#তুমি_আছো_হৃদয়ে_তাই
#শোভা_আক্তার(লাভলী)
#পর্ব_১১
“থামুন এই বিয়েতে আমি রাজি নই।”
সবাই দরজার দিকে তাকালো। একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে ঘনঘন নিশ্বাস ফেলছে। মাশরাত যেন আকাশ থেকে পরলো। মাশরাত দাঁড়াতেই সবাই দাঁড়াল। আধুনিক্তা হনহন করে হেটে এসে মাশরাতের বরাবর দাঁড়াল-
“হাউ ডের ইউ? আমাকে জিজ্ঞেস না করে তুমি বিয়ে করছো কেন?”
মাশরাত থতমত খেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মা হঠাৎ বলে উঠল-
“এই মেয়ে কে তুমি?”
আধুনিক্তা মায়ের দিকে চোখ ছোটো ছোটো করে তাকাল। মা অবাক না হয়ে পারলো না। মেয়েটা চোখ রাঙাচ্ছে? আধুনিক্তা মায়ের বরাবর দাঁড়িয়ে বলল-
“আমি মেয়ে নই।”
“তো কী তুমি ছেলে?”
মালিহা ফিক করে হেসে দিলো। আধুনিক্তা আমতা আমতা করে বলল-
“হ্য..হ্যাঁ আমি মেয়ে। কিন্তু আমাকে মেয়ে বলবেন না। আমার অনেক সুন্দর একটি নাম আছে।”
“তো তোমার নামটা বলো।”
“আধুনিক্তা মজুমদার”
“খুব সুন্দর নাম। এখন বলো চাও তুমি?”
“আপনার ছেলেকে”
সবাই একসাথে “কী” বলে উঠল। মাশরাত হা হয়ে তাকিয়ে আছে আধুনিক্তার দিকে৷ আধুনিক্তা সবার চেহারা দেখে বুঝতে পারলো সে ভুল কিছু বলেছে নিশ্চয়ই। মালিহা বলল-
“তাহলে আপনি সেই মেয়ে যার সাথে আমি কিছুক্ষণ আগে কথা বললাম।”
“হ্যাঁ আমিই সেই মেয়ে। আর তুমি..”
আধুনিক্তা হনহন করে মালিহার দিকে এসে রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল-
“আমাকে বলো নি কেন তোমার ভাইয়ের আজ বিয়ে?”
“বিয়ে নয় আজ বাগদান।”
“হোয়াট দান?”
“বাগদান অর্থাৎ এনগেজমেন্ট। কেন আপনি বাংলা জানেন না?”
“জানি শুধু ভুলে গেছিলাম। এনি ওয়েজ আমি এই বাদগান ইয়ে মানে..বাগদান মানি না।”
মা এইবার রেগে গেলেন। মেহমানদের সামনে মেয়েটা প্রচুর তামাশা করছে। পাত্রীর বাবা বললেন-
“আপা এই বিয়ে হয় তো সম্ভব না। অচেনা এক মেয়ে যাকে আপনারা চিনেনও না সে এসে বলছে বাগদান মানে না। এইটা আমাদের জন্য অপমান ছাড়া কিছুই না। আসি ভালো থাকবেন।”
“ভাই এইভাবে বলবেন না। আমরা তো মেয়েটাকে চিনি না। কে না কে উড়ে এসে জুড়ে বসতে চাইছে।”
আধুনিক্তা রাগে কটমট করছে। রাগান্বিত কন্ঠে বলল-
“কী বলবেন আপনি? আমি উড়ে এসে জুড়ে বসতে চাচ্ছি? আপনার ছেলেকে জিজ্ঞেস করুন আমি কে।”
মা মাশরাতের দিকে তাকালো। মাশরাত এখনো ঘোরের মাঝে আছে। পাত্রীপক্ষ আর এক মুহূর্ত দাঁড়াল না। সবাই বেরিয়ে গেল বাসা থেকে। মা আর মালিহা মিলে অনেক চেষ্টা করলো কিন্তু উনাদের থামাতে পারলেন না। মা রাগে গজগজ করতে করতে এসে মাশরাতের সামনে দাঁড়াল-
“এসব কী হচ্ছে মাশরাত?”
