কাঁটা মুকুট,পর্ব:৪+৫

0
430

#কাঁটা_মুকুট (একটি ডিভোর্স ও সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি)
||৪র্থও৫ম পর্ব||
-ঈপ্সিতা শিকদার
রাতের দেড়টা বাজে সবাই যেখানে ঘুমে ব্যস্ত আমি আমার স্বামী মানে অর্ক খাটাশটার চুলের মুঠি ধরে টানাটানি করছি। কিন্তু কোনো লাভ হচ্ছে না, একে তো মহাশয় একটা তালগাছ, তার উপর আর্মি কাট দেওয়া চুল মুঠিতে কী আর নেওয়া যায়! কোন দুঃখে যে চুল ছাঁটতে গিয়েছিলাম!

অর্ক ধরণীর বুকে গর্বিত পাহাড়ের ন্যায় দণ্ডায়মান। রাগ প্রকাশ না করার ব্যর্থতায় চোখে পানি নেমে এলো।

“সালা হারামী! আমারে জ্বালিয়ে শেষ করে আরাম করে বসে… দাঁড়া দেখাইতেছি তোরে!”

বলেই তার হাতটা নিয়ে মনের ঝাঁঝ মিটানোর উদ্দেশ্য দাঁত বসিয়ে দিলাম। কিন্তু এক মুহূর্ত না যেতেই সে ঝাড়া দিয়ে হাত সরিয়ে দিল। হাত না লাগিয়েই আমার দিকে ঝুঁকে বলল,

“দেখো মনপাখি, তোমার অধরজোড়া এমনিতেই দেখতে টসটসে বেরির মতোন, আর এখন তো পুরোই রসালো চেরির মতোন লাগছে। ইউ নো হাউ মাচ আই লাভ চেরিস! অনেক কষ্টে কন্ট্রোল করে আছি। রাগিয়ো না একদম কামড়ে খেয়ে ফেলব।”

তার কথা শুনে একটু ভয় পেয়ে প্রথমে নিজের মুখ ঢাকলাম হাত দিয়ে। পরে গল্পের ডায়লগ মারছে ভেবে আবারও রাগ মাথা চাড়া দিয়ে উঠলে জোরেসোরে এক ধাক্কা দিলাম অর্ককে। তার পিছনে ছিল বিছানা সে বিছানার উপর চিৎপটাং। আমি রাগে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে তার উপর উঠে বসে ইচ্ছে মতোন কিল-ঘুষি দিতে শুরু করলাম। আহা! এবার বেশ শান্তি বোধ হচ্ছে।
“থামো বলছি! আরে থামতে বলছি!” বলতে বলতেই সে আমাকে বিছানায় ফেলে আমার উপর চড়ে যায়।

“এখন?” দুষ্টু হেসে ভ্রু উঁচিয়ে তার প্রশ্ন। আমি মুখ ঘুরিয়ে ছোটাছুটি করতে শুরু করি।

তাতে বিন্দুমাত্রও নড়ানো যায় না তাকে। বরং এবার আমার দু’পা বন্দী তার দু’পায়ে। আর হাত জোড়া বন্দী তার ডান হাতে।

আমি মুখ ফুলিয়ে তার দিকে তাকালাম। প্রতিশোধের তাড়নায় আমার চোখজোড়া ছলছল করছে। আমার যে স্বভাব, যে যা দেয় তাকে তা যেভাবেই হোক ফিরাতে হবে।

অর্ক এবার তার তর্জনী আমার ললাটের মধ্যিখানে ঠেকায়। তার আঙুলটি ধীরে ধীরে নিচে নামাতে নামাতে হিসহিসিয়ে বলে,

“এত কীসের রাগ গো তোমার বালিকা? তবে রাগই তো না কি অভিমান? রাগ হলে উপরে ফেল, প্রেমিকের উপর রাগ থাকতে আছে না কি? রাগ থাকবে পরের উপর। প্রেমিকার সাথে হবে খুনসুটি, প্রেমের সংঘর্ষ, অভিমান।

