#তুমি_নামক_প্রশান্তি
#লেখনীতে_জেনিফা_চৌধুরী
#দ্বিতীয়_খন্ড
#শেষ_পর্ব[প্রথমাংশ]
আজ নীলাভ্র বেলীর হলুদ ছোঁয়া। চারদিক ঝলমল করছে কৃত্রিম লাইটের আলোয়। বক্সে উচ্চস্বরে গান বাজছে। গানের তালে তালে সমানে নেচে যাচ্ছে, মেরিনা, ইশু, রাকিব। নীলাভ্র আর বেলী পাশাপাশি বসে উপভোগ করছে সেসব দৃশ্য। নীলাভ্র আর বেলী দেশে ফিরে এসেছে_আজ ১৫দিন। এখন নীলাভ্র সুস্থ আছে। বেলীপ্রিয়াকে কাছে পাওয়ার তীব্র নে’শাটাকে আর দমিয়ে রাখতে পারছিল না। তাই বড়োসড়ো অনুষ্ঠান না করে, ছোটো খাটো করে সব নিয়ম মেনে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। নীলাভ্রর গায়ে সাদা রঙের পাঞ্জাবী। হাতে ঘড়ি, মুখে লেগে আছে হালকা হলুদ। দেখতে ছেলেটাকে মিষ্টি লাগছে খুব! বেলী খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে যাচ্ছে। চোখ জোড়া যেন আজ নিঁখুত কারোর সৌন্দর্যে আটকে যাচ্ছে বারংবার। বেলী আনমনে বলে উঠল,
“মাশ-আল্লাহ! নজর না লাগুক কারোর।”
নীলাভ্রর কর্ণপাতে কথাটা যেতেই, সঙ্গে সঙ্গে উত্তর ভেসে আসল,
“বহুকাল আগে থেকে-ই এক কাল-না’গিনীর নজর লেগে আমি কালো হয়ে গেছি৷ এখন আর অন্য মেয়ে তো দূরের কথা, কোনো ভূত-পেত্নীও আমার দিকে নজর দিবে না।”
নীলাভ্রর কথাটা শুনে ভ্রু যুগল আপনা-আপনি কুঁচকে আসল বেলীর। কাল-নাগি’নী! এই কাল-নাগি’নীটা কে? বেলী একবার নিজের গায়ের রঙ দেখল। কই সে-তো কালো না। তাহলে, কাল-নাগি’নী বলল কেন? একটা শব্দ নিয়ে বেলী আকাশ-পাতাল চিন্তা করতে করতে, প্রশ্ন করে বসল,
“আপনি আমাকে কালনা’গিনী কেন বললেন?”
নীলাভ্র অন্যদিকে চেয়ে একটু মুচকি হাসল। কিন্তু বেলী সেটা লক্ষ্য করল না। পরক্ষণেই হাসি মুখটাকে গম্ভীর করে বলল,
“মাঝে মাঝে যেভাবে সা°পের মতো ফোস করে উঠিস, সেটা দেখে যে কেউ তোকে কালনা°গিনী ভেবে বসবে। আমার আর কী দোষ বল?”
নীলাভ্রর এমন কথায় বেজায় রাগ হলো বেলীর। নাক ফুলিয়ে, চোখ দুটো ছোটো ছোটো করে, কপাল কুঁচকে ফেলল। রাগান্বিত স্বরে বলে উঠল,
“আর একবার উল্টা পাল্টা কথা বললে, দেইখেন কী করি?”
“কি করবি? চুমু দিবি? দিতে পারিস। আই ডোন্ট মাইন্ড।”
বলেই বেলীর দিকে চেয়ে চোখ টিপ মা°রল নীলাভ্র। তা দেখে বেলী সঙ্গে সঙ্গে কাশতে শুরু করল। চারদিকে নজর দিল একবার। কেউ শুনে ফেলল কি-না? নীলাভ্রর মুখ দিয়ে এমন কথা বেলী কখনো আশা করে নাই। এমন বেশরম মার্কা হঠাৎ কিভাবে বলল? বেলীকে চুপ থাকতে দেখে নীলাভ্র আবার বলে উঠল,
“চুপ করে আছিস কেন? লজ্জা পাচ্ছিস? আরে লজ্জা পেয়ে কী লাভ? আমি তো তোরেই। তাই লজ্জা না পেয়ে তাড়াতাড়ি চুমু দিয়ে ফেল। আচ্ছা! কোথায় চুমু দিবি? গালে না-কি ঠোঁটে? না-কি অন্য কোথায়? আ…।”
আর কিছু বলার আগেই বেলী নীলাভ্রর মুখ চে°পে ধরল। বেচারীর কান দিয়ে ধোয়া উঠছে বোধহয়? হঠাৎ করে নীলাভ্রর এহেতুক রুপটা দেখে বিস্ময়ে চোখের পাতা পড়ছে না৷ বেলী এবার ফিসফিস করে বলে উঠল,
“চুপ। একদম চুপ। নির্লজ্জের মতো কী বলে যাচ্ছেন? কেউ শুনলে কি ভাববে?”
নীলাভ্র বেলীর হাতটা মুখের থেকে সরিয়ে ভাবলেশহীন ভাবে জবাব দিল,
“আমার বউকে আমি যা খুশি তাই বলব, তাতে কার দাদার কি?”
বেলী এবার জোরে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। কপালে হাত রেখে বলে উঠল,
“এই ছেলেকে বুঝানো আর কলা গাছকে বুঝানো, একই হলো।”
নীলাভ্র সে কথায় পাত্তা দিল না। পাত্তাহীন ভাবে আগের ন্যায় বলল,
“এখন বল কোথায় চুমু দিবি?”
