তবু মনে রেখো পর্ব ১৩

0
80

#তবু_মনে_রেখো
#নাজমুন_বৃষ্টি
#পর্ব_১৩

সন্ধ্যা পেরিয়ে ধরণীর বুকে রাত ঘনিয়ে আসলো। তিনদিকে বিলের শুরুতেই দোচালা বাড়িটাতে চিন্তার শেষ নেই। বাড়ির কর্তা হাসি হাসি রবে উৎফুল্ল, কীভাবে মান সম্মানের সহিত মেয়েকে পাড় করিয়ে দিবেন সেই চিন্তা। আর বাকী তিনজন! একজন ছোট, না বুঝলেও সেও কিছুটা হলেও বুঝতে পারছে,তার উৎকণ্ঠা তার আপা যেন সুখী হয়, আবারো আগের মতো চঞ্চল হয়ে যায়। আর দুজনের চোখে খুশির রেশটুকু নেই। জোহরার চিন্তা, কখন রাত নামবে আর মেয়েটাকে সহীহ সালামতে পাড় করিয়ে দিতে পারবে। এতবড়ো সিদ্ধান্ত তার একারই নিতে হলো। আর সন্ধ্যা! সব চিন্তার চেয়ে বড়ো চিন্তাতে সেই আছে। তার চিন্তা, সে কী আদৌ পারবে!

রাত ৯টা। গ্রামের রাত ৯টা মানে গভীর রাত। প্রতিটা ঘরে ঘরে সবাই খেয়ে শুয়ে পড়ার উপক্রম। আস্তে আস্তে সম্পূর্ণ গ্রাম নীরব- নির্জীবতায় ঢেকে গিয়েছে। কিন্তু ঘুম বা স্বস্তি কোনোটায় নেই একটি ঘরে। গ্রামের একদম শুরুর দোচালা ঘরটাতে হারিকেনের হলদে আলো দেখা যাচ্ছে। মৃদু আলো জানান দিচ্ছে হারিকেনটাও হয়ত ক্লান্ত। এই ঘরের মানুষগুলোর মতোই। সন্ধ্যা শেষবারের মতো চিঠির কারুকার্যের বক্সটার উপর হাত বুলিয়ে দিল। এরপর কালি নিয়ে আরেকটি চিঠি লিখতে বসলো।
এই চিঠিতে লিখেছে কাল তার বিয়ে।
সন্ধ্যা ফিরতি চিঠির আশা করলো না। যেদিন অঘটনটা ঘটেছে সেইদিন রাতেই সে মুহিবের জন্য চিঠি দিয়েছিল। পরেরদিন সকালে কুসুমকে দিয়ে ডাকপিয়নের কাছে পৌঁছে দিয়েছিল। সন্ধ্যা দ্বিতীয় চিঠিটাতে পুরো ঘটনাটা বর্ণনা করেছিল। একটা আশায় ছিল যে মুহিব হয়ত আসতে না পারুক, একটা ফিরতি চিঠি হলেও দিবে। একটা না একটা পথ সে বের করবেই কিন্তু না। মুহিবের কাছ থেকে কোনোরূপ চিঠি আর আসেনি। সন্ধ্যা প্রথমে ভেবেছিল চিঠি হয়ত পৌঁছোয়নি কিন্তু ডাকপীয়ন আশস্থ করেছেন চিঠি মুহিবের লেখা ঠিকানাতে ঠিকমতোই পৌঁছে গিয়েছিল। হয়ত মুহিব কোনোকারণে চিঠিগুলো দেখেনি। সন্ধ্যা জানে, চিঠিগুলো পড়লে মুহিব নিশ্চই কোনো পথ বের করে দিতো। তাহলে এই কঠিন পথটা তারা দুজন একসাথে পাড় করতে পারতো। কিন্তু এসবের কিছুই হলো না।
