তুমি_আছো_হৃদয়ে_তাই পর্ব_৪_৫

0
3032

#তুমি_আছো_হৃদয়ে_তাই
#শোভা_আক্তার(লাভলী)
#পর্ব_৪_৫

আধুনিক্তার চোখদুটোকে মাশরাত ভীষণ ভয় পেলো। কারণ মাশরাত জানে বেশীক্ষণ এই চোখের দিকে তাকিয়ে থাকলে মাশরাত মোহে ডুবে যাবে।

বাসায় এসে আধুনিক্তা গোসল করে নিল৷ বসে থাকতে থাকতে ক্লান্ত হয়ে গিয়েছিলো সে। মাথা মুছতে মুছতে খাটে বসলো। আজ সবার খেলা দেখে তার ভীষণ ইচ্ছে করছিলো খেলতে। কিন্তু সে তো এখন নিরুপায়। প্রাণ বাঁচাতে হলে প্রিয় খেলাটাকে ত্যাগ করতেই হবে। বসে থাকতে থাকতে ডুবে গেলো অতীতে।

অতীতের কিছু অংশ…..
খেলা প্রায় শেষের দিকে। দুই দলের সদস্যরাই ক্লান্ত। সবার শরীর লেপ্টে আছে ঘামে৷ আর মাত্র একটা রাউন্ড। দুই দলই ৬ বার করে বল বাস্কেটে ফেলেছে। এখন এই শেষ রাউন্ডে যে টিম আগে বল বাস্কেটে ফেলবে সে টিম জিতবে। ৭ বারে খেলা শেষ হবে। শেষ সময়টা বেশ রোমাঞ্চকর। কোন টিম হতে পারবে এই বছরের বেস্ট ফিমেল বাস্কেটবল ন্যাশনাল টিম? আর কোন টিমের কে পারবে বলকে বাস্কেটে আগে ফেলতে? Team Rider’s vs Team Tigresses. হুইসেল এর শব্দ শোনা গেলো। শুরু হলো আজকের খেলার শেষ রাউন্ড। দাদাই হাত মুঠো শক্ত করে বসে আছে। কারণ আজ হেরে গেলে উনার মাথা নিচু হয়ে যাবে। এইটা সত্যি লজ্জাজনক বিষয় হবে। সামনেই বরাবর চলছে খেলা। আর তার একমাত্র নাতনি একপাশে দাঁড়িয়ে আছে। মেয়েটা এমনই, শেষ মুহূর্তে হামলা করে গিয়ে৷ সবাই বেশ এক্সাইটেড। বল বিরোধী দলের কাছে গেতেই আধুনিক্তা বাঘিনীর মতো দৌড়ে গেলো। এইভাবে দৌড়াচ্ছে যেনো তার শিকার অন্য কেও ছিনিয়ে নিয়েছে। দাদাই তা দেখে বাঁকা হাসি দিয়ে তার বিরোধী দলের চিফের দিকে তাকালো। বিরোধী দলের চিফ চোখ মুখ শক্ত করে রেখেছে কারণ প্রত্যেক রাউন্ডে এই আধুনিক্তা নামের মেয়েটা খুব ভালো খেলেছে৷ এখন উনার মনে ভয় কাজ করছে। কিছুক্ষণ আগেই তো অহংকারের সাথে বলেছিলো টিম রাইডারস জিতবে। এখন যদি হেরে যায় নাক কাটা যাবে। আধুনিক্তা দৌড়ে গিয়ে সেই মেয়েটার সামনে বাস্কেট পিলারের সামনে দাঁড়ালো। বিরোধী দলের মেয়েটা বল বাউন্স করতে করতে নিয়ে এসে বল ধরে লাফ দিল। আধুনিক্তা সুযোগ বুঝে লাফ দিয়ে বলে সজোরে থাপ্পড় মেরে দিলো। তার দলের একটা মেয়ে বল নিয়ে বাউন্স করতে করতে অন্যদিকে চলে গেল। পয়েন্ট হতে হতেও হলো না। বিরোধী দলের মেয়েটা রাগী দৃষ্টিতে তাকালো আধুনিক্তার দিকে। আধুনিক্তা তার দিকে তাকিয়ে চোখ টিপ দিয়ে দৌড়ে গেলো। তার টিমের একটা মেয়ে আধুনিক্তার সামনে এসে বললো-
“আধুনিক্তা যেভাবেই হোক আমাদের জিততে হবে। বেশী সময় নিলে চলবে না। এখন সব তোমার উপর। প্লিজ ডু সামথিং।”
“জাস্ট চিল বেবী, আত্মবিশ্বাস থাকা উচিত। জিতবো তো আমরাই ইন শাহ আল্লাহ।”
মেয়েটা মুচকি হাসলো আধুনিক্তার কথায়। আধুনিক্তা কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে চারপাশে চোখ বুলিয়ে ভাবলো কী করা যায়। হঠাৎ দাদাইর দিকে চোখ যেতেই দাদাই চোখের ইশারায় আধুনিক্তাকে বললো মাথা ঠান্ডা রেখে ভেবে খেলতে। তারাহুরো করা ভালো নয়। বিরোধী দলের মেয়েরা শুধু ভাবছে বলটাকে বাস্কেটে ফেলতে হবে। কিন্তু আধুনিক্তা ভাবছে তাদের বল কিভাবে আটকানো যায় বাস্কেটে যেতে। নিজের শত্রুকে কখনো হারানোর কথা ভাবা উচিত না। শত্রুকে কিভাবে বিজয়ী হতে আটকানো যায় তা ভাবা উচিত। বল আবারো বিরোধী দলের কাছে চলে গিয়েছে। আধুনিক্তা ভাবতে ভাবতে হঠাৎ মাথায় একটা বুদ্ধি আসলো। দৌড়ে গিয়ে আবার বাস্কেট পিলার থেকে ৪ কদম দূরে গিয়ে দাঁড়ালো। কেন সে শুধু শুধু কষ্ট করবে? বুদ্ধি থাকলে উপায় হয়। মেয়েটা দৌড়ে বল নিয়ে আসতেই আধুনিক্তা তার হাত থেকে বল ছিনিয়ে নিয়ে চার কদম দৌড়ে গিয়ে বল বাস্কেটে ফেলে দিলো। মুহূর্তের মধ্যে কী হয়ে গেলো কেও বুঝতে পারলো না। হঠাৎ সবাই একসাথে তালি বাজিয়ে উঠলো। আধুনিক্তা দাদাই খুশীতে আত্মহারা। উনি দাঁড়িয়ে জোরে জোরে তালি বাজাচ্ছে। বিরোধী দলের চিফ চিৎকার করে করে বলছে চিটিং করেছে আধুনিক্তা কিন্তু সবাই তালি বাজাতে ব্যস্ত। আধুনিক্তার কারণে তাদের টিম হয়েছে এই বছরের বেস্ট ফিমেল বাস্কেটবল ন্যাশনাল টিম। আধুনিক্তার হাতে যখন ন্যাশনাল টিম হওয়ার এওয়ার্ড ছিলো তখন দূর থেকে একটা মেয়ে হুইলচেয়ারে বসে হাসি ভরা মুখে চোখের জল ফেলছিল।