বেলী এবার দুই কানে হাত রেখে জোরেই বলে উঠল,
“আল্লাহ রে ভাই! চুপ থাকেন একটু। মানুষ শুনলে নির্ঘাত আমাদের নির্লজ্জ বলবে।”
“আমি আগের থেকেই নির্লজ্জ।”
নীলাভ্রর কথা শুনে, বেলী এবার নিজেই চুপ হয়ে গেল। নাকের ডগা লাল হয়ে আছে, রাগে। নীলাভ্র মুখটা অন্য দিকে ঘুরিয়ে হাসতে লাগল। আর বেলী রাগে অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে আছে। কিছুক্ষণ রাগান্বিত মুখটা গোমড়া করে রাখল। তারপর নিজে নিজেই হেসে উঠল। প্রশান্তির চোখে চারদিকে তাকিয়ে দেখল একবার। সবাই কত খুশি আজ। সবার মুখে হাসি। বহুদিন পর এই বাড়িটায় প্রাণ ফিরে এসেছে। যখন কষ্টের পর সুখ আসে তখন আগের সব দুঃখ, কষ্ট, ব্যাথা, বেদনা সব ভুলিয়ে দেয়। বেলী হঠাৎ করেই নীলাভ্রর বাহু ধরে, কাঁধে মাথা রাখল। শান্ত স্বরে বলে উঠল,
“আজ সবাই কত খুশি, তাইনা?”
নীলাভ্র ও শান্ত স্বরে, আস্তে করে জবাব দিল,
“মানুষের যতটুকু কষ্ট সহ্য করার ক্ষমতা থাকে, তার চেয়ে বেশি কষ্ট উপরওয়ালা কখনো দেয় না। এবার থেকে সবটা ভালো হবে, ইন’শা’আল্লাহ। ”
বেলী উত্তর দিলো না। শুধু চোখ বন্ধ করে রইল। এই একটা মানুষ পাশে থাকলে সব কষ্ট নিমিশেই ভুলে যায় মেয়েটা। এই যে এই একটা বছর এত কষ্ট, এত অপমান, অবহেলা সহ্য করল। তবুও মেয়েটা উপরওয়ালাকে একফোঁটাও অভিযোগ করেনি। “ধৈর্যের ফল নিশ্চয়ই মিষ্টি হয়।”
—
রাত ১২টা বেজে ৪৫ মিনিট। গায়ে হলুদের প্রোগ্রাম শেষ হতেই, বেলী রুমে আসল। ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে এসে বসল ড্রেসিং টেবিলের সামনে। পড়নে লাল রঙের থ্রি-পিস। চুল গুলো দিয়ে টুপটাপ করে পানি পড়ছে। এখন আর এই লম্বা চুলগুলো মোছার মতো শক্তি নেই গায়ে। অনেক ক্লান্ত লাগছে। কাল আবার ভোরে উঠতে হবে। ঘুমে চোখের পাতা গুলো নিভে আসছে। চুলে একবার তোয়ালে প্যাঁচিয়েও রেখে দিল ড্রেসিং টেবিলের উপর। ইশু আর মেরিনার খবর নেই। কোথায় আছে, কে জানে? বিছানার দিকে পা বাড়াতেই, দরজায় ঠুকঠুক শব্দ হলো। বেলী দরজার দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বলতে লাগল,
“কত রাত হয়ে গেছে৷ আর এখনো তোদের হৈ-হল্লা শেষ হলো না। ঘুম আসবি কখন? পরে আবার কাল সকালে তোদের টেনে উঠাতে হবে। পারিস ও বটে তোরা। এ…।”
এইটুকু বলে দরজাটা খুলেই, বেলী থেমে গেল। চোখের সামনে অনাকাঙ্ক্ষিত ব্যক্তিটাকে দেখে থমকে গেল। কপাল কুঁচকে সাথে সাথে বলে ফেলল,
“আপনি! আপনি এখানে!”
নীলাভ্র কিছু বলল না। শুধু বেলীর হাত ধরে বলে উঠল,
“চল।”
“কোথায় যাব?” বেলী অবাক স্বরে প্রশ্ন করতেই, নীলাভ্র বলল,
“প্রশ্ন করবি না।”
“আরে, বলবেন তো কোথায় যাব? তাও আবার এত রাতে!”
“ম°রতে যাব।”
“ধুর কি সব বলছেন? ভালো করে বলুন কোথায় যাব?”
এবার নীলাভ্র বিরক্ত হলো। বেলীর দিকে চোখ রাঙিয়ে তাকাল। বলল,
“আর একটা প্রশ্ন করবি, তো থা°প্পড় খাবি।”
বলেই বেচারির হাত ধরে টেনে নিয়ে যেতে শুরু করল…,
“কিন্ত…?”
নীলাভ্রর রাগী স্বরে জবাব দিল,
“কোনো কিন্তু না। যেখানে নিয়ে যাব, সেখানে যাবি। নো কুয়েশ্চন। মনে রাখবি, আমি তোর বর, বয়ফ্রেন্ড না যে, ইটিশ পিটিশ করতে নিয়ে যাব।”
এবার বেলী সত্যি সত্যি চুপ হয়ে গেল। এই মানুষটা আজকে বড্ড লাগামহীন হয়ে গেছে। আজ সব প্রশ্নের উল্টাপাল্টা উত্তর দেওয়াটাই তার কাজ।
—
নীলাভ্রদের বাড়ির পেছনের সাইডে একটা গোলাপ ফুলের বাগান আছে। বেলীর খুব পছন্দের এই জায়গাটা। কিন্তু সচারাচর এখানে কেউ আসার নাম নিলেও, নীলাভ্র রেগে আগুন হয়ে যায়। আজ নীলাভ্র নিজ ইচ্ছায় বেলীকে সেখানে নিয়ে এসেছে। বেলীকে বাগানের সামনে এনে ছাড়তেই, বেলী চোখ বিস্ময়ে বেরিয়ে আসার উপক্রম। গোলাপ বাগানের চারপাশটা বিভিন্ন লাল, নীল, হলুদ, সবুজ লাইটের আলোয় ঝিকমিক করছে৷ নীলাভ্র বেলীর হাতটা আলতো করে ধরল। বেলী অবাক চাহনীতে দিতেই, বলল,
“চল।”
বলেই হাঁটা শুরু করল। সরু আইল দিয়ে বাগানের মাঝ খানটায় এসে দাঁড়াল। আজকে বেলীর সারপ্রাইজ পাওয়ার দিন নাকি? এখানটায় তো গাছে ভরপুর ছিল। আজ ফাঁকা কেন? শুধু ফাঁকা না, ফাঁকা জায়গায়টা গোলাপ ফুল দিয়েই, লাভ বানানো। লাভের চারপাশটায় ছোট ছোট প্রদীপের শিখা জ্বলজ্বল করছে। মাঝে সুন্দর করে লেখা,
“উইল ইউ ম্যারি মি, বেলীপ্রিয়া?”