সন্ধ্যা চিঠিটা লিখেই ক্লান্ত পরিশ্রন্ত ভাবে হাতে কালি নিয়েই চিঠিটার উপর দুহাত দিয়ে বসলো। সে চোখ বন্ধ করে নিল।
কতই না সুন্দর ভাবে সব চলছিল! অথচ আজ সব ভিন্নদিকে ঘুরে গিয়েছে। হয়ত সবকিছু শেষ হতে চলেছে খুব তাড়াতাড়ি। কী হতো যদি তাদের মিলনটা সুন্দরভাবেই হতো! মুহিব পরীক্ষা শেষে ফিরে আসতো! এরপর পরিবার পরিজন নিয়ে সন্ধ্যার জন্য বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসতো। খুব হাসিখুশিতে তাদের সেই সুখটা ধরা দিতো কিন্তু এখন আর এই কোনোটারই হবার নয়।
সন্ধ্যা কল্পনায় আনার চেষ্টা করলো। তাদের কল্পনার সেই সুন্দর পথচলা কী শেষ! কী হতো যদি না তাদের পথচলাটা ভাবনার মতোই সুন্দর হতো! খুব বেশি কী চাওয়া ছিল এটা! সন্ধ্যা তার ছোট মস্তিষ্ক দিয়ে হাতড়ে খোঁজার চেষ্টা করলো। না তো। খুব তো বেশি কিছু চাওয়ার ছিল না। তবুও নিয়তি কেন এতো নিষ্ঠুর হলো!
এই পর্যন্ত মুহিবকে তিনটি চিঠি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু একটিরও জবাব নেই। তিনটি চিঠিতে সে তার অবস্থান জানিয়ে দিয়েছে। একটিতে তার অঘটন, আরেকটিতে তার কাল বিয়ে। আর এটাতে সে চলে যাচ্ছে।
এটাই হয়ত শেষ চিঠি। আর কোনো চিঠি সন্ধ্যার তরফ থেকে যাবে না। না, কোনো অভিমানের জন্য নয়। আজ যদি সে এখান থেকে চলে গিয়ে বেঁচে থাকতে পারে তবেই সে যোগাযোগ করবে।
এই গ্রামেরই স্টেশনে রাত ১১টার ঢাকা গামী বাস যায়। আজ কিছুক্ষন পরেই সন্ধ্যা রওনা দিবে। সে জানে না সে কীভাবে থাকবে! কিন্তু এটা ছাড়া আর উপায় নেই।
বেশ কিছুক্ষন পরে সন্ধ্যা ফিরে তাকালো। তার অবচেতন মন জানান দিচ্ছে, কেউ একজন তার পেছনে এসে তার দিকে মায়াভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আর সেই একজনটা হচ্ছে একমাত্র তার মা। তার পুরো পৃথিবী। তার প্রিয় একটা অংশ। এই মানুষটিকে ছাড়া সে থাকবে কীভাবে তা জানা নেই কিন্তু থাকতে তো তাকে হবেই। অন্তত এই মনের বিরুদ্ধে গিয়ে অন্য একজন খারাপ মানুষের সাথে তার জীবনটা সে জড়াবে না।

