তুমিময় আমি।
মার্জিয়া খাঁন নিহা।
পর্ব : ১১।
হৃদয় ব্যাগ গোছাচ্ছে। জুমা পেছনে দাঁড়িয়ে উশখুশ করছে। সময়টা বড্ড বেশি কেড়ে নিচ্ছে তার থেকে। না কিছু করতে পারছে, না ধরতে।
” ভাই, যাওয়াটা জরুরি? ”
” জরুরি বলেই যাচ্ছি। ”
শান্ত স্বরে হৃদয়ের জবাব।
” ভাই প্লিজ, এভাবে আর ভালো লাগছে না আমার। আপু পড়ে আছে এত দূরে। আর তুইও। একবার বাবা-মার কথাটা ভাববি না? ”
” তাদের কথা ভাবি বলেই তাদের থেকে দূরে থাকি। তোর কথা রাখতেই আমি বাড়িতে এসেছিলাম। কিন্তু ইট পাথরে ঘেরা এ বড় প্রাসাদে তাকে ছাড়া আমার কষ্ট হয় ভীষণ। ”
জুমা হতাশ হয়ে বেরিয়ে গেল। হৃদয় ব্যথাতুর হেসে মন দিল নিজের কাজে।
——————————-
বাম হাতে গিটার, সাদা শার্ট এর উপরে কালো ব্লেজার সাথে কালো জিন্স। ডান হাতের মুঠোয় আকড়ে রাখা হোয়াইট স্টোনের একটা ঘড়ি।পায়ে হোয়াইট সুজ। চোখে কালো সানগ্লাস।মাথায় ক্যাপ। আর মুখটায় রুমাল বাঁধা। চেহারা বোঝা যাচ্ছে না। হাঁটতে হাঁটতে নদীর পাড়ের একটা গাছের গুরিতে বসল সে। বাম পা পিছনে রেখে গাছের গুরির সাথে ঠেকিয়ে সে পায়ের হাঁটুতে একটা বাম হাত রাখা। অন্য হাতটা গিটারসহ অন্য পায়ে ঠেকিয়ে। দৃষ্টি কোন দিকে বোঝা যাচ্ছে না। কিন্তু নদী মুখো হয়ে বসে আছে।আশেপাশে বহু মানুষের আনাগোনা। কেউ তার দিকে অদ্ভুতভাবে তাকিয়ে আবার কেউ কেউ বা আপনমনে ছুটছে নিজের গন্তব্যে। কিন্তু তাতে ছেলেটির কোনো বোক্ষেপ নেই। সন্ধ্যা বিকেলের মাঝামাঝি সময়। পশ্চিমে সূর্য তার রক্তিম আভা ছড়িয়ে দিয়েছে। সে আভা উজ্জ্বল হয়ে ভাসছে নদের জলে। কী অপূর্ব দৃশ্য!
চিত্রানদ।
যশোরে মূলত এটি একটি উপশাখা।গোপালগঞ্জের চিত্রানদীর একটি শাখা। যা বুড়িগঙ্গাতে গিয়ে মিশেছে। খুব ছোট একটি নদ।নদের পূর্ব – পশ্চিমে রয়েছে বন জঙল। সময়টা শীতকাল হওয়াতে নদের পানি অনেকটা শুকিয়ে। নদের তীরেই চাষ করা রয়েছে সরিষার মতো বিভিন্ন শস্যাদি। এক সময় এই নদের ধারেই ছিল ছোট, মাঝারি আকারের পাথর।এইসব পাথরের পাতালের নিচ দিয়ে বয়ে যেতো শীতল পানি। সময়ের পেক্ষিতে এখন তা বিলুপ্ত প্রায়। যশোর বাংলাদেশের খুলনা বিভাগের প্রসাশনিক ও রাজনৈতিক গুরুত্বসম্পন্ন অঞ্চল। ব্রিটিশ আমলে খুলনা ছিল যশোর জেলার অধিভুক্ত মহকুমা। এখানের প্রকৃতি অনেক মনোমুগ্ধকর। অনেক সহজ সরল জীবন-যাপন এখানের মানুষের। এখানে প্রকৃতি দু-হাত মেলে আমন্ত্রণ জানায়। মোটকথা এখানে চাইলেই নিজেকে সময় দেওয়া যায় নিজের কর্মব্যস্তটা ভুলে।
সন্ধ্যা নেমে আসছে। চারপাশে হালকা কুয়াশা সাথে ঠান্ডা বাতাস। ফুরফুরে পরিবেশ। হঠাৎ কেউ ছেলেটিকে ডাকতেই সে উঠে দাঁড়ায়। বড় বড় পা ফেলে কুয়াশায় মিলিয়ে যায়।
তাবুতে ফিরেই গা এলিয়ে দেয় ছেলেটি। সাথে সাথে সাব্বির এসে প্রবেশ করে।
