গোধূলিলগ্ন ১৮

0
390

উপন্যাসঃ”গোধূলিলগ্ন”
শান্তনা আক্তার
পর্বঃ১৮

চার দেয়ালের মাঝে ফুলে ফুলে সাজানো একটি খাটে হাটুদ্বয় বুকে ঠেকিয়ে নিঃশব্দে বসে আছে মিতু। মাঝেমধ্যে তার চঞ্চল, ছটফটে চোখজোড়া এদিকসেদিক চেয়ে চলেছে। তার মনে যেমন ভয় হচ্ছে তেমনই লজ্জাও স্পষ্ট। এই বয়সের মেয়েদের লজ্জা অন্য ধাঁচের। এর কারণ এই বয়সী মেয়েরা বাস্তবতা সম্পর্কে অজ্ঞাত। জ্ঞান কম। ফলে বোধবুদ্ধিও কম। যে যেটা বোঝাবে তাই বুঝবে। ঠিক – বেঠিক ধারণা নেই বললেই চলে। এরা কখনো ভেবে কাজ করেনা। ঠিক এইজন্যই এই বয়সের মেয়েরা ভুল পথে খুব সহজেই চলে যায়। মিতুর বয়সী মেয়েরা খুব একটা আবেগপ্রবণ হয় না। তবে আবেগের সূত্রপাত যেন এই বয়সের কোন অংশ ধরেই হয়ে থাকে। এরা খুব সহজেই যেকোনো সম্পর্কে জড়াতে পারে না। বিশেষ করে প্রেমের সম্পর্ক। তবে মিতুর বয়সী ছেলেদের ক্ষেত্রে কয়েক দফা বেশি ভিন্নতা রয়েছে। তাদের মন মানসিকতা সম্পূর্ণ শিশুর মতো হয়ে থাকে। তাই সেসব ছেলেদের কাজ কর্মও শিশুদের মতোই। অন্যান্য মেয়ের তুলনায় মিতুর বোঝার ক্ষমতা একটু হলেও কম। মিতু মায়া,মমতা, স্নেহের ভালবাসা বুঝলেও, প্রেম ভালবাসা বোঝে না। তাইতো সে তার প্রতি কাব্যর ভালবাসাটার প্রকারভেদ ঠাউরে উঠতে পারলো না।

অকস্মাৎ দরজা লাগানোর শব্দে মিতুর মনের ভেতরে অন্যরকম এক ভয় উঁকি দিল। যা দ্রিমদ্রিম শব্দ তুলে আতংক সংকেত জারি করছে। বাড়িয়ে দিচ্ছে হাত-পায়ের কম্পন। মিতু পিটপিট করে তাকাতেই নুরুলের ভয়ংকর চাহনি ভেসে ওঠে। নুরুল হেলে দুলে মিতুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে এলোমেলো পা ফেলে। মিতুর ভয় আরও বেড়ে গেল নুরুলের বিভৎস অবস্থা দেখে। মিতু আচমকাই কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বলে উঠল,
‘আপনি এইহানে ক্যান? আমার বুবু কই? আমার বুবুরে ইকটু আইতে কন। বুবু, ও বুবু!’

নুরুলের ভাব ভঙ্গিতে এটা স্পষ্ট যে সে মাদক সেবন করেছে। মদ খেয়ে সে চোখে শর্ষে ফুল দেখলেও কান ঠিকই খাড়া। সে হুংকার ছেড়ে বলল, ‘ওই মেয়ে চুপ। এখন তুই আমার বউ। আমার ঘরে আমি আসবো না, তো কে আসবে শুনি? বুবু টুবুর সাথে সকালে কথা বলবি।’

নুরুল শত চেষ্টা চালিয়েও স্বাভাবিক ভাবে কথা বলতে পারছে না। গলায় তার নেশাগ্রস্তদের ন্যায় টান চলে আসছেই। শব্দগুলো অস্পষ্ট শোনায়। ফলে বাক্যগুলোও অস্পষ্ট।

মিতু চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে বলল,
‘আপনি আমারে যাইতে দেন। আমার বুবু এহনো আমার কাছে আহে নাই এইহানে আসার পর থেইক্যা। আপনি আমার বুবুর কাছে যাইতে দেন দয়া কইরা।’

নুরুল অট্টহাসি দেয়। ঘাড় বাকিয়ে কুৎসিত স্বরে বলে, ‘তোর সাহস তো কম না। আজ আমাদের বাসরঘর আর তুই কিনা তোর বুবুর কাছে যেতে চাচ্ছিস! তোর বুবুর কাছে যাওয়ার জন্য মনে হচ্ছে তোকে বিয়ে করে এনেছি? আরেকবার বুবু বললে তোর গর্দান যাবে আমার হাতে।’

ভয়ে চোখ ফেটে কান্না ছলকে আসে মিতুর। এই মুহুর্তে নুরুলকে মিতুর নিকট আলিফ লায়লার সেই ভয়ানক দৈত্য মনে হচ্ছে। যে দৈত্যকে মিতু ভীষণ করে ভয় পায়। মিতু জবুথবু হয়ে বসে থাকল। নুরুল কাছে এগোলে এক পাহাড় আতংক নিয়ে বলল,
‘আপনি কি করবেন আমার লগে? আপনি তো আমার বাজানের লাগান। আপনি আমারে যাইতে দেন। আমারে ধমকাইয়েন না, মাইরেন না।’

