তবু মনে রেখো পর্ব ১

0
138

“কে তুমি? এই রাতে আমাদের এখানে কী করছো?”
পেছনে থেকে আকস্মিক অচেনা গম্ভীর কণ্ঠ শুনে সন্ধ্যা ভড়কে গেল। সে আর পা বাড়াতে পারলো না। কে! এই বাড়ির ছেলে না-কি! বাবা তো এজন্যই দিনে বের হতে দেয় না কিন্তু রাতেও যে এমন হবে কে জানতো! এমন আকস্মিক পুরুষের কণ্ঠস্বর শুনে সে ভেতরে ভয়ে কুঁকড়ে গেল। মাথার কাপড়টা এক হাতে টেনে ধরে চেহারা ভালোভাবে ঢেকে নিলো। আরেক হাতে হারিকেনটা শক্ত করে ধরে রাখলো। যদিও পূর্ণিমার আলো হাল্কা আছে কিন্তু তবুও মা জোর করে হারিকেনটা ধরিয়ে দিয়েছে।

পূর্ণিমার চাঁদের হাল্কা আলোতে হারিকেন নিয়ে একটি মেয়েলি অবয়ব। চাঁদর দিয়ে মুখ ঢাকা। মুহিব দুপা এগিয়ে গেল। এমন নিশ্চুপ, নির্বাক ভঙ্গিমা সে সহ্য করতে পারে না।
“কে তুমি? কী হলো! কথা বলছো না কেন?”
বিগত কয়েকদিন আগে সে ছুটিতে এসেছে। কিন্তু বাইরে থেকে বাসায় ঢুকতে গিয়েই এই প্রথম অচেনা প্রতিবিম্ব দেখে সে থমকে দাঁড়িয়েছে।
সন্ধ্যা আলো আঁধারে ঠায় দাঁড়িয়ে রইল। সে কী করবে ভেবে পেল না। পালিয়ে যাবে কী!
গোমটা পরিহিত হারিকেন নিয়ে মেয়েটিকে অদ্ভুত লাগছে। মনে হচ্ছে কোনো অশ্ররীরী দাঁড়িয়ে আছে কিন্তু মুহিব সেদিকে পাত্তা দিল না। মেয়েটি পালিয়ে যেতে পা বাড়াতে নিতেই মুহিব আরো সামনে এগিয়ে গেল।

“এই মেয়ে! এদিকে ফিরো।”
সন্ধ্যা ফিরলো না। মুহিব নিজেই সন্ধ্যার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। যদিওবা রাত কিন্তু পূর্ণিমার হাল্কা আলো আছে আর মেয়েটির মুখের সামনে থাকা হারিকেনের আলোতে সবকিছু আরো বেশি স্পষ্ট। মেয়েটা তার গায়ের চাঁদর দিয়ে মুখ ঢেকে রেখেছে বলে চেহারা দেখা যাচ্ছে না। মুহিব পর্যবেক্ষণ করলো। এরূপ গঠনের মেয়ে এর আগে সে এ পাড়ায় দেখেছে বলে মনে হচ্ছে না। এরূপ অচেনা মেয়ে তাদের বাসার উঠানে কী করছে সেটা জানার জন্য তার আরো আগ্রহ বেড়ে গেল।
সন্ধ্যা চাঁদরের আড়ালে তার সামনে আকস্মিক দুটা পা এসে দাঁড়াতেই হকচকিয়ে পিছিয়ে গেল। সে কিছু বলতে মুখ খুলতে নিতেই ছোটবোনের ডাকে থেমে গেল।
পেছনে থেকে কুসুম এসে সন্ধ্যার পিছের চাঁদরের কোনা ধরে টান দিতেই তার মাথা থেকে চাঁদরের আঁচল নিচে পড়ে গেল। চাঁদর সরতেই খোলা মাথা বেরিয়ে এসেই ফর্সা-সুন্দর চেহারাটি হারিকেনের আলোতে জ্ব’লজ্ব’ল করে উঠল। কৃত্রিম আলোর পাশাপাশি চাঁদের আলোয় ভালোই স্পষ্ট সব।

সন্ধ্যা তড়িঘড়ি পেছনে ফিরে আঁচল টেনে মুখ ঢেকে খুব দ্রুতই প্রস্থান করলো।
আর মুহিবের সময়টা ওখানেই আটকে গেল। তার ধ্যান দুসেকেন্ডের সেই সময়টাতে আটকে গিয়েছে। এতটা উজ্জ্বল মুখশ্রী! সে ধ্যান থেকে বেরিয়ে কিছু বলে উঠার পূর্বেই মেয়েটি তার চেয়ে অনেক দূরে চলে গেল। এ যেন পূর্ণিমার আলোতে আরেক পূর্ণিমা। মুহিব কথা বলতে ভুলে গেল।
সে যেন এতদিন এমনই একটি মেয়ের অপেক্ষায় ছিল!

