ক্যামেলিয়ান ৮+৯

0
1290

#ক্যামেলিয়া
#সাদিয়া_খান ( সুবাসিনী)
#পর্বঃ৮+৯

(২২)

সুফিয়া বেগম মিনতি করে চলেছেন সবার সামনে। নত স্বরে বার বার বলে চলেছেন তার মেয়েকে এত বড় অপবাদ যেন না দেওয়া হয়। ধীরে ধীরে গ্রামের সকল মানুষ জমা হচ্ছে তাদের বাড়ির সামনে। কেউ তামাশা দেখতে এসেছে। আবার কেউ এসেছে বিচার করতে।ইতিমধ্যে গ্রামের চেয়ারম্যানের বাড়িতে খবর পাঠানো হয়েছে। লোক পাঠানো হয়েছে মেম্বর সাহেবের বাড়িতেও।

জাফরিনের বড় চাচা এসে তার মা কে বলছে

“ভাই মরে নাই দুই দিন, আর এখনি তোরা আমার ভাইয়ের বাড়ি বাজারের বাড়ি বানায় নিছিস?”

জাফরিনদের বাড়ির সামনে এবং ভিতরে চলছে তুমুল ঝগড়া। মেয়েটার পক্ষ নিয়ে যে কথা বলতে এসেছে তাকেই কথা শোনাতে পিছপা হচ্ছে না কেউ।তবে জাফরিন?
জফরিন একদম চুপচাপ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার ভিতর মনে হচ্ছে না কোনো অনুভূতি কাজ করছে।
এক গ্রাম লোকের সামনে সে হুট করে এসে দাঁড়ালো ফয়সালের সামনে। চোখে চোখ রাখতেই মাথা নিচু করে দাঁড়ালো ছেলেটা।
জাফরিন তাকে শক্ত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,

“আপনি রাতে আমার সাথে ছিলেন?”

ফয়সাল দৃঢ় কণ্ঠে জবাব দিলো

“হ্যাঁ।”

“কোন ঘরে ছিলেন আপনি?”

“তোর ঘরে। তুই ভুলে গেছিস?”

“আপনি নিশ্চিত? আপনি আমার সাথে আমার ঘরে ছিলেন?”

“হ্যাঁ।”

“তবে তো আপনি আমার শিৎকারেও আমার সাথেই ছিলেন?আপনার গায়ে এসব দাগের কারণ ও নিশ্চয়ই আমি?”

” লোকে যখন জেনে গেছে তখন এসব লুকিয়ে রেখে লাভ কী?”

জাফরিন সজোড়ে থাপ্পর মারলো ফয়সালের গালে। বাড়িতে উপস্থিত মানুষের সবাই অবাক চোখে তাকিয়ে রইল মেয়েটার দিকে৷ রাগে জাফরিনের শরীর জ্বলে যাচ্ছিলো।ঠিক সেই সময় তাদের বাড়ির ভিতর থেকে বেরিয়ে এলো জাফরিনের বড় মাম-মামী এবং এলাকার চেয়ারম্যান এবং তার স্ত্রী। চেয়ারম্যানকে দেখে সবাই উঠে দাঁড়ালো।সুফিয়া বেগম জাফরিনকে টেনে এনে তার পাশে দাঁড় করাতেই জাফরিন চিৎকার করে বলল,

” ঠোঁট টেনে ছিড়ে ফেলবো আমার বাবা- মায়ের সম্পর্কে কেউ কিছু বললে। কুত্তার বাচ্চারা তোদের সাহস কী করে হয় আমার বাড়িতে এসে আমার বাবা মায়ের কথা এসব বলতে?”