মাটিও ফাঁকা নেই। সম্পূর্ণ মাটিতে গোলাপের পাপড়ি ছড়ানো। পাশে একটা টেবিল আর দুইটা চেয়ার রাখা। সেগুলো সুন্দর করে লাল বেলুন দিয়ে সাজানো। টেবিলের উপর ছোটো বড়ো কয়েকটা মোমবাতি। বেলী বিস্মিত নয়নে চারদিকটা একবার ঘুরে দেখল। চারপাশে লাল গোলাপ ফুটে আছে। আর মাঝে দুজন প্রেমিক যুগল দাঁড়ান৷ দৃশ্যটা এত সুন্দর যে, ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব না। এই দৃশ্যের বর্ণনা নিজ চোখে না দেখা অব্দি কেউ করতে পারবে না। বেলী যখন অবাক নয়নে সবটা দেখতে ব্যস্ত তখনি, শুনতে পেলো,
“বেলীপ্রিয়া, তোমার বাকি জীবনের পথচলার সঙ্গি হতে চাই। তোমার মন খারাপে জোকার হয়ে হাসাতে চাই। তোমার সুখের দিনে সঙ্গি না করো, অন্তত দুঃখের দিনে তোমার পাশে একটু ঠাঁই দিও। আমি তোমাকে চাই আমার স্বার্থে। তোমাকে ছাড়া আমি অসম্পূর্ণ। আমার মানসিক শান্তির জন্য তোমাকে চাই। মেঘলা দুপুরে এক কাপ চায়ের তোমার ঠোঁটের উঞ্চ চুমুক যে, আমার বড্ড প্রয়োজন। তুমি কি আমার নিস্তব্দ রাতের একলা পথের সঙ্গি হবে? তুমি কি হবে আমার রিকশায় একসাথে হাত ধরার সঙ্গি? তুমি কি আমার ধরনীর বুকে বেঁচে থাকার কারণ হবে? হবে কি আমার হৃদ মাঝারের সঙ্গি? হবে কি আমার মানসিক শান্তি? যার নাম হবে #তুমি_নামক_প্রশান্তি।”
বেলীর সামনে এক হাঁটু ভেঙে বসে আছে নীলাভ্র। হাতে গোলাপ ফুলের বড়ো একটা তোড়া। বেলীর চোখে অশ্রুকণা টলমল করছে৷ উত্তর দেওয়ার ভাষা খুঁজে পাচ্ছে না। শুধু মাথা নাড়াল। অর্থাৎ ‘হ্যা’। বহু কষ্টে মুখ ফুটে বলল,
“আমি আপনার সব হতে চাই নীলাভ্র। শুধু আপনার বক্ষস্থলে আমাকে একটু ঠাঁই দিয়েন, আমি সারাজীবন আপনার কাছে কৃতজ্ঞ থাকব।”
বলেই নীলাভ্রর হাত থেকে গোলাপটা নিয়েই হাম’লে পড়ল নীলাভ্রর বুকে। নীলাভ্র টাল সামলাতে না পারল না। দুজনেই সুয়ে পড়ল। নীলাভ্রর বুকে মাথা রেখে চুপ করে আছে, বেলী। আর নীলাভ্র চোখ বন্ধ করে বেলীকে আকঁড়ে ধরে আছে। বহু মাস, বহু বছর, বহু প্রতিক্ষা শেষে আজ দুজন একসাথে। মিনমিনিয়ে নীলাভ্র বলে উঠল
“ভালোবাসি, বেলীপ্রিয়া।”
“আমিও…।”
“আমিও কি?”
“ভালোবাসি!”
“কাকে?”
“আপনাকে।”
“আমাকে কি?”
