গোধূলিলগ্ন ২০

0
362

উপন্যাসঃ”গোধূলিলগ্ন”
শান্তনা আক্তার
পর্বঃ২০

দু’বছর পর;
দুপুরের মধ্যভাগে ফুটফুটে ছেলে সন্তানের আগমন ঘটে মিতুর কোলজুড়ে। দেওয়ান বাড়িতে উৎসবের ধুম পড়ে। নুরুল বেড়িয়ে যায় মিষ্টান্নের আয়োজনে। ছেলে হয়েছে! চারটে খানি কথা না। মছিদা তার ৬৫ বছরের জীবনে এই প্রথম দাদী হওয়ার স্বাদ পেল। শুরুটাই নাতি দিয়ে হলো। মছিদা এতো খুশি ধরে রাখার পাত্র খুঁজে পাচ্ছেন না। কিন্তু কে জানতো এই খুশি মাত্র কয়েক ঘন্টায় সীমাবদ্ধ?

সন্ধ্যা যখন রাতকে স্বাগত জানিয়ে বিদায় নেয়, তখনও মিতুর নাড়ি ছেড়া মানিক হাত-পা নেড়ে আকুপাকু করছিল। মিতু নিষ্পল চোখ দিয়ে সমানে দেখছিল ছেলের পাতলা মুখের গড়ন। দেখতে দেখতে চোখ লেগে যায়। হঠাৎ মছিদার আকাশ-পাতাল কাঁপানো চিৎকারে ধড়ফড়িয়ে উঠে মিতুর পানিশূন্য বুক। আঁতুড়ঘরে হন্ন হয়ে ছুটে আসে সেতুসহ আরও অনেকেই। সকলেই মহিলা, মেয়ে। এসে দেখে মছিদা মিতুর ছেলেকে বুকে জড়িয়ে কাঁদছে। ঠিক যেন পাগলাগারদের পাগলের মতো। মিতুর মন ভয়ে কাতর। সেতু ভীড় ঠেলে মছিদার নিকট পৌঁছে শুধায়, ‘আম্মা আপনে মিতুর ছেড়ারে জড়ায় কান্দেন ক্যান?’

মছিদা ফোঁপাতে ফোপাঁতে বললেন, ‘আমার ভাই নড়েচড়ে না। নিশ্বাসও চলে না। আল্লাহ গো!’

সেতু দ্রুত হাতে মিতুর ছেলের নাড়ি পরীক্ষা করে। সে জানে এই কৌশল। বুঝল সত্যিই বাচ্চাটি প্রাণহীন, মৃত। চোখের পানিতে সাগর হলো সেতুর। মিতু কেমন প্রতিক্রিয়া দেবে বুঝে উঠছে না। সে যে মা তেমন অনুভূতি এখনো পরিলক্ষিত হলো না তার মধ্যে। কিন্তু যখন সকলে বাচ্চাটিকে গোসল করানোর জন্য উদ্যত হয়, তখন গিয়ে মিতুর টনক নড়ে। হাউমাউ কান্নায় বাঁধ ভাঙায়। অসুস্থ শরীরেই ছুটে যায় ছেলের কাছে। অমনি তীব্র ক্রোধে নুরুলের মাথা ফেটে পড়ে। মিতুকে এক প্রকার টেনে হেঁচড়ে আঁতুড়ঘরে নিয়ে দরজা লাগায়। বেশ কয়েকটি লাথি বসায় মিতুর পেট বরাবর। ব্যথায় মুখ থেকে কোন প্রকার শব্দটুকু বের হলো না মিতুর। এমনিতেই ছেলেকে জন্ম দিতে গিয়ে ব্যথার শেষ নেই, তার উপর নুরুলের জোড়ালো লাথি। ওই মুহুর্তে জীবন বের হলে বোধয় শান্তি পেত মিতু। কিন্তু তার যে কৈ মাছের প্রাণ। ভেবে পায়না তার মরণ কেন হয়না! দরজায় একের পর করাঘাতের সাথে সেতুর আর্তচিৎকার ভেসে আসছে। সে বলছে, ‘মাইরেন না মিঞা ভাই, আমার বোইনডারে মাইরেন না। মইরা যাইবো ওইটুক মাইয়া। এত কষ্ট দিয়েন না ওরে। ওর বদলে আমারে মারেন আপনারা, তাও ছাইড়া দেন ওরে।’

নুরুল কোন কথাই কর্ণকুহরে ঢোকায় না। তবে মিতুকে অচেতন অবস্থায় দেখে নুরুল ভাবল হয়তো মারা গিয়েছে। এই ভেবে মানে মানে কেটে পড়ে সেখান থেকে। ফ্লোর রক্তে মাখামাখি। তার উপর পড়ে আছে মিতুর ক্লান্ত শরীর। সেতুর বুক ফুঁড়ে কান্না দেখার কাম্য রইল না। সে মিতুকে বুকে চেপে ধরল। বলল, ‘পোড়া কপালের মইধ্যে সেরা মনে হয় আমাগো দুই বোইনের কপালই। হায়রে সুখ! কত সুখ! সুখে চোখের পানি থামেনা। জানোয়ার বাপখান যদি আইজ একবার আইতো, আমার হাতে লাশ হইতো!’ রাগে দুঃখে জ্বলজ্বল করে ওঠে সেতুর অগ্নি চোখ।