জাফরিনের রাগ যেন হুট করেই বেড়ে গেল।সে পাশে পড়ে থাকা চ্যালা কাঠ নিয়ে এগিয়ে গেল ফয়সালের দিকে। ঠিক সেই সময় বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালো ইউভানের গাড়ি।সে দৌড়ে এসে জাফরিনকে দু হাতে আগলে ধরে সরিয়ে নিয়ে এলো সেখান থেকে। জাফরিনকে উঁচু করে তুলে নিয়ে সে ঘরের ভিতরে রেখে বাইরে থেকে দরজা লাগিয়ে দিয়ে বলল,

“বাপ রে! ইদানীং কী খাচ্ছিস রে তুই?আমার হাসফাস লাগছে এতটুকুতেই।”

“ভাইয়া তুমি দরজা খোলো। আজ ওর গুষ্টির কান্দে আমি যদি হাল না জুড়েছি তখন বলিও।”

“চুপচাপ বসে থাক।আমরা দেখছি।”

ইউভান তার বাবাকে যথেষ্ট ভয় পায় তবুও নিজেকে দমিয়ে না রাখতে পেরে সে বলল,

” আমি বলেছিলাম আপনাদের। এবার বিশ্বাস হলো?আমি থানায় কল দিয়েছি পুলিশ আসছে।”

এবার পরিবর্তন লক্ষ করা গেল জাফরিনের চাচাদের মধ্যে। তারা এগিয়ে এসে বলল,

“ওদের মধ্যে যা হওয়ার হয়েছে। জাফরিন যেমন আমাদের মেয়ে, ফয়সাল নিজেও আমাদের ছেলে।পুলিশের কাজ কী এখানে?আরো সাত পাঁচ গ্রামের মানুষ জানিয়ে মান সম্মান নষ্ট করার কী প্রয়োজন?”

“আপনার কথার ঠিক মানে বুঝলাম না।আপনি কি বুঝাতে চাচ্ছেন?”

“যা ঘটেছে তা তো আর অস্বীকার করা যাবে না।”

“আপনি যদি বয়সে আমার থেকে বড় না হতেন তবে আপনার এমন কথার জন্য আমি আপনার মুখে লাগাম লাগিয়ে দিতাম।”

তর্ক বির্তকের এক সময় চেয়ারম্যান সাহেব জাফরিনের বড় চাচা আজাহার এর উদ্দেশ্যে বললেন,

“আজাহার সাহেব, আপনি কী দেখেছেন? আমি আর আমার স্ত্রী কই থেকে এখন বের হয়েছি?”

“জি না।”

“আপনি দেখেছেন।এখানে যারা আছে তারা সবাই দেখেছে আমরা আপনার ভাইয়ের বাড়ির ভিতর থেকে বের হইছি।”

“তাতে কী?”

“তাতে কিছুই না।তবে কথা হচ্ছে গত কাল রাতেই আমরা এই বাড়িতে আসি। শুধু তাই না রাতে আমরা এই বাড়িতেই খান খেয়েছি।রাতে এই মেয়েটা আমার স্ত্রীর সাথে ঘুমিয়েছে। রাত ভর আমি এবং ওর মামা আলোচনা করেছি বিভিন্ন বিষয় নিয়ে। তাহলে কখন ফয়সাল এলো এই ঘরে? এমন কিছু হবে আগেই ওরা ধারণা করছিল।তাই আমরা এখানে।”

আজাহার সাহেব এবার বিপদে পড়লেন।তাদের জানা মতে কেউ ছিল না বাড়িতে।গত কাল সারা দিন বার বার এ বাড়ির খবর নেওয়া হয়েছে। জাফরিন এবং তার ম ব্যতীত তখন কেউ ছিল না।

আজাহার সাহেব তার ছোটো ভাই মানে আশার বাবার দিকে তাকালেন।তাকে দেখেও বেশ চিন্তিত মনে হচ্ছিল।গতকাল সন্ধ্যের পর সে ও বাড়ি গিয়ে খবর নিয়েছিল।তখন তো দুই মা মেয়ে কোর-আন শরীফ পাঠ করছিল।আর তো কেউ ছিল না।তাহলে জাফরিনের মামা কিংবা চেয়ারম্যান সাহেব কখন এলেন?

