তোমার_তুমিতেই_আমার_প্রাপ্তি লেখক-এ রহমান পর্ব ১৫

0
1017

তোমার_তুমিতেই_আমার_প্রাপ্তি
লেখক-এ রহমান
পর্ব ১৫

নির্জন রজনীতে চারিদকে নিস্তব্ধ। নিয়ন আলোয় রাস্তাটা দেখতে বেশ লাগছে। গাড়ি ঘোড়াও তেমন চলছে না এখন। হাতে ঘড়ি বা মোবাইল কিছুই না থাকায় ইভান ঠিক বুঝতে পারছে না কটা বাজে। চায়ের কাপে শেষ চুমুকটা দিতে দিতেই ঈশার বারান্দায় আরও একবার ভালো করে তাকাল। দরজা টা বন্ধ। ঘরেও কোন আলো নেই। ঘুমিয়ে পড়েছে মনে হয়। তাই আর সেখানে না দাড়িয়ে ঘরে চলে এলো। বারান্দার দরজাটা বন্ধ করতে যাবে ঠিক তখনই ফোনের ভাইব্রেশনের আওয়াজ কানে এলো। দ্রুত পায়ে গিয়ে ফোনটা হাতে নিতেই ঈশার নামটা দেখে ভ্রু কুচকে এলো। ফোন হাতে নিয়েই জানালার সামনে দাঁড়ালো। সাদা পর্দাটা টেনে দিয়ে উকি ঝুকি মেরে ঈশার বারান্দায় দেখল। সেখানে কেউ নেই। সব কিছুই অন্ধকার। এতো রাতে এভাবে ফোন করার কারণটা বুঝতে না পেরে তড়িঘড়ি করে ফোনটা ধরে বিচলিত কণ্ঠে বলল
–কি হয়েছে জান? তুই ঠিক আছিস তো?

–আরে বাবা! ঠিক না থাকলে কি তোমাকে ফোন করা যায়না?

ঈশা বিরক্তিকর কণ্ঠে বলল। ইভান একটু হেসে বলল
–তা বলিনি। এতো রাতে এভাবে ফোন করেছিস তাই জিজ্ঞেস করলাম। টেনশন হচ্ছিল। আচ্ছা তুই কোথায়? ঘরে আছসি তো? দেখলাম না যে?

–ওহো। একবারে এতো প্রশ্ন করলে কিভাবে উত্তর দিবো?

ঈশার আবার এমন কথায় এবার ইভান বিরক্ত হয়ে গেলো। একটু ধমক দিয়ে বলল
–তখন থেকে প্রশ্নের পরিবর্তে প্রশ্নই করে জাচ্ছিস। উত্তর তো দিচ্ছিস না।

ঈশা শব্দ করে হাসল। সেই হাসির শব্দ ইভানের মন ছুয়ে গেলো। সেও নিশব্দে হাসল। ঈশা শান্ত কণ্ঠে বলল
–ছাদে আসবে?

ইভান অবাক হল। একটু চেচিয়ে বলল
–ছাদে মানে?

–ছাদে মানে ছাদে। তোমার বাড়ির ছাদে।

ঈশার কথা বুঝতে পারলো না ইভান। একটু রাগ করে বলল
–আমার বাড়ির ছাদে এতো রাতে তুই কি করছিস?

ঈশা বিরক্ত হয়ে বলল
–সেটা তো আসলেই দেখতে পাবে। না আসলে কিভাবে জানতে পারবে বল?

