তুমিময় আমি।
মার্জিয়া খাঁন নিহা।
পর্ব : ৮।
বর্তমানে।
সারা বাড়ির সবাই ব্যস্ত। মেয়েরা সব সাজগোজে, বয়স্করা সবাই আলাপ- আলোচনায়, আবার কেউ বা ফাঁক- ফুকোরে নিজের ছেলের জন্য যোগ্য মেয়ের অনুসন্ধানে। বিয়েটা হৃদয়দের বাড়িতেই হচ্ছে। তাই ইতিমধ্যে বাড়িভর্তি মেহমানে। তার মধ্যে জানদের বাড়ির সবাইও আছে। কিন্তু নোমান আসেনি। কোনো বিশেষ কাজে সে আটকে। কিছুক্ষণ পূর্বেই জুঁইকে পার্লার থেকে আনা হয়েছে। ঘরে তাকে ঘিরে বসে অনেকেই। ” বর এসেছে ” আওয়াজেই সবাই তাকে ছেড়ে নিচে চলে গেল। জুঁই একা বসে। হুট করেই ঘরে প্রবেশ করে নোবাইদ।
” আসমানের সব তারা খসে পড়ে যেন তার পায়,
চান্দের আলো ঠিকরে পড়ে, চাঁদবদন গায়। ”
কোনো পুরুষের কন্ঠের মিষ্টি আওয়াজে জুঁই হকচকিয়ে ওঠে। চোখ তোলেই নোবাইদকে দেখতে পায়। কপাটের এক পাশে হেলে দাঁড়িয়ে। হাতজোড়া বুকের মাঝে আড়াআড়িভাবে রাখা। ঠোঁটে মৃদু হাসি। জুঁই প্রথমে ভয় পেলেও পরক্ষণেই নিজেকে সামলে বলে,
” এসবের মানে কী? ”
” নিজের প্রেয়সীর সৌন্দর্যের ক্ষুদ্র প্রশংসা করার প্রয়াস। ”
” সৌন্দর্য দৃষ্টি সৃষ্টি। যার দৃষ্টি যত স্বচ্ছ, বিপরীত পক্ষের সৌন্দর্য তত বেশি। ”
নোবাইদ কোনো প্রতিউত্তর না করে ঠোঁট চেপে হাসে। জুঁই থমথম খেয়ে যায়। চাপা গলায় বলে,
” আমাকে প্রেয়সী বলবেন না। ”
” কেন? ”
” কারণটা আপনার অজানা নয়। ”
” চাঁদ, সূর্যের কী নিবিড় সম্পর্ক! একে অন্যের পরিপূরক। কিন্তু কেউই কারো সঙ্গ পায় না।৷ একজন আসে তো অন্যজন ভাসে। তোমার আমার গল্পটা বোধহয় তেমনি। ধরা যাবে না, ছোঁয়া যাবে না, ছাড়াও যাবে না। আমি তোমার প্রিয়তম হতে না পারি, কিন্তু তুমিতো আমার প্রেয়সী। ”
” আমায় ভুলে কেন যাচ্ছেন না? ”
” বিভোর আমি তোমার নেশায়, ভালো না বাসলেও কী আসে যায়! ”
ঠুকরে কেঁদে ওঠে জুঁই। এই ব্যথা অযাচিত, তবুওতো ব্যথা। নিঃশব্দে বেরিয়ে আসে নোবাইদ। চোখের কার্ণিশে জমেছে নোনাজল। কিন্তু তার বাইরে আসার অনুমতি কোথায়! চোখ তুলে সামনে তাকাতেই হকচকিয়ে ওঠে। দ্রুত হাতের কোণে মুছে ফেলে অন্তরের ব্যথা। কিন্তু ততক্ষণে সময়ের চাকা ঘুরে গেছে। তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে জান।
জুঁইয়ের কাছেই যাচ্ছিলো জান। কিন্তু ঘরে প্রবেশ করার আগেই নোবাইদের গলা তাকে থামিয়ে দেয়। বুঝতে অসুবিধা হয় না কী নিয়ে কথা হচ্ছে ভেতরে। জান হালকা আওয়াজে জিজ্ঞেস করে,
” এখানে কী করছো, ভাই? ”
নোবাইদ জান কিছু শুনেনি ভেবেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ে। হালকা হেসে জবাব দেয়,
