গোধূলিলগ্ন ১৯।

0
363

উপন্যাসঃ”গোধূলিলগ্ন”
শান্তনা আক্তার
পর্বঃ১৯

ভোরের স্নিগ্ধ আলো জানালার ফাঁকফোকর গেলে কাব্যর চোখজোড়া নিবদ্ধ করতেই আঁখিপল্লব নাড়া দিয়ে ওঠে। লম্বা একটা ঘুমের পর চোখ খুলতে অসুবিধা হচ্ছে। আধোঘুমে চারপাশ দেখে নিল একরাশ কৌতূহল চোখে। তার সম্বিৎ ফিরতে বেশিক্ষণ সময় নেয়না৷ পায়ের দিকে চোখ গেলে রেখার দেখা মেলে৷ কাব্যর এক পা বুকে জড়িয়ে স্বস্তি নিয়ে ঘুমোচ্ছে রেখা। কাব্য পা টানতে গিয়ে শরীরে শক্তি অনুভব করল না। দু’হাতে স্যালাইন ধরানো। মুখে অক্সিজেন মাস্ক। ফলে মাকে জাগাতে ‘উম’ শব্দ করে উঠল কাব্য। রেখার ঘুম বেশ পাতলা৷ রেখা দ্রুত গতিতে উঠে বসল। কাব্যর জ্ঞান ফিরেছে দেখে অস্থির ভঙ্গিতে ছেলের মাথার কাছে চলে গেলেন। কাব্যর বুকে আলতো করে হাত বুলাতে বুলাতে বললেন, ‘কি হয়েছে বাবা? কষ্ট হচ্ছে? মাকে বল কোথায় ব্যথা করছে?’

বলেই ভুবন কাঁপানো শব্দে বুক ফুৃঁড়ে কান্না ছাড়লেন রেখা বানু। কাব্যর কপাল কুঁচকে ওঠে তাৎক্ষণিক ভাবে। রেখার কান্না কাব্যর মোটেও সহ্য হয়না। কাব্য আবারও ‘উম’ শব্দে মাথা নাড়িয়ে কাঁদতে নিষেধ করে। রেখা তাও কান্না থামান না। তখন একজন ডাক্তার সহ তৌসিফ সাহেব ক্যাবিনে ঢোকে। ডাক্তার হাসি দিয়ে বলে,
‘এইতো কাব্য আঙ্কেলের ঘুম ভেঙেছে।’ তিনি কাব্যর মুখের অক্সিজেন মাস্ক খুলে আবারও বললেন,
‘কিছুই হয়নি তোমার। দ্রুত সুস্থ হয়ে যাবে। কেমন লাগছে এখন?’