ইভান আর কোন কথা বলল না। ফোনটা কেটে দিলো। দ্রুত পায়ে বের হয়ে গেলো ঘর থেকে। সিঁড়ি বেয়ে উঠছে ছাদে। শেষ সিঁড়িটা পেরিয়ে চোখ দিয়ে চারিদিকে দেখল। কোথাও কাউকে দেখতে পেলো না। একটু সামনে এগিয়ে গিয়ে দাঁড়ালো। তবুও কেউ নেই। কিন্তু তখনই কেউ পিছন থেকে চোখ বেধে দিলো। ইভান বেশ অবাক হল। কিন্তু কিছু বলল না। ঈশা চোখ বেধে দিয়ে বলল
–জাস্ট দুই মিনিট অপেক্ষা করো।

ইভান হাসল। সে আজ কোন কথাই বলবে না। দেখতে চায় ঈশা কি করতে চাচ্ছে। মনে হচ্ছে তার জন্য কোন সারপ্রাইজ প্ল্যান করেছে। প্রেয়সীর এই সারপ্রাইজটাই সে দেখতে চায়। উপভোগ করতে চায়। ঈশা ইভানের হাত ধরে একটু সামনে টেনে আনল। তারপর ঈশা তার কাছ থেকে সরে দাঁড়ালো। সে নিশ্চুপ এক পাশে দাড়িয়ে ইভান কে দেখছে। ইভান একটু আন্দাজ করেই হাত বাড়িয়ে ঈশাকে নিজের দিকে টেনে নিলো। সে অবাক হয়ে তাকাল। চোখ বাধা অবস্থায় একটু হেসে বলল
–অবাক হচ্ছিস তো। অবাক হওয়ার কিছু নেই। তোর শরীরের এই মিষ্টি ঘ্রাণটা আমার খুব চেনা। আমি না দেখেও বলে দিতে পারি তুই ঠিক কোথায়। তুই আমার অস্তিত্ব। আর নিজের অস্তিত্বকে চিনতে আমার কখনও ভুল হতে পারেনা।

ঈশা নিশব্দে হাসল। ইভান হেসে বলল
–তোর এই হাসিটাই আমি সারাজীবন দেখতে চাই। তোর এই হাসিটা দেখতে আমি হাজারবার মরতে রাজি আছি।

ঈশা অবাক চোখে তাকিয়ে আছে। ইভান কে সারপ্রাইজ দিতে গিয়ে নিজে সারপ্রাইজড হয়ে যাবে সেটা সে কখনও ভাবেনি। একটা মানুষ কিভাবে এতো ভালবাসতে পারে। তার ভালবাসা পরিমাপ করার ক্ষমতা ঈশার নেই। ঈশা একটু হেসে ইভানের চোখ খুলে দিলো। নিজের দৃষ্টি স্থির করে নিয়ে সামনে তাকাল। চারিদিকে অসংখ্য মোমবাতি জালানো। অবাক চোখে তাকিয়ে আছে ইভান। কি হচ্ছে কেন হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছে না। ঈশা তার ঠিক পিছনে দাড়িয়ে আছে। ঘাড় বেকিয়ে তাকে দেখার চেষ্টা করেও পারলো না। সে পিছনে ঘুরতে গেলেই ঈশা তাকে আটকে দিয়ে বলল
–আমাকে দেখার অনেক সময় পাবে আগে সামনে দেখ।

ইভান ভ্রু কুচকে সামনে তাকাল। এক কোনায় আলো জলে উঠলো। একটা ছোট টেবিলে কি যেন রাখা আছে। ঈশা রীতিমতো পিছন থেকে ঠেলে নিয়ে গেলো ইভান কে। ইভান সেদিকে গিয়ে টেবিল থেকে কাপড় টা সরাতেই দেখল একটা কেক। তাতে লেখা ‘Happy BirthDay Ivan’। ইভান যেন আকাশ থেকে পড়লো। এতো চাপের মধ্যে জন্মদিনের কথা ভুলেই গিয়েছিলো সে। ঈশা যে মনে রাখবে সেটাই সে আশা করেনি আর এভাবে সারপ্রাইজ তো প্রশ্নই আসেনা। তার ভাবনার মাঝেই ঈশা মাথা পিছন থেকেই উঁচু করে দিলো। ইভান আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখে অনেক গুলো ফানুশ। বড় চাঁদ তার সাথে মিটিমিটি তারা জলছে। তার খানিক নিচে এক গুচ্ছ ফানুশ। অবাক চোখে তাকিয়ে আছে। মুহূর্তেই এক ঘোরের মধ্যে চলে গেলো ইভান। দেখা শেষ করে চোখ নামাতেই এবার আরেক ধাক্কা খেলো। সাক্ষাত নীল পরির দর্শন। নীল শাড়ি নীল টিপ চোখে কাজল। ঠোঁটে হালকা গোলাপি লিপস্টিক। অদ্ভুত এক দৃশ্য। ঘোর লাগা চোখে তাকিয়ে আছে ইভান। ঈশা একটু হেসে বলল
–কি দেখছ?