গ্রামের মানুষের মাঝে চাপা উত্তেজনা কাজ করছে।কি হতে চলেছে এখন?কারণ সবাই জানে আজমল সাহেবের ছোটো মেয়ে কথা ছেড়ে দেওয়ার মেয়ে নয়, অপর দিকে তার নামে এত বড় বদনাম রটানোর দায়িত্ব নিয়েছে তার নিজের পরিবার।
চেয়ারম্যানের কথায় জাফরিনকে আনা হলো সবার সামনে। তার মতামত জানতে চাইলে সে বলল,

“আমি থানায় অভিযোগ করতে চাই।আমার নিরাপত্তার ব্যাপার নিয়ে আমি চিন্তিত। তাই আমি।চাচ্ছি আইনের লোকের মাধ্যমে এসব সমাধান হোক।”

জাফরিনকে অনেক বোঝানোর পরেও তাকে মানানো গেল না।সে নিজের সিদ্ধান্তে অটল রইল।ফয়সালের মা এসে জাফরিনের হাতে ধরে ছেলের হয়ে মাফ চাইলে জাফরিন বলল,

“আমার জায়গায় আপনি হলে হয়তো মাফ করতেন কিন্তু আমি মাফ করতে পারবো না।এর জন্য আমি মাফ চাইছি।আমি চাই একদিনের জন্য হলেও সে হাজত বাস করুক।তাকে থানা অবধি টেনে নিয়ে যাওয়াই হবে আমার আজকের অপমানের যথাযথ মূল্য।”

জাফরিনের কথা শুনে অধরে প্রশস্ত হাসি ফুটে উঠলো মাশহুদের। জাফরিনের কণ্ঠস্বর তাকে বেশ আনন্দ দিচ্ছে। সামনে থাকা শতবর্ষী রেড ওয়াইনের গ্লাসে চুমুক দিয়ে সে মনোযোগ দিলো ফোনের স্ক্রীনে।সরাসরি ভিডিও কলে সব কিছু দেখছিল সে।
জাফরিনের এমন প্রতিবাদে সে মনে মনে পুলকিত হচ্ছিলো।একজন নারী, সে কী পারে এতটা শক্ত হতে?
মাশহুদ অনেক মেয়ের সাথে মেলামেশা করেছে। সে এ অবধি এটাই দেখেছে যে মেয়েদের প্রধান অস্ত্র হচ্ছে চোখের পানি।তারা চাইতেও না চাইতেও চোখের পানিকে ব্যবহার করে অন্যের মনে নিজের কথাকে প্রাধান্য দিতে। তারা খুশিতে কাঁদে,কাঁদে অপমানেও কিংবা কষ্টে। কিন্তু এই মেয়েটা তার জীবনের চূড়ান্ত অপমান সহ্য করেও নিজেই রুখে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশের মেয়েদের সম্পর্কে তার দাদার কাছ থেকে যতটা শুনেছে এই দেশে এমন পরিস্থিতিতে একজন মেয়ে থাপ্পর তো দূরে থাক প্রতিবাদ অবধি করতে হাজারো বার সমাজের কথা ভাবতে থাকে।

এক চুমুকে গ্লাসের পুরো ওয়াইন শেষ করে দিয়ে এতে হালকা পরিমাণের স্কচ ঢেলে নিলো সে। যেদিন থেকে আজমল শিকদার মারা গেছেন সেদিন থেকে তার এসব পান করার অভ্যসে যেন ধীরে ধীরে বেড়ে চলেছে। কারণটা কী তার কন্যা?যার কণ্ঠ শুনলে তার নেশা লাগে,তৃষ্ণা পায়। এক দেখা আজন্মকালের তৃষ্ণা? নাহ্ তার গলাটা পুনরায় শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেল।তার এই অসুখের ঔষধ যে সেই দূর দেশে রয়েছে।

এমিলিকে ডেকে সে তার ব্যক্তিগত ক্রেডিট কার্ড দিয়ে বলল,
” বাংলাদেশে যাওয়ার সকল কাগজ পত্র আগামী তিন দিনের মধ্যে রেডি করো।”

“স্যার হঠাৎ বাংলাদেশে?”