কাব্য শুকনো ঠোঁট জিভ দিয়ে ভিজিয়ে অস্ফুটস্বরে বলল, ‘মিতু কোথায়?’
***
সকাল সকাল ভয়াবহ সংবাদে দেওয়ান বাড়িতে মরাকান্নার আসর বসল। সংবাদের শিরোনাম হচ্ছে রাবেয়ার নৃশংস মৃত্যু। মিতু ও নুরুলের বিয়ের প্রথম সকালেই রাবেয়ার সন্ধান পাওয়া গেল। তবে জীবিত নয়, মৃত হিসেবে। গোয়েন্দারা কালিঘাট নামক গ্রাম থেকে আকিজকে খুঁজে বের করে রাবেয়া অবধি পৌঁছাতে সফল হয়েছে। গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে যুক্ত কর্মকর্তাদের তথ্যসূত্রে জানা যায়, আকিজ রাবেয়াকে বাপের বাড়ি থেকে টাকা আনতে বলায়, রাবেয়া সরাসরি না বলে দেয়। এই নিয়ে কথা-কাটাকাটির একটা সময়ে আকিজের মাথা নষ্ট হয়ে যায়। ফলে আকিজ তার রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে হুশ হারিয়ে রাবেয়ার গলা টিপে ধরে। যতক্ষণ না রাবেয়া হাত পা ছুটাছুটি বন্ধ করে, ততক্ষণ পর্যন্ত আকিজ রাবেয়াকে ছাড়েনি। ধস্তাধস্তির একপর্যায়ে আকিজ যখন সজ্ঞানে ফিরে, তখন অনেক দেড়ি হয়ে যায়। ততক্ষণে রাবেয়া শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মারা যায়। আকিজ প্রাণ বাঁচাতে রাবেয়াকে সেভাবে রেখেই পালিয়ে যায় অন্যত্র। লাশের অধিকারী না পেয়ে স্থানীয় পুলিশ রাবেয়ার লাশ মর্গে পাঠায়। পর্যায়ক্রমে পোস্টমর্টেম করে দাফন কার্য সম্পাদিত হয়। ঘটনাটি ঘটেছিল রাবেয়ার বাড়ি ছাড়ার কয়েক সপ্তাহ পরপরই। আকিজ বর্তমানে পুলিশের দখলে। তিনি যাবজ্জীবন অর্থাৎ ৩০ বছরের সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত এক আসামী। গোয়েন্দাদের মাধ্যমে রাবেয়ার মৃত্যুর সংবাদ পেয়ে অতিরিক্ত শোকে জ্ঞান হারান মছিদা বেগম। চোখ ছলছল করে নুরুল, নাহিদসহ অন্যান্য আত্মীয়স্বজনদের। সেই সাথে সেতুরও। সেতুর প্রতি রাবেয়া নানান অনৈতিক আচরণ করলেও, সেতু মনেপ্রাণে তা ভুলে যায়। তার উপর হওয়া অন্যায়গুলো মন থেকে মাফ করে দেয়। সাথে দু হাত তুলে দোয়া চায় রাবেয়ার শান্তি কামনায়। আর মিতু! সে তো ঘর থেকে বের হওয়ার শক্তিটুকু পাচ্ছে না। পরে আছে এক কোণে পরিত্যক্ত উচ্ছিষ্ট হয়ে। নাহিদ, নুরুল হায় হুতাশ জানায় বোনের মৃত্যুতে। ভাগ্যের নির্মম খেলা বড়োই জটিলতায় ভরপুর৷ এ যেন নিঠুর বাণ। যেখান থেকে তাক হবে, ঘুরেফিরে সেখানে এসেই খুটি গাড়বে। অর্থাৎ, অন্যের ক্ষতি করলে, একদিন নিজেকেও তেমনি বড়ো কোনো ক্ষতির সম্মুখীন হতে হবে। এটাকেই বোধয় প্রকৃতির প্রতিশোধ বলে।
***
‘আছে, ওর বাড়িতেই আছে।’ হেসে বললেন তৌসিফ সাহেব।

কাব্য করুণ চোখে শুধায়, ‘সত্যি?’

রেখা বললেন, ‘হ্যাঁ সত্যিই। মাকে বিশ্বাস হয়না?’

‘কিন্তু ওরতো গতকাল বিয়ে ছিল মা! তাহলে…’
কাব্যকে কথা শেষ করতে দিলেন না রেখা বানু।
‘ছিল তো বিয়ে৷ কিন্তু আমরা হতে দেইনি। ওইটুকুন মেয়ে বিয়ে দেওয়া কি এতই সোজা? পুলিশের পিটুনি খেয়ে আবুল কালামের ঘাড়ের রগ সোজা হয়েছে। পুরো গ্রামের লোকজনের সামনে আবুল কালাম কানে ধরে বলেছেন, তিনি ১৮ বছরের আগে মেয়ের বিয়ে দেওয়ার কথা মাথাতেই আনবেন না।’

কাব্য এতক্ষণের দুঃশ্চিন্তা ঠেলে অধরে হাসি টেনে আনে। শরীরের মরণ যন্ত্রণাও লাঘব হয় অনেকাংশ। ঠোঁটের হাসি ধরে রেখে বলে,
‘তোমাদের দুজনকে অসংখ্য ধন্যবাদ। এবার মিতুকে এখানে নিয়ে আসো নইলে আমাকে ওর কাছে নিয়ে যাও। তাহলে আমি সম্পূর্ণভাবে সুস্থ হয়ে যাব।’

তখনই তৌসিফের ঝাঁঝালো কন্ঠস্বর শোনা যায়।
‘কাব্য! বেশি বাড়াবাড়ি করছো তুমি। তোমার কতটা ক্রিটিকাল অবস্থা সেটা সবচেয়ে ভালো তুমি নিজে জানো। আমাকে রাগাবে না একদম।’

রেখা বলল, ‘থামো, কিছু বলোনা ছেলেকে। আমি বোঝাচ্ছি। দেখ বাবা, গ্রামের লোক তোকে আর মিতুকে নিয়ে ছিঃছিঃ করছে। এমন এক পরিস্থিতিতে যদি তুই মিতুর সঙ্গে দেখা করিস, তাহলে আমাদের অপমানিত হতে হবে। তোর বাবার অবস্থানটা একটু চিন্তা কর।’