দাফন সম্পন্ন হলে মছিদা আঁতুড়ঘরে প্রবেশ করেন। মিতু পেটের ব্যথায় এপাশ থেকে ওপাশে গড়াগড়ি খেয়ে চলেছে। সেতু প্লেটে খাবার নিয়ে মিতুকে নলপত করছে খাওয়ার জন্য। আচমকাই মছিদা এক টানে প্লেট ছুড়ে মেঝেতে ফেলে দেন। তার অগ্নি চোখজোড়া সেতুর দিকে নিবদ্ধ রেখে বলে,
‘এত বড়ো সাহস কোথা থেকে পেলি তুই? এই ডাইনি রাক্ষসীর জন্য খাবার আনিস! ছেলেকে খেয়ে শান্তি হয়নি যে আরও কিছু খেতে ইচ্ছে করছে ওর!’

সেতু চেঁচিয়ে বলল, ‘চুপ করেন আম্মা৷ এমনে কইয়েন না। পাপ বাড়াইয়েন না আর৷ এত পাপ আপনাগো মা-পুতেগো সইবো না। আপনে কি জীবনও মা হন নাই? বুঝেন না মা হইতে কত কষ্ট হয় একটা মাইয়ার?’

‘চুপ! মা হওয়ার কষ্ট তোর মতো আঁটকুড়ার থেকে জানতে হবে আমায়! তিন তিনটে বাচ্চা গর্ভে ধারণ করেছি। তারা দুনিয়ায় এসেছেও৷ তোর বোনের মতো গিলে খাইনি বাচ্চা। আর তোর তো কপালেই নেই বাচ্চা।’

‘বারবার এক কথা কইবেন না। ভাগ্যে যা থাহে তাই হইবো৷ বাচ্চা খাইছে, বাচ্চা গিলছে এইগুলা কেমন কথা কইতে পারেন? মিতুর বয়স কত? চৌদ্দ বছর। এই বয়সের মাইয়াগো বাচ্চা মরা কি এমন আহামরি কিছু? কত মরতাছে হাজার হাজার। এই বয়সে গর্ভধারণ করলে হয় মা মরে, নাইলে বাচ্চা মরে। আবার দেহা যাই মা-শিশু দুইজনই। এইগুলা মনে হয় জানেন না আপনে? ম্যাট্রিক পাশ নাকি করছিলেন হুনছি। হেরপরও এমন কুসংস্কার নিয়া কেমনে চলেন?’

মছিদা নাক মুখ থেকে গরম হাওয়া ছাড়তে ছাড়তে বললেন, ‘বেশি কথা বলবি না একদম। জিভ টেনে ছিড়ে দেব। বের হ দুই বোন এই বাসা থেকে। বের হ বলছি।’

সেতু এমন করে হাসল যেন মজার কিছু শুনেছে। হাসি মুখেই বলল, ‘বাঁচমু তাইলে।’

মছিদা দাঁত কিড়মিড় করছেন। হঠাৎ এগিয়ে আসতে আসতে বললেন, ‘ওর পড়ে পড়ে ঘুমানো ছুটাচ্ছি আমি। আমার নাতি খেয়ে শুয়ে থাকা! দাঁড়া দেখাচ্ছি।’
মছিদার হাত মিতুর শরীরে পড়ার পূর্বেই সেতু হাত মোচকে দেয় ভালো করে। এরপর ধাক্কা দিতেই মছিদা মাটিতে লুয়িয়ে পড়ে। ব্যথায় কুঁকড়ে যায় মছিদা। হাত ধরে চেঁচাতে থাকে জোরে জোরে।
নাহিদ ছুটে আসে মায়ের কান্নার শব্দ শুনে। এসে দেখে এই অবস্থা। নাহিদ তীব্র আক্রোশ নিয়ে সেতুর দিকে ছুটে গেলে আত্মরক্ষার জন্য সেতু দাঁ তুলে নেয়। বলে, ‘আমার আর আমার বোইনের গায়ে যদি একটাও টোকা পড়ে, তাইলে তোমাগো মা-পুতের কল্লা একখানে আর দেহ অন্যহানে থাকবো কইয়া রাখলাম। আইজ দেখমু কার জীবনের মায়া নাই।’

সেদিন নাহিদ ভয়ে পিছিয়ে এসেছিল। সেতুর মধ্যে সেদিন আজরাইল ভর করেছিল যেন। সেটার আঁচ করেই মছিদাকে নিয়ে সরে আসে নাহিদ।

পরদিন খবর পেয়ে আবুল কালাম ও রুপালি ছুটে আসে মিতুকে দেখার জন্য৷ বাড়িতে পা ফেলতেই তারা সেতুর মুখোমুখি হয়। রুপালি এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘মিতু কইরে মা? কাইল রাইতে নাকি….’