মিতুর কন্ঠে করুণা। নুরুলের সারা শরীরের রক্ত যেন মাথায় চড়ে গেল তাকে বাবার সমতূল্য ভাবায়। সে গলা উঁচিয়ে ঝাঁঝ কন্ঠে বলল,
‘মেরে রাস্তায় ফেলে দেব। বিয়ে করা স্বামীকে বাজান বলিস! লজ্জা করেনা? অত কথা বাদ। তুই এখন আমার কাছে আয় তোকে একটু আদর করি।’

‘না আমি আপনার কাছে যাইতে চাইনা। আমার আদর লাগবো না। আমি আমার বুবুর কাছে যামু। বুবু রে, কই তুই?’

নুরুল গিয়ে মিতুর মুখ ঠেসে ধরে। মিতু ছোটার জন্য ছুটাছুটি করলে খাটের সাথে এক-দুইটা বারি দেয়। একটুর জন্য মাথা ফাটেনি বোধয়। মিতু ব্যথায় গোঙ্গাতে থাকে। মুখ চেপে রাখায় শ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। মিতুর জীবনের সবচেয়ে কঠিন সময় বোধয় এই মুহুর্তটাই।
নুরুল কুৎসিত ভাষায় বলছে, ‘ঢং জ্বালিয়েছে তোর? বাচ্চামি দেখাস? তোর বাচ্চামি ছুটিয়ে দেব। চিৎকার করবি তো জানে মেরে দেব। তোকে বিয়ে করার জন্য এতগুলো টাকা উঁড়ালাম,আর তুই কিনা আমার কাছে আসবি না? সেটা কিভাবে হয়? জবাই করে তারপর তোর বুবুকে ডাকা ছুটাবো আমি।’

নুরুল সরিয়ে আনে তার হাত মিতুর মুখ থেকে। ছাড়া পেয়ে মিতু সাপের মতো ফোঁস করে ওঠে।
‘আমি থাকুম না এইহানে। আমি আমার বাইত্তে চইল্যা যামু। কাইলই আমার বাজানরে কমু আমারে নিয়া যাওনের লাইগ্যা। আপনি একটা শুওর, শয়তান, আজরাইল।’

নুরুল মিতুর মাথা ঝাঁকুনি দিতে দিতে বলল,
‘চুপ কর। তোকে পাওয়ার জন্য টাকাকে টাকা ভাবিনি। আর এখন কিনা তুই পালাতে চাস! আর চাইলেই কি আমি তোকে পালাতে দেব নাকি? আমার টাকাগুলো উশুল না করেই তোকে কিভাবে যেতে দেই বল? আমার এখান থেকে তোর লাশ যাবে, কিন্তু তুই না।’

‘লাশ’ শব্দটা শুনে মিতুর কলিজা পানিশূন্য হয়। ভয়ে আতংকে চেঁচাতে শুরু করে দেয়। অবস্থা বেগতিক দেখে নুরুল মিতুকে টেনে বিছানা থেকে নামায়। বেশ কয়েকটি বারি মারে দেয়ালের সাথে। শেষ বার বেশ জোরে মারায় মাথায় এক পাশের চামড়া ফেটে রক্ত বের হয়। রক্ত দেখে মিতুর চিৎকার দেওয়া থেমে গেল। ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে সে নুরুলের পা জড়িয়ে ধরে।
‘আপনি আমারে ছাইড়া দেন। মাইরেন না। আমি আর চিল্লামু না। আমার ব্যথা করতাছে মাথায়। আমার সব রক্ত শেষ হইয়া যাইবো। আমি বাঁচুম না। আমারে মাইরেন না।’

নুরুল পৈশাচিক হাসি দিয়ে নরম হলো। হাত আলগা হতেই মিতু বিদ্যুৎ গতিতে দরজার কাছে চলে গেল। ছিটকিনি অবধি হাত যেতেই সাথে সাথে নুরুলও গিয়ে মিতুর হাত শক্ত করে ধরে ফেলল। তারপর এক টানে মেঝেতে ফেলে দিল মিতুকে। মাথা চুইয়ে সরু রক্তের রেখা বেয়ে চলেছে নিরন্তর। মিতুর গলার দিকটা রক্তে টইটম্বুর হয়ে গিয়েছে।

সেই দিকে নুরুলের বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই। সে গরম নিশ্বাস ছেড়ে বললেন, ‘এত বড়ো কলিজা তোর? তুই আমার হাত থেকে পালাতে চাস? ফন্দি আঁটোস? চালাকি করিস? তুই চাইলেই কি তোকে ছেড়ে দেব নাকি? আজ থেকে তুই আমার জেলে বন্দী। দুনিয়ার কেউ তোকে আমার জেল থেকে মুক্তি দিতে পারবে না। তোর ওই বাজান আর বুবু তো এক তুড়ির বাতাসে উঁড়ে যাবে। সেই ক্ষমতা আমার আছে।’

