তবু মনে রেখো পর্ব ২

0
102

#তবু_মনে_রেখো
#নাজমুন_বৃষ্টি
#পর্ব_২

রাতে খেয়ে দেয়ে শুতেই কুসুম বোনকে জড়িয়ে নিল। সন্ধ্যা আলো আঁধারের মাঝে এক নজর বোনের দিকে তাকিয়ে জড়িয়ে ধরা হাতটার উপর হাত রাখলো। হারিকেনের আলো নিভু নিভু করছে। হয়ত জ্বালানি ফুরিয়ে আসছে।
“আপা, ঘুম আসছে না।”

সন্ধ্যা বোনের দিকে পাশ ফিরে বোনকে আগলে নিল। কুসুমের মাথার চুলে হাত বুলাতে বুলাতে বলল,
“এবার ঘুম আসবে। ঘুমিয়ে পড়।”

“আপা, একটা গল্প বলো।”

“কিসের!”জিজ্ঞেস করতেই কুসুমের মন নেচে উঠল। তার মানে আপা আজ গল্প শোনাবে।
“তোমার যেটা ভালো লাগে।”

“আমার তো রূপকথা পছন্দ।”
“তাহলে সেটাই বলো।” বলেই কুসুম ফিরলো বোনের দিকে।

সন্ধ্যা রূপকথার সাগরে হারিয়ে গেল। তারও ইচ্ছে করে রূপকথার রাজকন্যাদের মতো করে মুক্ত পাখির মতো বিচরণ করতে তারপর একটা সময় কোনো এক রাজপুত্র এসে ভালোবাসার চাঁদরে মুড়িয়ে নিয়ে যাবে।
সন্ধ্যা হাসলো! এসব কী ভাবছে সে! রূপকথার জীবন কী কোনোদিনও মানুষ পায়!
বেশ কিছুসময় পরে সে গল্প শেষ করে পাশ ফিরতে গিয়েই খেয়াল করলো কুসুম তাকে জড়িয়ে ধরা অবস্থায় ঘুমিয়ে পড়েছে। সন্ধ্যা হেসে বোনকে আরো আগলে নিল। পাশ ফিরে হারিকেন বন্ধ করতে নিতেই অনুধাবন করলো তাদের বাড়ির পেছনে কেউ হয়ত হাঁটছে।
সন্ধ্যার মনে মনে আওড়ালো,’এতো রাতে পেছনে মানুষ!’
সে পাত্তা দিল না। বাড়ির আশেপাশে ইদানিং মানুষের আনাগোনা বেড়েছে। কী জানি! হয়ত শীতের রাত তাই চোরের উপদ্রব বেড়েছে।
সন্ধ্যা কুসুমকে ডিঙিয়ে হারিকেন নিভিয়ে বোনকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে পড়লো। রাত গভীর থেকে গভীরতর হচ্ছে কিন্তু তার চোখে ঘুম ধরা দিচ্ছে না। চারদিকে থেকে নীরব রাতের ঝিঁঝি পোকার ডাক ভেসে আসছে। তার ইচ্ছে করলো এক দৌড়ে বাইরে গিয়ে এই নিশ্চুপ পরিবেশটা উপলব্ধি করতে। তার মাঝে মাঝে ইচ্ছে হয় মুক্ত পাখির মতো অন্যদের মতো করে বাইরে বিচরণ করতে কিন্তু বাবার কড়া নিষেধে সে পেরে উঠে না।
মাঝে মাঝে বোনের উছিলায় বের হওয়া হয়। এইতো যেমন আজকের রাতেও সে বের হয়েছে। কুসুমের জন্য সে নিজেও একটু খোলা বাতাস গায়ে লাগাতে পেরেছে। হোক না রাত! তবুও সুন্দর অনুভূতি তো পেল! এসব ভাবতেই সেই কণ্ঠস্বরটার কথা মনে পড়ে গেল। এই প্রথম কোনো পুরুষের কাছাকাছি অবস্থান করেছিল সে।
———
মুহিব নড়েচড়ে বেশ কিছুক্ষন ঘুমানোর চেষ্টা করলো কিন্তু ঘুম যেন আজ তার সাথে আড়ি করেছে। বারবার চোখ বন্ধ করতে নিতেই চোখের সামনে ভেসে উঠছে সেই হারিকেনের হলদে আলোয় জ্ব’ল’জ্ব’ল করা চেহারাটা। মুহিব শোয়া থেকে উঠে বসলো। সে উঠে মাথা চেপে ধরলো। না, চোখের সামনে থেকে যেন সেই চেহারাটা সরছেই না। আরেকবার মেয়েটিকে দেখতে পেলে শাস্তি দেওয়া দরকার যে তার ঘুম হারাম করার জন্য। মুহিব হাসলো। আচ্ছা, তখন মেয়েটি জবাবে কী দিবে! মুহিব নিজের উপরেই হাসলো। সে কী বাচ্চা হয়ে গেল নাকি!
সে খাট ছেড়ে উঠে দরজা খুলে বেরিয়ে এলো। তার ঘরটা মূলত সে নিয়েছে ছাদে। বাইরে থেকে আসলে সে এই ঘরটায় থাকে। এতে মায়ের অনেক রাগ। কিন্তু মুহিবের এটাই পছন্দ। এতো বড়ো ছাদের একাংশ জুড়ে শুধুমাত্র তার এই ঘরটাই আছে। আর বাকী ছাদ খালিই পড়ে থাকে। মুহিব দরজা খুলে খোলা ছাদের একদম কর্নারে গিয়ে দাঁড়ালো। আজ চাঁদ যেন তার কিরণ উপচে দিয়েছে। সম্পূর্ণ ছাদজুড়ে পূর্ণিমার আলোর ছড়াছড়ি। বোঝায় যাচ্ছে, রাত বেশ গভীর। চারদিকে নিস্তব্ধতায় ঘেরা। আর গ্রামে তো মানুষ এমনিতেও খুব তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে যায়। চারপাশে থেকে জোনাকি দেখা যাচ্ছে। আলো আঁধারের মাঝে জোনাকিগুলো দেখতে বেশ মনোমুগ্ধকর লাগছে। মুহিব আকাশের দিকে তাকালো। দুয়েকটা ফানস এখনো চোখে পড়ছে। আজ বৌদ্ধ পূর্ণিমা তাই সন্ধ্যা থেকেই আকাশটা আলাদা সৌন্দর্যে ভরপুর ছিল। মুহিব ছাদের একদম শেষাংশে গিয়ে দাঁড়ালো। পরিবেশটাকে কুয়াশা তার চাঁদরে মুড়িয়ে দিয়েছে। চারদিকে দেখে মনে হচ্ছে কোনো ভুতুড়ে পরিবেশ। মুহিব ট্রাউজারের পকেটে হাত পুড়ে সামনের দিকে দৃষ্টি দিল। তার ঠান্ডা অনুভব হলো কিন্তু রুমে যেতে ইচ্ছে হলো না। সে চারপাশে নজর দিল। যেদিকে তাকাচ্ছে ওই মেয়েটির চেহারা ভাসছে। মুহিব হাসলো। সে কী প্রেমে পড়লো নাকি! আশ্চর্য! তার মতো একটা ছেলে এই গ্রামেরই মেয়ের প্রেমে পড়েছে। তার সেই এতদিনের কাংক্ষিত মানুষটি যে তারই পাশে লুকিয়ে আছে সে সেটা উপলব্ধিও করতে পারেনি।
মুহিব হাসলো। আকাশের অর্ধ চাঁদের দিকে দৃষ্টি দিয়ে বুলি আওড়ালো,’মেয়ে তোমাকে তো আমার করে নিবোই। শাস্তির জন্য তৈরী থেকো।’
মুহিবের মুখে লেপ্টে আছে মুচকি হাসি।