আমার ভুলে তুমি গাল ফুলিয়ে বসে থাকবে বারান্দাতে। হাসনাহেনার গন্ধে মেতে থাকবে চারিধার। আমি ধীরপায়ে এসে হাত রাখব তোমার কাঁধে। তুমি অভিমানে চোখ ভিজিয়ে ফেলবে, ক্ষোভ মিটিয়ে কিল-ঘুষিতে ছাড়খাড় করে দিবে আমার বক্ষ খানা, তবুও আমি আগলে রাখব তোমায় বুকের মাঝে। শক্ত করে এক চুমু খাব তোমার শুষ্ক ওষ্ঠদ্বয়ে, শুষে নিব সকাল অভিমান। ক্লান্ত হয়ে, অভিমানের বরফ গলিয়ে শান্ত হবে তুমি। এরই নাম তো কাঁটা মুকুটের ভালোবাসা। অসংখ্য কাঁটায় ভর্তি তবুও এক অন্যরকম সৌন্দর্য মণ্ডিত পুষ্পময় প্রেম আছে।”

এই কথাগুলোতে কি কোনো জাদু ছিল? জানি না আমি, তবে তার অনুভূতি মাখা দৃষ্টি, শিহরণ জাগানো ছোঁয়া, এমন বুলিতে আমি এক মুহূর্তের জন্য থমকে গেলাম। ফ্যালফ্যাল চাহনি ফুটে উঠে চোখজোড়ায়। সেই ষোল বছরে কিশোরীর মাঝে যে অনুভূতিগুলো ছিল তা কি পুনরায় জেগে উঠছে? না, এ সম্ভব না, অনুচিত।

মনে মনে নিজেকে শাসন করলাম,

“ভুলে যেয়ো না নিজের বাস্তবতা, ভুলে যেয়ো না তুমি অন্ধকারচ্ছন্ন জীবন। যা হওয়ার নয় তার আশা রেখে শুধুই কষ্ট পাবে। নিজের হৃদয়ে জ্বলতে থাকা আগুনে এক বালতি পেট্রোল ঢালা ছাড়া এ আর কিছুই না। আর কী ভাবছো ছেলেটা তোমায়… আবেগে ভেসে বেড়াচ্ছে, কেটে গেলেই দূর-দূর করবে। অথবা, এটাও কোনো প্রতিশোধ। দ্রুত সামলে নেও নিজেকে। এই বিয়ের ভবিষ্যৎ শুধুই ডিভোর্স।”

ভাবনার মাঝেই খেয়াল হল অর্কের হাতটা ঠোঁটজোড়ার উপর, সরিয়ে দিলাম। আমার চেহারাটা এখন আবার সবসময়কার ন্যায় গাম্ভীর্যপূর্ণ হয়ে উঠেছে হয়তো। নিচু সুরে বললাম,

“ঘুম আসছে, ঘুমাব। সরেন আমার থেকে।”

অর্ক অবাক হলো। সে তো খাণিক আগেও শক্ত খোলস থেকে বেরিয়ে আসা এক সাধারণ অনুভূতিময় নারীকে দেখেছিল, কিন্তু এখন আবার সেই রাশভারী অনুভূতিহীন মেয়েটি। এমন কেন হলো? হয়তো এর জন্য দায়ী নারীটির তমসাচ্ছন্ন অতীত।

তবে যাই হোক হাল ছাড়তে অর্ক প্রস্তুত নয়। ছোট্ট এক শ্বাস ফেলে সে মেকি হেসে শুধায়,

“না, না, কোনো ছাড়াছাড়ি নয়। এভাবেই ঘুমাতে হবে। আফটার অল উই আর ম্যারিড।”

“উফঃ! অতিরিক্ত করছেন আপনি, অর্ক। বলছি না ছাড়তে আমাকে!”