“হ্যাঁ,এবং আজমল সাহেবের লাশ সেদিন পাঠানোর সকল ব্যবস্থা করে ফেলো।”

(২৩)

জাফরিনদের নিয়ে তার বোনেরা আর এক মুহুর্ত কোনো দুশ্চিন্তা নিতে রাজি নয়। তাদের কে যত দ্রুত সম্ভব শহরে চলে আসার জন্য দুই বোন অনুরোধ করতে লাগলো।শুধু তাই নয় বড় আপা তো কাঁদতে কাঁদতে প্রেশার হাউ করে ফেলেছে।
জাফরিনের মনে হচ্ছে এই মানুষটার জন্মই হয়েছে কাঁদার জন্য।সে কাঁদতে থাকে কোনো না কোনো।কারণেই। মায়ানের রেজাল্ট খারাপ হলেও সে কাঁদে, আবার ভালো হলেও কাঁদে।
সবার কথা এবার আর ফেলতে পারলো না তারা। সুফিয়া কে নিয়ে তার ভাই এক গাড়িতে করে চলে এলো।জাফরিন আসছিল ইউভানের সাথে।কিছু দূর আসার পর ইউভান রাস্তা পরিবর্তন করতেই জাফরিন জিজ্ঞেস করলো,

“কোথায় যাচ্ছি আমরা?”

“কাজী অফিস।”

জাফরিনের দুই চোখ হঠাৎ করেই আনন্দে ভরে উঠলো।কিছুটা রাগত স্বরে সে বলল,

“তবে এত দিন নাটকের কী দরকার ছিল?আমি।অন্তত একটা শাড়ি পরে আসতাম।”

“আগে এই সমাজের মুখ তো বন্ধ করি এরপর একটা না দশটা শাড়ি পরা যাবে।”

চলবে
#ক্যামেলিয়া
#সাদিয়া_খান (সুবাসিনী)
#পর্বঃ ৯

(২৪)

কাজী অফিসের সামনে দাঁড়িয়ে জাফরিন শক্ত করে জড়িয়ে ধরেছে ইউভানের হাত।দীর্ঘ পাঁচ বছর যাবত এই দিনটার অপেক্ষা করেছে সে। যেদিন সে প্রথমে বুঝতে শিখেছে মা-বাবা কিংবা আপন জনের ভালোবাসা ছাড়াও অন্য আরো একটি ভালোবাসার সম্পর্ক হয় সেদিন থেকেই সে এই দিনটির অপেক্ষায় ছিল।

কাজী অফিসের ভিতরে প্রবেশ করেই দেখতে পেলো সেখানে কনে বেশে বসে আছে মোনালী।তার দু হাত ভর্তি রয়েছে মেহেদীর আলপনা। প্রথমেই মোনালী যেদিকে তাকালো সেটা হলো ইউভানের হাতের দিকে। হুট করেই মনে হলো শরৎের আকাশে মেঘ জমেছে। যে কোনো সময় হবে বৃষ্টি। তার নিজের মন খারাপ কে লুকানোর ব্যর্থ চেষ্টা করে সে তাকালো ইউভানের হাতের দিকে।
যে হাত আবদ্ধ রয়েছে জাফরিনের হাতে। হাত ছাড়িয়ে নিয়ে জাফরিন তার দিকে গিয়ে বলল,

“আমার অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে এবার তবে তোমরা বিয়ে করে নিচ্ছো।”

অনিচ্ছাকৃত ভাবে হেসে মোনালী হ্যাঁ সূচক জবাব দিলো। জাফরিন খুশিতে তাকে জড়িয়ে ধরে রইল।বেশ সময়। এর ফাকে ইউভান প্রয়োজনীয় কাজ সেরে এসে তাদের পাশে বসে বলল,

“এবার তবে কাজ শেষ করা যাক?”

