#ঢেউয়ের_স্রোতে_নিবিড়
#ঊর্মি_আক্তার_ঊষা
#পর্ব-৪
রিয়া, শাওন, রাহাত আর নির্ঝর ক্যাম্পাসেই ঊর্মির জন্য অপেক্ষা করছে৷ আজ তাদের একটা জায়গায় ঘুরতে যাবার কথা ছিলো। রিয়া ক্রমাগত কল দিয়ে যাচ্ছে। ঊর্মির নাম্বারে কল ঢুকছে তবে কেউ তুলছে না। ওরা বার বার হাত ঘড়ির দিকে আর গেইটের দিকে তাকাচ্ছে৷ কিছুক্ষণ পরেই বাইকে করে বড় গেইটাকে অতিক্রম করে ভার্সিটির ভেতরে প্রবেশ করে নিবিড়। সে আসা মাত্রই বাকি স্টুডেন্টরা আড়চোখে তাকেই পর্যবেক্ষণ করতে থাকে। বোরকা পরিহিত মেয়েটাকে কেউই চিনতে পারছে না। রাহাত তার চশমাটা খুলে পরিষ্কার করে আবার পড়ে নেয়। রিয়া ব্যাপারটা বুঝতে পেরে তার মাথায় চাটি মে’রে বলে….
–আরে ব্যাটা ভুল কিছু দেখিসনি। আমরা যা দেখছি তুইও ঠিক তাই দেখছিস৷ তবে কথা সেটা না কথা হচ্ছে বাইকে পেছনে বসে থাকা মেয়েটি কে? আর নিবিড় স্যারের সাথেই বা কেন এসেছে?
–আমাদের ঊর্মির ক্রাশ গত কপাল আজ পুড়লো রে। ‘মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে কথাটা বলল রাহাত….
–তা আর বলতে। আমি যতদূর শুনেছি নিবিড় স্যারের কোনো বোন নেই আর ছোট জমজ কাজিন আছে দশ এগারো বছরের, সবে ক্লাস টু তে পড়ে।
নিবিড়ের সাথে অন্য একটা মেয়েকে দেখে নির্ঝর মনে মনে কিছুটা খুশিই হয়। যাক এবার অন্তত ঊর্মির মাথা থেকে নিবিড়ের ভূত নামবে আর তাকেও পাত্তা দেবে। তার অনুভূতি গুলোকে মূল্যায়ন করবে। সে কিছুটা ভাব নিয়ে বলে…..
–আমি আগেই জানতাম এই বজ্জাত স্যারের মেয়ে নিয়ে কোনো ঘাপলা আছে। হয়তো উনার আগে থেকে কোনো গার্লফ্রেন্ড ছিলো তা নাহলে এই লোক কাউকে পাত্তা দিতো না কেন?
–আরেকদিন ক্লাসের বাইরে দাঁড় করানো নিয়ে কি কেসটাই না খেলাম এই নিবিড় স্যারের জন্য। উনি তো ডিরেক্ট বাসায় বিচার দিয়েছিলেন।
–আমার সেদিনের কথা এখনো মনে আছে। বাবা আমাকে সেদিন বাসার গেইটের সামনে কান ধরিয়ে এক পায়ে দাঁড় করিয়ে রেখেছিলো। আর পাশের বাসা থেকে জিনিয়া জানালার কাছে দাঁড়িয়ে থেকে দেখছিলো আর হাসছিলো।
শাওনের কথাটা শুনে রিয়া হাসতে শুরু করে। ফাস্ট ইয়ারের পড়াকালীন সময়ে ওরা পাঁচজন প্ল্যান করেছিলো ক্লাস বাঙ্ক করে ধানমন্ডি লেকের ধারে ঘুরতে যাবে। নিরিবিলি সেই জায়গাটা ঊর্মির পছন্দের জায়গার মাঝে অন্যতম। ওরা পাঁচজনই সেদিন ক্লাস না করে ঘুরতে চলে যায়। যার দরূন পরের দিন ক্লাসে ম্যাথ না পাড়ায় ওদের পাঁচজনকে ক্লাসের বাইরে দাঁড় করিয়ে রেখেছিলো নিবিড়। আর সেদিন প্রত্যেকের বাসার বিচারও দিয়েছিলো। নিবিড় এতো সুন্দর ভাবে তাদের বাঁশ দেবে এটা তাদের কল্পনার বাইরে ছিলো। সেদিনের পর থেকে তাদের পছন্দের খাতায় নিবিড়ের নামটা যুক্ত করে দেয়। তারপরও ঊর্মির মুখে একটা কথাই ছিলো “শ্যাম পুরুষ যেমন সুন্দর তেমনই সুন্দর তার বাঁশ দেবার পদ্ধতি” তার এমন কথা শুনে বন্ধুমহল হাসবে না কাঁদবে বুঝে উঠতে পারে না৷ অবশ্য ক্লাস বাঙ্ক দিয়ে ঘুরতে যাবার আইডিয়াটা ঊর্মির মাথাতেই প্রথম এসেছিলো। এতে সঙ্গ দিয়েছিল রিয়া, শাওন, নির্ঝর আর রাহাত। রিয়া তার ছোট বেলার প্রিয় বান্ধুবী হলেও শাওন, নির্ঝর আর রাহাতের সাথেও খুব ভালো বন্ধুত্ব ওদের। ওরা তিনজন ওদের কলেজ জীবনের বন্ধু।
নিবিড় তার বাইকটা পার্কিং সাইডে দাঁড় করিয়ে ঊর্মিকে ক্লাসে যেতে বলে সেও তার ডিপার্টমেন্টে চলে যায়। অন্যদিকে শাওন, রিয়া, নির্ঝর আর রাহাত নিজেদের মতোই কথা বলছিলো এমন সময় কালো বোরকা আর নেকাব পরিহিত মেয়েটি তাদের সামনে এসে দাঁড়ায়। ওরা কেউই মেয়েটাকে চিনতে পারে না। চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে থাকে৷ ওদের এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে ঊর্মি খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে আর বলে….