মাশরাতের ঘোর কাটলো। সে তিনজনের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। আধুনিক্তা হেসে বলল-
“যা চেয়েছিলে তাই হলো তোমার বিয়ে আমি ভেঙে দিয়েছি।”
মাশরাত জিহ্বায় কামড় দিয়ে দিল আধুনিক্তার কথা শুনে। এই মেয়েটার জন্য আজ সে মরবে হয় তো। মা অবাক হয়ে বলল-
“তুই বিয়ে ভাঙার জন্য এসব নাটক করালি?”
“মা আসলে..আমি তো বলেছিলাম আমার বিয়ে করার ইচ্ছে নেই।”
“কবে বিয়ে করবি তাহলে তুই?”
“আমার আরো কিছুদিন সময় দাও প্লিজ।”
“সময়? তোর আরো সময় লাগবে? আরে সেদিন আমি তোর সুখের জন্য তাবাসসুমকে পুত্রবধূ হিসেবে মেনে ছিলাম। কিন্তু হলো কী? আসলো না মেয়েটা। তুই আজও তার অপেক্ষায় আছিস আমি কী বুঝি না? তুই ভালো মতো জানিস মেয়েটা জীবনেও ফিরবে না তোর জীবনে। তুই বলছিস আরো সময় লাগবে। আর কত সময়? আমার মৃত্যুর অপেক্ষা করছিস তুই?”
“আম্মু প্লিজ এসব বলছো কেন?”
মা কেঁদে দিলেন। মালিহা দ্রুত গিয়ে মাকে ধরলেন। মাশরাত কী বলবে ভেবে পাচ্ছে না। আধুনিক্তা থ মেরে দাঁড়িয়ে আছে। তার মানে মাশরাতের জীবনে কেও ছিল? মাশরাত অপেক্ষাতেই আছে। তার মানে মাশরাত মেয়েটাকে আজও ভালোবাসে? ভাবতেই কলিজা মোচড় দিয়ে উঠলো আধুনিক্তার। মাশরাত হঠাৎ বলে উঠলো-
“মা, আমি চাই না অপেক্ষা করতে। আমি চাই এইবার অতীত ভুলে যেতে। কিন্তু আমি যে পারছি না। যদি তাবাসসুম সেদিন আমার সাথে প্রতারণা করতো তাহলে হয় তো এত দিনে ভুলে যেতাম। কিন্তু আমি তো তার না আসার কারণ জানি না।”
“আরে মেয়েটা তোর সাথে প্রতারণা করেছে।”
“আমি কিভাবে ধরে নেই ও আমার সাথে প্রতারণা করেছে? ও তো আসে নি সেদিন। নিশ্চয়ই কোনো কারণ ছিল।”
“তুই ভালোবাসায় অন্ধ হয়ে গিয়েছিস। আমি আর তোকে কিছু বলবো না। তুই যা খুশী কর। আমার মেয়েকে আমি ভালো একজন মানুষের হাতে তুলে নিয়ে নিশ্চিন্তে মরে যাব। তোকে দিয়ে আমার আর আশা ভরসা নেই।”
“বিয়ে এত জরুরি জীবনে? বিয়ে না করে কী মানুষ বাঁচতে পারে না?”