রেগে বেশ শব্দ করেই বলি। তাতেও যুবকের খাপছাড়া ভাব।

“তুমি ভুলে যাচ্ছো আইনত তুমি আমার বউ, আর আজ আমাদের ফার্স্ট নাইট। বাংলাতে যাকে হয়তো বাসর বলে। আমি চাইলেই অনেক কিছু করতে পারি, তোমার সহ্য করা ছাড়া উপায় থাকবে না। কারণ যতই হোক একজন ছেলের শক্তির সাথে তো… আই হোপ ইউ আন্ডারস্ট্যান্ড হোয়াট আ’ম ট্রাইং টু সে। তাই বলি কী, চুপচাপ যেভাবে আছো সেভাবেই ঘুমাও, সেটাই বেটার।”

বাধ্য হয়ে মনের বিরুদ্ধে অনেকটা ক্ষোভে নিয়েই অর্কের কথা মেনে নিল সে। পরে অবশ্য অর্ক নিজে থেকেই সরে গেল।

একই ছাদের নিচে, একই কামরায় একজোড়া নরনারী ঘুমের ভান করে বিছানায় পড়ে আছে একে অপরের থেকে নিজের আতঙ্ক, নিদ্রাহীনতা লুকাতে।

অর্ক ঘুমুচ্ছে না প্রেয়সীকে নিজের করে পাওয়ার উত্তেজনায় এবং হুট করেই নেওয়া এই সিদ্ধান্তের পরিণতি ভেবে। অপরজনের ভাবনা একদমই পৃথক।

আমার তন্দ্রাহীন রাত কাটানো শুধু আজকের নয়, প্রায় প্রতিদিনের ঘটনা। রাতটা গভীর হলে দম বন্ধ হওয়া বাড়ে, ভার হয়ে উঠে হৃদয় অতীতের বোঝায়। তবে আজ খুব বেশিই মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে সেই কালরাত্রীর স্মৃতিকথা।

অতীত,

আমি তখন ষোড়শী। এক সাধারণ কিশোরীর হৃদয়ঘর যতটা রঙিন আলোয় ভরা থাকে, অনুভূতি মাখা থাকে, প্রেমের অপেক্ষায় থাকে আমার মনটাও তেমন ছিল। চোখ ভর্তি স্বপ্ন, হৃদয় ভরা আশা, মস্তিষ্কে উজ্জ্বল ভবিষ্যতের চিন্তা।

হুট করেই এক ফ্যাকাসে বিকেলে আমার বড় ভাই মাহিন খাণিক ক্ষণ খোশামুদি করে আব্বুকে বলল,

“আব্বা একটা কথা ছিল। একজন ছেলে দেখেছি মনের জন্য। প্রবাসী ছেলে, আমেরিকায় সেটেল্ড, টায়া-পয়সার কোনো অভাব নাই, কোনো জঞ্জালও নাই বাড়িতে, বাপ-মা খালি। আমি চাচ্ছিলাম তার সাথেই…”

“তা তো বুঝলাম। কিন্তু ছেলে কেমন? আর বংশ কেমন? বিদেশে কী কাজ করে বা কার সাথে থাকে, সেটাও তো একটা ব্যাপার।”

এবার কিছুটা বিচলিত হয় মাহিন। যেন কিছু লুকাচ্ছেন বা অপ্রস্তুত হয়ে পড়েছে। এবার স্বামীকে সামাল দিতে সামনে এগিয়ে আসে রুমেলা, সে হলো মাহিনের স্ত্রী।

“আরে আব্বা ছেলে খুব ভালো। একদম সোনার টুকরা! আমার গ্যারান্টি আব্বা। তাছাড়া আজকাল এত সহজে এমন বাড়িওয়ালা, পয়সাওয়ালা ছেলে পাওয়া যায় না কি?”

