বিয়ে করবে না বলে আজ পঞ্চম বারের মতো দেখতে আসা ছেলেকে ভাগাতে কিছুটা উদ্ভট সেজে নিজের ঘরে বসে আছে ঊর্মি। এর আগেও চার বার বিভিন্ন পন্থা অবলম্বন করেছে সে বিয়ে ভাঙার জন্য। প্রত্যেকবার সফল হয়েছে সে। তবে এইবার না জানি কি হয়। ঘরের বাইরে থেকে গুমগুম আওয়াজ ভেসে আসছে। হয়তো মেহমানরা চলে এসেছে। ঊর্মি ঠিক হয়ে বিছানার একপাশে মুখ অন্যদিকে ঘুরিয়ে জড়োসড়ো হয়ে বসেছে। কিছুক্ষণের মাঝেই তার ভাবী রিধিমা এসে রুমে প্রবেশ করে। তাকে দেখা মাত্রই সে বলে….
–এমন উদ্ভট সাজসজ্জা কেন তোর? তুই জানিস না আজ তোকে পাত্রপক্ষ দেখতে আসছে?
–তো কি হয়েছে ভাবী? আমি এভাবেই তাদের সামনে যাবো।
–চুপ কর তো তুই? আমি জানি আগে দেখতে আসা পাত্র গুলোকে তুই ভাগিয়েছিস তাইনা?
–পাত্র! কিসের পাত্র? ওইযে রান্না ঘরে যে রাখা আছে সেগুলো?
–আমি কিন্তু এখন দুষ্টুমি করার মুডে নেই। তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নে।
–আমারও সং সাজার মুড নেই।
–তুই যদি চাস এই উদ্ভট সাজে তোর বিয়ে হোক তাহলে আমাদের কারোরই এতে কোনো আপত্তি থাকার কথা না। চল তাহলে তোকে এভাবেই বসার ঘরে নিয়ে যাচ্ছি।
বিয়ের কথা শুনে ঊর্মি যেন আকাশ থেকে পড়লো। কিন্তু তার বাবা যে বলেছিলেন উনার বন্ধুর ভাইয়ের ছেলের জন্য তাকে দেখতে আসার কথা হয়েছে। তাহলে বিয়ের কথা কেন হচ্ছে? সে তো এই বিয়ে কিছুতেই করতে পারবে না! কাউকে একবার মন দিলে কি অন্য কারো সাথে সংসার বাধা যায়? সে যে কাউকে প্রচন্ড রকমের ভালোবাসে। একপাক্ষিক ভালোবাসার মাঝে একধরনের শান্তি অনুভুত হয়। তবে যন্ত্রণা তার থেকে দ্বিগুণ প্রখর। দুবছর ধরে একটা মানুষকে মনের গহীনে একটু একটু লালন করেছে সে। ভার্সিটির নবীন বরণ অনুষ্ঠানে চকলেট কালারের পাঞ্জাবি পরিহিত লোকটাকে দেখে হৃদয়ে প্রথম অন্যরকম অনুভুতি দোলা দেয়। যাকে বলে প্রথম দেখায় প্রেমে পড়া। সেদিনই বন্ধুদের থেকে প্রথম জানতে পারে লোকটি আর কেউ নয় ওদেরই একাউন্টিং ডিপার্টমেন্টের লেকচারার। একবছর ধরে তিনি এখানে লেকচারার হিসেবে জয়েন করেছেন। সেদিন থেকেই ক্লাস করার ফাঁকে আড়চোখে দেখে যেতো মানুষটাকে। যা ধীরে ধীরে একপাক্ষিক ভালোবাসায় রুপান্তর হতে থাকে। ভাবনার ছেদ ধরিয়ে রিধিমা ঊর্মিকে দুই বাহুতে ধরে হাল্কা