” শালা, কোথায় ছিলি? কখন থেকে খুঁজতেছি। ”
” এত আদর করে শালা ডাকলেও আমি আমার বোন দেব না। ”
” লাগব না তোর বোন, তুই ডাকাতের মত এমন বেশ নিয়ে ঘুরছিস কেন? ”
” একটু শান্তির খুঁজে। ”
সাব্বির চুপ করে পাশে বসে পড়ে। হালকা আওয়াজে বলে,
” হৃদয় এইভাবে আর কত? ভুলে যাচ্ছিস না কেন? ”
নিঃশব্দে হাসলো হৃদয়। ঠোঁটের কোণের হাসি বজায় রেখেই বলল,
” আমি ভুলতে চাইলেও তোরা আমায় ভুলতে দিবি না হারামি। আমি প্রকৃতি কথার বলছিলাম। আর তুই ওর কথা বলে ফেললি? তোরাও বুঝে গেছিস ও আমার আত্মার অংশ। যেখানে তোরা দূসম্পর্কের হয়েও ভুলতে পারিস না, সেখানে আমি কী করে ভুলি? ”
” চাইলে সব সম্ভব হৃদয়। তুই নিজেই ওর মায়া থেকে বেরুতে চাইছিস না। সেতো বেশ আছে তোকে ছাড়া। ”
” আমায় ছাড়া সে ভালো আছে তার কী গ্যারান্টি আছে? ”
” ভালো থাকার জন্যইতো ছেড়ে গেছে। ”
” কথাটা হয়তো সত্য নয়। দোষ থাকলে দুপক্ষেরই ছিলো। সে যেতে চেয়েছে, আমি বাঁধা দেইনি। তাইতো আজ আমাদের এত দূরত্ব। আর দূরত্ব, হৃদয়ে চিরস্থায়ী বসবাসের সর্বোৎকৃষ্ট পন্থা। ”
” তুই কি এখনো আশা রাখিস ও ফিরবে? ”
” আশা নয় বিশ্বাস। ওকে ফিরতে হবে। আমার ভালোবাসার জোরে কিংবা আমাকে শাস্তি দেওয়ার জন্য হলেও ওকে ফিরতেই হবে। ”
” পাঁচ বছর হৃদয়। সময়টা কম নয়। একটা মানুষ একেবারে অদৃশ্য। কমতো চেষ্টা করিসনি তাকে খোঁজার। ”
” সময়টা কম নয়। পাঁচ বছর একমাস দুদিন। আমার স্বপ্ন হয়তো মিথ্যে। কিন্তু সত্যিকার অর্থে কিছু মিথ্যে, অপূর্ণ স্বপ্নই মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে। ”
” তাকে ভুলতে না পারিস, নিজেকে ভালোতো রাখতে পারিস? ”
” আমার খারাপ থাকার সাথে তার কোনো সম্পর্ক নেই। বর্ষার বৃষ্টি সিক্ত কদম, শরৎকালের শিউলির মতোই প্রিয় ছিলো সে আমার। কিন্তু আমি কিছুতেই মানতে পারছি না ঐ সময়টাকে। আমার ছোট্ট কিছু ভুলের জন্য আজ যোজন যোজন দূরত্বে আমরা। সে ভুলগুলো না করলে ও আমার সাথে থাকতো, একদম কাছে। আর অনুশোচনার চেয়ে বড় কোনো শাস্তি হয় না। ”
” তোকে কী বলা উচিত আমি বুঝতে পারছি না। বিশাল বাংলা ভাষার সমৃদ্ধ ভান্ডার তোর সামনে প্রাণহীন। কিন্তু তোকে আমরা কেউ এভাবে দেখতে পারছি না। ”
” আমিও পারছি না। আমারো অন্তর পুড়ে ভীষণ। সবকিছু স্পষ্ট কিন্তু ধরা ছোঁয়ার বাইরে। তার সরোষ চোখ, ব্যথাতুর রাশভারি ঠোঁট, অভিমানে গাল ভারি,
তবে কেন মেঘলা আকাশটা একা আমারি? ”
পরক্ষণেই হৃদয় হন্তদন্ত হয়ে তাবুর বাইরে ছুটলো। সাব্বির কিছুই বুঝলো না। সে নিজেও হৃদয়ের পেছনে ছুটলো। হৃদয় ছুটে এসেই থামল নদের ধারে, যেখানে সে বসেছিলো তার আশেপাশে ব্যস্ত ভঙ্গিতে খুঁজে চলেছে। সাব্বির বার বার জিজ্ঞেস করেও কোনো উত্তর পায়নি। হণ্য হয়ে বালির মাঝে খুঁজে চলেছে। অবশেষে কাঙ্ক্ষিত বস্তুটি পেয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস নিলো। সাব্বির এগিয়ে এসে দেখতে পেল হৃদয়ের হাতের মুঠোয় ঘড়ি। সাব্বির বিরক্তির দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