——–
বাড়ির উঠান পেরিয়ে ঘরের দরজার কাছে যেতেই যে ভয়টা সবসময় পায় সেটাই হলো সন্ধ্যার। আব্বা চলে এসেছে। বারান্দার খাটে বসে আছে। উঁচু আওয়াজে সন্ধ্যার নাম ধরে বার দুয়েক হাঁক ছাড়লো। সন্ধ্যার ছোট বোন কুসুম তার আপার দিকে ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকালো। সন্ধ্যা হারিকেনটা নিভিয়ে দিয়ে ধীরপায়ে ঘরের কাছাকাছি এগিয়ে গেল।
ততক্ষনে সন্ধ্যার মা জোহরা ঘর থেকে গ্লাস ভরে পানি নিয়ে স্বামীর সামনে দিল।
“সন্ধ্যা কই?”

জোহরা শান্তস্বরে উত্তর দিল,”ঘরে আছে।”

“আমি ডাকতাছি, তইও আসতাছে না ক্যান?”
জোহরা জানতো একটা না একটা খুঁত বের করবেই। তাই সে চুপ রইল।
সন্ধ্যা ধীর পায়ে ঘরের বারান্দার কাছে এগিয়ে গেল। সে কুসুমকে কিছু একটা ইশারা করতেই কুসুম ধীরপায়ে বাবার পাশে গিয়ে বসলো। এই সুযোগে সন্ধ্যা দ্রুতপায়ে বাবার পেছনে দিয়ে ঘরে ঢুকে গেল। ঘরে ঢুকতেই সে স্বস্তির শ্বাস ফেলে চুলার কাছে এগিয়ে গেল।

“ও একটু কাজ করছে। রান্না ছড়িয়েছি তাই।”

“তোমাগো মা মেয়ের এই শুদ্ধ শুদ্ধ বয়ানগুলো আমার লগে কইবা না তো। আর এই মেয়ে আমার অবাধ্য কবে থাইকা হলো! ডাকতাছি তাও আসতাছে না।”
“ও চুলার কাছে তাই। আর তুমিই তো ওকে সবসময় ঘর বন্দী করে রাখ। তুমিই তো বারান্দায় আসা বারণ করে দিয়েছো।”

জোহরার কথাগুলো বলতে দেরি কিন্তু গালে থা’প্প’ড় পড়তে দেরি হলো না। জোহরা গালে হাত দিয়ে স্বামীর মুখপানে চেয়ে দাঁড়িয়ে রইল। হাতে থাকা গ্লাসটা মাটিতে গড়িয়ে পড়লো। পুরুষের শক্তপো’ক্ত হাত স্বাভাবিকভাবেই গালে আ’ঘা’ত লাগবে কিন্তু এটা অনেক রাগ থেকে দিয়েছে বিধায় ব্যথা একটু বেশিই অনুভব হচ্ছে। সে চোখ মুখ কিচে ব্য’থা সংবরণ করার চেষ্টা করলো। ব্যর্থ হতে গিয়েও তিনি সামলে নিলেন। তার শক্ত থাকা লাগবে।
বাবার এমন কার্যকলাপ দেখে কুসুম দ্রুত দৌড়ে বই নিয়ে বসে পড়লো।
মাটিতে স্টিলের গ্লাসটা পরে দীর্ঘক্ষণ ধরে ঝনঝন শব্দ তুলছে। জোহরা সেদিকে তাকালো।
“তোমার মাইয়া তোমার এসব দেইখাই তো বে’দ্দ’প হইবো। আর আমার মাইয়া আমি জানবো তাকে কীভাবে রাখতে হইবো। জোয়ান মাইয়া। কওন তো যায় না।”

জোহরা আর চুপ থাকতে পারলো না। সেও সমান তালে বলে উঠল,
“কেন তোমার ঘটনার পুনরাবৃত্তি হবে বলে ধারণা করছো নাকি? চিন্তা করো না। যুগ পাল্টেছে, সবাই তোমার মতো জোর করে একটা মেয়েকে বিয়ে করবে না।”