হঠাৎ সেই বিরোধী দলের মেয়েটা রাগে আধুনিক্তার টি-শার্টের কলার ধরে বললো-
“চিটিং করেছো তুমি। বল নিয়ে আমি আসলাম কিন্তু আমার থেকে তুমি ছিনিয়ে নিয়েছো।”
“আমার টি-শার্ট ছাড়ো”
“তোমার মতো চিটার আমি আজ পর্যন্ত দেখি নি।”
“আমি ছাড়তে বলেছি।”
“ছাড়বো না, কী করবে তুমি? তোমার মতো চিটারকে আমি ভয় পাই না।”
আধুনিক্তা এইবার রাগে আগুনের মতো জ্বলে উঠলো। মেয়েটার কাছ থেকে এক ঝটকায় নিজের টি-শার্ট ছাড়িয়ে নিয়ে মেয়েটার হাত ধরে টানতে টানতে নিয়ে গেলো। সবাই থতমত খেয়ে তাকিয়ে আছে। মেয়েটাকে আধুনিক্তা নিয়ে এসে একজনের কাছে এনে ছুঁড়ে মারলো। মেয়েটা পড়ে গেলো মানুষটার পায়ের সামনে। মেয়েটা ধীরে ধীরে মাথা তুলে দেখে একটা মেয়ে হুইলচেয়ারে বসে আছে। আধুনিক্তা তার পাশে হাঁটু ভেঙে বসে বললো-
“কিছু মনে পড়ছে?”
মেয়েটা ঢোক গিললো। এক এক করে সবাই তাদের ঘিরে ধরলো। আধুনিক্তা সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বললো-
“মাসুমা খাতুন, গত বছরের সেমি ফিনালেতে বেস্ট ফিমেল প্লেয়ারের খেতাব পেয়েছিল। কিন্তু ফিনালের দিন তার এক পা পুরোপুরি প্যারালাইজড হয়ে যায়। মনে পড়েছে কেন?”
সবাই রাগী দৃষ্টিতে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে আছে। মেয়েটা চারপাশে চোখ বুলিয়ে ঢোক গিলে বললো-
“আ..আমি মাসুমাকে ইচ্ছে করে ধাক্কা মারি নি। খেলতে খেলতে ভুলে লেগে গিয়েছিল।”
“ওহ প্লিজ এখন ভিক্টিম সাজতে হবে না। সেদিন তুমি আর তোমার টিমের মানুষ ইচ্ছে করে তাকে আঘাত করেছিলে যার কারণে আজ পর্যন্ত তার এক পা প্যারালাইজড। সেদিন চিটিং ছিল না? আজ আমি তোমার হাত থেকে বল নিয়ে নেওয়ায় চিটিং হয়ে গেলো?”
মেয়েটা রাগে মাথা নিচু করে ফেললো। তার কাছে কোনো জবাব নেই এখন। আধুনিক্তা আবার বললো-
“আমি এখন শিখেছি, খেলায় জেতবার জন্য কাওকে আঘাত করতে নেই। এতে একজনের বাস্কেটবল প্লেয়ার হওয়ার স্বপ্ন ভেঙে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। মাসুমা, আমরা অতীত পরিবর্তন করতে পারবো না। কিন্তু মনে আশার বাসা বাঁধতে পারবো। একদিন তুমি সুস্থ হবে আমার মন বলে।”
মাসুমা মুচকি হাসলো আধুনিক্তার কথায়। তখনই সবাই হৈহল্লা করে উঠলো। আধুনিক্তার জন্য তাদের টিম জিতেছে। সবার সামনে হাসি মুখে দাঁড়িয়ে আছে আধুনিক্তা। সবাই তার প্রশংসা করছে। দাদাই আধুনিক্তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো। সেই বিরোধী দলের মেয়েটা দূরে দাঁড়িয়ে রাগে কাঁপছে। তাদের দলের চিফ তার সামনে এসে বললো-
“এখন রাগ করে লাভ নেই যা হওয়ার হয়ে গিয়েছে। হেরে গিয়েছি আমরা এখন চলো।”
“এই মেয়েকে আমি ছাড়বো না।”
“কেন কী করবে তুমি?”
“সামনে চ্যাম্পিয়ন সিলেকশন ম্যাচ বাকি। তখন তাকে বুঝাবো আলিয়ার সাথে পাঙা নেওয়ার শাস্তি কী।”

বর্তমান….
মায়ের ডাকে আধুনিক্তা বর্তমানে ফিরলো। মা হাতে খাবারের প্লেট নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আধুনিক্তা মুচকি হেসে বললো-
“ডেকে নিয়ে আসো তোমার নবাবপুত্রকে।”
মা আরমানকে ডাক দিতেই আরমান দৌড়ে আসলো। দৌড়ে এসেই আধুনিক্তাকে জড়িয়ে ধরলো। আধুনিক্তা আরমানের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললো-
“আজ আমার ছোটু কী কী পড়েছে স্কুলে?”
“অনেক কিছু”
“তাহলে খাওয়া দাওয়া করতে করতে বলবে আমাকে ওকে?”
আরমান মাথা নাড়িয়ে খাটের উপর বসলো। মা আধুনিক্তার হাতে ভাতের প্লেট দিয়ে চলে গেল। আধুনিক্তা পরম যত্নে তার একমাত্র ছোটো ভাইকে খাইয়ে দিতে পারলো। ছেলেটা যে এত কথা কিভাবে বলে আধুনিক্তা বুঝতে পারে না।আধুনিক্তা আরমানের প্রত্যেক কথার জবাবে শুরু হাসি দিচ্ছে।