মাশরাত রাগে গর্জে উঠলো। মা অবাক দৃষ্টিতে তাকাল ছেলের দিকে। জীবনে প্রথম মাশরাত মায়ের সাথে উঁচু স্বরে কথা বলছে। আধুনিক্তা ভয়ে চুপসে গেল। মাশরাত আবার বলল-
“বিয়ে বিয়ে বিয়ে বলে আমার মাথা খারাপ করে দিয়েছ তোমরা। শেষ বারের মতো বলছি আমাকে জোর করো না।”
“ঠিক আছে তাই হবে। আমার আর ভালো লাগছে না। আমি ঘরে যাই মালিহা তুই এইসব পরিষ্কার করে ফেল।”
মালিহা মাথা নাড়ালো। মা ধীরপায়ে হাঁটা ধরেলো ঘরে যাওয়ার জন্য। মাশরাত শান্ত গলায় বলল-
“আমি একদিন নিজেই তোমাকে বলবো আমার জন্য পাত্রী দেখতে। এখন আমার মনের পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করার অনুরোধ রইল।”
মা জবাব দিলেন না। দ্রুত হেটে ঘরে চলে গেলেন। মালিহা চলে গেল টি টেবিল পরিষ্কার করতে। আধুনিক্তা এখনো চুপসে দাঁড়িয়ে আছে। মাশরাত আধুনিক্তার দিকে তাকাল। আধুনিক্তা আরো ভয় পেল। চুপচাপ মাথা নিচু করে রাখলো। মাশরাত হাত আড়াআড়িভাবে ভাজ করে বলল-
“আমার দিকে তাকাও।”
আধুনিক্তা তাকাল না। মাশরাত আবার বলল ধমকের স্বরে। আধুনিক্তা এইবার ভয়ে ভয়ে মাথা তুলে তাকাল।
“কে বলেছিল ইস্টুপিটদের মতো কাজ করতে?”
“তুমি তো বলেছিলে বিয়ে করতে চাও না।”
“হ্যাঁ বলেছিলাম কিন্তু আমি কী বলেছিলাম এখন এসে আমার বিয়ে ভাঙো?”
“তার মানে তুমি এই বিয়েতে রাজি ছিলে।”
“ছিলাম আবার ছিলাম না।”
“মানে?”
“মানে হলো আমি হ্যাঁ বলিনি নাও বলিনি।”
“ওওও, আচ্ছা তুমি রাগ করেছো আমার উপর?”
মাশরাত চেয়েছিল রাগী দৃষ্টি বানিয়ে আধুনিক্তাকে ভয় দেখাবে যে সে রেগে আছে। কিন্তু মেয়েটার মায়াবী চেহারা দেখে মাশরাত তা পারছে না। শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আধুনিক্তা আবার জিজ্ঞেস করায় মাশরাত মুচকি হাসলো। তার হাসি দেখে আধুনিক্তা বুঝতে পারলো মাশরাত রাগ করে নি। আধুনিক্তাও দাঁত বের করে হাসলো। হঠাৎ মাশরাতের অতীতের কথা মনে আসতেই মন খারাপ হয়ে গেলো। মাথা নিচু করে ফেলল চুপচাপ। মাশরাত অবাক হয়ে বলল-
“কী হলো? মন খারাপ করো না আমি রাগ করি নি।”
“না আমি মন খারাপ করি নি।”
“তাহলে?”
“কিছু না, আচ্ছা তুমি কারো অপেক্ষা করছো?”
আধুনিক্তা মাশরাতের চোখে চোখ রেখে প্রশ্ন করলো। মাশরাত কিছুটা অপ্রস্তুত হলো। আধুনিক্তা অপেক্ষা করছে মাশরাতের জবাবের। মাশরাত মুখে কিছু বলল না। হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়াল। আধুনিক্তার মন আরো খারাপ হয়ে গিয়েছে মাশরাতের জবাব দেখে। মাশরাত আধুনিক্তার দিকে তাকিয়ে বলল-
“শুনবে আমাদের প্রেমের কাহিনী?”