কিশোরী আমি অবাক হলাম খুব। বাড়িওয়ালা ছেলেই বুঝি সবচেয়ে যোগ্য? কাকী, ফুপিদের থেকে যে সবসময় শুনে এসেছি স্বামী-স্ত্রীর মাঝে মিল-মোহাব্বাতটাই বেশ দরকার।

“তারপরও…”

বাবা একটু ইতস্তত হয়ে বলল।

“আরে আব্বা অত ভেবে কী আর দুনিয়া করা যাবে! তাছাড়া আব্বা আমি আর আপনার ছেলে কথা দিয়ে ফেলেছি তাদের। কালকেই তারা দেখতে আসবে। এখন না করলে আমরা ছোট হয়ে যাব।”

আর কী আমার বাবা আজাদ শিকদার রাজি হয়ে গেলেন। ছেলে আর ছেলের বউকে বেশ সমীহা করে বলেন কথা। তাদের কী করে ছোট হতে দিবে! মেয়ের ভবিষ্যৎ, ইচ্ছে, স্বপ্ন জাহান্নামে যাক। আমার মা পুরোটা সময়ই নিশ্চুপ। দাদী অবশ্য কী যেন বিড়বিড়াল তাদের বিপক্ষে।

পরদিন দেখতে আসে ছেলেপক্ষ, পছন্দ করল আমায়। ছেলেও আসল, চল্লিশ উর্ধ্বে বয়স্ক এক লোক। যদিও ভাবী জানিয়েছিলেন পঁয়ত্রিশ। আজাদ শিকদার খোশামোদ করলেন প্রথম প্রথম ছেলের বয়স নিয়ে। পরে অবশ্য ছেলের বউয়ের মন রক্ষার্থে রাজি হয়ে গেলেন। তবে আমার দাদী সাহেরা নাকোচ করলেন বিলাপ করে।

“মাইয়াটার কপাল এমতে পুড়াইছ না আজাদ! ঐ পোলার বাপ-মায়ের যে মনে মনে কূটনামি তা চেহারা দেইখা বুঝবার যায়। পোলাটাও কেমন বুইড়া বেটা!”

তার কথা কেউ শুনল না, সে এই বাড়িতে দুধ-ভাত। আমার মর্জি জানার অপেক্ষাও কেউ করল না। আমি বারংবার না করলাম মাকে, সে শুনল না। শুধু নাটকীয়তা করে বলেছিল, “আমার মরা মুখ দেখবি বিয়েটা না হলে।”

অতঃপর বিয়ে হলো। ছেলে মানে বুড়োটা আমাকে দেখেই পাড়ি জমিয়েছিল বিদেশে তাই বিয়েটা হলো ফোনে। আমি সেদিন কাঁদতে কাঁদতেই মনে মনেই মাকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলাম,

“দেখলে বিয়ে না হলে তোমার মরার কথা ছিল। এখন বিয়েটা হয়েও তুমি মরে গেলে।”

ভাগ্যের পরিহাস ছিল না আমার বাপ-মা আর তার বাপ-মায়ের আল্লাহ জানে। আমাকে ঘটা করে বিদায় দিয়ে পাঠানো হলো শ্বশুড়বাড়িতে। তারাও ঘটা করে বাসরঘর সাজাতে ভুলেননি।

যদিও বিয়েটা মনের বিরুদ্ধে ছিল কিন্তু বাঙালি মেয়ে বলে কথা কবুল বলেছিলাম যখন তখনই ক্ষীণ আশা, ভরসা, ভালোবাসা জুড়ে গিয়েছিল সম্পর্কে।

বাসর রাতের পর প্রতিটা রাত কেটেছে আমার শাশুড়ির পা টিপতে। ফজরের ওয়াক্ত থেকে রাত বারোটা পর্যন্ত কেটেছে খাটতে। পড়াশোনা তো স্বপ্ন বৈকী কিছুই ছিল না।

রাজবাড়িতে থাকছিলাম ঠিকই। তবে রাজরানি হয়ে নয়, চাকরানি হয়ে। বিশাল দুইতলা ডুপ্লেক্স বাড়িতে একটা সাহায্যকর্মীও ছিল না। আর স্বামী? দুই বছরের সংসারে দেশে তো একবারও আসেনিই, আবার যখনই কল করেছে নোংরা-নোংরা, অশ্লীল সব কথার জন্য কল দিয়েছে। মায়ের কাছে জানালে বলল মানিয়ে নিতে।

