তুমি নামক প্রশান্তি দ্বিতীয় খন্ড পর্ব ৯

0
337

#তুমি_নামক_প্রশান্তি
#লেখনীতে_জেনিফা_চৌধুরী
#দ্বিতীয়_খন্ড
#পর্ব_নয়

“তোকে দেখতে দেখতে আমি অন্ধ হয়ে গেলেও, তোকে দেখার স্বাধ আমার মিটবে না, বেলীপ্রিয়া।”
সুমধুর কণ্ঠে কথাটা বেলীর কানে যেতেই বেলীর ঘুম মুহূর্তেই কে’টে গেলো। ধড়ফড়িয়ে উঠল ঘুমের থেকে। ঘুম ঘুম চোখে সামনে তাকাতেই চোখ জোড়া জুড়িয়ে গেলো। নীলাভ্র কী সুন্দর বেডে হেলান দিয়ে বসে আছে! আঁখি জোড়া বেলীতেই সীমাবদ্ধ। দেখতে একদম সুস্থ মনে হচ্ছে। বুকের ভেতরে হঠাৎ করেই প্রশান্তির হাওয়া বয়ে গেলো,বেলীর। ঠোঁটে কোনে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠল। হাস্যজ্বল স্বরে উচ্চারণ করল,
“আপনি সত্যিই সুস্থ হয়ে গেছেন? বলুন না।”
বেলীর কণ্ঠে তীব্র আকুলতা। নীলাভ্রকে সুস্থ দেখার জন্য চোখ গুলো এতদিন তৃষ্ণার্ত কাকের মতো পথ চেয়ে ছিল। আজ কতদিন পর মানুষটাকে সুস্থ দেখছে। এই মানুষটার মুখের হাসি দেখার জন্যই তো এতদিন অপেক্ষা করে ছিল। নীলাভ্র ক্যানোলা লাগানো হাতটা এগিয়ে দিলো বেলীর দিকে। সুক্ষ্ম ব্যাথায় একটু নড়ে উঠতেই বেলী কেঁপে উঠল। তৎক্ষনাৎ নীলাভ্রর হাতটা আলতো করে ধরে, ধমকে বলে উঠল,
“কী করছেন কী আপনি? মাথা খারাপ হয়ে গেছে? নড়াচড়া করছেন কেন? একটু সুস্থ হতে না হতেই মাথায় উঠে গেছেন। জ্ঞান বুদ্ধি কি দিন দিন লোপ পাচ্ছে? কখন কি করতে হয় জানেন না? এই এক বছরে দেখছি আপনার উন্নতির থেকে অবনতি ঘটেছে। একবার শুধু সম্পূর্ণ সুস্থ হন। তারপর দেখবেন…? ”
বেলী কথাগুলো একদমে বলে ফোঁস করে নিশ্বাস ছাড়ল। আর নীলাভ্র শব্দ করে হেসে উঠল। ছেলেটার হাসি কিছুতেই থামছে না। আর বেলী বিস্মিত নয়নে নীলাভ্রর দিকে তাকিয়ে রয়েছে। আচ্ছা গল্পটা তো ভিন্ন হওয়ার কথা ছিল। নীলাভ্রকে খুঁজে পেলে ঘৃণিত স্বরে বলার কথা ছিল,
“আপনি আমাকে ঠকিয়েছেন। আপনি একটা ঠকবাজ, প্রতারক। আপনাকে আমি ঘৃণা করি।”
কিন্তু, সেই ঘৃণার পরিবর্তে ভালোবাসা মিশ্রিত নয়নে তাকিয়ে থাকবে। ভালোবাসাটা বোধহয় আগের থেকে বেড়ে গেছে। নীলাভ্র হাসি থামিয়ে হাস্যজ্বল স্বরেই বলে উঠল,
“তুই তো দেখছি খুব বড় হয়ে গেছিস। পাকা পাকা কথা শিখেছিস। বাহ! উন্নতি হয়েছে দেখছি। একটু চালাকও হয়েছিস।”
বেলী ভ্রু যুগল আপনা-আপনি কুঁচকে এলো। বিস্ময়ে চোখের পাতা ঝাপটাল। কোমরে হাত দিয়ে রাগান্বিত চাহনী নিক্ষেপ করল। দাঁতে দাঁত চে°পে বলে উঠল,
“এই আপনি আমার সাথে মশকরা করছেন?”
নীলাভ্র সাথে সাথে চেহারার রঙ পাল্টে ফেলল। কেমন একটা সিরিয়স ফেস করে মাথা নাড়িয়ে বলল,
“একদম না। আপনি কি আমার বেয়াইন লাগেন?”
বেলী কী বুঝল কে জানে? মাথা দুইদিকে নাড়াল। অর্থাৎ’না’। তা দেখে নীলাভ্র আগের ন্যায় বলল,
“তাহলে আমি আপনার সাথে মশকরা করব কেন?”