‘কি চাই আপনাগো?’ সেতুর সোজা কথার বাণ।

আবুল কালাম বললেন, ‘এমনে কইরা কইস না মা। আমরা তোর বাপ-মা।’

‘দুই বছর আগে মইরা গেছে তারা। আমি মাইরা ফেলছি তাগোরে। আপনারা ভাগেন এইহান থেইক্যা। আমার বাপ-মা নাই।’

রুপালি আর আবুল কালাম কিছুক্ষণ একে অপরের চোখ চাওয়াচাওয়ি করে। রুপালি বলে, ‘মিতুর আঁতুড়ঘরখান কই? চিনায় দে।’

সেতু এবার উগ্রবাদী হয়ে গেল। ‘যাইতে কইছি না এইহান থেইক্যা? গলা ধাক্কা খাওয়ার ইচ্ছা আছে?’

মছিদা কোত্থ থেকে প্রকট হলো। হাতের যন্ত্রণা কমেনি এখনো। আঘাতপ্রাপ্ত বাঁ-হাতটা ডান হাতের দখলে রেখে দু কদম এগিয়ে রুপালির সামনে দাঁড়ায়। চোখ উল্টে বলে, ‘ঝাড়ুর বারি খেয়ে যাবেন নাকি জুতোর বারি? গলা ধাক্কা তো কমই।’

অপমানে আবুল কালাম ও রুপালির গা ঝিমঝিম করে। মাথা তুলে তাকানো দায় হয়ে পড়ে। মছিদা আবারও বললেন, ‘মেয়েদেরসহ যেইদিন নিয়ে যেতে পারবেন, ওইদিন দেখা করতে আসবেন। তার আগে আসলে জুতা, ঝাড়ুই কপালে পড়বে। দুই মেয়েকে তো বিক্রি করেই দিয়েছেন, আবার মেয়ে দেখতে আসেন কোন মুখে? নির্লজ্জের সীমা ছাড়িয়ে কতদূর গিয়েছেন হিসাব আছে তো? কুকুরের জাত বলে কথা! ভাবতেই শরীর ঘিনঘিন করে। বাবাগো বাবা! এগুলো কি মানুষ? লোভীর বংশ এখনও দাঁড়িয়ে আছে দেখি! ছিঃছিঃছি, আমি হলে কিভাবে মরবো সেই উপায় খুঁজতাম।’

সেতু দাঁত কামড়ে জায়গা ছাড়ে। শত হলেও আপন বাবা-মা বলে কথা। ভাবলো সে চলে গেলে তার বাবা-মাও চলে যাবে। ফলে মছিদা আর কটু কথা বলার সুযোগ পাবে না। সেতু ঘরের ভেতর ঢুকে ঠাস করে দরজা বন্ধ করে ফেলে। মছিদা তৃপ্তির হাসি দেয়। মাথায় রোদ ও অপমানের পাহাড় নিয়ে মেয়েদের শ্বশুরবাড়ি ছাড়লেন আবুল কালাম ও তার স্ত্রী রুপালি, সঙ্গে ছেলে রুজন। সেইদিন রুপালি আর আবুল কালামের মধ্যে তুমুল ঝগড়া বাঁধে। মেয়েদের বিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্তটা অবশ্য আবুলের ছিল। তবে দোষীর খাতায় রূপালির নামটাও জুড়ে গিয়েছে। বাড়ি যখন ফাঁকা তখন মনের মধ্যে অঢেল সাহস জুগিয়ে ফাঁস নেওয়ার কায়দা খাটান রুপালি। সফলও হন। মরার আগে ছেলে রুজনের জন্য মনটা চাচ্ছিল বেঁচে থাকি আরও কয়টা বছর। কিন্তু কোন মনে আবার সিদ্ধান্ত ঘুরে গেল। কষ্টের জীবনের ইতি টেনে চিরতরে বিদায় জানানোর ইচ্ছে জেগে উঠলো। যেই ভাবা সেই কাজ। তিনি রেখে গেলেন ব্যর্থ মায়ের জীবন কাহিনী এবং নিম্নবিত্তদের অসহায়ত্বের শেষ ফলাফল।

রুপালি আত্মহত্যা করেছে এক সপ্তাহ হলো। তবে সেতু ও মিতু জেনেছে গতকাল সকালে। চোখের পলকে দুনিয়া থমকায়। হতভাগাদের আর কত কি দেখতে হবে জানা নেই। তাদের এই রঙহীন সাদা-কালো জীবন স্থায়ীভাবে গেঁথে রবে নাকি কোন এক কাক ডাকা ভোর সোনালি দিন হয়ে বদলে দেবে জীবনের মোড়?
চলবে ইনশাআল্লাহ..

বিঃদ্রঃ কয়দিন ব্যস্ত থাকায় ছোট হচ্ছে পর্বগুলো। তবে পরবর্তী পর্ব বড়ো দেওয়ার ইচ্ছে ইনশাআল্লাহ। সবাই শেষ অবধি পাশে থাকুন এটাই চাওয়া।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here