতো নির্লজ্জ কেউ কিভাবে হয়?নির্ঘাত দরজা খোলা না পেয়ে মাকে নিয়ে আবার এসেছে।বিরবির করে বললাম,

-আপনি পানি নিতে এসেছিলেন না?নিয়ে যান!আপনাকে আপনার পরমাত্মীয় ডাকছে।

ইমরোজ ভাইয়া মুচকি হেসে চলে গেলো।শুদ্ধ ভাইয়ার দিকে তাকালাম,সে ঠোট টিপে হেসে চোখ ঘুরিয়ে আমাকেই পানি নিতে বললো।কথা‌ না বারিয়ে করছিলামও তাই।হঠাৎই কানে স্পর্শ!ঝুকে বোতল ভরতে যাওয়ার সময় কানে গোজা চুলগুলো সামনে চলে এসেছিলো।সেগুলো আবারো কানে গুজে দিলো কেউ।টের পেলাম পাশে শুদ্ধ ভাইয়াও ওভাবেই ঝুকে,তবে আমার দিকেই তাকিয়ে।ঘাড় ঘুরিয়ে দেখার সাহস হলো না।শ্বাস থামিয়ে নজরটা বোতলেই আটকে রাখলাম।উনি আমার কানে ফিসফিসিয়ে বললেন,

-সে কি জানে না?ভালোবাসার বর্ষন না থাকলেও,শুদ্ধ শুধুই তার নামের রোদ্দুরে পুড়তে ভালোবাসে।তার জন্য অপেক্ষার প্রহরের প্রতিটা প্রস্তরাঘাতও সয়ে যাবে আমার।অন্যকোথাও ভালোবাসার সমুদ্র থাকলেও তার শীতলতায় ডোবার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা নেই।নিশ্চিন্ত থাকুক সে,আমি তারই।সে না হয় নাইবা পুড়লো,আমার নামের রোদ্দুরে!

অবাক চোখে তাকালাম।উনি ততক্ষনে সোজা হয়ে দাড়িয়ে গেছেন।বোতলটা হাতে ঘুরিয়ে চলেও গেলেন মুচকি হেসে।কিন্তু এসব কি বলে গেলেন?কেনো বলে গেলেন?পানি নিতে এসেছিলো না সে?চলে গেলো কেনো তবে?আর এই চুলগুলো তাকে কে বলেছে কানে গুজে দিতে?আমি নিজেই পারতাম!বুঝিই না ওনার কোনো কাজের কারন আর ধরন।হতভম্ব হয়ে তাকে ভাবলেশহীনভাবে চলে যেতে দেখলাম শুধু।

-সকালে বারান্দা ভাসিয়েছো!এখন পুরো ডাইনিংটা ডুবাও!পরে গেলো সব পানি!

ইরামের চিৎকারে নিচে তাকিয়ে দেখি বোতল ভরে পানি উপচে পরছে।আম্মু দৌড়ে এসে বললো,

-এই মেয়েটাকে নিয়ে আর পারি না।বিয়েবাড়িতে এমনিতেও কাজের অভাব নেই,ও ঝামেলা করেই‌ যাচ্ছে।করেই যাচ্ছে।

-আমি কি করলাম?

-কি করলি মানে?পানিটা কি ভুতে এসে ফেললো?

-তো এই একটা ভুল…

-একটা?সকালে বারান্দাতেও পানি ফেলেছিস।আর তাহমিনাকে বাসায় ঢুকতে দিস নি কেনো?

-ত্ তোমাকে কে বললো?ওহ্!তারমানে আন্টি বাড়ি বয়ে বলতে এসেছে?

-না।সে আসবে কেনো?মাত্র গিয়েছিলাম ওদের বৌভাতের দাওয়াত করতে,তখন বললো।এসব কি ইনসু?তোকে নিয়ে আর কতো ঝামেলায় পরবো আমি?

বকা হজম করতে করতে দুরেই দেখলাম শুদ্ধ ভাইয়া রুমের দরজার সামনে দাড়িয়ে।বুকে হাত গুজে দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাড়িয়ে হাসছেন উনি।ইচ্ছা করে এসব উল্টাপাল্টা বলে গেলেন তবে?যাতে ওসবের মানে ভাবতে ভাবতে পানি পরে যায় আর আমাকে কথা শুনতে হয়?উনি তো বেশ মজাই নিচ্ছেন মনে হচ্ছে।গাল ফুলিয়ে আবারো রুমে আসলাম।এসে একগাদা মানুষ দেখে একটা বড় শ্বাস ফেলে তাদের মধ্যেই বসে পরলাম।শান্তি নেই কোথাও!