মাশরাত শাওয়ারের নিচে দাঁড়িয়ে আছে চোখ বন্ধ করে। আজ কাঠফাটা রোদ উঠেছে। সে হেঁটে এসেছে বাসায় তাই মাথা ঘুরছে। লম্বা শাওয়ার নিয়ে কোমড়ে তোয়ালে পেঁচিয়ে বাথরুম থেকে বের হলো। ফ্যান অন করে চেয়ার টেনে ফ্যানের বরাবর নিচে বসলো। এখন ভালো লাগছে। কিছুক্ষণ বসে উঠে ড্রয়ার থেকে জামা বের করে পড়ে নিল। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মাথা মুছছিল তখনই মা আসলো ঘরে। মাশরাত মা কে দেখে মুচকি হাসি দিয়ে বললো-
“কী খবর বিউটিফুল কেমন আছো?”
“দুষ্টুমি না করলে ভালো লাগে না তাই না? আমি কেমন আছি তুই জানিস না?”
মাশরাত চিরুনি ওয়ার্ডরোবের উপর রেখে খাটে বসে বললো-
“কী হয়েছে বলো এখন।”
“পাড়াপ্রতিবেশিরা আমাকে খোঁচা মেরে কথা বলে তুই কী বুঝতে পারিস না?”
“আহা আম্মু কী হয়েছে সেটা তো বলো।”
“তোর বিয়ে, তোর বিয়ে নিয়ে আমাকে কথা শুনাচ্ছে। আর তারা ঠিক বলছে তোর বয়স হচ্ছে কিন্তু তোকে এখনো বিয়ে দিতে পারছি না।”
“আরো এক বছর অপেক্ষা করা যায় না?”
“তুই কি তাবাসসুমের অপেক্ষায় আছিস?”
মাশরাত জবাব দিলো না। শান্ত দৃষ্টিতে মায়ের দিকে তাকিয়ে রইলো। মা মাশরাতের পাশে এসে বসে বললো-
“হয় তো এতদিনে ওর বিয়ে হয়ে গিয়েছে। এমনো তো হতে পারে ও এখন সন্তানের মা।”
মাশরাত এখনো চুপ করে বসে আছে। মা মাশরাতের মাথায় হাত বুলিয়ে বললো-
“আমার জীবনের এখন গ্যারান্টি নেই বাবা। আমার জন্য হলেও রাজি হয়ে যা।”
“আমার বোনের বিয়ে না হওয়ার পর্যন্ত আমি বিয়ে করবো না।”
মা কিছু বলতে যাবে তার আগেই দরজার সামনে থেকে মালিহা বলে উঠলো-
“ঠিক আছে পাত্র খুঁজো।”
মাশরাত আর মা দরজার দিকে তাকালো। মালিহার চোখে মুখে রাগ স্পষ্ট ফুটে রয়েছে। মাশরাত বললো-
“তা তো খুঁজবোই। শুধু তোর পারমিশনের প্রয়োজন ছিলো। যেহেতু নিজ থেকে বলেছিস তাই খুব শিগগিরই খুঁজবো।”
“আমার বিয়ে দিয়ে তোর এত টেনশন কেন? আমি বলেছিলাম না এখন বিয়ে করবো না।”
“এটা বলে লাভ নেই বিয়ে তো করতেই হবে।”
“সত্যি করে বল তো ভাই আমি কী বঝা ভাবিস?”
“একটা চড় মেরে সব দাঁত ফেলে দিবো। এমন উল্টা পাল্টা কথা তোর মাথায় কেন আসে?”
মালিহা কিছু না বলে হনহন করে চলে গেল। মাশরাত দাঁড়িয়ে রাগান্বিত কন্ঠে বললো-
“দেখলে আম্মু তোমার মেয়ে কত বেয়াদব হয়েছে? ও ভাবলো কী করে আমরা ওকে বঝা ভাবি?”
“রাগের মাথায় বলেছে মন খারাপ করিস না।”
মাশরাত রাগে ফুসতে লাগলো। কিছু না বলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল। মা চুপচাপ বসে আছে। ভাই-বোন কেও কারো থেকে কম না। ঝগড়া করবে তারা মাঝখান দিয়ে ফাসবেন উনি।

আধুনিক্তা দাদাইর সামনে মুখ লটকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। দাদাই খবরের কাগজ থেকে চোখ সরিয়ে নাতনির দিকে তাকিয়ে বললো-
“দাঁড়িয়ে না থেকে বলো কী চাই?”
“দাদাই..দাদাই আসলে..”
“বলো, ভয় পেতে হবে না।”
“আমার নতুন বেস্টফ্রেন্ডদের সাথে ঘুরতে যাই?”
“আমার থেকে পারমিশন নিচ্ছো কেন? তোমার মা বাবাকে গিয়ে বলো।”
“বাবা তো দিবেই না তাই তোমাকে বলছি। তুমি আব্বুকে হ্যান্ডেল করো প্লিজ।”
“আমি পারবো না।”
“প্লিজ দাদাই প্লিজ আই বেগ ইউ।”
দাদাই বিরক্ত চেহারা বানিয়ে আধুনিক্তার দিকে তাকালো। কিন্তু নাতনির চেহারা দেখে উনার বেশ মায়া হচ্ছে। তখনই বাবা আসলো এক হাতে কফি আর এক হাতে ল্যাপটপ নিয়ে। আধুনিক্তা দাদাইকে চোখ দিয়ে ইশারা করে বললো বাবাকে মানাতে। দাদাই একটা লম্বা নিশ্বাস ফেললো। নাতনির সুখ উনার জন্য সব।
“সারাদিন কাজ করতে তোর ভালো লাগে?”
“কী করবো? কাজ জরুরি আব্বু।”
“হুম তা ঠিক, আচ্ছা শুন আধুনিক্তাকে কিছু টাকা দে ও বাহিরে গিয়ে ঘুরে আসুক ওর বান্ধবীদের সাথে।”
“বাহিরে যাওয়ার কী প্রয়োজন। ওর বান্ধবীদের বাসায় ডেকে নিক।”
“তুই কী তোর মেয়ের মন খারাপের কারণ হতে চাস? গত তিন বছর ধরে মেয়েটা কোথাও ঘুরতে যায় নি।”
বাবা আধুনিক্তার দিকে তাকালো। আধুনিক্তা বাচ্চাদের মতো চেহারা বানালো। বাবা দাদাইর দিকে তাকিয়ে বললো-
“আমার কাছে ক্যাশ নেই আপনি দিন ওকে টাকা।”
“আমার কাছে টাকা নেই।”
বাবা ভ্রু কুঁচকালো। দাঁড়িয়ে বললো-
“এলাকার চেয়ারম্যান তবুও কিপ্টামি রগে রগে ঘুরে।”
বাবা বকবক করতে করতে চলে গেল। আধুনিক্তা হাসতে হাসতে বললো-
“দেখলে দাদাই বাবা তোমাকে কিপ্টা বললো।”
“তোর বাবা তো এমনই।”
তখনই বাবা আসলো। আধুনিক্তার দিকে টাকা এগিয়ে দিয়ে বললো-
“আমার কাছে ৬ হাজার টাকাই আছে। আরো লাগবে?”
“না, চলবে।”
“যা খরচ করার করো। বেচে গেলে ফিরিয়ে দিও আমাকে।”
“ফিরিয়ে দেওয়া জরুরি?”
“হ্যাঁ, কারণ তুমি টাকা এদিক সেদিক রেখে ভুলে যাও। গতকাল তোমার আম্মু তোমার ব্যাগ থেকে দু হাজার টাকা পেয়েছে। কবে রেখেছিলে মনে আছে?”
“উমমম দু মাস যখন মোবাইল কিনেছিলাম তখন রেখেছিলাম।”
বলেই আধুনিক্তা জিহ্বায় কামড় দিলো। বাবা সোফায় বসে বললো-
“টাকা বাচলে আমাকে দিয়ে দিবে।”
আধুনিক্তা ভেংচি কেটে বললো-
“এত বড়ো বিজনেসম্যান কিন্তু কিপ্টামি রগে রগে ঘুরে।”
আধুনিক্তা বকবক করতে করতে চলে গেলো। দাদাই হঠাৎ হো হো করে হেসে উঠলো। বাবা বললো-
“এতে হাসার কী আছে?”
“তোমার মেয়ে তোর ডায়ালগ তোকেই চিপকিয়ে গেলো।”
বলেই দাদাই আবার হেসে উঠলো। বাবাও হাসলো সাথে।