মোনালী হ্যাঁ সূচক জবাব দিলো। ঠিক সেই মুহুর্তে তার ফোন বেজে উঠেছে। কল রিসিভ করে নিঃশব্দে কিছু সময় পার করলো সে। নিজের চেয়ার ছেড়ে উঠে যেতে যেতে সে বলল,

“আমার পক্ষে এই বিয়ে করা সম্ভব নয় ইউভান।আমি জানি আজকের পর থেকে হয়তো তুমি কখনো আমার মুখ দেখতে চাইবে না কিন্তু আমার কোনো উপায় নেই।আমি তোমার জন্য কনে বেশে এখানে বসে ছিলাম পুরো পরিবার এবং বাবার মতের বিরুদ্ধে। কিন্তু আমি পারলাম না আমার পঁচিশ বছরের পিছুটান রেখে তোমার হাত ধরতে। আমার বাবার কান্না যে আমি সহ্য করতে পারছি না। পারলে আমায় মাফ করো তুমি।”

ইউভান নিশ্চুপ হয়ে বসে রইল।সে যেন জানতো যে এমন কিছুই হতে চলেছে৷ কিন্তু জাফরিন নিজেকে স্থির রাখতে পারলো না।সে মোনালীর হাত ধরে বলল,

“আপু আমরা সবাই মিলে একটা ব্যবস্থা ঠিক করে ফেলবো।এই ভাবে সব কিছু শেষ করে দেওয়া ঠিক নয়।”

মোনালী কিছু না বলে জাফরিনের হাত ছাড়িয়ে দিয়ে দ্রুত গতিতে বেরিয়ে গেল সেখান থেকে।পিছনে ফেলে গেল তার দীর্ঘ পাঁচ বছরের প্রতিশ্রুতি, ভালোবাসা এবং এক জীবনের স্বপ্ন।

গাড়িতে বসে জাফরিন ইউভানের দিকে তাকিয়ে রইল।ইউভান আপন মনে ড্রাইভিং করতে ব্যস্ত। শহরের ভিতরে ইতিমধ্যে প্রবেশ করেছে তারা। রাস্তায় সিগন্যালে গাড়ি দাঁড়াতেই জাফরিনকে পানি কিনে দিলো সে।এক বাচ্চার থেকে হাওয়াই মিঠাই ও নিলো।সেসব হাতে নিয়ে জাফরিন ইউভানের উদ্দেশ্যে বলল,

“ভাইয়া তোমার কান্না পেলে তুমি কাঁদতে পারো।”

“কেন?”

” আপুর চলে যাওয়াতে তোমার কষ্ট হচ্ছে আমি বুঝতে পারছি। কিন্তু কী বলবো?”

জাফরিনের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল ইউভান।মেয়েটার হাতে থাকা হাওয়াই মিঠাইয়ের প্যাকেট খুলে দিয়ে বলল,

“আমাদের সমাজ বড্ড খারাপ সমাজ। জানিস তো?এখানে প্রেমিক ব্যতীত অন্য কেউ একজন মেয়ের জন্য ফুল কিনতে পারে, এটা এই সমাজ মেনেই নেয় না।একজন মানুষ যখন ফুলের দোকানে, কিংবা রাস্তায় কোনো ফুল কিনে তখন ফুল বিক্রেতা থেকে শুরু করে আশেপাশের সবাই মনে করতে থাকে যে ব্যক্তিটা তার প্রেমিকার জন্যই কিনেছে। অথচ ফুলগুলো তার বোন কিংবা মায়ের জন্যও তো কিনতে পারে।
কিংবা ধরে নে এই হাওয়াই মিঠাই। এর গায়ে কোথাও কি লেখা আছে যে এই হাওয়াই মিঠাই শুধু মাত্র প্রেমিকাকেই দেওয়া যাবে?