আস্তে আস্তে সকাল ফুটতে শুরু করেছে। সন্ধ্যার ঘুম অনেক আগেই ভেঙে গিয়েছে। চারদিক থেকে সকালের মিষ্টধ্বনি আজান ভেসে আসছে। সে উঠে বসলো। কুসুমের দিকে দৃষ্টি দিতেই হাসি পেল। তার এক হাত জড়িয়ে ধরে ঘুপটি মেরে বিড়াল ছানার মতো আদুরে ভঙ্গিমায় ঘুমিয়ে আছে সে। সন্ধ্যা এগিয়ে গিয়ে বোনের মাথায় পরম আদরে হাত বুলিয়ে বার দুয়েক ডাকলো। কিন্তু কুসুম নড়েচড়ে বিরক্তি সূচক শব্দ তুলে পাশ ফিরে গেল।
সন্ধ্যা হাসলো। সে বালিশের পাশ থেকে উড়নাটা নিয়ে ভালোভাবে গায়ে জড়িয়ে নিল। এরপরই উঠে গিয়ে হারিকেনটা ধরালো। যদিওবা সকালের আজান পড়ছে কিন্তু এখনো অন্ধকার ভাবটা আছে বিধায় এটা জ্বালালো। সে হারিকেন ধরিয়েই ঘরের দরজা খুলে উঠানের কলপাড়ে এগিয়ে গেল। সে জানে, আব্বা দেখলে বকা দিবে কিন্তু সকালের এই স্নিগ্ধ মোহময়ী বাতাসটা সে অনুভব করতে চায়। তাই তো ঘরে বারান্দার বালটিভর্তি পানি থাকা সত্ত্বেও কিছুটা দূরের এই কলপাড়ে আসে। যদিওবা পুরো গ্রাম এসময় নিশ্চুপ থাকে। নিশ্চুপ থাকে বিধায় সন্ধ্যা এ জায়গাতে এসময় আসে, নয়তো আসতো না।
সন্ধ্যা এগিয়ে এসে হাতে থাকা হারিকেনটা রাখলো। এরপর কল থেকে সতেজ ঠান্ডা পানি দিয়ে ওযু করে নিল।
চারদিকে থেকে তখনো অনেক মসজিদ থেকে আজানের শব্দ কানে আসছে। সে ওযু করে ঘরে ফিরেই নামাজ আদায় করে নিল। এরপর আবারো সেই একই জায়গায় গিয়ে দাঁড়ালো। এই কলপাড়ের পাশ আর কোনো বাড়ি নেই। এর পাশে কতগুলো গাছ সারি সারি দাঁড়িয়ে আছে। এরপর পরেই বিলের শুরু। দেখতে মনে হয়, প্রকৃতি যেন গাছ দিয়ে সীমানা দিয়ে দিয়েছে। মানে তাদের এই বাড়িটাই গ্রামের শেষপ্রান্তে। ভোরের এই স্নিগ্ধ আলো আঁধারে সবুজ বিলগুলো দেখতে অদ্ভুত সুন্দর লাগে। অদূরে এই বিলের মাঝে দিয়ে একটা সরু রাস্তা চলে যায়। সে রাস্তা দিয়ে ভোর ফুটতেই মাঠের মানুষগুলো কাঁধে লাঙ্গল, যার যার প্রয়োজনীয় জিনিস নিয়ে চলে যায়। সন্ধ্যার এসব দেখতে ভালোই লাগে।