এবার বেলী বিরক্ত হলো। নীলাভ্রর বুকে কয়েকটা কিল বসিয়ে দিয়ে বলে উঠল,
“ভালোবাসি! ভালোবাসি! ভালোবাসি। শুনতে পেয়েছেন? ভালোবাসি আপনাকে। ”
এবার নীলাভ্র হাসল। জোরে চিৎকার করে বলে উঠল,
“বেলীপ্রিয়া, আই লাভ ইউ।”
নিস্তব্দ রাতে, খোলা আকাশের নিচে, কোলাহল থেকে দূরে এই উচ্চস্বরটা চারদিকে প্রতিধ্বনি হতে শুরু করল। মুহূর্ত এখানে থমকে যাক। নয়ত এই ছোটো জীবনে এমন প্রশান্তিময় মুহূর্ত বার বার আসুক…
#চলবে
#তুমি_নামক_প্রশান্তি
#লেখনীতে_জেনিফা_চৌধুরী
#দ্বিতীয়_খন্ড
#শেষ_পর্ব[শেষাংশ]
বিয়ের গেট দিয়ে বরকে রিকশা চালিয়ে ঢুকতে দেখে উপস্থিত সবাই অবাক চাহনী নিক্ষেপ করে আছে! রিকশাটা রজনীগন্ধা আর গোলাপ দিয়ে খুব সুন্দর করে সাজানো। বেলী রিকশাটার দিকে তাকিয়ে অবাক না হয়ে পারল না। নীলাভ্রর গায়ে গোল্ডেন রঙের শেরওয়ানি। মাথায় পাগড়ী, চোখে কালো সানগ্লাস। মুখে অদ্ভুত সুন্দর হাসি! দেখতে ছেলেটাকে মারাত্নক সুন্দর লাগছে। বেলী মুগ্ধ নয়নে
তাকিয়ে আছে। ইশু আর মেরিনা দৌড়ে নীলাভ্রর পাশে গিয়ে দাঁড়াল। নীলাভ্র চশমাটা নাকের ডগায় এনে বেলীর দিকে তাঁকিয়ে চোখ মা°রল। উপস্থিত সবার সামনে চিৎকার করে বলে উঠল,
“বেলীপ্রিয়া, তুমি আমাকে ভালোবাসি না বললে ভাত খাব না। ”
নীলাভ্রর কথায় আর কাজে বেলী ভড়কে গেলেও, উপস্থিত সবার মাঝে হাসির রোল পড়ে গেল। সবাই উচ্চস্বরে হেসে উঠল। বেলী শুধু বিস্ময়ে চোখের পাতা ঝাপটাল বার কয়েক। পরক্ষণেই লজ্জায় কুঁকড়ে গেল। ইশু আর মেরিনা এবার একসাথে চিৎকার করে নীলাভ্রর তালে তালে বলল,
“ভালোবাসি বলে দাও আমায়।”
মেরিনা ইশুর মাথায় চাপড় মে°রে বলে উঠল,
“তোরে ভালোবাসি কইব কেন? কইব তো ভাইয়্যুরে। গাঁ°ধি…।”
ইশু জিভ কা°মড়ে কপাল চাপ°ড়াতে চা°পড়াতে বলল,
“ইস! থুক্কু! আচ্ছা চল একসাথে শুরু করি।”
বলেই দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে চোখ মে°রে হেসে উঠল একসাথে। চ্যাঁচিয়ে বলে উঠল,
“বেলীপ্রিয়া, ভালোবাসি না বললে ভাত খাব না।”
এবার বেলীও হেসে উঠল। নীলাভ্রর মুখের থেকে হাসি যেন সরছেই না। সীমা, রিতাসহ বড়রা সবাই মুচকি হাসছে। তা দেখে বেলী একটু লজ্জা পাচ্ছে বটে! আপাদত লজ্জা পাওয়ার সময় না। তাই লজ্জাটাকে সাইডে রেখে চ্যাঁচিয়ে বলে উঠল,
“আমি তোমাকে ভালোবাসি, নীলাভ্র!”
নীলাভ্রর কর্ণপাতে কথাটা যেতেই বুকে হাত দিয়ে ‘হায়’ বলে পড়ে যেতে নিলে ইশু আর মেরিনা দুজনে ধরে ফেলল। একবার উচ্চস্বরে হাসির বন্যা বয়ে গেলো পুরো বাড়িতে। সবার চোখের আড়ালে নীলাভ্র ইশারায় চু’মু দেখাল বেলীকে৷ লজ্জায় মুখটা ঢেকে নিল বেলী। বিয়ে শুরু হবে এমন সময় রাকিব দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে গেট দিয়ে ঢুকল। রাকিবকে এমন করে দৌড়াতে দেখে বেলী একটু ঘাবড়ে গেল। কিন্তু পরে খেয়াল করল, রাকিবের পেছন পেছন কয়েকটা কু°কুরেদ বাচ্চা দৌড়ে আসছে৷ তা দেখে বেলীর আর বুঝতে বাকি রইল না কি হয়েছে? রাকিব দৌড়ে এসে নীলাভ্রর পেছনে লুকাল। ভয়ার্ত স্বরে বলতে লাগল,
“ও গো, দুলাভাই গো! মোরে বাঁচান৷ মোর জান, প্রাণ, জীবন, যৌবণ সব ওই কু°ত্তার বাচ্চা গুলা লুটে নিব। আমি এহনো বিয়া করি নাই। আমার ভবিষ্যৎ বউর কি হইব?”
রাকিবের এমন কথা শুনে নীলাভ্র হাসবে না কাঁদবে বুঝতে পারছে না। ওইদিকে কু°কুরের বাচ্চা গুলা নীলাভ্রর সামনে ঘেউ ঘেউ করে যাচ্ছি৷ বেলী, ইশু, মেরিনা হাসতে হাসতে শেষ হয়ে যাচ্ছে। নীলাভ্রর মুখে ভয়ের ছাপ স্পষ্ট। নীলাভ্র আর রাকিব দুজন দুজনে জড়িয়ে ধরে আছে। নীলাভ্র কয়েকবার ঢোক গিলে মিনমিনিয়ে বলল,
“হুস, হুস। যা না বাপ। আজকে আমার বিয়া। তুই না গেলে আমি বিয়া করুম ক্যামনে?”
রাকিব এবার জোরেই বলল,
“আরে, এই বিড়ালের মতো শব্দে কি কু°ত্তা পলাইব। বা°ঘের মতো গর্জন কইরা কন, যা, কু°ত্তা যা। ভাগ। আপনি নাকি আমার দুলাভাই? এই আপনার সাহস?
এবার নীলাভ্র বিরক্ত হলো। বলল,
“তুমি তো বা°ঘের বাচ্চা। তাইলে আমার পেছনে লুকাইছো কেন?”