___________

বিকেলে সীমা ভাবিকে মাঝে বসিয়ে সব কাজিনরা ড্রয়িংরুমে সোফায় বসে আড্ডা দিচ্ছিলাম।আম্মু,সেজোমা,ফুপিরা সবাই আম্মুর রুমে চা খেতে কথা বলছে নিজেদের মতো।দীদুন আমাদের সাথেই।আপু ভাইয়ারা সবাই আছে,শুদ্ধ ভাইয়া ব্যাতিত।তাপসী আপু জিজ্ঞাসা করতেই ইরাম বললো সে নাকি ল্যাপটপে ব্যস্ত।আমিও ভেবে নিয়েছি,ভয় পাবো না আর তাকে।তাই যতোদুর সম্ভব স্বাভাবিক আছি সবার সাথে।অবশ্য ওনার উপস্থিতিতে এভাবে থাকতে পারতাম কি না তা নিয়ে এখনো যথেষ্ট সন্দেহ আছে আমার।মেজোমা এসে খেকিয়ে বললো,

-এই রিফাত?বাজারে যা তো!এটাওটা কয়েকটা জিনিস কেনা বাকি আছে।সময়ও নেই।কালই রিসেপশন।তো তাই…

-পারবো না।তোমার এটা ওটা মানে মিনিমাম দু ব্যাগ কাচাবাজার তা আমি জানি।আব্বু তো বাজারেই মেবি।বলে দাওনা তাকে।

-তার আসতে‌ দেরি হবে।

-রান্না তো এখনই বসাচ্ছো না।

-আরে পারবে না সে অতোকিছু!

-দেখেছো?জানতাম!হাজারটা জিনিস কেনাবে।

-আমাকে‌ দাও মেজোমা।আমি চলে‌‌‌ যাচ্ছি।

সবাই বিস্ফোরিত চোখে পাশে তাকালো।তামিম ভাইয়া আর ইরাম দাড়িয়েও গেছে।শুদ্ধ ভাইয়া নীল শার্টটার হাতা গুটাতে গুটাতে কথাটা বললেন।সিফাত ভাইয়া চেচিয়ে বললো,

-কি‌ বললি তুই শুদ্ধ?

-বাজারে যাবো।

ইমরোজ ভাইয়া বললো,

-হু।তা যাও।তবে এটা জানো তো?বাজারটা কাচাবাজার।তোমার বসুন্ধরা সিটি কমপ্লেক্স না!

-সো হোয়াট?সেখানে কেউ যায় না?আমিও যাবো।

ওনার স্পষ্ট উত্তরে সবাই একজন আরেকজনের দিকে তাকাতে লাগলো।ইমরোজ ভাইয়া নিজের হাতে চিমটি কেটে বললো,

-এই শুদ্ধ?আবার বল তো!আমি কোন দুনিয়ায়?কি শুনলাম এটা?

-ঢং কম কর।যাচ্ছি আমি।মেজোমা,দাও ব্যাগ দাও।

যীনাত আপু বললো,

-আজ এই দিনটাও দেখতে পেলাম।আমার তো জন্মই সার্থক।ইরহাম আজাদ শুদ্ধ ব্যাগ হাতে বাজারে যাচ্ছে!

দীদুন এতোক্ষনে মুখ খুললো।বললো,

-তো কি হয়েছে?শুদ্ধ?যা দাদুভাই।ঘুরে আয় তুই।ওদের কথায় কান দিস না।

মেজোমা ব্যাগ ধরিয়ে দিলেন ওনার হাতে।আমি বড়বড় চোখে শুধু দেখছি।ওনার এসব ব্যবহার মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে আমার।উনি একপলক আমার দিকে তাকিয়ে দীদুনকে বললেন,

-কি বলোতো দীদুন?তোমার লেটেস্ট ভার্সন বড্ড চুপচাপ হয়ে গেছে।বাইরে যাই।তাতে ওটা যদি একটু স্বাভাবিক হয়!

উনি বেরিয়ে গেলেন।পুরো রুমটা ছোটখাট শকে চুপ ছিলো কিছুক্ষন।স্বাভাবিক ভাবটা ফিরিয়ে আনতে তামিম ভাইয়া হাতে তালি দিয়ে বলে উঠলো,

-গাইস!লেটস্ প্লে আ গেইম।সীমা ভাবি বোর হচ্ছে হয়তো।কি বলো সবাই?