” আবার? এটাকে হাতে পড়ে থাকলে কী হয়! তাহলেই এত হারায় না? ”
” মানুষ অনাকাঙ্ক্ষিত ভুল একবার করে, বার বার নয়। একবারের শাস্তি এখনো পাচ্ছি। আমানতের খেয়ানত করতে নেই। আর এটা তার আমানত। ”
সাব্বির আর কিছুই বলল না। তার ভেতর চিড়েও বেরিয়ে এলো আক্ষেপের দীর্ঘশ্বাস। তেতো মুখে সরোষ দৃষ্টিতে শূন্যে তাকিয়ে। ‘ প্রকৃতি এত নিষ্ঠুর কেন! ‘ এমন সময় তার ফোন বেজে উঠল। স্কিনের নামটা চোখের সামনে আসতেই তার অবচেতন মনে প্রশ্ন খেলে গেল, ‘ সে কি আমানতের খেয়ানত করছে? ‘ কল বেজে একসময় কেটে গেল। আবারো কল এলো একই নাম্বার থেকে। সাব্বির একবার হৃদয়ের দিকে তাকালো। হৃদয় তাবুর দিকে যাচ্ছে। মন মস্তিষ্কের খেলায় মনকে জয়ী ঘোষণা করে ফোন কানে তুলে নিলো সে। ঐ মানুষটাকে উপেক্ষা করার সাহস তার নেই। ফোন কানে তুলতেই ওপাশ থেকে ভেসে এলো এক মিষ্টি মেয়ের কন্ঠ স্বর,
” আসসালামু আলাইকুম। ”
” ওয়ালাইকুম আসসালাম। কেমন আছো? ”
” ভালো। হৃদয় ভাই কেমন আছে? ”
” ভালো। একবারোতো জিজ্ঞেস করলে না আমি কেমন আছি? ”
” আপনার ভালো থাকার দায়িত্ব আপনার। আমি জিজ্ঞেস করলেতো আর আপনি ভালো কিংবা খারাপ থাকবেন না! ”
” ওহ, হয়তো। আচ্ছা সবাইতো হৃদয়ের উপর রেগে আছে, তাহলে তুমি রোজ কল করে ওর খবর নেও কেন? তাছাড়া কলটাতো ওকে করলেও পারো। ”
” আপনাকে কল করি বলে কি আপনি বিরক্ত? ”
” না। তা বলিনি। কৌতূহল থেকে প্রশ্নটা করলাম। অনেকদিন থেকেই করতে চাইছিলাম কিন্তু সাহসের অভাবে করতে পারিনি। ”
” তাকে ঘৃণা করার সাধ্য আমার নেই। হয়েও না হওয়া অতি প্রিয়জন সে আমার। তার খোঁজ নেই অপরাধবোধ থেকে। তার এই পরিস্থিতির জন্য কোথাও না কোথাও আমি দায়ী। তাই বলে আপ্পিকেও আমি উপেক্ষা করতে পারি না। তথাপি তাকে সরাসরি কল করতেও মন সায় দেয় না। ”
” সবকিছুতো কত সুন্দর বুঝ, তবে আমায় কেন বুঝ না? ”
” আপনাকে বুঝারতো কিছু নেই। আমি আগেও বহুবার বলেছি, ভুলে যান আমায়। ”
” ভুলা কী এতই সোজা?
একটু একটু যে গড়েছে এতদিন
সে জানে ভাঙা, ভুলা কত কঠিন। ”
” আপনিতো রোজ হৃদয় ভাইয়াকে বলেন আপ্পিকে ভুলে যেতে। সে পারলে আপনি কেন পারবেন না? ”
” আমার বিলবোর্ড ধোঁয়াটে, ঘোলাটে।
তাই আমার গল্পটা অভ্যক্তই রয়ে যাবে
কাব্যময় সংলাপে
ভুল চিত্রপটে
ভাঙা দর্পণে
শব্দের প্রতিবিম্বে। ”
ওপাশ থেকে আর কোনো সাড়া পাওয়া গেল না। সাব্বির ফোন নামিয়ে পকেটে পুড়ে নিলো। সারাদিন সকলকে হাসিখুশি রাখা মানুষটা জানে
কত কষ্ট লুকিয়ে সে খুশি গুণে।
চলবে।