ইভান ভাষা হারিয়ে ফেলেছে। একটা বড় শ্বাস টেনে বলল
–তোকে একবার জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছা করছে খুব করে।

ইচ্ছা থাকলেও ইভানের মাঝে সংকোচ কাজ করছে। ঈশা কি ভাববে সেটা নিয়েই সে বড় সংকোচের মধ্যে পড়ে গেছে। ঈশা হেসে ইভান কে জড়িয়ে ধরল। ইভান মুহূর্তেই যেন কোথায় হারিয়ে গেলো। দুই হাতে শক্ত করে ঈশাকে জড়িয়ে ধরে চোখ বন্ধ করে ফেলল। সে আজ নতুন ভাবে ঈশাকে অনুভব করছে। ঈশা হেসে বলল
–এভাবেই রাতটা পার করে দিবে?

ইভান চোখ খুলে ফেলল। ঈশাকে ছেড়ে দিলো। ভীষণ রকমের অপ্রস্তুত হয়ে পড়েছে সে। এই আবদারটা হয়তো এই মুহূর্তে করা ঠিক হয়নি। এখনো তাদের মধ্যে সেরকম কোন সম্পর্ক হয়ে উঠেনি তাই ইভানের এসব আবদার নিতান্তই অন্যায়। ঈশা একটু হেসে বলল
–এবার কেক কাটো।

ইভান কেক কাটার জন্য ছুরি হাতে নিতেই ইফতি হন্তদন্ত করে ছাদে উঠে গেলো। ইভান ভ্রু কুচকে তাকাল। ইফতি সরু চোখে ঈশার দিকে তাকিয়ে বলল
–কোনভাবে সব ক্রেডিট কি তুই নিতে চাইছিস?

ঈশা ইভান দুজনি শব্দ করে হাসল। ইফতি কেকের সামনে দাড়িয়ে বলল
–তাড়াতাড়ি কাটো ভাইয়া আমার আর ত্বর সইছে না।

ইভান আর ঈশা সেদিকে এগিয়ে গেলো। ইভান কেক কাটল। প্রথম বাইট ঈশার জন্য। ঈশা সেখান থেকেই ইভান কে খাইয়ে দিলো। বাকি পুরোটা নিয়ে ইফতি পাশে রাখা চেয়ারে বসে পড়লো। ইভান ভ্রু কুচকে তার দিকে তাকাল। ইভান তার মাথায় মেরে বলল
–জন্মদিন আমার আর কেক পুরোটাই তোর?

ইফতি তার দিকে না তাকিয়েই বলল
–তুমি তো এটা খাবে না। এখন তো প্রেমে ব্যস্ত হয়ে পড়বে। আমি ততক্ষন খেতে থাকি। প্রেম করা শেষ হলে যদি ততক্ষনে বাকি থাকে তাহলে খেয়ো।

ইভান আবারো ইফতির মাথায় মারল। ঈশা সেখান থেকে সরে গিয়ে রেলিঙ্গে হাত দিয়ে দাড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। ইভান পাশ ফিরে ঈশাকে না দেখতে পেয়ে সামনে তাকাল। তার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। সামনে তাকিয়েই বলল
–আর কিছু বলতে চাস না আমাকে?