জোহরা এগিয়ে এসে আচমকা মেয়েকে জড়িয়ে ধরে ডুকরে উঠলেন। সন্ধ্যা বসা অবস্থায় মায়ের কোমর চেপে জড়িয়ে ধরে চোখ বুজে নিল। সে জানে না আর মায়ের এই ঘ্রান নিতে পারবে কিনা! ডুকরানোর শব্দ শুনে সে মাথা তুলে মায়ের দিকে তাকালো। না, তার মা তো কান্না করছে না। তবে কী এটা তার অবচেতন মনের ধারণা। কিন্তু সে জানে তার এই ধারণা সঠিক। তার মা কান্না করেছে। মেয়ের সামনে কান্না না করার বৃথা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে আর তাতে তিনি সফল হলেও সন্ধ্যা কিন্তু ঠিকই বুঝতে পেরেছে।
জোহরা মেয়ের দুগালে পরম আদরে হাত রেখে মেয়ের অশ্রু মুছে দিলেন।
এরপর ফিসফিস কণ্ঠে শুধালেন,
‘একদম কান্না নয়। তুই ঢাকায় গিয়ে খুব ভালোভাবে বাঁচবি মা। তোর মামা তোকে ফিরিয়ে দিতে পারবে না। মামা তোকে খুব ভালোবেসে পড়াশোনা করাবেন। আগলে থাকবি ওখানে। বাবার আদর কিছুটা হলেও উপলব্ধি করতে পারবি। মানুষের মতন মানুষ হো মা।’
সন্ধ্যা জোহরাকে জড়িয়ে নিল। জোহরাও মেয়েকে আরো চেপে জড়িয়ে নিলেন। যেন মনে হচ্ছে, ছেড়ে দিলেই মেয়েটা তার কাছ থেকে অনেক দূরে চলে যাবে। সে তো চায় না এই মেয়েটা তার কাছ থেকে দূরে সরুক। কিন্তু উপায় যে আর নেই। তার মেয়ের জীবন বাঁচাতে হলে তাকে যে এই ত্যাগ করতেই হবে। তাদের মা মেয়ে দুজনকেই।
——
মুহিব সামনে বই নিয়ে বসে আছে।পরপর দুইটা পরীক্ষা দিয়ে সে ক্লান্ত। কালকের পরীক্ষাটাও অনেক কঠিন। সে দীর্ঘক্ষণ যাবৎ মনের সাথে যুদ্ধ করে মাত্র কয়েকটা প্রশ্নের উত্তর করতে সক্ষম হয়েছে অথচ এর আগে এমন পরিস্থিতি তার হয়নি। আজ তিনদিন যাবৎ সে শ্বাস ফেলারও সময় পায়নি। আর কালকে এমন একটা পরীক্ষা আর সে কোনোমতে বইয়ে মন দিতে পারছে না। বারবার চোখের সামনে শুধু সন্ধ্যার চেহারাটা ভেসে উঠছে। মুহিব ভাবনা থেকে সন্ধ্যাকে সরিয়ে বইয়ে মন দেওয়ার চেষ্টা করলো। কিন্তু এবারও সে ব্যর্থ। মুহিব মাথা চেপে বইয়ের উপর বসে রইল। এরপর সামনের খোলা জানালার বাইরে দৃষ্টি দিয়ে আপনমনেই আওড়ালো,’তুমি আমার সাথে সাথে আমার মস্তিষ্কটাকেও হাত করে ফেললে।’ বলেই মুচকি হাসলো।
সে বইয়ে আবারো মনোযোগ দেওয়ার চেষ্টা করলো। কিন্তু একইভাবে আবারো ব্যর্থ হলো। মাথা থেকে কিছুতেই সন্ধ্যার কথা সরছেই না। আজ এমন কেন মনে হচ্ছে! সন্ধ্যা ভালো আছে তো! এই কথাটা নিজের মনে আওড়াতেই সন্ধ্যার জন্য তার খারাপ লেগে উঠল। সন্ধ্যাকে সে কথা দিয়েছিলো চিঠি দিবে কিন্তু পরীক্ষার চাপে আর দেওয়া হয়ে উঠেনি। অথচ সে আসার সময় বলেছিল, প্রতিদিন চিঠি দিবে। জানে না মেয়েটা কেমন অভিমান করে আছে! এটা ভাবতেই সন্ধ্যার অভিমানী চেহারাটা মুহিবের কল্পনায় হানা দিল। মুহিবের অনুশোচনা হলো। মেয়েটাকে যে সে বড্ড ভালোবাসে। কালই একটা চিঠি দিয়ে মন ভালো করে দিবে। মুহিব ঠিক করলো, কালই সে পোস্টঅফিসে গিয়ে সন্ধ্যা আর পরিবারের জন্য চিঠি পাঠাবে আর চিঠি জমে থাকলে তাও নিয়ে আসবে। কে জানে! বাবা কতগুলো চিঠি দিলো! মুহিব সামনের বই সরিয়ে চিঠি লিখতে বসলো। মুহিব জানে, সন্ধ্যা এতো সব অভিমানের মাঝে তার একটিমাত্র চিঠিতে অভিমান ভুলে যাবে।
——