রাকিবের মুখটা চুপসে গেলো। আমতা আমতা করে বলল,
“ইয়ে মানে? আপনি আমার দুলাভাই না। তাই আপনার পেছনেই তো থাকুম।”
ওদের দুজনের কান্ডে এবার বেলী বিরক্ত হলো। কোমড়ে হাত দিয়ে, রাগী স্বরে বলে উঠল,
“আপনারা কি পুরুষ মানুষ?”
রাকিব সাথে সাথে উত্তর দিল,
“কেন আমারে কি তোর হি°জড়া মনে হয়, বে°দ্দপ বেডি?”
সবার মাঝে আরেকদফা হাসির রোল পড়ে গেলো।
বেলী ওদের সাথে আর কথা বাড়াল না। নিজেই কু°কুরের বাচ্চাগুলো খুব সুন্দর করে তাড়িয়ে দিলো। কু°কুরের বাচ্চাগুলো চলে যেতেই রাকিব আর নীলাভ্র একসাথে লাফিয়ে উঠল। হাসি, মজা করেই শুরু হলো বিয়ের অনুষ্ঠান। খুবই সাধারণ ভাবে শেষ হলো বিয়ে। কবুল বলার সময় বেলীর বুক কাঁপছিল। প্রিয় মানুষটাকে পাওয়ার অনুভূতি যে এত মিষ্টি! আগে জানা ছিল না। আজ সম্পূর্ণ রুপে মানুষটা একান্তই বেলীর। কবুল বলা শেষ হতেই নীলাভ্র বেলীর কানে কানে বলল,
“কিছুক্ষণ আগে প্রশ্ন করলি না, আমি পুরুষ কি-না? প্রমাণ টা ঠিক টাইমে পেয়ে যাবে বেবি।”
নীলাভ্রর এমন কথা শুনে বেলীর হাসি মুখটা চুপসে গেলো। প্রতিউত্তরে একটু মেঁকি হাসি দিয়ে বলল,
“ইয়ে মানে? মজা করে বলেছিলাম।”
নীলাভ্র কিছু বলবে তার আগেই ইশু আর মেরিনা এসে জড়িয়ে ধরল বেলীকে। মেরিনা বলে উঠল,
“অবশেষে তুই আমাদের বোন টু ভাবি হয়ে গেলি, বেলী। খুশিতে আমার নাঁচতে মন চাচ্ছে।”
ইশু শুধু শান্ত স্বরে বলল,
“অনেক ঝড়-ঝাপটার পর অবশেষে তোরা দুজন আজ দুজনের। দোয়া করি এভাবেই সারাজীবন তোরা খুব সুখী থাক। কারোর বদ নজর না পড়ুক।”
বেলীও দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। সীমা এগিয়ে এসে বসল বেলীর সামনে। বেলীর হাত দুটো জড়িয়ে ধরে বলে উঠল,
“অতীত হচ্ছে বিষাক্ত স্মৃতির কারখানা, বুঝলি? যত মনে রাখবি তত বেশি কষ্ট বাড়বে। তাই অতীত ভুলে যা। আজ থেকে সব নতুন করে শুরু হবে। তুই, আমি, আমরা সবাই নতুন করে শুরু করব। আজ থেকে তুই আমার ছেলের বউ না। আমার মেয়ে। তাই আজ শাশুড়ী বা মামি হয়ে না, মা হিসেবে তোর কাছে আমার একটা অনুরোধ আছে রাখবি?”
বেলীর চোখে পানি টলমল করছে। রিতার মুখে প্রশান্তির ছাপ। অবশেষে মেয়েটা একটু সুখের মুখ দেখেছে। মনে মনে একবার প্রার্থনা করল,
‘সারাজীবন মেয়েটা এমনই সুখী থাকুক।’ বেলী অশ্রুসিক্ত চোখে তাকিয়ে হ্যা বোধক মাথা নাড়াল। সীমা বেলীর হাত দুটো এবার আরো শক্ত করে ধরল। বলল,
“তোর সাথে আমি অনেক অন্যায় করেছি, গায়ে হাত দিয়েছি, বিশ্রি কথা বলেছি। জানি এই অন্যায়ের ক্ষমা হয়না হয়তো? তবুও বলছি আমাকে ক্ষমা করে দিস মা। অনেক সময় তো মায়েরাও ভুল করে। সন্তান কি পারেনা তার মাকে ক্ষমা করতে?”
বেলী কিছু বলল না। সীমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। কান্নারত স্বরে বলল,
“আমাকে মেয়েও বলছো, আবার ক্ষমাও চাইছো? এই তো বললে, অতীত মনে রাখতে নেই। তাহলে তুমি কেন অতীতে পড়ে আছো, মা?”
বেলীর মুখে মা ডাকটা যেন সীমার ভাঙা হৃদয়ে তীরের মতো আঘাত করল। দুজনেই কিছুক্ষণ নিরবে চোখের পানি ফেলল। ইশুর চোখের কোনেও পানি। শুধু নীলাভ্রর মুখে রয়েছে হাসি৷ এই হাসিটা সুখের হাসি৷ প্রশান্তির হাসি। অবশেষে সব ঠিক হয়েছে। মনে মনে একবার শুকরিয়া আদায় করে নিলো উপরওয়ালার কাছে। ইশু আর মেরিনা বেলীকে নিয়ে রুমে গেলো। ওদের কয়েকজন বান্ধবীও রয়েছে সাথে। হঠাৎ করে রাকিব একটা গিফট বক্স নিয়ে হাজির হলো। সবার উদ্দেশ্য বলল,
“আমার একটু বেলীর সাথে কথা আছে৷ তোমরা যদি একটু…?”