বেলী বোধহয় ভাবতে বসল। গালে হাত দিয়ে কিছুক্ষণ ভাবল। তারপর যখনি নীলাভ্রর কথাটা বুঝতে পারল। তখনি সা°পের মতো ফোঁস করে উঠল। ছোট ছোট চোখ করে তাকাল নীলাভ্রর দিকে। নীলাভ্রর চেহারাটা এমন যেন, সে কিছুই বুঝতে পারছে না। বেলী দাঁড়িয়ে পড়ল। নীলাভ্রর সামনে গিয়ে দাঁড়াল। মুখে রয়েছে রহস্যময় হাসি। এই হাসির ব্যাখা জানা নেই নীলাভ্রর। তবে বেলীর মাথায় যে দুষ্টু কিছু ঘুরছে তা সে খুব ভালো করেই বুঝতে পারছে। বেলী হঠাৎ করেই নীলাভ্রর দিকে ঝুঁকে পড়ল। নীলাভ্রর গলার দুই পাশে হাত রাখল। চোখে চোখ রেখে আরো কিছুটা নীলাভ্রর মুখের উপর ঝুঁকে পড়ল। নীলাভ্রর বেলীর কান্ডে আকাশ থেকে পড়ল। চোখের পাতা পড়ছে না। মাথা খারাপ হয়ে গেলো না-কী মেয়েটা? এটা হসপিটাল। নীলাভ্র চারদিকে একবা চোখ বুলাল। কেবিনে কেউ নেই। কিন্তু দরজা তো খোলা। বাইরে দিয়ে অনবরত মানুষের আসা যাওয়া। যদি কেউ দেখে ফেলে। কী ভাববে? ভেবেই নীলাভ্রর গলা শুকিয়ে আসতে লাগল। বেলী এক নজরে নীলাভ্রর চোখের দিকে তাকিয়ে আছে। নীলাভ্র এই অস্বস্তিকর মুহূর্তটা কা°টিয়ে উঠার জন্য আমতা আমতা করে বলল,
“এটা হসপিটাল। তু…।”
নীলাভ্রর কথাটা সম্পূর্ণ শেষ হওয়ার আগেই বেলী নীলাভ্রর ঠোঁটের উপর আঙ্গুল রেখে বলে উঠল,
“চুপ! আজ আমি বলব। আপনি শুনবেন।”
বলেই নীলাভ্রর ঠোঁটের উপর থেকে আঙ্গুল সরিয়ে নিলো। এলোমেলো চুল গুলো গুঁছিয়ে দিতে লাগল এক হাতে। মেয়েটার চোখের কোনে কী জল? চোখ গুলো কী ছলছল করছে? কিন্তু কেন? এইযে এক্ষুনি তো ভালো ছিল? বেলী হঠাৎ করে সরে আসল নীলাভ্রর কাছ থেকে। চেয়ারটা টেনে বেডের একদম কাছে এনে বসল। নীলাভ্রর হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলতে শুরু করল,
“আমি এখন যা যা প্রশ্ন করব। সব প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্য আপনি তৈরি তো?”
নীলাভ্র চট করেই সব বুঝে গেলো। এবার আর বেলীর চোখের চাহনীর ভাষা বুঝতে দেরি হলো না। শান্ত স্বরে শুধু জবাব দিলো,
“আজ তোর সব প্রশ্নের উত্তর দিব। উত্তর যে আমাকে দিতেই হবে। এই উত্তর দেওয়ার জন্যই তো আমি এখনো বেঁচে আছি।”
বেলী একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। খানিকক্ষণ চুপ থাকল। তারপর শান্ত, শীতল স্বরে বলতে শুরু করল,
“আমাকে কেন সেদিন বিয়ের আসরে ছেড়ে গিয়েছিলেন? কেন এইরকম জঘন্য একটা চিঠি দিয়েছিলেন? যদি ধরে নেই, আপনি অসুস্থতার জন্য আমাকে ছেড়ে গেছেন। তাহলে প্রশ্ন করি, ‘আপনি আমাকে কী সত্যিই ভালোবেসেছিলেন?’। যদি ভালোবাসতেন তাহলে অন্তত একবার আমাকে নিজের অসুস্থতার কথা বলতেন। ওইভাবে কাপুরুষের মতো বিয়ের আসরে নিজের ভালোবাসার মানুষটাকে ছেড়ে পালিয়ে যেতেন না। পালিয়ে যাওয়ার আগে একবার চিন্তা করতেন। যাকে ছেড়ে যাচ্ছেন তার কী হবে? তাকে কী কী ফেস করতে হবে? সে কী করে বাঁচবে? তাকে সমাজের লোক কোন চোখে দেখবে? একবার তার সম্মানের কথা চিন্তা করতেন। সেদিন আপনি ছেড়ে যাওয়ার পর আমি কোন পরিস্থিতিতে পড়েছিলাম আপনি কী তা জানেন? জানার চেষ্টা করেছিলেন? উত্তর দিন?”