মিতু আবারও নুরুলের পা জড়িয়ে ডুকরে কেঁদে উঠে বলল, ‘আমি বুবুর কাছে যামু। আমারে ছাইড়া দেন। আপনারে আল্লাহর দোহাই লাগে। আমার মাথায় জ্বালা করতাছে। জীবন বাইর হইয়া যাইতাছে। আমারে ছাইড়া দেন। মায় তো কইছে আমি বুবুর লগে থাকমু। আপনারা তা না কইরা আমার বুবুরে সরায় রাখছেন আমার থেইক্যা।’

নুরুল মিতুর দুবাহু ধরে তুলে শয়তানি এক হাসি দিয়ে বলল, ‘যাবি তো। কিন্তু এখন না। কাল সকালে। তোরা দুইবোন মিলেই তো এই সংসারের হাল ধরবি। সংসারের সব দায়িত্ব পালন করবি। কিন্তু তার আগে তোর মাথায় ঔষধ দিতে হবে। রক্ত পড়া বন্ধ করতে হবে, তারপর তোকে স্বামীর দায়িত্ব পালন করতে হবে। পরিশেষে তোর বুবুর কাছে যেতে পারবি। আমি কিচ্ছুটি বলবো না।’

নুরুলের কাছ থেকে বিচ্ছিরি এক গন্ধ বারে বারে মিতুর নাকে গিয়ে বারি খাচ্ছে। নুরুলের একদম কাছে থাকায় গন্ধটা তীব্র ভাবে মিতুর মাথা ধরিয়ে দিচ্ছে। ইতোমধ্যে পুরো ঘরেই গন্ধ ছড়িয়ে গিয়েছে। মিতু বুঝতে পারছে না এটা কিসের গন্ধ। কিন্তু এটা যে নুরুলের কাছ থেকে আসছে, সেটা খুব ভালো করেই বুঝতে পারছে। পেটে পাক দিয়ে মিতুর যেন ঠেলে বমি আসছে। সে অন্যদিকে ফিরে মুখে হাত চেপে বলল, ‘সত্যি আমারে বুবুর কাছে যাইতে দিবেন?’

‘হুম দিব তো। তবে আমি কি বলেছি? আগে স্বামীর দায়িত্ব পালন করতে হবে, তারপর সব।’

মিতু অসহায় দৃষ্টি মেলে বলে, ‘সেইডা কি?’

‘আমি বোঝাবো তো। তবে রক্তপাত বন্ধ করবো আগে।
নুরুল প্রাথমিক চিকিৎসার মাধ্যমে মিতুর আঘাতপ্রাপ্ত স্থানের রক্তপাত বন্ধ করল। এরপর ধিরে ধিরে লোলুপ দৃষ্টি প্রখর করে কুৎসিত মনে মিতুর শরীরে হাত বিচরণ করতে লাগলো৷ একটা সময় যা অমানবিক জুলুমে রূপ নেয়। যাকে এক হিসেবে বৈধ ধর্ষণ বললেও ভুল হবে না। মিতু নিজেকে ছাড়ানোর প্রচেষ্টা করতে করতে একটা সময় স্তব্ধ হয়। হেরে যায় বলিষ্ঠ, দীর্ঘদেহী লোকটির জোরাজুরির কাছে। ১২ বছরের বাড়ন্ত বয়সের মেয়েটি হাজার চেষ্টা করেও পারলো না হিংস্র নুরুলের লালসার হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করতে। নুরুল এতটাই পাষাণ একজন মানুষ, যার মনে কিনা বিন্দুমাত্র মায়া জন্মালো না মিতুর হাহাকারে কাতরানোর জলজ্যান্ত দৃশ্য দেখে। আজ থেকে নুরুল নামক এই মৃত্যুপুরীর ঠিকানায় মিতুর নামটি জড়িয়ে গেল। যে ঠিকানার শেষ গন্তব্য স্টেশন কতটা বিভীষিকাময়, তার আঁচ করা প্রায় অসম্ভব।

অন্যদিকে মিতুর আর্তচিৎকার বুকের ভেতরটা ছিন্নভিন্ন করে প্রাণপাখি বেরিয়ে আসতে চাইল সেতুর। নিজ ঘরে বসে থাকতে পারছিল না সে। নাহিদকে ঠেলে বেরিয়ে আসতে গিয়ে বাঁধাপ্রাপ্ত হয় বারবার। নাহিদ না পেরে সেতুর হাত-পাসহ মুখ বেঁধে দেয়। এরপর শুরু করে বেত্রাঘাত। একের পর এক বেত্রাঘাত একটা সময় চোখ ঝাঁপিয়ে ক্লান্তি টেনে আনে। জ্ঞান হারানোর পূর্বে হাহাকারের দীর্ঘশ্বাস হাওয়ায় ছেড়ে সেতু তার চোখ জোড়াকে আরাম দিল লম্বা একটা সময়ের জন্য।
চলবে ইনশাআল্লাহ….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here