রাকিব বলতেই সবাই বেলকনিতে গিয়ে দাঁড়াল। রাকিব বেলীর হাতে বক্সটা দিয়ে শুধু বলল,
“এটা রাফিন পাঠিয়েছে।”
বেলী শুধু অবাক হলো। রাফিন নামক কালো ছায়াটার নাম শুনে রাগে শরীর গিজগিজ করে উঠল। রাকিবের দিকে তাকিয়ে কঠিন স্বরে বলল,
“তুই কোন সাহসে তার দেওয়া কোনো গিফট আমার জন্য এনেছিস?”
রাকিব শান্ত স্বরে শুধাল,
“তুই এটা খুলে দেখ। সব প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যাবি৷ আর রাফিন কাল বউ আর পরিবার নিয়ে ইন্ডিয়া চলে গেছে।”
এবার বেলী অনেকটাই অবাক হলো। অবাক স্বরে জিজ্ঞেস করল,
“বউ! রাফিন বিয়ে করেছে?”
রাকিব এক কথায় উত্তর দিল,
“হ্যাঁ! তুই এবার এই বক্সটা খোল।”
বেলীর এবার বক্সটার প্রতি আগ্রহ জন্মাল। দেরি না করে বক্সটা খুলতেই, একটা স্বর্ণের আংটি চোখে পড়ল। পাশেই এক টুকরো কাগজ৷ দেখেই বুঝা যাচ্ছে একটা চিঠি। কাঁপা হাতে বেলী চিঠিটা খুলল। পড়তে শুরু করল,
“বেলী,
প্রথমেই তোমাকে জানাই কংগ্রাচুলেশনস! নতুন জীবনে অনেক অনেক সুখে থেকো। আমার মতো কোনো কালো ছায়া তোমাকে স্পর্শ না করুক। অতীত ভুলে নতুন জীবনে অনেক বেশি ভালো থেকো। আমি তোমার সাথে যেই জঘন্য অপরাধ করেছি তার ক্ষমা হয়না। ক্ষমা চাওয়ার কোনো মুখ নেই। তোমার পায়ে ধরে ক্ষমা চাইলেও হয়ত, ক্ষমা পাওয়ার যোগ্যতা নেই আমার। আমার কালো ছায়া তোমার জীবনে আর পড়তে দিতে চাইনা, তাই নিজের কথাগুলো এই কাগজে, কলমে লিখে দিতে হলো। আমাকে ক্ষমা করে দিও বেলী। মানুষ বাঁচে কয়দিন বলো? এই জীবনে তোমার সাথে অনেক বেশি অন্যায় করেছি। তুমি ক্ষমা না করলে যে, উপর ওয়ালাও আমাকে ক্ষমা করবে না। যদি পারো, আমাকে ক্ষমা করে দিও। আমি যতদিন বেঁচে আছি, ভুল করেও তোমার সামনে আসব না। চিন্তা করো না। তোমাদের জন্য অনেক অনেক শুভকামনা রইল। ও হ্যাঁ, একটা কথা জানাতে ভুলে গেছি, ‘আমি বিয়ে করেছি’। আমার স্ত্রী ইন্ডিয়ান। তাই সেখানেই শিফট হতে যাচ্ছি। যদি আমাকে ক্ষমা করতে পারো, তাহলে আমার দেওয়া ছোট্ট উপহারটা গ্রহণ করো। ভালো থেকো।”
বেলী চিঠিটা পড়েই একটা স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়ল। অজান্তেই মুখে হাসি ফুটল। রাকিবের দিকে তাকিয়ে হেসে বলল,
“এখন থেকে সব ভালো হবে, তাইনা দোস্ত?”
রাকিব মাথা নাড়াল। অর্থাৎ ‘হ্যা’। তারপর বেলীর সামনে বসল হাটু ভেঙে বসল। শান্ত স্বরে বলতে শুরু করল,
“জীবন কখনো কারোর জন্য থেমে থাকে না, বেলী। এই যে, দেখ না আমার জীবনটা কি থেমে আছে? আমি তো বেঁচে আছি। অনেক ভালো ভাবে। অতীতের সব স্মৃতি হয়ত চিরতরে মুছে দেওয়া যায় না। কিন্তু, কিছু স্মৃতি আছে যেগুলো আমাদের প্রতি মুহূর্তে যন্ত্রণা দেয়। সেই স্মৃতি গুলোকে সাময়িক সময়ের জন্য ভুলে থাকা যায়। ঠিক আমি যেমন ভুলে আছি। এইযে দেখ না, কত মেয়ের সাথে এখন ফ্লাট করি, ঘুরে বেড়াই। কিন্তু, কাউকে সত্যিকারের ভালোবাসতে পারিনা। শুধুমাত্র ভালো থাকার জন্য এই রাস্তায় আসতে বাধ্য হয়েছি। এইজন্য আমাকে সবাই ভুল ভাবছে। ভাবুক। সমস্যা নেই। যে যা খুশি তাই ভেবে ভালো থাকুক। আমার কথা সবাই ভালো থাকুক। তাতেই চলবে। আমি যদি হঠাৎ করে হারিয়ে যাই আমাকে ভুল ভাবিস না, বেলী?”
শেষ কথাটায় বেলী কেঁপে উঠল। আর কাউকে হারানোর কষ্ট সহ্য করার শক্তি নেই বেলীর। তাই আঁতকে উঠে বলল,
“হারিয়ে যাবি মানে? কই যাবি? ফাজলামি করছিস? আজ আমার বিয়ে রাকিব। তুই আজকের দিনেও আমাকে কষ্ট দিবি?”