ধাক্কা দিতেই সে বাস্তবে ফিরে আসে৷ এই মুহুর্তে কি করা উচিত সেই হিতাহিত জ্ঞান টুকু যেন হারিয়ে ফেলেছে সে। আজ পর্যন্ত নিজের মনের কথা টুকু যেই মানুষটাকে জানাতে পারলো না, সেই মানুষটার কথা পরিবারের সামনে কি করে বলবে সে? বাবাকে বরাবরই ভীষণ ভয় পায় ঊর্মি৷ ভয় আর বিষন্নতা দুটোই তাকে গ্রাস করেছে পুরোপুরি। রিধিমা জোরপূর্বক তাকে তৈরি করে দেয়। ঝটপট লাল বেনারসি শাড়িটা পরিয়ে ফেলে৷ চোখ মুখ ধুইয়ে দিয়ে হাল্কা করে সাজিয়ে দেয়। আলমারি থেকে কিছু গহনা বের করে পড়িয়ে দেয় ঊর্মিকে। এরই মাঝে ঘরে উপস্থিত হয় ঊর্মির মা অরুনা আহসান। তিনি খুব স্বাভাবিক ভাবেই আছেন। উনাকে দেখে মনে হচ্ছে না যে বিয়েটা হুট করে হচ্ছে বলে মেয়েকে নিয়ে উনার কোনো দুশ্চিন্তা আছে বলে। দেখে বুঝাই যাচ্ছে অনেকদিন আগে থেকে সবকিছু প্ল্যান করা হচ্ছিলো। বিষয়টা হয়তো সবাই-ই জানতো, শুধু তার থেকেই লুকিয়ে যাওয়া হয়েছে৷
তারপর আর কি করার? নিজের সব ইচ্ছে, ভালোলাগা, ভালোবাসা সবকিছুকে জলাঞ্জলি দিয়ে অবশেষে বিয়ের পীড়িতে বসতে হলো তাকে। নিজের পরিবারের প্রতি রেগেমেগে বো’ম হয়ে রয়েছে ঊর্মি। কারো সাথেই কোনো ধরনের কথা বলা তো দূরে থাকা টু টা শব্দও করছে না আজ সে। তীব্র অভিমান জড়ো হয়েছে আজ পরিবারের প্রতি। চেনা নেই জানা নেই হুট করে বিয়ে সিদ্ধান্ত কি করে নিতে পারে এই কথাটাই তার মাথায় বারবার ঘুরপাক খাচ্ছে। আজ থেকে সেই মানুষটাকে চিরদিনের জন্য মন থেকে মুছে দিতে হবে। বিবাহিত নারীদের অন্যকোনো পরপুরুষের কথা চিন্তায় আনাও পাপ। প্রথম কিশোরী মনের ভালোবাসা কি এতো সহজেই মুছে ফেলা যায়? হয়তো যায় না। আবার হয়তো সময়ের সাথে সাথে সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে উঠলো। হয়তো কোনো এক মুহুর্তে অতীত হুট করেই মন থেকে মুছে গেলো। পরিবারের উপর রাগ করে নিজের বিবাহিত স্বামীকে পর্যন্ত চোখের দেখা দেখতে চাইছে না ঊর্মি। যার সামান্য নাম টুকু জানার আগ্রহ জাগেনি তাকে দেখার কথা ভাবাটাই বিলাসিতা। ঊর্মিকে চুপ থাকতে দেখে তার দাদি বলে…..
–এই ছেরি! একবার নাতজামাইয়ের মুখ পানে তাকা। এমন কাইল্লা আন্দার কইরা রাখছিস কেন মুখটারে?
–তোমার এতো কষ্ট লাগলে তুমিই দেখো বুড়ি। আমাকে কেন খোঁচাচ্ছো?