আধুনিক্তা মাশরাতের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো। মাশরাত বলল-
“তাহলে চলো বাহিরে যাই। আমার এখন মুড ফ্রেশ করা প্রয়োজন।”
“ঠিক আছে”
“তুমি কিছুক্ষণ অপেক্ষা করো আমি পাঞ্জাবিটা খুলে আসি।”
আধুনিক্তা এখন মাশরাতকে খেয়াল করলো। ছেলেটাকে পাঞ্জাবি বেশ লাগছে। মাশরাত চলে যাচ্ছি আধুনিক্তা হঠাৎ হাত ধরে ফেলল। মাশরাত থমকে গেল আধুনিক্তার ছোঁয়া পেয়ে। হঠাৎ তার এত ভালো লাগছে কেন বুঝতে পারছে না। মেয়েটা যেন তার হাত না বরং হৃদয় ছুঁয়ে ফেলল। আধুনিক্তা বলল-
“পাঞ্জাবিটা তোমাকে মানিয়েছে। এইভাবেই চলো।”
মাশরাত জবাব দিলো না। তার ভেতরে ভালো লাগা কাজ করছে খুব। আধুনিক্তার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে মাথা নাড়াল।
“তাহলে দাঁড়াও আমি মোবাইল নিয়ে আসি।”
আধুনিক্তা মুচকি হেসে ছেড়ে দিলো মাশরাতের হাত। মাশরাত দ্রুত হেটে ঘরে গেল। হঠাৎ মালিহার কন্ঠ ভেসে আসলো পাশ থেকে।
“অনেকদিন পর যেন ভাইয়াকে সত্যিই মন থেকে হাসতে দেখলাম। তার সেই মুচকি হাসিটা যেন হারিয়ে গিয়েছিল। সত্যি করে বলো তো তুমি কী জাদু জানো?”
“না তো, আমি একজন সাধারণ মানুষ। আর তোমার ভাই তো এমনই। আমি তো অনেকবার দেখেছি ওকে হাসতে।”
“তোমার সাথে ভাইয়ার কী সম্পর্ক জানতে পারি?”
আধুনিক্তা বলার আগেই মাশরাত বলল-
“বন্ধুত্ব, আমি আর আধুনিক্তা বেস্টফ্রেন্ড।”
“আমি যতটুকু জানি একজন ছেলে আ একজন মেয়ে কখনো বেস্টফ্রেন্ড হতে পারে না।”
“পাশের বাসার আন্টিদের মতো কথা বলিস না। তোরও ছেলে ফ্রেন্ড আছে আমি জানি।”
“আমরা একসাথে আর্ট স্কুলে আছি তো ফ্রেন্ড হওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু আমরা কখনো ঘুরতে বাহিরে যাই নি।”
আধুনিক্তা হঠাৎ লজ্জা পেল। সে চুপচাপ মাথা নিচু করে রাখলো। মাশরাত বলল-
“গুড গার্ল, কখনো ছেলেদের সাথে ঘুরতে যাবি না। গেলে তোর সব হাড় গুঁড়ো করে ফেলব বলে দিলাম।”
“নিজের বেলায় ১৬ আর অন্যের বেলায় ৪ আনা? আমি সইছি কিন্তু উপরওয়ালা সইবে না। এর জবাব তুই পাবি-ই।”
মাশরাত একটা লম্বা নিশ্বাস ফেলল। তার বোনও এত ড্রামা করতে পারে তার জানা ছিল না। মাশরাত বলল-
“আধুনিক্তা চলো তোমাকে বাসায় দিয়ে আসি।”
“ওকে”
“ওয়েট তুমি আগে তোমার ড্রাইভারকে বলো চলে যেতে। আমি গাড়িতে উঠবো না।”
“আমি তো গাড়ি নিয়ে আসি নি।”
“তাহলে কিভাবে এসেছো?”