রাকিব একটু মুচকি হাসল। দুজনের চোখ জলে টলমল করছে। রাকিব হেসেই বলল,
“ধুর বোকা মেয়ে! আমি সেই হারিয়ে যাওয়া বুঝাতে চাইনি। আচ্ছা, এত কথা বাদ দেই। আসল কথায় আসি।”
বলে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। বেলী রাকিবের দিকে প্রশ্নোত্তর চোখে তাকিয়ে আছে। রাকিব খানিক্ষন থেমে বলে উঠল,
“আমি আর দুইদিন এই দেশে আছি৷ তারপর চলে যাব।”
বেলী সাথে সাথে অবাক স্বরে প্রশ্ন করল,
“চলে যাবি! কই যাবি? কি বলছিস? কিছু বুঝতে পারছি না। ”
রাকিব দেরি করল না উত্তর দিতে, বলল,
“আমি সিঙ্গাপুর চলে যাচ্ছি। পরশুউ রাত ৯টায় আমার ফ্লাইট।”
বেলীর চোখের পানি এবার গড়িয়ে পড়ল। অসহায় স্বরে জিজ্ঞেস করল,
“আর তুই আমাকে আজ বলছিস?”
রাকিব চোখের পানিটুকু মুছে নিয়ে বলল,
“তোর পরিস্থিতি বুঝেই বলেনি।”
“তুই সত্যিই চলে যাবি? আমাকে একা করে চলে যাবি? আমার পাশে তাহলে কে থাকবে?”
বেলী কথাটুকু বলেই কেঁদে দিল। রাকিবের চোখের পানিটুকু এবার গড়িয়ে পড়ল। বলল,
“তোকে একবার জড়িয়ে ধরি, বেলী। না মানে, যদি তোর কোনো সমস্যা না থাকে?”
বেলী সাথে সাথে রাকিবকে জড়িয়ে ধরে কান্না করে দিল। নীলাভ্র দরজার পাশে দাঁড়িয়ে দেখছে সবটা। না কোনো রাগ হচ্ছে না ওর। না হিংসাও হচ্ছে না। বরং এত সুন্দর একটা বন্ধুত্বের দৃশ্য দেখে চোখ জুড়িয়ে যাচ্ছে। আজকাল সত্যিই এমন ফ্রেন্ড কি পাওয়া যায়? বেলী অনেক ভাগ্যবতী যে, এমন একটা বন্ধু ওর পাশে ছিল সবসময়। কয়জন বিপদে নিজের বন্ধুদের পাশে পায়? বেলী রাকিবকে ছেড়ে বলে উঠল,
“তুই যেখানেই থাকিস, অনেক ভালো থাকিস। শুধু আমাকে ভুলে যাবিনা।”
রাকিব চোখের পানিটুকু মুছে নিয়ে বলল,
“আমার ঘাড়ে কয়টা মাথা শুনি? তোর মতো পে°ত্নীকে ভুলে যাব। পরে আমার ঘাড় মটকাবি তো?”
রাকিবের কথায় বেলী না চাইতেও হেসে দিলো। রাকিব বলল,
“আর কানবি না। চোখের পানি মুইছস নে। মেকাপ ধুয়ে শাক°চুন্নির মতো লাগছে। একটু স্মাইল কর তো৷ পেত্নীর লগে একখান ছবি তুলি।”
বলেই ক্যামেরা চালু করল। তারপর দুজনেই দাঁত বের করে ছবি তুলল। রাকিব সবাইকে ডেকে বলল,
“এবার তোরা আড্ডা দে। আমি আসছি। বাসর রাতের জন্য অল দ্যা বেস্ট।”
বলেই চোখ মা°রল। বেলী ‘তবে রে ‘বলেই বেলী উঠে দাঁড়াতেই রাকিব দৌড়। এক দৌড়ে রুমের বাইরে। রাকিব চলেই যেতেই বেলী হাসতে লাগল…
—
বিকেলের সূর্যটা পশ্চিম দিকে হেলে পড়েছে৷ চারদিকে লাল আভা ছড়িয়ে আছে। গোধূলির বিকেলটা দেখতে সুন্দর! ভীষণ সুন্দর! ব্যস্ত রাস্তায় চলছে শত শত গাড়ি। কিছুক্ষণের মধ্যেই সন্ধ্যা নামবে। বেলী এতক্ষণ সবার সাথে বসে আড্ডা দিচ্ছিল। আর নীলাভ্র বার বার ঘুর ঘুর করছিল চারদিকে। কিন্তু সবার সামনে কিছু বলতে পারেনি। এবার ধৈর্যের বাধ ভেঙে গেল। আর সহ্য হচ্ছে না। নিজে নিজেই বিরক্ত হয়ে বলল,
“আশ্চর্য! আমি লজ্জা পাচ্ছি কেন? বেলী আমার বউ। তাই আমার বউকে আমি ডাকতে যাব, তাতে কার দাদার কী? না! নীলাভ্র তোর লজ্জা পেলে হবে না। বিয়ে করলে একটু আধটু নির্লজ্জ হতে হয়।”
বলেই দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। তারপর সবার সামনে গিয়েই বেলীকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠল,
“বেলীপ্রিয়া, উঠে আয় তো।”
বেলী কিছু বলার আগেই ইশুর এক বান্ধবী পাশ থেকে বলে উঠল,
“আপনার বুঝি তর সইছে না, ভাইয়া?”
বলেই সবাই একসাথে হেসে দিল। এবার বেলী আর নীলাভ্র দুজনেই একটু লজ্জা পেল। কিন্তু নীলাভ্র তা প্রকাশ করল না। মুখে লম্বা একটা হাসি ঝুলাল। হাসি মুখেই উত্তর দিল,
“বউটা তো আমার, তাইনা? আমার বউকে কাছে পাওয়ার জন্য ধৈর্য কেন ধরতে হবে? যখন তখন কাছে টেনে নিব। এমনকি, তোমাদের সামনেও আমি আমার বউকে কাছে টানতে পারি। তোমরা কী দেখতে চাও?”