মাশরাত ভ্রু কুঁচকে বসে আছে। অকারণে বিরক্ত লাগে তার৷ মাঝে মধ্যে। কিছুক্ষণ পর ওয়েটার তার জন্য কফি নিয়ে আসলো। মাশরাত মোবাইল অন করে ডায়ালে গেলো। তাবাসসুমের নাম্বারে কল করলো। নাম্বার এখনো বন্ধ। মাশরাত লম্বা নিশ্বাস ফেললো। কবে এই নাম্বার অন হবে কে জানে। মোবাইল পাশে হেসে কফিতে চুমুক বসালো। মা বিয়ের কথা বলছে। মাশরাতের মাথা কাজ করছে না। বিয়ে করা কী খুব জরুরি? হঠাৎ পাশ থেকে একটা মেয়েলী কন্ঠ ভেসে আসলো।
“স্যার আপনি?”
মাশরাত ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে মেহরিন। মাশরাত বললো-
“হুমম, তুমি এইখানে?”
“হ্যাঁ বান্ধবীদের সাথে এসেছি।”
“মানে মল্লিকা আর আধুনিক্তা?”
“জ্বী স্যার, ওইতো ওরা এসেছে।”
মাশরাত সামনে তাকালো। আধুনিক্তা আর মল্লিকা হেটে আসছে। আধুনিক্তাকে দেখে মাশরাত ঢোক গিললো। মেয়েটার হাসি এত সুন্দর কেন। আধুনিক্তা মাশরাতকে দেখে দাঁড়িয়ে গেলো। মল্লিকা দাঁড়িয়ে পেছনে ফিরে বললো-
“তোর আবার কি হলো?”
“কিছু না”
আধুনিক্তা আবার হাঁটা ধরলো। মাশরাতকে দেখে মল্লিকা আর আধুনিক্তা সালাম দিলো। মাশরাত সালামের জবাব নিয়ে কফিতে চুমুক বসিয়ে জানালার দিকে তাকালো। আকাশে মেঘ জমছে ধীরে ধীরে। তারা তিনজন গিয়ে অন্য টেবিলে বসলো। আধুনিক্তার দৃষ্টি বার বার মাশরাতের দিকে যাচ্ছে। মাশরাত আড়চোখে আধুনিক্তাকে দেখে অকারণে মুচকি হাসলো। হেসে সে নিজেই থতমত খেয়ে গেল। ভ্রু কুঁচকে কিছুক্ষণ ভাবলো মায়ের কথা শুনে তার মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছে। তারাতাড়ি কফি শেষ করে উঠে দাঁড়ালো। আধুনিক্তা মাশরাতকে দেখে দু’বার চোখের পলক ফেললো। মাশরাত কী চলে যাচ্ছে? মাশরাত ধীরে ধীরে হাঁটা ধরলো। আধুনিক্তা ডান বাম দেখে মেহরিন আর মল্লিকাকে বললো-
“চল চলে যাই।”
“কিন্তু কেন?”
“এইভাবেই, চল না প্লিজ।”
“কিন্তু কোথায় এইটা তো বল।”
আধুনিক্তা পেছনে ফিরলো। মাশরাত বেরিয়ে যাচ্ছে। আধুনিক্তা দৌড়ে কফিশপ থেকে বেরিয়ে গেল। মল্লিকা ও মেহরিন অবাক হয়ে বসে রইল। মাশরাত পকেটে হাত দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। আধুনিক্তা শপ থেকে বের হয়ে ডান বাম দেখলো। মাশরাত ডান রাস্তা দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। আধুনিক্তার গলা দিয়ে শব্দ বের হচ্ছে না। কোনো দৌড়ে গিয়ে মাশরাত সামনে দাঁড়ালো। মাশরাত হঠাৎ আধুনিক্তাকে দেখে ভ্রু কুঁচকালো। আধুনিক্তা ঘন ঘন নিশ্বাস ফেলছে।
“কিছু বলবে?”
মাশরাতের প্রশ্নে আধুনিক্তা অপ্রস্তুত হলো। কেন এসেছে আর কী বলতে এসেছে সে নিজেও জানে না। চারপাশে মেঘ গর্জনের শব্দ ভেসে বেড়াচ্ছে। বাতাসও বইছে খুব জোরে। মাশরাত আবার জিজ্ঞেস করলো-
“কী হয়েছে মিস আধুনিক্তা?”
“স্য..স্যার আ..আমি কিছু বল..বলতে চাই।”
“যা বলতে চাও স্পষ্ট বলো।”
আধুনিক্তা ঢোক গিললো। মাথা নিচু করে ওড়না আঙুলে পেঁচাতে পেঁচাতে বললো-
“আ..আমি বাস্কেটবল খেলতে চাই।”
“তুমি তো বলেছিলে তোমার খেলা বারণ।”
“জ্বী”
“ভুলে যাও সম্ভব না। প্রাণ থেকে খেল জরুরি না।”
“খেলাটাই যে আমার প্রাণ।”
আধুনিক্তা ছলছল দৃষ্টিতে মাশরাতের দিকে তাকালো। মাশরাত আধুনিক্তার চাহনি দেখে মুখ ফিরিয়ে নিলো।
“স্যার আপনি তো ট্রেইনার। আপনি খুব সুন্দরভাবে সবাইকে বুঝাতে পারেন। আপনি কী আমার পরিবারকে মানাতে পারবেন প্লিজ।”
মাশরাত আধুনিক্তার দিকে তাকালো। মেয়েটার চোখে যেন হাজারো শব্দ লিখা যা মাশরাত এখন পড়তে পারছে না। মাশরাত কিছু বলতে যাবে তখনই সামনে দিয়ে একটা বাইক ফুল স্পিডে এড়িয়ে আসছে। বাইকটা আকাবাকা হয়ে এগিয়ে আসছে। বাইক চালক বার বার সরে যেতে বলছে। হয় তো ব্রেক ফেল হয়েছে। মাশরাত দ্রুত আধুনিক্তার হাত ধরে টেনে জড়িয়ে ধরে সরে গেলো। বাইক পাশ কাটিয়ে যেতেই মাশরাত টাল সামলাতে না পেরে ঝুকে গেলো আধুনিক্তাকে নিয়ে। আধুনিক্তা মাশরাতের বুকের সাথে লেপ্টে আছে। মুখ তুলে দৃষ্টি মাশরাতের দিকে রাখলো। বাইক গিয়ে শপিংমলের দেয়ালের ধাক্কা খেয়ে পড়ে গেল। আকাশ গর্জে বৃষ্টি পড়া শুরু হলো। মুহূর্তেই শপিংমলের বাহিরে ভীর হয়ে গিয়েছে। মাশরাত আধুনিক্তার কোমড় জড়িয়ে ধরে রেখেছে। দুজনের দৃষ্টি একে অপরের চোখে আটকে গেলো। মিনিটেই মাশরাতের হৃদয়ের স্পন্দন বেড়ে গেলো। আধুনিক্তা নেশাগ্রস্ত চোখে তাকিয়ে আছে। নিজের অজান্তেই মাশরাত হাত তুলে আধুনিক্তার গালে রাখলো। মাশরাতের ছোঁয়ায় আধুনিক্তা চোখ বন্ধ করে ফেললো।