‘আমার সম্মান অবশিষ্ট আছে বলছো রেখা? তোমার ছেলে আমার সম্মান ধূলিসাৎ না করে রেখেছে কিছু? আজ প্রথম আমার শিক্ষা, যোগ্যতা নিয়ে লোকে আঙুল তুলল আমার দিকে। আমার সন্তান কুলাঙ্গার। আমি কেমন বাবা? কি শিক্ষা দিয়েছি ছেলেকে? অন্যদের কি করে শিক্ষা দেব? ভাবিনি এমনভাবে কোন দিন প্রশ্নবিদ্ধ হবো। কিন্তু হলাম তো।’ তৌসিফ হাতের আড়ালে চোখের পানি লুকান। কাব্য নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না। ছোট থেকে বাবার সম্মানের কথা ভেবে যে ছেলে প্রতিটি কদম সাবধানে ফেলেছে, আজ তার জন্যই তার বাবা লাঞ্চিত সমাজের কাছে। কাব্য ভেজা চোখে বলল, ‘আমাকে মেরে দাও তোমরা।’

রেখা চমকায়। ছেলের গালে হাত রেখে বলে,
‘কি বলিস তুই?’

কাব্য একই স্বরে বলল, ‘আমি আসলেই কুলাঙ্গার। আব্বু আর তোমার কুলাঙ্গার সন্তান।’

‘মার খাবি কাব্য৷ তোর আব্বু কিন্তু আমাকে থামাতে পারবে না।’

কাব্যর সোজা কথা, ‘থেমো না।’

তৌসিফ বললেন, ‘আর একটাও খামখেয়ালি কথা বলবে না। তুমি কে তোমাকে নিয়ে ভাবার? আমি জগন্মাতা, আমিই তোমার দিক প্রদর্শক। যে যাই বলুক, আমি তোমাকে কোরবানি দিতে প্রস্তুত নই। আজ হলাম আমি কুলাঙ্গার ছেলের বাবা। কিন্তু কুলাঙ্গার ছেলের বাবা হয়ে আমি মরতে চাইনা৷ আমি আদর্শ বাবার উপাধি পেয়ে মরতে চাই। তার জন্য তোমার সাহায্য লাগবে আমার।’

কাব্য পাহাড় সমান কৌতূহল নিয়ে তার বাবার দিকে তাকায়। কিছু বলেনা৷ জিজ্ঞেসও করেনা। তৌসিফই বললেন, ‘আমরা এই গ্রাম ছেড়ে শহরে চলে যাব। আজ, কিছুক্ষণের মধ্যেই।’

কাব্য চোখের পানি ছেড়ে দিল মুহুর্তেই। সজল চোখে বলল, ‘মিতুকে ছেড়ে যাব না আমি।’

‘তাহলে বাবা মাকে ছেড়ে দাও। ভুলে যাও বাবা-মার ঠিকানা।’

‘আব্বু!’

‘নেই আর।’

‘এভাবে বলো না, কষ্ট হচ্ছে।’

‘আমারও হচ্ছে। কিছু বলার নেই আমার।’

‘আমি শেষ হয়ে যাব।’

‘তোমার বাবা বেঁচে থাকতে কখনোই না।’

‘আমি রাজি আব্বু।’ গোটা এক পাহাড় বুকে নিয়ে বলল কাব্য।

তৌসিফ হাসলেন। সঙ্গে চুমু খেলেন কাব্যর ব্যান্ডেজ করা কপালে। কাব্য বলল, ‘কতদিনের জন্য যাব আমরা? বেশিদিন কিন্তু থাকবো না।’

তৌসিফ নড়বড়ে কন্ঠে জবাব দেয়, ‘পড়াশোনা শেষ হলেই চলে আসবো। কটা বছর শুধু।’

‘ততদিনে মিতুর বিয়ে হয়ে গেলে?’

‘হবে না, আমি কথা দিলাম।’

তৌসিফের সেদিনকার মিথ্যে আশ্বাসবাণী কাব্যকে শক্ত করে প্রবলভাবে। বাঁচার নতুন আলো দেখায়। যাবার আগ মুহুর্তে কাব্য শেষবার মিতুকে দেখার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিল বটে। তবে সেটাও কৌশলে নিষেধাজ্ঞায় ফেলতে সফল হলেন কাব্যর বাবা-মা। নিরুপায় কাব্যকে জীবনের বড়ো একটা অংশ ফেলে পাড়ি দিতে হয় যানবাহনের কালো ধোঁয়া, ইট ইমারতের কোলাহলময় শহরে। কাব্যর সাথে ছিল কিছু স্বপ্ন। যা পর্দার আড়ালে লুকানো হয়েও, কাব্যর নিকট দৃশ্যমান। কি জানি কবে সেই পর্দা সরবে কাব্যর মন-দ্বার থেকে।
চলবে ইনশাআল্লাহ…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here