আনিস মিয়া তেড়ে এলো। জোহরা ভয় পেল না। তিনি জানেন সে মারবে না কারণ আর যাই হোক না কেন আনিস তাকে ভালোবাসে এটাই সত্য। কিন্তু সেদিক দিয়ে জোহরার পক্ষ থেকে কোনো ভালোবাসা ছিল না। এমন না যে এতো বছরেও তার সংসারের প্রতি মায়া আসেনি। তার মায়া আছে কিন্তু তার ঘটনার পুনরাবৃত্তির ভয় তার স্বামীকে পেতে দেখে তার রাগ উঠে। সবাই কী তার মতো না-কি যে তার স্থান ভুলে যাবে! তার জন্য পরিবারের সাথে যোগাযোগটা পর্যন্ত নেই। বিয়ের এতো বছর পড়েও তাকে এভাবে চোখে চোখে রাখে। এটা ভাবতেই জোহরা তাচ্ছিল্য হাসলো। তার স্বামী মনে করে,এতো বছর পড়েও জোহরা তার পছন্দের মানুষের সাথে ভে’গে যাবে! এটাই তার মনের ভয়। জোহরা হাসলো, সে ঘটনা নিজে করেছে আর তার ফল ভোগ করছে তারা মা মেয়ে!
আনিস মিয়া মা’র’তে তেড়ে গিয়েও পিছিয়ে আসলো। এই মেয়েটিকে সে অসম্ভব ভালোবাসে কিন্তু কেন জানি দেখাতে বা প্রকাশ করাতে পারে না। সেজন্যই হয়ত এখনো তার ভয় হয় যে মেয়েটি বোধহয় শুধুমাত্র তার ভয়েই এখানে সংসার করছে, হয়ত এখনো তাকে ভালোবাসতে পারেনি। জোর করে কী আর ভালোবাসা হয়! তার বউ আর মেয়ে অসম্ভব সুন্দরী। সে নিজের কর্মকান্ডের জন্য এই দুইটা মানুষকে সবসময় বাঁধার উপর রাখে কারণ তার ধারণা যদি মেয়েটার পরবর্তী জীবনও তার মায়ের মতো হয়! তার মাকে যেভাবে সে তুলে এনেছিল মেয়েটিকেও যদি সেরকম কেউ করে! বাবা হয়ে এটাতো সে মেনে নিতে পারবে না। তাই তো এতো ধমকের মধ্যে রেখে মেয়েটিকে ভয়ের মধ্যে রাখে। নয়তো তারও তো ইচ্ছে করে ফুলের মতো মেয়েটিকে কাছে টেনে আগলে নিতে! অথচ তার এই ভেতরের ভালোবাসাটা কেউ উপলব্ধি করতে পারে না।
জোহরা সামনের দুয়ারের উপর থেকে পাটের বস্তা এনে পানি পড়ার স্থানটাতে বিছিয়ে দিল। মাটি হওয়াতে পানিগুলো শুষে নিলে সেই স্থানটা ভেজা ভেজা হয়ে কালচে রঙের হয়ে যায়। এই জিনিসটা তার অপছন্দ তাই তো তাড়াতাড়ি বস্তা এনে দিয়েছে কিন্তু এরই মধ্যে পানি অনেকটা শুষে গিয়েছে। সে বসে বস্তাটা দিয়ে মেঝেটা একটু মুছে সেই স্থানে আরেকটা শুকনো বস্তা বিছিয়ে দিল।
বস্তা বিছিয়ে সে ঘরে ঢুকে গেল। ঠোঁটের পাশে জ্ব’লছে খুব। ছিঁ’ড়ে-টিরে গেল নাকি!
সন্ধ্যা রান্নাঘরেই ছিল। মা চুলাতে রান্না ছড়িয়েছে। সে চুলার কাঠটা ভালোমতো ঠেলে দিল । গ্লাস পড়ার আওয়াজ সে শুনেছে কিন্তু যায়নি। সে জানে, তার বাবা ঠিকই আবার মাকে আগলে নিবে। কিন্তু সে গেলে হয়ত রেগে যাবে। আবার সেই রাগ তার মায়ের উপর ফেলবে তাই সে উঠে মায়ের কাছে গেল না। সে বুঝতে পারে না, তার বাবার চ’ক্ষু’শূ’ল কেন সে! এই প্রশ্নের উত্তর তার জানা নেই।

#তবু_মনে_রেখো
#নাজমুন_বৃষ্টি
#পর্ব_১
(আসসালামু আলাইকুম। প্রায় অনেকমাস পরে আবারো লেখার চেষ্টা। ভুল ভ্রান্তি হলে ধরিয়ে দিবেন, সংশোধন করে নিব ইন শা আল্লাহ। অগোছালোর জন্য ক্ষমাপ্রার্থী। আশা করি, রেসপন্স করবেন।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here