চলবে……

#তুমি_আছো_হৃদয়ে_তাই
#শোভা_আক্তার(লাভলী)
#পর্ব_৫

নিজের অজান্তেই মাশরাত হাত তুলে আধুনিক্তার গালে রাখলো। মাশরাতের ছোঁয়ায় আধুনিক্তা চোখ বন্ধ করে ফেললো। হঠাৎ মল্লিকা বললো-
“আধুনিক্তা তুই ঠিক আছিস?”
মল্লিকার কথা শুনে মাশরাত তাদের দিকে তাকালো। মেহরিন আর মল্লিকা হা হয়ে তাকিয়ে আছে। মাশরাত একটা ঢোক গিলে আধুনিক্তাকে ছেড়ে দিলো। আধুনিক্তার ধপ করে মাটিতে পড়ে গেলো। পড়ার সাথে সাথে কোমড় ধরে আম্মু বলে চিৎকার দিয়ে উঠলো। মল্লিকা ও মেহরিন আরো অবাক হলো। তারা দৌড়ে এসে আধুনিক্তাকে ধরে বললো-
“একি তুই..উঠ আমরা সাহায্য করছি।”
মাশরাত আধুনিক্তার পাশে হাঁটু ভেঙে বসে বললো-
“আই এম সরি আই এম রিয়েলি সরি আধুনিক্তা।”
“স্যারররর আপনি আমাকে ছাড়লেন কেন? আমার খুব লেগেছে।”
“আমি আসলে বুঝতে পারি নি।”
মাশরাত আধুনিক্তার ডান হাত নিজের মুঠোয় বন্দী করে নিল। আধুনিক্তা শিউরে উঠলো মাশরাতের ছোঁয়ায়। তার হাত কাপছে হঠাৎ। মনে মনে মিনতি করতে লাগলো মাশরাত যেন তার হাতটা না ছাড়ে। মাশরাত হাত মুঠো ছাড়তেই আধুনিক্তা আবার চিৎকার দিয়ে উঠলো। মাশরাতের কলিজা মোচড় দিয়ে উঠলো আধুনিক্তার চিৎকার শুনে। সে আবার আধুনিক্তার হাত শক্ত করে ধরে ফেললো। আধুনিক্তার মনে লাড্ডু ফুটছে। তিনজন মিলে তাকে ধরে তুলে দাঁড় করালো। আধুনিক্তা এইবার বুঝতে পারছে তার কোমড়ে সত্যি খুব ব্যাথা লেগেছে। সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছে না। মেহরিন বললো-
“কষ্ট হচ্ছে তোর?”
আধুনিক্তা শুধু মাথা নাড়ালো। তার গলা দিয়ে শব্দ বের হচ্ছে না। মল্লিকা কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বললো-
“দোস্ত আমার টেনশন হচ্ছে। তোর কিছু হয়ে গেলে? কফিশপের বিলটাও পে করা হয় নি।”
আধুনিক্তা বড়ো বড়ো চোখ করে মল্লিকার দিকে তাকালো। বিরক্ত চেহারা বানিয়ে বললো-
“তুই বন্ধু না প্রতারক? আমি ব্যাথায় মরছি আর তুই… বাদ দে তোর সাথে আর কথা নেই।”
“আরে আমি বলতে চাচ্ছি আমরা যে খাবার অর্ডার দিলাম সেটাও খাওয়া হয় নি। খাবারগুলা টেবিলে এখনো সাজানো। এইগুলোর টাকাও তো দিতে হবে।”
আধুনিক্তা রাগান্বিত কন্ঠে চিল্লিয়ে বললো-
“যা প্রতারক যা সব একা খা গিয়ে। আল্লাহ গো আমি দাঁড়াতেও পারছি না।”
আধুনিক্তা দাঁতে দাঁত চেপে রাখলো। মল্লিকা ভেংচি কাটলো। মেহরিন বললো-
“আরে আধু মল্লিকা মজা করছে। আমরা তো বিল পে করেই এসেছি। টাকা না দিলে না আমাদের বাহিরে আসতে দিতো না। আচ্ছা তুই একটু অপেক্ষা কর আমি রিকশা ডাকছি আমি। তুই এখন বাসায় চলে যা।”
“রিকশা? না না আমি রিকশায় বসতে পারি না৷ পড়ে যাবো বসলে।”
মাশরাত ভ্রু কুঁচকে বললো-
“কেন?”
“অভ্যেস নেই তাই।”
মাশরাত লম্বা নিশ্বাস ফেলে মনে মনে বললো-
“বড়লোকের বড়লোকদের মতো কথা। এইদিকে গাড়িতে বসলে আমার মাথা ঘুরে।”
মাশরাতকে চুপ থাকতে দেখে আধুনিক্তা বললো-
“স্যার কি ভাবছেন?”
“কিছু না। তুমি কিভাবে এসেছো?”
“গাড়ি নিয়ে এসেছি।”
“গাড়ি কোথায়?”
“ড্রাইভার মামা চলে গিয়েছে। কারণ আমি বলেছিলাম এইখান থেকে মেহরিনদের বাসায় যাবো। বাসায় যেতে সন্ধ্যা হতে পারে।”
“মেহরিনদের বাসায় কি হেটে যেতে?”
“হ্যাঁ ওদের বাসা তো কাছেই।”
মেহরিন বিরক্তি নিয়ে বললো-
“আচ্ছা এই বৃষ্টির মধ্যে দাঁড়িয়ে কথা বলার কারণ বুঝলাম না। তোর কোমড়ে ব্যাথা। সামনে হয়েছে এক্সিডেন্ট। আমরা কি দাঁড়িয়ে থাকবো?”
“দোস্ত আমি হাঁটতে পারবো না। সত্যি খুব লেগেছে।”
মল্লিকা নখ কামড়াতে কামড়াতে বললো-
“এখন তো রাস্তায় মানুষের ভীর। রিকশাও চোখে দেখা যাচ্ছে না। তার মানে কিছু রাস্তা হেটে গিয়ে সামনের মোড় থেকে রিকশা নিতে হবে।”
আধুনিক্তা বললো-
“আচ্ছা ওদিক পর্যন্ত চল আমি ড্রাইভার মামাকে কল দিয়ে ওখানে আসতে বলি।”
“হ্যাঁ এইটা ঠিক হবে।”
মাশরাত বিরক্ত না হয়েও পারলো না। এই মেয়েগুলো এত কথা কিভাবে বলে উপর ওয়ালা ছাড়া আর কেও জানে না। আধুনিক্তা তো একটু বেশীই বকবক করছে। মাশরাত আর একটা মুহুর্ত অপেক্ষা করলো না। আধুনিক্তাকে কোলে তুলে নিল। এমন কিছু হবে আধুনিক্তা কল্পনাও করে নি। সে হা হয়ে মাশরাতের দিকে তাকিয়ে আছে। মাশরাত আধুনিক্তাকে কোলে নিয়ে পাথর হয়ে গিয়েছে। আধুনিক্তা তো ভীষণ শুকনা কিন্তু এত ভারী কেন? মাশরাত আধুনিক্তার দিকে তাকিয়ে বললো-
“মোবাইল নিয়ে কল দিয়ে ড্রাইভারকে আসতে বলো।”
আধুনিক্তার কান দিয়ে যেন কোনো কথা ঢুকলো না। সে এখনো ঘোরের মাঝে আছে। মেহরিন আর মল্লিকাও যেনো আকাশ থেকে পরলো এমন দৃশ্য দেখে। তাদের গলা দিয়েও শব্দ বের হচ্ছে না। মাশরাত ধমকের স্বরে বললো-
“কী হলো আমার কথা কানে যায় নি?”
আধুনিক্তার ঘোর কাটলো৷ মল্লিকার উদ্দেশ্যে বললো-
“আমার মোবাইল তোর ব্যাগে তাই না?”
মল্লিকা মাথা নাড়ালো। ব্যাগ থেকে মোবাইল বের করে আধুনিক্তার হাতে দিলো। আধুনিক্তা ড্রাইভারকে কল দিয়ে সামনের মোড়ে আসতে বললো। মাশরাত বললো-
“চলো আমরা সেখানে যাই। এইখানে ভীর জমছে আরো।”