” তেমন কিছু না। জুঁইকে শুভ কামনা জানাতে এসেছিলাম। ”
হু হু করে কেঁদে ওঠে জান। রুদ্ধ কন্ঠে বলে ওঠে,
” আর কত লুকোবে ভাই? তোমার কষ্ট হয় না? ”
নোবাইদ বুঝে গেছে জান সবটা শুনেছে। একটা লম্বা দীর্ঘশ্বাস টেনে জানের দিকে পূর্ণ দৃষ্টি মেলে তাকায়। মুখে হালকা সাজ নিয়ে, কালো শাড়িতে আবৃত তার ছোট পরীটাকে মোটেও আজ ছোট লাগছে না। চোখের লেপ্টানোর কাজল যেন তার পরিপূর্ণ নারী হওয়ার সাক্ষী বহন করছে। হাত বাড়িয়ে বোনকে বুকে আগলে নেয়। জানও ভাইয়ের স্পর্শ পেয়ে শব্দ করে কেঁদে ওঠে।
” আমার বোনটা চোখে নিমিষেই এত বড় হয়ে গেল, আর আমি খেয়ালই করিনি। ”
” ভাই, তুমি কথা ঘুরাচ্ছো? কেন বলোনি এতদিন আমায়? কিছু একটাতো করতে পারতাম। কমপক্ষে চেষ্টাতো করতে পারতাম। ”
জানের শব্দে অভিযোগ। নোবাইদ নিঃশব্দে হাসে। হুট করেই জান নিজেকে ছাড়িয়ে নেয়। সশব্দে বলে ওঠে,
” তবে এখনো দেরি হয়ে যায়নি। শেষ চেষ্টা করাই যায়। ”
নোবাইদ চমকে ওঠে। জান নিচে যাওয়ার জন্য পা বাড়ায়। নোবাইদ তাকে হাত বাড়িয়ে থামিয়ে দেয়। জান আবারো শব্দ করে কেঁদে ওঠে।
” তোমার সাথেই কেন এমন হবে ভাইয়া, কেন? ”
নোবাইদ জানের মাথায় ভরসার হাত রাখে। সান্ত্বনার স্বরে বলে ওঠে,
” সব পেয়ে গেলে জীবনের স্বাদ থাকে না। কিছু একটা অপ্রাপ্তি থাকা উচিত, তা পাওয়ার আশায় বাঁচা যায়। ”
জানের কান্না বাড়ে বৈ কমে না। নোবাইদ জানের মাথায় হাত বুলায়, স্বস্তির নিঃশ্বাস নেয়। একটু আগে জান কী করতে যাচ্ছিলো ভেবেই তার গা শিউরে ওঠে। আপনজনরা বোধহয় এমনিই হয়, এক পৃথিবী অশান্তির বিনিময়ে হলেও আপনজনের সুখ কিনতে চায়। কিন্তু তার এমন সুখ চাই না। তার প্রেয়সীর সুখে অন্যকারো বুকে, তার সুখ তার প্রেয়সীর হাসিমাখা মুখে।
—————————
বিয়ের সমস্ত রীতিনীতি শেষ। বিদায় হয়েছে কিছুক্ষণ পূর্বেই। হৃদয় বিষণ্ণ মুখে নিচে বাগানে নিজের বন্ধুদের সাথে কথা বলছিলো। বড় বোন মায়ের প্রতিরূপ। তার হুট করে দূরে যাওয়াটা বিকলাঙ্গ হওয়ার মতোই। অনেকেই ফিরে গেছে, বাকিরা বাগানে। হুট করেই হৃদয়ের জানের কথা মনে পড়ে। জান বাড়িতে একা আছে। নূরজাহান আহমেদ তাকে জানের কাছে থাকতে বলেছিলো। এসব ঝামেলায় সে ভুলেই গেছে। শরীর খারাপের অজুহাতে জান বিয়ের কোনো আনুষ্ঠানিকতাতেই থাকেনি। হৃদয় দ্রুত পায়ে ঘরে প্রবেশ করে। ঘরের সমস্ত লাইট বন্ধ। তবু বাইরে থেকে আশা হালকা আলোয় ভেতরকার সবকিছুই স্পষ্ট। হৃদয় সরাসরি জানের ঘরে চলে যায়। ঘরে প্রবেশ করেই হৃদয় হতবিহ্বল হয়ে যায়। সারা ঘর অন্ধকার। হৃদয় শব্দ করে জানকে ডাকে। কিন্তু কোনো সাড়া পায় না। ধীর