–সারপ্রাইজ!
ঊর্মির কন্ঠ শুনে যেন থ হয়ে যায় ওরা। কারো মুখ থেকে কোনো কথা বের হচ্ছে না। এক একটা যেন আকাশ থেকে টপকাচ্ছে। নির্ঝর গলা খাকড়ি দিয়ে বলে…..
–তুই এভাবে ভার্সিটি এসেছিস ব্যাপার কি? আর নিবিড় স্যারের সাথে আসলি যে?
–স্বামীর সাথে আসবো এটাই স্বাভাবিক নয় কি?
–স্বামী!
ওরা চারজন একত্রেই কথাটা বলে ওঠে। সবই যেন তাদের মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। আজ যেন তাদের সারপ্রাইজ পাওয়ার দিন। ঊর্মি ওদেরই পাশে দাঁড়িয়ে আছে। সে ওদের সব কথা খুলে বলে। বিয়ের কথা শুনে ওরা সবগুলো যেন হা করে তাকিয়ে আছে ঊর্মির দিকে। নির্ঝর এর মাঝে একটা কথাও বলে না। হুট করে এভাবে ছ্যাঁকা খেয়ে বসবে এটা তার ভাবনার বাইরে ছিলো। তারপরও মুখে হাসির রেখা ফুটিয়ে রাখে সারা সময়। ঊর্মিকে সবাই বিবাহিত জীবনের জন্য অভিনন্দন জানায়। এরপর ওরা কিছুক্ষণ বাইরে দাঁড়িয়ে কথা বলে ক্লাসে চলে যায়। পরপর তিনটা ক্লাস করে ঊর্মি ওদেরকে নিয়ে ক্যান্টিনে চলে যায়। ওরা নিজেদের মতো খাবার অর্ডার করে৷ খাওয়া শেষে বিল দিয়ে ওরা বাইরে চলে আসে। কিছুক্ষণ পর একাউন্টিং ক্লাস শুরু হয়ে যাবে। ওরা ক্লাসে গিয়ে বসে। বেল বেজে উঠলে কিছুক্ষণের মাঝেই নিবিড় ক্লাসে এসে প্রবেশ করে৷ স্টুডেন্টরা বারবার আড়চোখে নিবিড় আর ঊর্মির দিকে তাকায়৷ ওদের বিয়ের খবরটা ইতিমধ্যেই সবাই জেনে গেছে।
ছুটির পর সবাই একসাথে কথা বলতে বলতে গেইটের সামনে আসতেই দেখে নিবিড় ঊর্মির জন্য অপেক্ষা করছে। সে ওদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নিবিড়ের কাছে আসে। তাকে দেখা মাত্রই বাইকে উঠে বসে নিবিড়। ঊর্মিকে নিয়ে বাড়িতে যাবার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ে। বাসায় আসা মাত্রই নিবিড় তার ঘরে চলে আসে। পেছন পেছন ঊর্মিও যায়৷ নাজিয়া মাহমুদ নিবিড় আর ঊর্মিকে খাবার খাওয়ার জন্য ডাকতে শুরু করেন। দুজনে ফ্রেশ হয়ে খাবার টেবিলে আসে। তিনি দুজনের জন্য টেবিলে খাবার বেড়ে রেখে দিয়েছেন মাত্রই। দুজনে খেয়ে নেয়। ঊর্মি এঁটো খাবারের প্লেট গুলোকে রান্নাঘরে নিয়ে আসে। এর আগে খুব একটা কাজ করতে হয়নি তাকে। তবে মাঝে মাঝে মা আর ভাবীকে কাজে সাহায্য করতো কিন্তু খুব কম। সে খাবারের প্লেট গুলোকে ধুয়ে রেখে দেয়। রান্না ঘর থেকে বের হতেই নাজিয়া মাহমুদ এর সাথে দেখা হয়ে যায় তার।
–তোমাকে এইসব কাজ করতে হবে না মা৷ মন দিয়ে পড়ালেখা করবে আর আমার ছেলেটাকে দেখে রাখবে। এটাও তোমার বাড়ি। বাবার বাড়িতে যেভাবে ছিলে এ বাড়িতেও সেভাবেই থাকবে। তুমি শুধু এ বাড়ির বউমা নও এ বাড়ির মেয়ে তুমি।