বলেই মাশরাত হাঁটা ধরলো। মেহরিন আর মল্লিকা একবার একে অপরের দিকে তাকিয়ে আবার সামনে তাকিয়ে মাশরাতের পেছনে হাঁটা শুরু করলো। মাশরাত ভীরের মাঝেই হেটে যাচ্ছে। আধুনিক্তা মাশরাতের গলা জড়িয়ে ধরে কাঁধে মাথা ঠেকালো। জীবনে প্রথম তার এত ভালো অনুভব হচ্ছে। চোখ তুলে মাশরাতের দিকে তাকালো। ঘন দাড়িতে ছেলেটার সৌন্দর্য আরো ফুটে উঠেছে। এই শ্যাম বর্ণের ছেলেটা একটু একটু করে জায়গা করছে তার মনে। ভীর থেকে বের হয়ে মাশরাত লম্বা নিশ্বাস ফেললো। পেছনে ফিরে দেখে মেহরিন আর মল্লিকাও আসলো।
“ইশশ আমার পা শেষ। কতজন যে উপর দিয়ে গেল। স্যার এইবার না হয় ওকে নামিয়ে দিন। আমি আর মেহরিন ওকে ধরে নিয়ে ওখানে যাই।”
মল্লিকার কথার মাশরাত জবাব দিলো না। আধুনিক্তা মুখ লটকিয়ে রেখেছে। মাশরাত তাকে নামিয়ে দিবে। তার ভাবনা ভুল প্রমাণিত হলো। মাশরাত কিছু না বলেই ঘুরে হাঁটা ধরলো। আধুনিক্তা খুশীতে আত্মহারা কিন্তু চেহারায় প্রকাশ করলো না। মাশরাত বুঝতে পারছে আধুনিক্তা তার দিকেই তাকিয়ে আছে। মেয়েটা এমন কেন? আজব দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। রাস্তার সবাই তাদের দিকে হা হয়ে তাকিয়ে আছে। কিছু কিছু মানুষদের চোখে তারা বেয়াদব আর কিছু কিছু মানুষদের চোখে তারা বেস্ট কাপল হয়ে উঠেছে। আধুনিক্তা লজ্জা পেলেও মাশরাত এগিয়ে যাচ্ছে। কিছু কিছু মানুষদের তো কাজই সত্য না জেনে উল্টা পাল্টা ভাবা। তাই রিয়্যাক্ট না করে এগিয়ে যাওয়াই ভালো৷ মোড়ের সামনে এসে দাঁড়ালো তারা। মাশরাতের নিশ্বাস ভারী হয়ে গিয়েছে। কষ্ট হচ্ছে নিশ্বাস নিতে। আধুনিক্তা বললো-
“আহারে স্যার আপনি তো দেখছি ঘেমে গিয়েছেন।”
মাশরাত ভ্রু কুঁচকে বললো-
“আজব তো, বৃষ্টি পড়ছে চোখে দেখো না?”
আধুনিক্তা থতমত খেয়ে আকাশের দিকে তাকালো। সত্যি তো বৃষ্টি পড়ছে সে ভুলেই গিয়েছিলো মাশরাতের মাঝে ডুবে। আধুনিক্তার মাশরাতের দিকে তাকিয়ে মাশরাতের গাল ছুঁয়ে বললো-
“তার মানে এইগুলো বৃষ্টির পানি। তাই তো বলি ঝর্ণার পানির মতো ঘাম ঝড়ছে কেন।”
মাশরাত কিছুক্ষণ অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো আধুনিক্তার দিকে। সে এমন অদ্ভুত মানুষ আগে কখনো দেখে নি। মাশরাত হঠাৎ ফিক করে হেসে দিলো। আধুনিক্তা অবাক হলো মাশরাতের হাসি দেখে। মাশরাত কাঁপিয়ে হাসছে। আধুনিক্ত মুচকি হাসলো। পছন্দ হলো তার হাসিটা। প্রচুর পছন্দ হলো।
“স্যার আপনার হাসিটা খুব সুন্দর।”
মাশরাত থমকে গেল আধুনিক্তার কথা শুনে। মাশরাত সত্যি অবাক হলো৷ আজ ৩ বছর পর সে মন খুলে হাসলো। কিন্তু কেন? আধুনিক্তার কথাগুলো তার বেশ মজাদার মনে হচ্ছে। মাশরাত কিছু বললো না। ধীরে ধীরে আধুনিক্তাকে নামালো। মেহরিন আর মল্লিকা আধুনিক্তাকে ধরে রাখলো। চারজনই নিশ্চুপ। নিরবতা আধুনিক্তার পছন্দ না। তার বোরিং লাগছে। মাশরাতের দিকে তাকিয়ে বললো-
“স্যার একটা কথা জিজ্ঞেস করি?”
“করো”
অন্যদিকে দৃষ্টি রেখেই মাশরাত বললো কথাটা। আধুনিক্তা বললো-
“আপনি সবসময় মুখ গোমরা করে রাখেন কেন? দেখে মনে হয় কেও আপনার মুখে জোর করে করলা দিয়ে রেখেছে।”
মাশরাত রাগী দৃষ্টিতে আধুনিক্তার দিকে তাকালো। আধুনিক্তা ঢোক গিললো। সে কি ভুল কিছু জিজ্ঞেস করেছে? মাশরাত ধীরে ধীরে আধুনিক্তার দিকে ঝুকলো। আধুনিক্তার মনে হচ্ছে তার হৃদয়টা এখন বেরিয়ে যাবে। মাশরাত বললো-
“ছোটো মানুষদের এত কিছু জানতে নেই। তোমার গাড়ি এসে পড়েছে।”
তখনই হর্ন বাজানোর শব্দ আসলো। আধুনিক্তার পাশে তাকিয়ে দেখে সত্যি তার গাড়ি এসেছে। আধুনিক্তা মাশরাতের দিকে তাকিয়ে বললো-
“স্যার আপনি কিভাবে জানলেন এইটা আমার গাড়ি?”
মাশরাত সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বললো-
“ভার্সিটিতে দেখেছিলাম।”
“ওওওও”
“যাও এখন”
আধুনিক্তা মুখ লটকিয়ে হাঁটা ধরলো। আবার পেছনে ফিরে বললো-
“তোরাও এসে পড়। বাসায় পৌছে দিয়ে আমিও চলে যাবো নি।”
“দোস্ত তুই যা আমরা যেতে পারবো।”
“আসতে বলেছি”
আধুনিক্তার কথায় মল্লিকা ও মেহরিনও তার সাথে গাড়িতে উঠে পরলো। আধুনিক্তা মাশরাতকে বললো-
“স্যার আপনিও ড্রাইভার মামার পাশের সিটে বসে যান। বৃষ্টি পড়ছে খুব আপনার ঠান্ডা লেগে যাবে।”
মাশরাত না বোধক মাথা নাড়ালো। আধুনিক্তা আর জোর করতে পারবো না। মাশরাতের চোখে রাগ দেখতে পারছে সে। হয় তো প্রশ্ন করা তার ঠিক হয় নি। মেহরিন গাড়ির দরজা বন্ধ করতে যাবে তখনই মাশরাত বললো-
“আধুনিক্তা, আই এম সরি।”
“স্যার ইটস ওকে আমি ঠিক আছি।”
“বাসায় পৌঁছে… মানে ঠিক মতো বাসায় যেও।”
আধুনিক্তা মুচকি হাসলো। মাশরাত সাথে সাথে মুখ ফিরিয়ে নিলো। মেহরিন দরজা বন্ধ করে দিলো। গাড়ি স্টার্ট দিলো ড্রাইভার মামা। ধীরে ধীরে গাড়ি এগিয়ে যাচ্ছে। মাশরাত তাকালো গাড়ির পথে। সে বলতে চেয়েছিলো “বাসায় পৌঁছে আমাকে কল দিও নাহলে টেনশন হবে” আজ অনেকদিন পর এই কথাটা তার মুখ থেকে বের হতে চেয়েও বের হলো না। মাশরাত একটা লম্বা নিশ্বাস ফেলে বাসার উদ্দেশ্যে হাঁটা ধরলো।