——
মুহিবেের চোখের সামনেই চারদিকে আলোকিত হতে লাগলো। শহরে এমন অনেকবার পড়তে পড়তে বা বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতে দিতে চোখের সামনে দিন হয়ে গিয়েছে কিন্তু আজকের মতো সুখ সুখ অনুভূতি আর কোনো সময় হয়নি। মুহিব লম্বা শ্বাস ফেলে জ্যাকেট নিয়ে নেমে পড়লো। এরপরই ঘরের দরজা খুলে বেরিয়ে গেল। আজ সে নিজের গ্রাম দেখবে। ছোট থেকেই শহরে পড়াশোনার জন্য থাকা বলে কোনো সময় ঐভাবে নিজের গ্রামের সৌন্দর্য দেখা হয়নি। মুহিব বিলের মাঝে সরু রাস্তা দিয়ে হাঁটতে লাগলো। চারদিকে সবুজ। কুয়াশার চাদরে মুড়ে রেখেছে পুরো গ্রামটা। সে চারদিকে তাকালো। আজ মনে হচ্ছে, তার গ্রামের চেয়ে সুন্দর আর কোনো জায়গা নেই।
সন্ধ্যা বিলের পাশে চাঁদর ভালোমতো গায়ে জড়িয়ে দাঁড়িয়ে রইল। হাল্কা শীত শীত অনুভূতি হচ্ছে কিন্তু তার ঘরে যেতে ইচ্ছে করছে না। কেননা এখন ঘরে গেলেই সারাদিনের জন্য আর বেরোনো যাবে না। তাই সন্ধ্যা এই মুহূর্তটা বাদ দিতে চায় না। শীতের সকাল তার ভারী প্ৰিয়। সে খালি পায়ে বিলের ধারে নেমে গেল। নেমেই খালি পায়ে ঘাসের উপরে পা’গুলো নড়াচড়া করতে লাগল। ঘাসের উপর জমে থাকা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র শিশিরকণা গুলো পায়ে লাগলে বেশ লাগে। তার খুশি খুশি অনুভূতি হয়।

মুহিব আশেপাশে গ্রামের সৌন্দর্যে আটকে গিয়েছে। চোখ ফেরাতেই দেখতে পেল সেই কাংক্ষিত মুখটি। চাঁদর মুড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এ যেন প্রকৃতির মাঝে আরেক সৌন্দর্য। মুহিব উৎফুল্ল হয়ে উঠল। আজকের সকালটি এতো সুন্দর!

#চলবে ইন শা আল্লাহ।
(আসসালামু আলাইকুম। গ্রাম্য প্লটে লেখার চেষ্টা গল্পটা তাই ভুলভ্রান্তি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। অগোছালো হওয়ার জন্য দুঃখিত।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here