“উবার দিয়ে এসেছি। ড্রাইভার মামা আসলে আব্বু সব জেনে গেতো। মামা তো আব্বুর ডান হাত বুঝেছো।”
মাশরাত হাসলো আধুনিক্তার কথা শুনে। মালিহাকে বলল মায়ের খেয়াল রাখতে সে আধা ঘণ্টার মধ্যে এসে পরবে। মালিহা মাথা নাড়াল। আধুনিক্তা মালিহাকে হঠাৎ জড়িয়ে ধরলো। মালিহা আর মাশরাত দুজনই অবাক। আধুনিক্তা মালিহাকে ছেড়ে হাসিভরা মুখে বলল-
“তোমার সাথে একদিন পরিচয় হয়ে নিব ভালো মতো। আজ আসি আল্লাহ হাফেজ।”
মালিহা মুচকি হেসে আল্লাহ হাফেজ বলল। তার আধুনিক্তাকে বেশ পছন্দ হয়েছে। মালিহা প্রথম রাগ করেছিল। কিন্তু আধুনিক্তার হাসি মাখা চেহারা দেখে রাগ করে থাকতে পারলো না।
মাশরাত আর আধুনিক্তা বেরিয়ে গেল বাসা থেকে। হাটতে হাটতেই তারা কথা বলছে।
“এখন বলো তোমাদের প্রেমের কাহিনী।”
“তুমি তো দেখছি বেশ এক্সাইটেড।”
“আধুনিক্তা হাসলো কিন্তু মনে মনে বলল- “আমি শুধু জানতে চাই কে সে ভাগ্যবতী কে তোমার মন চুরি করেছিল।”
মাশরাত বলা শুরু করলো-
“এটা ৬ বছর আগের ঘটনা যখন আমি এইচএসসি পরীক্ষা দিয়েছিলাম। পরীক্ষার পর সবসময় খেলা নিয়ে ব্যস্ত থাকতাম। সব ধরনের খেলা খেলতাম কিন্তু বাস্কেটবল হলো সবচেয়ে প্রিয় খেলা। একদিন ছাদে উঠে দেখেছিলাম একটা মন কেড়ে নেওয়ার মতো মানুষকে। তার নাম তাবাসসুম। মেয়েটা ছিল শান্তশিষ্ট চঞ্চল। একসময় শান্ত আর এক সময় দুষ্টু। আমাদের মাঝে ফ্রেন্ডশিপ নামক সম্পর্কটা মাত্র ৬ মাস টিকেছিল কোনো মতো। ও কলেজে ভর্তি হওয়ার ৩ মাস পর আমি ওকে প্রপোজ করি তার ছাদে গিয়ে। সেদিন তাকে প্রথমবার কাঁদতে দেখেছিলাম। যখন সে বলেছিল সেও আমাকে ভালেবাসে আমি প্রায় পাগল হয়ে গিয়েছিলাম খুশীতে। জীবন ভালোই চলছিল। দুজন সারাদিন বন্ধুবান্ধব আর পড়া নিয়ে ব্যস্ত থাকতাম আর সন্ধ্যা হলে ছাদে দেখা করতাম। আর রাতের বেলা ফজরের ওয়াক্ত পর্যন্ত ফোনালাপ তো ছিলোই৷ একদিন জানতে পারি তাবাসসুমের বাবা আমাদের সম্পর্কের ব্যপারে জেনে গিয়েছে। সেদিন ওর মা বাবা আমাদের বাসায় এসে খুব অপমান করে আমাদের। আমি রাগলেও আমার মা রাগে নি। বরং আমাকে সামলিয়েছে। সেদিন রাতে তাবাসসুম আমাকে কল দিয়ে বলে সে আমাকে বিয়ে করতে চায়। যেভাবেই হোক, পালিয়ে হলেও বিয়ে করবে। আমি ওকে বোঝানোর চেষ্টা করি কিন্তু মেয়েটা কিছুতেই বুঝতে চাইছিলো না। এই নিয়ে আমি আম্মুর সাথে আমি কথা বলি। আম্মু জানে আমি অনেক ভালোবাসি তাবাসসুমকে। সেদিন আমার হাতে আংটি দিয়ে বলেছিল উনার বউমাকে বিয়ে করে নিয়ে আসতে। আমি আংটি নিয়ে কাজী অফিসে যাই। অপেক্ষা করছিলাম তার আসার কিন্তু সময় কেটে যাচ্ছিলো খুব দ্রুত। ৩ ঘন্টা অপেক্ষা করেছিলাম। সে আসে নি সেদিন। অনেকবার কল দিয়েছিলাম নাম্বার বন্ধ ছিল। আজ অব্দি নাম্বারটি বন্ধ।”
অতীতের ঘটনা বলা শেষ করে মাশরাত আধুনিক্তার দিকে তাকাল।আধুনিক্তা মাথা নিচু করে হাটছে।
“কী হলো?”
মাশরাতের প্রশ্নে আধুনিক্তা মাথা তুলে মাশরাতের দিকে তাকাল। মাশরাতের চোখের কোণায় একটুখানি পানি জমে আছে। চোখ দুটো হালকা লাল হয়ে আছে। মাশরাতের চেহার দেখেই আধুনিক্তা বুঝতে পারলো মাশরাত অনেক ভালোবাসে তাবাসসুম নামের মেয়েটাকে। মুচকি হেসে মাথা নাড়িয়ে কিছু না ইশারা করলো। মাশরাত বলল-
“তোমার জীবনে কেও ছিল না? আই মিন কাওকে পছন্দ করতে না?”