আধুনিক্তার উপুর হয়ে শুয়ে আছে। মা তাকে এক গাদা কথা শুনাচ্ছে আর কোমরে মালিশ করে দিচ্ছে। বাবার রাগ আজ সপ্তম আসমানে। মেয়ে আজ বাহিরে যেতে না যেতে ব্যাথা পেয়ে এসেছে। দাদী ছেলের মাথা করাচ্ছে নানা ধরণের কথা বলে। দাদাই ঘরের বাহিরে পায়চারি করছে। নাতনি কেমন আছে না জানার পর্যন্ত ভালো লাগবে না। মা বকছে কিন্তু আধুনিক্তার কান দিয়ে কথা যাচ্ছে না। যাবে কিভাবে সে তো মাশরাতের ভাবনায় ডুবে আছে। মা ঘাড় বাঁকা করে আধুনিক্তার দিকে তাকালো। মেয়ে দেখি চোখ বন্ধ করে মুচকি হাসি দিয়ে রেখেছে। মা চোখ ছোটো ছোটো করে ধমকের স্বরে বললো-
“কী ব্যাপার আমি একা একাই কথা বলছি আর তুমি হাসছো?”
আধুনিক্তা চোখ খুললো। মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো-
“তোমার বকা দেওয়া শেষ হয়েছে?”
“শুধরাবে না তুমি?”
“আমি কী বিগড়ে গিয়েছি আম্মু?”
“আলবাত বিগড়েছ।”
“তুমি কী আমার মা?”
“তো আর কে?”
“আমার আম্মু কখনো এইসব বলে না। নিশ্চয়ই তুমি প্লাস্টিক সার্জারি করে এসেছো। টেল মি দ্যা ট্রুথ হু আর ইউ?”
মা ফিক করে হেসে দিলো। এই মেয়েটা যে এমন আজব আজব কথা কোথা থেকে নিয়ে আসে। মা আধুনিক্তার গাল ধরে টেনে মাথায় চুমু দিয়ে বললো-
“প্লাস্টিক তো তুমি কিনেদিয়েছিলে তাই না? দুষ্টুমি এখন সাইডে রাখো। উঠে বসে জামা পড়ো।”
আধুনিক্তা হেসে ধীরে ধীরে উঠে বসলো। জামা পড়ে আড়মোড়া ভেঙে বললো-
“আম্মু তুমি কি ম্যাজিশিয়ান?”
“না তো, কেন?”
আধুনিক্তা মায়ের হাত ধরে হাতে চুমু দিয়ে বললো-
“তোমার হাতে ম্যাজিক আছে। আমার কোমড়ের ব্যাথা উড়ানছু হয়ে গিয়েছে।”
মা হেসে আধুনিক্তাকে জড়িয়ে ধরে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো।
“আমি গিয়ে তোমার দাদাই আর বাবাকে বলি তুমি ঠিক আছো। উনারা তো বাড়ি মাথায় তুলে ফেলেছিলেন।”
“উনাদের ভেতরে ডাকো আমার কিছু কথা আছে উনাদের সাথে।”
“ওকে মহারানী আপনি বসুন আমি ডাকছি।”
“কল মি মহারাজ।”
মা হাসলো আধুনিক্তার কথায়।

মাশরাত সিগারেট নিয়ে ছাদে উঠেছে। বৃষ্টির পানিতে ছাদে পানি জমেছে খুব। ধীরে ধীরে হেটে গিয়ে রেলিং ধরে দাঁড়ালো। আবার দৃষ্টি গেলো পাশের ছাদে দোলনার দিকে। মনে হচ্ছে এখনই তাবাসসুম দৌড়ে আসবে। সেই ছাদে জমে থাকা পানিতে ইচ্ছে মতো লাফাতে। মাশরাত সেটা দেখে মুচকি মুচকি হাসবে। মাশরাত দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে সিগারেট জ্বালালো৷ আকাশে রংধনু দেখা যাচ্ছে। রংধনুটা দেখে তার অতীতের পৃষ্ঠা উল্টে গেলো।