–দেখছো নি কারবার? ফুলজান বিবিরে এই ছেরি চেৎ দেহায়৷ আমার রূপ-যৌবন কি কম আছে নাকি? হুন আমারে দেখলে তর সোয়ামি এমনেই কাইত হইয়া যাইবো।
–বুড়ির ঢং যায় না।
এখানে উপস্থিত সবাই ওদের কথা শুনে হাসতে শুরু করে৷ ঊর্মি কিছুটা চোখ রাঙিয়ে ওদের দিকে তাকায়। তা চোখ রাঙানোতে কারো কোনো যায় আসছে বলে মনে হচ্ছে না। তবুও ঠোঁট টিপে হাসছে। এদের কান্ডে দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে। এদের বলে কয়ে কিছুই সম্ভব না এটা ঊর্মি বেশ ভালোই বুঝতে পারছে! এরপর সারাক্ষণ চুপচাপ যে যেটা বলছে সেটাই করার চেষ্টা করে সে। যেহেতু নতুন বউ তাই সারাক্ষণ ঘোমটার আড়ালেও নিজেকে লুকিয়ে রেখেছিলো। সবকিছু বেশ অসহ্য মনে হচ্ছে তার কাছে। অল্প কিছু মানুষকে বিয়ের কথা জানানো হয়েছিলো। ছেলে পক্ষ থেকে ছেলের বাবা, মা, চাচা, চাচী আর দুটো ছোট্ট জমজ মেয়ে। ঊর্মির নানু বাড়ি থেকে তার দুই মামার পুরো ফ্যামিলি এসেছে। কাজিন বলতে সাদিয়া, তার স্বামী, সানজিদা, আইরিন আর রিফাত।
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে গভীর ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে ঊর্মি। হুট করেই আজ তার বিয়ে হয়ে গেলো। বন্ধুমহলে এই ব্যপারে কিছু জানাতেও পারলো না সে। না জানি এই খবরটা জানতে পেরে তারা কি রকম রিয়েক্ট করে। হুট করে বিয়ে দেবার কারণটা ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না সে। বিয়ে হয়েছে ভালো কথা তাই বলে আজই শশুর বাড়িতে পাঠিয়ে দিতে হবে! এ কেমন কথা? দ্বিতীয় বর্ষের ফাইনাল পরীক্ষার সময় থেকে এলাকার চেয়ারম্যান আবদুল মান্নান এর ছেলে মিহন তাকে খুব করে বিরক্ত করছিলো। শেষমেশ বিরক্ত হয়ে ঊর্মি এই কথাটা তার বড় ভাই দিদারকে জানায়। বড়লোক বাবার বিগড়ে যাওয়া ছেলেরা আর কেমনই বা হতে পারে! দিদার তার বাবাকে নিয়ে চেয়ারম্যান আবদুল মান্নানকে ছেলের ব্যাপারে সব বলে। নিজের প্রেস্টিজ রক্ষার্থে তিনি ওদের সাথে মিহনকে শাসন করেন৷ কিছুদিন মিহন নিজেকে গুটিয়ে রাখলেও আবার ঊর্মিকে রাস্তাঘাটে বিরক্ত করা শুরু করে দেয়। হয়তো এই জন্যই ঊর্মির বিয়ে দেবার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন ঊর্মির বাবা আনিসুজ্জামান। এতো কিছু ভেবে যেন তার মাথাটা ছিড়ে যাচ্ছে।
বাইরে থেকে কারো আসার শব্দ পেয়ে ঊর্মি আয়নার সামনে থেকে সরে গিয়ে বিছানায় জড়োসড়ো হয়ে বসে। মাথায় লম্বা ঘোমটা টেনে নেয়। বাবার বাড়ি থেকে আসার সময় খুব একটা কান্না করেনি সে। খুব অভিমান জমেছে পরিবারের প্রতি তার। সঙ্গে আইরিন আর সানজিদাও এসেছে। হঠাৎ দরজা আটকানোর শব্দ শুনে নিজেকে আরও জড়োসড়ো করে নেয়। হয়তো তার স্বামী এসেছে। ঘোমটাটা হালকা সড়িয়ে দেখে লোকটা ওয়াশরুমে ঢুকছে। হাতে তার সাদা রঙের তোয়ালে। লোকটার পেছন সাইডটা স্পষ্ট দেখতে পায় সে। বিছানার বালিশের সাথে কিছুটা হেলান দিয়ে বসে ঊর্মি। শাড়ির আঁচলে আঙ্গুল পেঁচিয়ে কিছু একটা ভাবতে থাকে সে। মুহূর্তেই ভার্সিটির বসন্ত উৎসবের কথাটা মনে পড়ে যায়।
চলবে?…….
#ঢেউয়ের_স্রোতে_নিবিড়
#ঊর্মি_আক্তার_ঊষা
#সূচনা_পর্ব
–
–
আসসালামু আলাইকুম। আশা করি সবাই রেসপন্স করবেন। সকলের মন্তব্যের উপর ভিত্তি করে পরবর্তী পর্ব দেবো ইনশাআল্লাহ।