“না, কিন্তু কেও একজন ছিল যে আমাকে পছন্দ করতো। এক কথায় ভীষণ ভালোবাসতো।”
“তাই? বলা যাবে আমাকে?”
“নিশ্চয়ই”
আধুনিক্তা লম্বা নিশ্বাস ফেলে নিজের কাহিনী বলা শুরু করলো-
“আমার জন্ম লন্ডনে হয়েছিল। আমার পুরো পরিবার আগে বাবার কাজের জন্য লন্ডনেই ছিল। আমি সেখানে ৭ বছর কাটিয়েছিলাম। আমি সেখানের যে স্কুলে পড়তাম সেখানে একটা ছেলে পড়তো। নাম ফারদিন ওয়াহিদ। সেও বাঙালি ছিল। আমার মতোই পরিবারের কারণে লন্ডনে থাকতে হচ্ছিল। ছেলেটা ছিল চাপা স্বভাবের। কিন্তু আমাদের মাঝে বন্ধুত্ব খুব তারাতাড়ি সৃষ্টি হয়। আমাদের বন্ধুত্বের দুই বছর পর আমরা বাংলাদেশে এসে পড়ি। আসার আগে ফারদিনের সাথে দেখাও হয় নি আমার। এই নিয়ে মন খারাপ থাকতো। কারণ ফারদিন ছিল আমার সবচেয়ে ভালো বন্ধু। বাংলাদেশে আসার ১০ বছর পর আমি হঠাৎ করেই ফারদিনকে দেখি। সে এসেছিল আমাদের বাসায়। আমি প্রায় আকাশ থেকে পড়েছিলাম ওকে দেখে। দেখতে বেশ সুন্দর ছিল সে। কিন্তু কখনো আমার মনকে কাবু করতে পারে নি। তার সাথে আবার আমার বন্ধুত্ব সৃষ্টি হয়। বেশ আনন্দ করতাম আমরা। একদিন তার বাবা মা আম্মু আব্বুকে বলে আমাদের বিয়ের কথা। সেদিন আমার অনেক রাগ হয়েছিলো। কারণ আমি ফারদিনকে বন্ধু ছাড়া আর কিছু মানতে পারবো না কখনো। ফারদিন সেদিন আমার পা পর্যন্ত ধরতে চেয়েছিল। আমি চাই নি আমার বন্ধু ছোটো হোক। তাই রাজি হয়ে গিয়েছিলাম বিয়েতে। কিন্তু বিয়ে হতো আমাদের পড়াশোনা একেবারে শেষ হলে। ফারদিন অনেক চেষ্টা করেছিল। কিন্তু পারে নি আমার মন জয় করতে। একদিন তার আব্বু কল দিয়ে বিয়ে ভেঙে ফেলে। আমরা কিছুই বুঝতে পারি নি কেন। যেদিন কল দিয়েছিল সেদিনই তারা লন্ডন ফিরে চলে গিয়েছিল। তারপর আমাদের আর কথা হয় নি।”
আধুনিক্তা কথা শেষ করে মাশরাতের দিকে তাকাল। মাশরাত সামনের দিকে তাকিয়ে হাটছে। আধুনিক্তা বলল-
“কোথায় হারিয়ে গেলে?”
“ভাবছি সে তোমাকে অনেক ভালো বেসেছে। তাই তোমাকে জোর করে খাঁচায় বন্দী করে নি। তোমাকে পাখির মতো আকাশে ছেড়ে দিয়েছে।”
“আমি শুনেছি কাওকে ভালোবাসলে সব রেখা অতিক্রম করে ফেলে মানুষ। ফারদিন আমাকে ভালোবাসলে ছেড়ে যেতো না তাই না?”