একটু স্বাভাবিক হয়ে সম্মতি দিয়ে নড়েচড়ে বসলো সবাই।আমিও মাথা থেকে‌ ঝেড়ে ফেললাম কিছুক্ষন আগের ঘটনাটা।উনি নেই।ভালো হয়েছে।এবার ঠিকমতো আড্ডা দিতে পারবো ওদের সাথে।তামিম আবারো ভাইয়া বললো,

-নিয়মটা হলো,একটা নির্দিষ্ট দুরুত্ব থেকে ফু দিয়ে টেবিলের উপর রাখা মোম নেভাতে হবে।সিরিয়ালি যাবো আমরা।যে মোম নেভাতে পারবে না,তাকে এক্টিভিটি দেওয়া হবে।সিম্পল!তবে একটা একটা এক্টিভিটির পর একটু একটু করে দুরুত্ব বাড়ানো হবে।

আইডিয়াটা ভালো।রাজি হয়ে গেলো সবাই।লটারি করে সিরিয়াল করা হলো।প্রথম স্টেজে তামিম ভাইয়াই নিভিয়ে দিলো।পরেরবার ইরাম।আটকে গেলো তাপসী আপু।ওকে তখন এক্টিভিটি দেওয়া হলো ম্যাডাম ফুলি এর অভিনয়।আপু ঝাড়ু কাধে বাঝিয়ে যা একটিং করেছে।পুরো ড্রয়িংরুমে হাসির রোল পরে গেলো।আমার প্রথমবার নিভিয়ে দিয়েছিলাম।কিন্তু সে বার ব্যর্থ হয় সিফাত ভাইয়া।নতুন বরের এক্টিভিটি ছিলো বউকে নিয়ে গান বলা।ভাইয়া খালি গলাতেই,তবে সীমা ভাবির দিকে তাকিয়ে তাহসানের প্রেমাতাল গানটা গাইলো।পরেরবার ইমরোজ ভাইয়া মোম নিভাতে না পেরে কয়েকটা জোকস্ বললো।

চতুর্থবারে আমিই ফেসে গেলাম।পারি নি মোম নেভাতে।দুরুত্বটা ততক্ষনে অনেকটাই বেশি হয়ে গিয়েছিলো তাই।এক্টিভিটি দিলো সীমা ভাবি নিজে।নাচতে হবে আমাকে।অন্য কেউ হলে ম্যানেজ করেই নিতাম।তাইতো খেলায় ছিলাম।নইলে যেচে এদের ফাদে পা দেওয়ার কাজ ইনসিয়া করতো না।কিন্তু সীমা ভাবিমে আর মানা করতে পারি নি।কোমড়ে ওড়না বেধে দাড়ালাম নাচার জন্য।তাপসী আপু “যাও পাখি বলো” গান বাজালে নাচলাম!নিজের মতো করে!ওরা সবাই বাহবা দিচ্ছে।আশ্চর্যের বিষয় হলো,আমি নাচতে গেলে চিরশত্রু ইরামটাও হাতে তালি দিয়ে দিয়ে উৎসাহই দেয় বরাবর।সীমা ভাবিও বেশ খুশি দেখলাম।তাই নিজেও খুশি ছিলাম।কিন্তু কে জানতো?সে খুশি বেশিক্ষন সইবে না আমার।

গানের শেষে ঘুরে উঠতে গিয়ে হাত জরিয়ে গেলো কারো গলায়।চমকে উঠে সে মানুষটার দিকে তাকাতেই চোখ আটকে গেলো আমার।ঘামে ভিজে ওঠা চুলগুলো,কপালেও বিন্দুবিন্দু মুক্তোদানার মতো ঘর্মকনা,কানের পাশ দিয়ে গরিয়ে পরছে কিছুটা,অপ্রত্যাশিত কিছুতে থমকে যাওয়া চাওনি নিয়ে নিস্পলক তাকিয়ে শুদ্ধ ভাইয়া।তার হাতে থাকা ব্যাগদুটো ধুপ পরে গেলো টের পেলাম।তাপসী আপু বলে উঠলো,

-ওয়াহ্….শাহরুখ্ দিপিকার মানওয়া লাগে লাইভ!

হুরমুড়িয়ে সরে দাড়ালাম আমি।পাশেই মোম পড়ে গিয়ে আগুন লেগে গেছে টি টেবিলের উপরে রাখা কারো এক রুমালে।ইরাম গ্লাসে থাকা সবটুকো পানি ওতে ঢেলে দিলো।সেদিক থেকে চোখ সরিয়ে একটা শুকনো ঢোক গিলে শুদ্ধ ভাইয়ার দিকে তাকালাম।সে ওভাবেই ঠায় মেরে দাড়িয়ে।হলোটা কি এর?এভাবে চুপচাপ আছেন মানে বড়সরভাবে ধমক দেবেন আমাকে।শুধুই ধমক?এই কাজের জন্য আমার শাস্তি কি?কি হতে চলেছে আবার?

#চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here