অতীতের কিছু অংশ…..
ফুটবল খেলে পায়ে ভীষণ ব্যাথা পেয়েছে মাশরাত। ব্যাথার কারণে জ্বর পর্যন্ত এসে পড়েছিলো। যার ফলে বিছানা থেকে উঠতে পর্যন্ত পারে নি। তাবাসসুমের সাথে সেদিন পর আর দেখা হয় নি। মেয়েটাকে মাশরাত বড্ড মিস করে। জীবনের প্রথম ভালোবাসার ছোঁয়া পেয়েছে তার মন। এত তারাতাড়ি ভালোবাসা যায় কাওকে? হয় তো যায়। মাশরাত একবার ভাবে হয় তো আবেগ জমেছে তার মনে। যদি আবেগ হয়েও থাকে। তার ভীষণ ভালো লাগছে এই অনুভূতিটা। এই অনুভূতি থেকে মাশরাত মুক্তি চায় না। বরং তাবাসসুমের মনেও এই অনুভূতি জাগাতে চায়। মাশরাত ছাদে দাঁড়িয়ে আছে। সকাল থেকে ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি পড়ে ছাদ ভিজিয়ে দিয়েছে। পাশের ছাদে তো পায়ের কব্জি অব্দি পানি জমেছে। মাশরাত মনে মনে মিনতি করছে যাতে তাবাসসুম আসে। প্রতিবার তার আশা পূরণ হয়। এইবারও হলো। তাবাসসুম তার নুপুর পড়া পায়ে ছনছন শব্দ করে দৌড়ে আসলো। তাবাসসুমকে দেখে মাশরাতের মন যেনো ময়ূরের মতো নেচে উঠলো। তাবাসসুম পানি দেখে লাফাতে লাফাতে এগিয়ে আসলো। মাশরাতকে দেখে হাসি ভরা মুখে বললো-
“ভাইয়া আপনি এসেছেন। এতদিন কোথায় ছিলেন? আমি অনেকগুলো কবিতা লিখেছি। ভাবলাম আপনাকে পড়ে শোনাবো কিন্তু আপনি আসেনই নি।”
“একটু অসুস্থ ছিলাম।”
“বলেন কী? কী হয়েছিলো আপনার?”
“বেশী কিছু না। হালকা জ্বর এসেছিলো। এখন বলো কেমন আছো তুমি?”
“আমি তো সবসময়ের মতোই বিন্দাস আছি।”
মাশরাত জবাবে হাসলো। তাবাসসুম একা একাই বকবক করে গেলো। মাশরাত শুধু মাথা নাড়াচ্ছে আর হাসছে। এক সময় তাবাসসুম বললো-
“আমি কি বেশী কথা বলি? আপনার কি বোরিং লাগছে?”
“না তো কে বলেছে?”
“আপনি চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছেন তাই জিজ্ঞেস করলাম।”
“এখন যদি আমি আমার চুপ করে থাকার কারণ বলি তুমি পালিয়ে যাবে।”
“পালাবো কেন?”
“এইভাবেই, তোমার পড়াশোনা কেমন যাচ্ছে।”
“ভালো, কিন্তু আমার টেনশন হচ্ছে যদি এসএসসিতে ফেইল করি?”
“ধ্যাত পাগল ভবিষ্যৎ জানো তুমি? চেষ্টা না করে হার মানতে নেই।”
“হ্যাঁ ঠিক বলেছেন। জানেন আমার একজন হার্ট সার্জন হওয়ার ইচ্ছা।”
“তাই?”
মাশরাত মনে মনে বললো- “তাই তো বলি আমার হৃদয় এমন ছটফট করে কেন৷ এই সার্জনের হাতে ধরা পড়তে চায়।”
“হ্যাঁ, আমি শত শত মানুষের মন সুস্থ করতে চাই। জানেন তো হাজার হাজার মানুষ প্রতিদিন নতুন করে ডিপ্রেশনের মাঝে ডুবে। কারণ হচ্ছে তাদের মন অসুস্থ হয়ে যায়। মন সুস্থ করার জন্য শুধু সার্জারীর প্রয়োজন হয় না। আমি সবাইকে পরামর্শ দিবো কিভাবে মন ভালো রাখা যায়। সেই জেনারেশনে সবার কাছে৷ নিজের কথা পাঠানো খুব সহজ।”
মাশরাত আবারো মুগ্ধ হলো। মেয়েটা এত গভীর কথা ভাবে কিভাবে? তাবাসসুম মাশরাতকে চুপ থাকতে দেখে আবার বললো-
“বোরিং করে তুললাম আপনাকে?”
“উঁহু, বলতে থাকো যা বলছো।”
“না থাক অনেক বলে ফেলেছি। যদি আমার এই স্বপ্ন কোনোদিন সত্যি না হয় ভীষণ লজ্জিত হবো সেদিন আপনার সামনে।”
“এতে লজ্জা পাওয়ার কিছুই নেই। সব স্বপ্ন পূরণ হয় না জীবনের। কিন্তু আমার মন বলে তোমার এই স্বপ্ন নিশ্চয়ই পূরণ হবে।”
“তাই যেন হয়। ভবিষ্যতে একজনের হলেও হৃদয় সুস্থ করতে চাই আমি।”

বর্তমান…..
মাশরাত সিগারেট মাটিতে ফেলে লম্বা নিশ্বাস ফেললো। প্রতিদিন অতীত নাড়াচাড়া দিয়ে উঠে তার। ভীষণ কষ্ট হয় তার। কেন সে তার প্রথম ভালোবাসা পায় নি? মাশরাতের মন বার বার বলে তাবাসসুমের সাথে তার নিশ্চয়ই দেখা হবে। মাশরাতেরও ইচ্ছে করে অতীত ভুলে যেতে কিন্তু পারে না। সে ভাবে, হঠাৎ কোনো একদিন তাবাসসুম তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকবে। সেদিন মাশরাত তাকে মন ভরে দেখতে পারবে না। শুধু তার মনে জমে থাকা প্রশ্নগুলো করবে। তাবাসসুমের কাছ থেকে উত্তর পেয়ে গেলেই মাশরাত তার মন থেকে তাবাসসুমকে চিরকালের জন্য মুক্ত করে দিবে।

চলবে…….

[যদি দেখেন গল্প দিতে দেরি হচ্ছে অপেক্ষা করার অনুরোধ রইলো। গল্প আমি অবশ্যই দিব শুধু কিছু সময় দেরি হতে পারে আর কী। আর যেদিন গল্প দিতে পারবো না সেদিন পোস্ট করে বলে দিবো। ভুল ক্রুটি ধরিয়ে দিবেন প্লিজ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here