“ভুল ভাবছো, কিছু কিছু ভালোবাসা ত্যাগের জন্য জন্মায়। ফারদিন তোমাকে ত্যাগ করেছে কারণ সে তোমাকে অনেক ভালোবাসে।”
“হয় তো, যদি কোনোদিন আমাদের দেখা হয় আমি শিওর ওকে বিবাহিত রূপে দেখব।”
“তুমি শিওর?”
“হ্যাঁ কারণ গত দু’বছর আগেই শুনেছিলাম ওর জন্য পাত্রী দেখা হচ্ছে।”
“কিন্তু ও তো তোমার বয়সী তাই না?”
“হ্যাঁ”
“এত ছোটো বয়সে বিয়ে করে ফেলবে?”
“করতেও পারে, সবাই তো তোমার মতো বুড়ো হতে চায় না।”
“হেই তুমি আবার আমার বয়স নিয়ে পড়ো না তো।”
“তো আর কী করবো? তোমার বয়স তো ৩০ পাড় করলো।”
“এক্সকিউজ মি আই এম অনলি টুয়েন্টি নাইন ইয়ার্স ওল্ড ওকে?”
“হোয়াটেভার, আর এক বছর কেটে গেলেই ৩০ হয়ে যাবে।”
মাশরাত ভেংচি কাটলো। বয়স নিয়ে এমন খোঁটা সহ্য হয় না। আধুনিক্তা হেসে দিলো। আধুনিক্তার হাসি দেখে মাশরাতও হাসলো। দুজন মিলে কথার ঝুড়ি খুলে বসলো। জীবনে ঘটে যাওয়া সব ঘটনা একে অপরকে বলছে।
আধুনিক্তা রাস্তার পাশ দিয়ে হাটছিল আর মাশরাত কিনারার পাশ দিয়ে। হঠাৎ মাশরাত দেখলো গাড়ি চলাচল বাড়ছে রোডে। রাস্তার এপার ওপার দেখলো। দু’পাশ দিয়েই গাড়ি আসছে আর যাচ্ছে। আধুনিক্তা বকবক করতে করতে বার বার রোডের দিকে যাচ্ছে। মাশরাত দু’বার হাত ধরে টেনে নিয়ে এসেছে। হঠাৎ মাশরাত হর্নের আওয়াজ শুনলো। তিনটে গাড়ি পেছন দিক দিয়ে আসছে। মাশরাত হাত ধরে তারাতাড়ি টান দিলো। আধুনিক্তা গিয়ে পড়লো মাশরাতের বুকে। মাশরাত জড়িয়ে ধরে রেখেছে আধুনিক্তাকে বুকের মাঝে। আধুনিক্তা জীবনে প্রথম কারো হৃদপিণ্ডের শব্দ শুনছে। মাশরাতের হৃদয়ের স্পন্দন বেড়ে গিয়েছে আধুনিক্তাকে জড়িয়ে ধরে। আধুনিক্তা হঠাৎ আনমনে মাশরাতকে আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে বুকের ডান কান ঠেকিয়ে চোখ বন্ধ করে রইল। এমন কিছু দেখে মাশরাত অবাক না হয়ে পারলো না। কিন্তু তার খাবার লাগছে না। সেও আলতো করে আধুনিক্তাকে জড়িয়ে ধরলো। রাস্তার কিনারায় দুজন ছেলে মেয়ে একে অপরকে জড়িয়ে ধরেছে রেখেছে। বিষয়টা অন্যরা খারাপ দৃষ্টিতে নিলেও মাশরাত আর আধুনিক্তা তার পরোয়া করবে না। মাশরাত ধীরে ধীরে চোখ বন্ধ করে ফেলল। তার মস্তিষ্কে বার বার তাবাসসুমের কথা ভাবছে কিন্তু মন আজ আধুনিক্তার কাছে ধরা দিতে চাচ্ছে।
চলবে……
[যেহেতু গতকাল গল্প দেই নি আজ দু’টো পর্ব পাবেন । রাত ১০ টার মধ্যে আর একটা পর্ব দেওয়া হবে ইন শাহ আল্লাহ । অপেক্ষা করার অনুরোধ রইল । ভুল ক্রুটি ধরিয়ে দিবেন প্লিজ ❤️❤️]