যে মানুষটা সাধারণ সম্পর্ক গুলোকে জটিল করে ফেলে, শুধু জটিল নয় একটা সম্পর্ক নিয়ে সব সময় বাজে চিন্তাভাবনা রাখে সে মানুষ নিয়ে কী সারা জীবন কাটানো যেত?”

ইউভানের কথার স্পষ্ট মানেটা আজ বুঝতে পারলো জাফরিন।তবে এটাই ছিল ইউভান- মোনালীর সম্পর্কের ফাটল ধরার এক মাত্র কারণ?

“আমার জন্য তোমাদের সম্পর্ক ভেঙ্গে গেল?”

“না, এখানে তোর কোনো দোষ নেই।কারণ তুই আমার কাছে আমার বোনের মতো না,আমার ছোটো বোন।
তোর জন্য আমি তোর বড় ভাই। যার কাছে তুই সব থেকে বেশি নিরাপদ। অথচ দেখ এই সমাজ কিংবা আমার প্রাক্তন? সে কিন্তু এমন ভাবছে না।
আমি মাইরি তাকে এটা বুঝাতে অক্ষম হয়েছি যে
তোকে নিয়ে আমার মনে সামান্যতম অন্য অনুভূতি হলে কি ঈশানের পরিবার তোর বাড়িতে আসতে পারতো? না আজ যা হলো এসব হতে পারতো?”

এই সমাজ কি মানে জানিস? এই সমাজ মানে মেয়েদের জন্ম হয়েছে মাত্রই পুরুষদের সেবা করার জন্য এবং সন্তান জন্ম দেওয়ার জন্য।তাছাড়া তাদের আর কি কাজ এই সমাজের?
অথচ নারীরাই এই সমাজের ভিত্তি এটা কেউ মানতেই চায় না।

জাফরিন নিঃশব্দে তাকিয়ে রইল ইউভানের দিকে। গাড়ি চলতে শুরু করেছে, বাইরের দিকে তাকিয়ে সে আপন মনেই ভাবতে লাগলো,

“মোনালী নামক মেয়েটা জীবনে চরম পর্যায়ে বোকামী করে বসলো আজ।ইউভান নামক মানুষটাকে সে পেয়েও হারিয়ে ফেলল মাত্র তার সন্দেহ এর কারণে।”

(২৫)

আজমল সাহেবের লাশ কে আজ শেষ বারের মতোন দেখতে গিয়েছে মাশহুদ। সেখানে থেকেই কাফন পড়িয়ে পাঠানো হবে তাকে। বাংলাদেশে ফেরার পর তার যত দ্রুত দাফন করা যাবে ততই ভালো।ময়নাতদন্তের কারণে তার দেহে রয়েছে অসংখ্য সেলাই।সেসব দেখে মনে মনে শিউরে উঠেছে মাশহুদ। দ্রুত বেরিয়ে এলো লাশ ফ্রিজিং রুম থেকে।
আর যাই হোক এই লাশ তাদের পরিবারকে এই ভাবে দেখানো যাবে না।আপন জনের মৃত্যু কিংবা এমন লাশ তারা দেখে সইতে পারবে না।

এমিলি এগিয়ে এসে মাশহুদের পাশাপাশি এসে দাঁড়িয়ে বলল,

“স্যার, সব কাগজ পত্র তৈরী হয়েছে। আপনি কী সত্যি যাচ্ছেন?”

” নিশ্চিত না হওয়ার তো কোনো কারণ নেই।”

“তবে কী একা যাবেন?”