আজগর শেখ খেয়ে উঠতেই আসমা বেগম জিজ্ঞাসা দৃষ্টিতে বলে উঠলেন,
‘বিয়ে কী কাল?’
আজগর শেখ জবাব দিলেন না। আসমা বেগম কিছু মনে করল না। তার স্বামীকে বিয়ের পরে থেকেই এরকমই দেখে আসছে। স্বামীর নীরবতাকে সে ধরে নিল তার কথায় ঠিক। আসমা বেগম আবার শুধালেন,
‘মুহিবকে একবার বলা উচিত ছিল না?’

আজগর শেখ চেয়ার ছেড়ে রুমের দিকে পা বাড়াতে বাড়াতে জবাব দিল,
‘পরীক্ষার মাঝে মুহিবকে বিরক্ত করা লাগবে না। একেবারে পরীক্ষা দিয়ে আসুক। আর এটাতো এতো ধুমধাম করে হচ্ছে না।’

——-

ঘড়ির কাঁটা নড়ে উঠতেই জোহরা আধ পুরোনো জুলন্ত ঘড়িটার দিকে দৃষ্টি দিল। ১০টা বাজতে চলল। বাস ছাড়তে আরো একঘন্টা বাকী কিন্তু সে কোনোরকম রিস্ক নিতে চায় না। সে মেয়েকে আগেভাগে বাসে বসিয়ে ঘরে ঢুকতে পারলেই শান্তি। জোহরা তাড়াতাড়ি মেয়েকে ছেড়ে আনিস মিয়ার ঘরের দিকে উঁকি মেরে আসলেন। না, স্বামী তার ঘুমাচ্ছে। কুসুমও গভীর ঘুমে। সন্ধ্যা বোনের দিকে এগিয়ে গেল। এই বোনটাকে সে কোলেপিঠে করে মানুষ করেছে। বোনটাকে ছেড়ে সে কীভাবে থাকবে! এতসব ছেড়ে আদৌ পারবে তো! কুসুম তো চলতে ফিরতে আপাকে খুঁজে। আপাকে ছাড়া নিজেকে অভ্যাস করতে পারবে তো মেয়েটা! সন্ধ্যা বোনের গালে হাত বুলিয়ে দিল। শেষ কয়েকদিন ধরে মেয়েটা একদম ভালো হয়ে গিয়েছে। যেন সে সব বুঝে গিয়ে আপাকেও আপার মতো থাকতে দিয়েছে। সন্ধ্যা কুসুমের কপালে চরম আবেশে চুমু দিয়ে অশ্রুমাখা কণ্ঠে ফিসফিস করে বলে উঠল,’তুই ভালো থাকিস বোন।’
জোহরা চাঁদরে মুখ ঢেকে মেয়েকে বোনের কাছ থেকে টেনে তুললেন। তিনি বারবার স্বামীর রুমের দিকে উঁকি ঝুকি মেরে সন্ধ্যাকে তাড়া দিলেন।
ফিসফিস কণ্ঠে শুধালেন,
‘আয় তাড়াতাড়ি। বাস ছেড়ে যাবে।’
সন্ধ্যা বোনকে জড়িয়ে ধরে মায়ের দিকে তাকালো। এরপর অনুরোধের সুরে অনুনয় করে বলে উঠল,
‘মা, আমি এই মেয়েটাকে ছাড়া কীভাবে থাকবো! ও তো আমাকে ছাড়া কিছু বুঝে না।’
জোহরা মেয়ের দিকে তাকালেন। তিনি জানেন, মেয়ে বৃথা মায়ার কথা বলছে। যেটা হবার নয়।
সন্ধ্যা আরেকবার বোনের দিকে ফিরে তাকালো। ফিরে তাকাতেই দেখল, ঘুমন্ত কুসুম জেগে উঠেছে। সে চোখ মেলে আপার দিকে তাকিয়ে রইল। আপার চুমু অনুভব করেই সে জেগে উঠেছে।
কিন্তু সে জেগে আপাকে কোনো প্রশ্ন করলো না। চুপচাপ আপাকে জড়িয়ে ধরে ভরসা দিল। তা দেখে সন্ধ্যা কান্নার মাঝে হেসে মায়ের দিকে তাকালো।
‘দেখেছো মা? আমাদের কুসুম কী বুঝদার হয়ে যাচ্ছে!’
সন্ধ্যা শেষবার বোনকে আগলে কপালে চুমু এঁকে দিল। এরপর একটা চিঠি বোনের হাতে গুঁজে দিল। কুসুমও বুঝে নিল যে ডাকপীয়ন এলে চিঠিটা উনার হাতে দিতে হবে। এরপর মা মেয়ে দুজনেই বেরিয়ে গেল।
কুসুম যতদূর মা বোনের অস্তিত্ব দেখা যায় ততদূর তাকিয়ে রইল। অন্ধকারে তেমন কিছু বোঝা যাচ্ছে না কিন্তু সে আন্দাজে তাকিয়ে রইল। এরপর চোখ মুছে ফিরতে গিয়ে চমকে গেল। আনিস মিয়া দাঁড়িয়ে আছে।

#চলবে ইন শা আল্লাহ।
(আসসালামু আলাইকুম। আর মাত্র দুইটা মতো পর্ব হবে হয়ত। রিচেক করা হয়নি। ভুল ভ্রান্তি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখার অনুরোধ।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here