কথাগুলো বলতে বলতে বেলীর চোখ বেয়ে পানি পড়ছিল। পুরনো ক্ষতটা মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছে বুকের ভেতর। সেদিন নীলাভ্র ছেড়ে না গেলে। পালিয়ে না গিয়ে পাশে থাকলে আজ গল্পটা সম্পূর্ণ ভিন্ন হতো। নীলাভ্রর চোখের কোনেও অশ্রুফোটা জমে আছে। বুকের ভেতরটা ছটফট করছে। এই এক বছরের জমানো কথাগুলো বলার জন্য হাসফাস করছে ছেলেটা। দেরি না করে সাথে সাথে একটু জোরেই বলে উঠল,
“আমি তোকে ছেড়ে যাইনি, বেলীপ্রিয়া। তোকে একা রেখে আমি পালিয়ে যাইনি। প্লিজ, এই মিথ্যা অপবাদ গুলো আমার সাথে জুড়ে দিস না। মিথ্যা অপবাদের ভার যে অনেক বেশি যন্ত্রণার। এক বছর ধরে এই যন্ত্রণা বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছি আমি। আর পারছি না। নিজের সাথে নিজে প্রতি মুহূর্ত লড়াই করে হেরে গেছি। নিয়তির কাছে, পরিস্থিতির কাছে আর কিছু মুখোশধারী মানুষের কাছে।”
শেষের কথাটা বেলী বুঝতে পারল না। প্রশ্নোত্তর চোখে তাকাল নীলাভ্রর দিকে। অবাক স্বরে প্রশ্ন করেই বসল,
“মুখোশধারী মানুষ! এর মানে কী? কী বুঝাতে চাইছেন আপনি?”
নীলাভ্র থামল না। পুনরায় বলতে শুরু করল,
“সেদিন আমাকে কিডন্যাপ করা হয়েছিল। টানা এক সপ্তাহ আমাকে আঘাতের পর আঘাত করা হয়েছে সারা শরীরে। দেখবি?
বলেই নীলাভ্র ডান হাত দিয়ে ফতুয়াটা উপরের দিকে উঠাতেই বেলী আঁতকে উঠল৷ সর্বাঙ্গে কাঁপুনি সৃষ্টি হলো। সারা পিঠ-পেট জুড়ে কালচে দাগ। তারপরে নীলাভ্র একটু পাশ ফিরে ডান কানের উপরের দিকে ইশারা করল। বেলী সেদিকে নজর দিতেই দেখল সেলাইয়ের দাগ। অটোমেটিক বেলীর মাথা ঘুরতে লাগল। চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে আসতে লাগল। শরীরে শক্তি বোধহয় কমে যাচ্ছে। কিন্তু এখন দূর্বল হয়ে পড়লে চলবে না। এইসবের কারণ জানতেই হবে। দেরি করল না। জড়ানো স্বরে প্রশ্ন করল,
” এইসব কী? কে করেছে? কিভাবে হয়েছে? কারা করেছে?”
নীলাভ্র নিশ্বাস ছাড়ল। চুপ থাকল কিছুসময়। তারপর হঠাৎ শান্ত, শীতল স্বরে একটা আবদার করে বসল। কাঁপা স্বরে বলে উঠল,
“আমাকে একটু জড়িয়ে ধরবি, বেলীপ্রিয়া। আমার বুকের ভেতরে অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছে রে। বুকটা শূন্য হয়ে পড়ে আছে বহুমাস ধরে। আমি যে তোর প্রশান্তিতে একটু প্রাণ ভরে নিঃশ্বাস নিতে চাই। একটু জড়িয়ে ধর না প্লিজ। কথা দিচ্ছি, তোকে সব বলব। বলতে যে আমাকে হবেই। আমাকে শুধু একটু জড়িয়ে ধর না প্লিজ।”
এই আকুল কণ্ঠের আবদার ফেরানোর সাধ্য কারোর নেই। নিজেকে আর সামলে রাখতে পারল না বেলী। হুড়োহুড়িয়ে হামলে পড়ল নীলাভ্রর বুকে। এতে অবশ্য নীলাভ্র ব্যাথা পেয়েছে। তবুও বুঝতে দিলো না বেলীকে। ক্যানোলা লাগানো ব্যাথাযুক্ত হাতটা দিয়েই বেলীকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। দুটো মন, দুটো প্রাণ আজ বছর খানেক পর শান্তি ফিরে পেলো। সব যন্ত্রণা, বিষাদ ভুলে একটু প্রশান্তিতে ডুবে রইল। ভালোবাসার থেকে মারাত্নক অসুখ আর নেই…

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here