নীলাভ্রর এমন কথায় বেলী খিলখিল করে হেসে দিল। এবার ইশু মেরিনা সহ সবাই মেঁকি হাসি দিয়ে আস্তে করে কে°টে পড়ল৷ ওদের একেক জনের মুখের অবস্থা দেখে এবার বেলী আর নীলাভ্র দুজনে একসাথে হেসে উঠল। হাসির মাঝেই হঠাৎ নীলাভ্র বেলীর গালে চুমু খেয়ে ফেলল। বেলী থমকে গেলো। লজ্জা পেলো। লজ্জায় মুখ লুকাল নীলাভ্রর বুকে। নীলাভ্র বেলীর কপালে ঠোঁট ছুঁয়ে বলে উঠল,
“তোর একটা ইচ্ছেছিল, মনে আছে?”
“কোনটা?”
“বলব না।”
“বলুন না। মনে পড়ছে না তো?”
“বলতে পারি একটা শর্তে।”
বেলীর ভ্রু যগল কুঁচকে এলো। বলল,
“কি শর্ত?”
নীলাভ্র শান্ত স্বরেই বলল,
“আমাকে চুমু খেতে হবে।”
বেলী হাসল। নীলাভ্রকে অবাক করে দিয়ে, নীলাভ্রর কপালে চুমু দিয়ে, বলল,
“ভালোবাসি, প্রিয় স্বামী।”
নীলাভ্রর বিস্মিত নয়ন জোড়া দেখে বেলী হেসে দিলো। সেই সাথে নীলাভ্রও হাসল। বলল,
“এবার আমার সাথে চল। কিন্তু লুকিয়ে যেতে হবে। কেউ যেন না দেখে।”
“ওমা! বউকে নিয়ে লুকিয়ে যেতে হবে কেন?”
“আরে, বউকে নিয়ে লুকিয়ে ঘুরতে যাওয়ার মজাই আলাদা। তুই বুঝবি না। আয় আমার সাথে।”
বলেই বেলীর হাত ধরে হাঁটা শুরু করল৷ সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলো। সাজানো রিকশাটাকে নিয়ে আসল। বলল,
“এবার উঠে পড়।”
বেলী কিছুক্ষণ চোখের পাতা ঝাপটাল। মনে পড়ল, বেলীর ছোট বেলায় খুব ইচ্ছে ছিল বিয়ের দিন রাতে সবার চোখের আড়ালে, বরের সাথে রিকশা দিয়ে ঢাকা শহরে ঘুরে বেড়াবে। নীলাভ্র যে সেই এত বছর আগের কথাটা মনে রেখেছে, ভেবেই বেলীর বুকের ভেতরে প্রশান্তির হাওয়া বইছে।
“কিরে খাম্বার মতো দাঁড়িয়ে আছিস কেন? উঠে পড়।”
বেলীর মুখে হাসি ফুটল। নীলাভ্র হাত বাড়িয়ে দিতেই বেলী উঠে বসল নীলাভ্রর পাশে৷ একজন মধ্য বয়স্ক লোক রিকশা চালানো শুরু করল। সন্ধ্যা নেমে এসে ধরনীর বুকে। চারদিকটা আলোয় ভরা। বেলী নীলাভ্রর হাতে হাত রেখে, কাঁধে মাথা দিয়ে বসে আছে। নীলাভ্র একেকটা গল্প শুনাচ্ছে আর বেলী হাসছে। ঢাকা শহরে রাতের বেলা রিকশা দিয়ে ঘোরার মতো শান্তি যেন আর নেই। তাও যদি হয় ভালোবাসার মানুষটার সাথে। তাহলে যেন কথাই নেই। এত ঝড়, এত কষ্টের পর আজ দুটো প্রাণ স্বস্তি পেয়েছে। রিকশা আপন গতিতে চলছে। আর রিকশায় বসা দম্পতি ভাসছে প্রশান্তির জোয়ারে। হঠাৎ করে নীলাভ্র বলে উঠল,
“আমাদের এই পথ চলা কখনো শেষ না হোক।”
বেলীকে আগলে নিলো বুকের মাঝে। বেলী শান্ত স্বরে উত্তর দিল,
“কখনো শেষ হবে না। কেননা, আপনি আমার মানসিক শান্তি।”
নীলাভ্র শীতল স্বরে শুধাল,
“আমাদের সম্পর্কের নাম ” তুমি নামক প্রশান্তি”। আর এই প্রশান্তি কখনো শেষ হবে না। আমরা দুজন দুজনের মানসিক শান্তি হয়েই বেঁচে থাকব।”
তাদের দুজনের পথ চলা শেষ না হোক। চলতে থাকুক। দুজন দুজনের প্রশান্তিতে ডুবে থাকুক। অনেক কষ্ট, যন্ত্রনা, হতাশার পরেই আসে প্রশান্তি। আর যখন আসে যখন আর শেষ হয় না। নীলাভ্র আর বেলীর প্রশান্তিও শেষ না হোক। ভালো থাকুক। দুজন দুজনের গল্পে, একসাথে।
#সমাপ্ত
[আসসালামু আলাইকুম। আমার দীর্ঘ পথ চলাটা আজ সম্পূর্ণ। শেষটা আপনাদের মন মতো হয়েছে কিনা জানিনা। তবে, চেষ্টা করেছি একটু অন্যরকম এন্ডিং দিতে। সবার জীবন যে, গুছানো হবে এমন টা। তাই এই গল্পেও রাকিবের জীবনটা না হয়, অগোছালো থাকুক। ভুল ত্রুটি গুলো ক্ষমা করবেন। আজকে অন্তত একটু বড় করে একটা মন্তব্য লিখবেন। আমার ভুল গুলো দেখিয়ে দিবেন। ভালো থাকবেন]