কথাটা বলে তিনি নিবিড়কে ডেকে এনে বলে সন্ধ্যের আগেই যেন ঊর্মিকে তার বাবার বাসায় নিয়ে যায়। নিবিড়ও তার মায়ের কথায় সায় দেয়। বাসায় যাবে ভাবতেই মনটা ফুরফুরে হয়ে যায় তার। সকালে ভার্সিটি যাবার আগে শুধু মায়ের সাথে কথা হয়েছিলো তার। ঊর্মি ঘরে এসে তৈরি হয়ে নেয়। আয়শা মাহমুদ এর বাবা কিছুটা অসুস্থ থাকায় তিনি পূর্ণ আর পুষ্পকে নিয়ে সেখানেই গেছেন। নিবিড় ঊর্মিকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। ঊর্মিদের বাড়িতে যাবার আগে কিছু কেনাকাটা করে নেয় নিবিড়। নতুন জামাই বলে কথা।
কলিং বেল এর শব্দ শুনে রিধিমা এসে গেইট খুলে দেয়। পেছন থেকে অরুনা আহসান রিধিমাকে জিজ্ঞেস করেন….
–কে এসেছে রে রিধি?
–মা ঊর্মি আর নিবিড় এসেছে।
মেয়েকে দেখা মাত্রই অরুনা আহসান জড়িয়ে ধরেন। নিবিড় তার হাতে থাকা মিষ্টি আর ফল গুলো রিধিমার হাতে দিয়ে দেয়। অরুনা আহসানকে সালাম জানায়৷ তিনি সালামের উত্তর নিয়ে মেয়ে আর মেয়ে জামাইকে বাড়ির ভেতরে নিয়ে আসে৷ কিছুক্ষণ ভালোমন্দ কথা বলেন। ঊর্মি নিবিড়কে নিজের ঘরটা দেখিয়ে দেয়৷ নিবিড় ফ্রেশ হয়ে আসতেই সেও ফ্রেশ হয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দেয়। দুটো দিন বাড়িতে না থাকায় মনটা বড়ো উশখুশ করছিলো কিন্তু এখন থেকে নিবিড়ের ঘরটাই তার সব। সে নীড়েই যে তাকে শান্তি খুঁজে নিতে হবে। সেখানেই নিজের ছোট্ট সংসার গড়ে তুলতে হবে৷ সবার সাথে মিলেমিশে থাকতে হবে৷ কিছুক্ষন পর ঊর্মি ঘর থেকে বের হতেই ছোট্ট দিয়া দৌঁড়ে এসে তাকে জড়িয়ে ধরে বলে….
–ফুপিমা তুমি কোথায় গিয়েছিলে? আমি তোমাকে এত্তো মিস করেছি।
–আমি একটা নতু জায়গায় গিয়েছিলাম মা।
–সেটা কোথায়? আমিও যাবো!
–আচ্ছা! তোমাকেও নিয়ে যাবো সেখানে।
ঊর্মি দিয়াকে নিয়ে তার ঘরে আসে। নিবিড় ছোট্ট মেয়েটাকে কোলে নেয়। অল্প সময়ের দুজনের মাঝে বেশ ভাব হয়ে যায়।
নাতনি আর নাতজামাই এসেছে শুনে ফুলজান বিবির খুশি দেখে কে! অরুনা আহসান আর রিধিমা মিলে সবাইকে খাবার খেতে দিচ্ছে৷ জাহিদ আহসান, দিদার, নিবিড় আর ঊর্মি খেতে বসেছে। ফুলজান বিবি ডায়বেটিস থাকায় তিনি রাতে শুধু রুটি আর সবজি খান। তিনি বসে বসে পান চিবুচ্ছেন। এমন সময় হঠাৎ করেই তিনি বলেন…..
–আহারে আমার নাতজামাইডা একদিনেই শুকাইয়া কাট হইয়া গেছে। তা আমার নাতনিডা কি তোমারে মেলা জ্বালায় গো ভাই?
উনার কথা শুনে নিবিড় কি বলবে কিছু বুঝতে পারে না। ঊর্মি খাবার খাচ্ছিলো ফুলজান বিবির এমন কথা শুনে তার কাশি উঠে যায়। রিধিমা হাসতে হাসতে পানিটা এগিয়ে দেয়। সে তাড়াতাড়ি করে পানিটা খেয়ে নিয়ে বলে….
–বুবু আমি কিন্তু রাগ করছি!
চলবে?…….