“জি না। সাত জনের টিম গঠন করুন।আমাকে যারা লিড করবে।”

“জি স্যার।আগামীকাল তবে আপনারা যেতে পারবেন।”

মাশহুদ কিছু না বলেই নিজের গাড়িতে উঠে বসলো।উঠে বসে অফিশিয়াল মেইলের মাধ্যমে জাফরিনকে জানিয়ে দেওয়া হলো আগামী কাল তার বাবার লাশ দেশে যাচ্ছে।
তাদের কে উক্ত সময়ে এয়ারপোর্টে উপস্থির থাকার জন্য।

মেইল পাঠিয়ে দিয়েও মাশহুদ উশখুশ করতে লাগলো। তিন ঘন্টা পার হয়ে যাওয়ার পরেও কোনো রিপ্লাই আসেনি জাফরিনের থেকে। অতঃপর সে নিজে কল দিয়ে বসলো জাফরিন কে।

অপর দিকে পুরো একটা ক্লান্তিকর দিন কাটিয়ে জাফরিন সবে মাত্র গোসল সেরে বেরিয়ে এসেছে। মায়ের ফোন বাজতে দেখে সে হাতে নিয়ে দেখলো বাইরের দেশ থেকে কল এসেছে।
কল রিসিভ করে সে খুবই শান্ত ভাবে মাশহুদের সাথে কথা বলল।কল কেটে দেওয়ার পর সে দুই চোখ বুজে রইল। হয়তো বৃষ্টি নামবে এজন্যই এমন গরম হাওয়া বইছে।
নিজের কান্নাকে সামলে নিলো সে। তার বাবার রেখে যাওয়া স্মৃতি হিসেবে তার কাছে কি আছে? হয়তো অনেক কিছু, অথবা কিছুই নেই।কয়েক ঘন্টা পর যে দেশে ফিরে আসবে তার বাবা এরপর শুরু হবে তাকে দাফন করার তোড়জোড়। যত দ্রুত তাকে দাফন করা যাবে ততই ভালো।
এত দিন তবুও সে আশায় থাকতো কবে তার বাবার লাশ দেশে আসবে, কবে এক নজর দেখবে?
কিন্তু আগামীর পর সেই আশাটাও থাকবে না।তার বাবার জন্য অপেক্ষা ফুরিয়ে যাবে। তার বাবা হারিয়ে যাবে তাদের থেকে।

অপর দিকে মাশহুদ অপেক্ষা করছে এই রমনীর থেকে নিজের উদ্দেশ্যটা যে করেই হোক উদ্ধার করতেই হবে। একটা তথ্য যে তথ্য কে সে হারিয়ে যেতে দিতে পারে না আজমল সাহেবের মৃত্যুর সাথে।

জাফরিন তার পরিবারকে জানানোর পর সবার মাঝেই এক উত্তেজনা বা অস্থিরতা কাজ করছিল।কিন্তু এয়ারপোর্টে যাওয়ার পর বাজলো আরেক বিপত্তি।জাফরিনের চাচারা গতকালকেই অভিযোগ করেছে মন্ত্রণালয়ে।তাদের ভাইয়ের লাশ মাত্র তারাই নিবে।জাফরিনদের কোনো অধিকার নেই।জাফরিন অবাক চোখে তাকিয়ে রইল তার রক্তের মানুষের দিকে।আজকের দিনেও কী তারা পারে? তার মৃত বাবার লাশ নিয়ে তাদের হয়রানি করতে?

চলবে -এডিট ছাড়া

(যারা গল্প পড়ছেন, তারা অনুগ্রহ করে রেসপন্স করবেন।কেনো না আপনারা রেসপন্স করলেই অনেকের টাইমলাইনে পৌঁছে যাবে এবং সবাই পড়তে পারবে। তাই অনুগ্রহ করে রেসপন্স করবেন। কারণ লিখছিই আপনাদের জন্য।”)

#ছবিয়ালঃতাসনীম

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here