পায়ে একটু এগিয়ে যেতেই পায়ে কিছু আটকায়। হৃদয় পাঞ্জাবির পকেট থেকে ফোন বের করে ফ্লাশ অন করতেই চমকে ওঠে। জান হাঁটু মুড়ে মুখে হাত দিয়ে ফ্লোরে বসে আছে। হৃদয় তার বাহুতে হাত রাখতেই সে চমকে ওঠে। পর মুহুর্তেই হু হু করে কেঁদে ফেলে। হৃদয় দ্রুত ঘরের আলো জ্বেলে দেয়। জানকে ফ্লোর থেকে তুলেই আলগোছে বুকে আগলে নেয়। জানও তাকে ঝাপ্টে ধরে। প্রচন্ড ভয় পেয়েছে বুঝাই যাচ্ছে। পরমুহূর্তেই এক ঝটকায় হৃদয়কে ছাড়িয়ে নেয়। হৃদয় অবাক হয়ে পুনরায় তাকে ধরতে এলেই সে চেঁচিয়ে ওঠে,
” আমাকে ছোঁয়ার সাহস দেখাবেন না।
কী মনে করেন আপনারা নিজেকে? যখন যা খুশি করবেন আর আমি মেনে নেবো? না, কখনো না। ভাঙতে শিখিনি আমি। ভেঙে গুড়িয়ে দিতে শিখেছি। আমাকে প্রোস্টিটিউবের মত ট্রিট করে, আমায় স্পর্শ করতে লজ্জা করলো না আপনার? ”
” আমি,,, ”
” আপনি কী আমি শুনতে চাই না। আপনার বলা একটা কথাও শুনতে চাই না। এখন আমি বলবো, আপনি শুনবেন। আপনার মনে হয় না আমাকে আমার ভাইয়ারা বিগড়েছে। হ্যাঁ বিগড়েছে, তো?আপনার কাছে যেটা বিগড়ানো আমার কাছে সেটা ভালোবাসা। আর আপনার কোনো অধিকার নেই আমার ভাইদের ভালোবাসার অপমান করার। কারো অধিকার নেই। তাদের ভালোবাসাই আমার শক্তি। আপনার কী মনে হয় আপনাকে বিয়ে করার জন্য আমি ইচ্ছে করে এসব করেছি? হাউ ফানি। আর আপনাকে আমি ভুলানোর চেষ্টা করছি? কেন আপনিকি ছোট বাচ্চা যে চকলেট দিলাম আর আপনি গলে গেলেন? বিয়েটা বড়দের ইচ্ছে মতো হয়েছে, আমি মেনে নিয়েছি। আপনার প্রতিটা আঘাত আমি মেনে নিয়েছি। প্রতিটা অপমান আমি মেনে নিয়েছি।কারন এটা আমার পরিবারের শিক্ষা।তার মানে এই নয় আমার কোনো আত্মসম্মান নেই। আসলে আপনাদের এসব সম্মান পাওয়ার কোনো যোগ্যতাই নেই। আর বিয়েটা আপনার সমস্যা তো? ঠিক আছে সেটাও মিটিয়ে দেবো।ডিবোর্স পেপার খুব তাড়াতাড়ি পেয়ে যাবেব। খুব দ্রুত। ”
পরমুহুর্তেই জান দুহাতে নিজের চুল আকড়ে ধরল। পাগলের মত বির বির করতে লাগল।
” আমি কী করে পারলাম এসব করতে? যে আজীবন আমার খুশির কারণ হয়ে এসেছে, তার জীবন এগোছালো হয়ে গেল। অথচ, আমি কিছু করতে পারলাম না। কিছু না। ”
হৃদয় অবাক হয়ে জানের কথা শুনছে। জান পাগলের মত ব্যবহার করছে। হৃদয় ভয়ে ভয়ে জানের হাতে হাত রাখল। জান হৃদয়ের বুকে এলিয়ে পড়ল। বিরবির করে বলতে লাগল,
” আমি খারাপ, খুব খারাপ। আমি স্বার্থপর। ”
হৃদয় সযত্নে জানকে আগলে নিলো। জানের কিছু হয়েছে সে বুঝতে পারছে কিন্তু সে এ বিষয়ে আপাতত জানকে কিছু বলতে চায় না বরং বুকের মাঝে আগলে রাখতে চায়। কিন্তু কেন তা সে জানে না।
চলবে।