ঈশা ইভানের দিকে তাকাল। ইভান সামনেই তাকিয়ে আছে। ঈশা হঠাৎই সুপ্ত আবদার করে বসলো।
–আজ সারা রাত ধরে চন্দ্র বিলাস করবে এখানে?

ইভান ঘুরে তাকাল তার দিকে। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল
–তোর মনের আবদার রাখতে গিয়ে কোন অঘটন ঘটিয়ে ফেললে সেটার দায়ভার যে আমি বইতে পারব না। এই আবদার টা নাহয় তোলা থাক কোন এক বিশেষ মুহূর্তের জন্য। যেই মুহূর্তে কোন কিছুর জন্য থাকবে না কোন বাধা। কোন কিছুকেই অঘটন মনে হবে না।

ঈশা ইভানের কথার মানে বুঝতে পেরে লাজুক ভঙ্গিতে হাসল। ইফতির দিকে তাকিয়ে জোরে বলল
–ওই ইফতি অনেক রাত হয়েছে। কাল সকালে ক্লাস আছে। তোর খাওয়া শেষ হলে চল।

ইফতি বিরক্ত হল। এখনো তার খাওয়া শেষ হয়নি। ইভান হাসল। সামনে এগিয়ে যেতে যেতে বলল
–চল তোকে বাসায় দিয়ে আসি।

ঈশাও হেসে ইভানের পিছনে চলে গেলো। ইফতি নিজের মতো খেয়েই যাচ্ছে। ঈশা আর ইভান পাশা পাশি হাঁটছে। হঠাৎ জিজ্ঞেস করলো
–আজ শাড়ি পরলি যে?

বাড়ির সামনে এসে গেছে। ঈশা দাড়িয়ে গেলো। স্বাভাবিক ভাবেই বলল
–বিশেষ দিনে শাড়ি পড়লে খারাপ লাগে না তো।

ইভান শেষ বারের মতো তাকে ভালো করে দেখে নিয়ে বলল
–তোকে ভয়ংকর সুন্দর লাগছে। এই অবস্থায় তুই যতক্ষণ সামনে থাকবি নিজেকে সামলানো আমার জন্য কষ্টকর।

ঈশা পিছনে ঘুরে গেলো। একটু অভিমানের সুরে বলল
–কারও কষ্টের কারন হতে চাইনা।

পা বাড়াতেই ইভান তার হাত ধরে ফেলল। ঈশা থেমে গেলো। ইভান ডাকল
–ঈশা।

–হুম?

–ভালবাসিস আমাকে?

ইশা ইভানের চোখে চোখ রাখল। বলল

“তোমাকে ঘিরে থাকা আমার সমস্ত অনুভুতি যদি ভালবাসার বহিঃপ্রকাশ হয় তাহলে আমি তোমাকে ভালবাসি। তোমার স্পর্শে আমার মাঝে বয়ে যাওয়া শীতল অনুভুতি যদি ভালবাসা হয় তাহলে তোমাকে আমি ভালবাসি। তোমার অনুপস্থিতিতে অস্থির হয়ে ওঠা যদি ভালবাসা হয় তাহলে আমি তোমাকে ভালবাসি। ভালবাসার সঙ্গা আমার জানা নেই। কিভাবে ভালবাসতে হয় সেটাও জানিনা। শুধু আছে আমার তোমাকে ঘিরে থাকা এক রাশ অনুভুতি। যেটা অনুভব করার ক্ষমতা আমার ছিলোনা। সেটাও আমি তোমার কাছেই শিখেছি। আমার আশে পাশে সবটাই তোমার তৈরি মায়াজাল। যেটা থেকে বের হওয়া সম্ভব নয়। তোমার কাছে যদি এটাই ভালবাসা হয় তাহলে আমি তোমাকে সত্যিই ভালবাসি। হয়তো তোমার মতো করে ভালবাসতে পারিনি। কিন্তু আমার যা আছে সবটা দিয়েই ভালবাসি তোমাকে।”

চলবে………

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here