আশ্রয় ছিল না মানিয়ে নিলাম। আমাকে নিশ্চুপ দেখে বুড়োর মা মারতেও দ্বিধাবোধ করলেন না। জানালে এবারও মানিয়ে নেওয়ার উপদেশ দেয় মা আর ভাবী। দেখতে দেখতে মারের হার বাড়তে থাকে।

একদিন এমন ভাবে পিটায় যে টানা এক সপ্তাহ কোমায় থাকি। হাসপাতালে আজকাল এমন রোগী গেলে সাথে সাথে থানায় কেস হওয়ার নিয়ম। এখানেও তাই হলো, সবকিছু স্থবির ছিল শুধু আমার একটা স্টেটমেন্টের জন্য। জ্ঞান ফিরতেই প্রথমেই একজন লেডি কনস্টেবল ও এসআই আমার স্টেটমেন্ট নেয়। আমিও অকপটে সব বলে দেই। মরার পথে যেয়ে সম্পর্ক ভুলে গিয়েছিলাম, অনুভূতি তা তো আরও আগেই ভুলেছি। এস.আই একজন নারী ছিলেন, আমার কথা শুনে তার চোখে জলই নেমে আসে।

এরপর সবাই এসে দেখা করল। মায়ের চোখের পানি, বাবার চিন্তিত মুখ দেখে শব্দ করে হেসে দিলাম। এই মানুষ দুটো যে কত রূপ দেখাতে পারে! গিরগিটি একেকটা। এরপর মাহিন আর তার বউ আসল। তারা এমন আচারণ করল যেন এগুলো সব স্বাভাবিক আর এমন তো হয়ই, বাড়াবাড়িই করছি আমি।

সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরার পর পুলিশ জানালো আরেক কাহিনী। আমার ভাইয়ের কাহিনী। ২,০০০,০০০ টাকার বিনিময়ে বা দেনমোহরে মাহিন সাহেব আর তার স্ত্রী বিক্রি করেছিলেন আমাকে ঐ লোকের দ্বিতীয় স্ত্রী তথা বাপ-মায়ের দাসী রূপে। পুলিশদের সহায়তায় সেদিনই আমাদের তালাক হয়ে যায়। ঐ পরিবারের অবশ্য কিছুই হয়নি, আমার বাপই ছাড় দিয়েছে, কারণ তাহলে যে আদরের মাহিনও ফাঁসবে।

আমার বাপ-মা এমন একটা ভাব করলেন যেন তারা বিস্মিত মাহিনের কর্মে। বাবা বেশ চেঁচামেচি করলে তার পুত্রবধূ আর পুত্রও কম যায় না কী! আমার দাদী আহাজারি করেই যাচ্ছেন। কিন্তু এতকিছুর মাঝে আমি একবারও কাঁদিনি। আমি কেন কাঁদব? বরং, আমি জ্বলছিলাম প্রতিশোধের তাড়নায়।

তাদের বিবাদের মাঝে যেয়েই বললাম,
“কালকের মাঝে আমার কাবিনের টাকা মানে বিশ লাখ টাকা ফেরত দিবে। অন্যথায় শালিস কেন কোর্ট অবধি যেতেও সময় লাগবে না।”

সবাই হতবিহ্বল আমার কথায়। আমি অত হেয়ালি না করে বাবার সামনে গেলাম। সর্বদা এদের তুমি করেই বলে আসছি কেন যেন পারছি না। অনুভূতিগুলো মরে গেছে।

“আপনি আইনত একজন অপরাধী জানেন? সার্টিফিকেটে আমার বিয়ে করার সময় বয়স ছিল চৌদ্দ, বাল্যবিবাহ, তার উপর এই করুণ অবস্থা। আপনার নামে আমি কেস পর্যন্ত করতে পারি জানেন?”

থেমে হালকা হেসে,
“চিন্তা করবেন না, করব না। তার বিনিময়ে শুধু এই বাড়িটা আর ব্যবসা-বাণিজ্য সহ সবকিছু আমার নামে লিখে দেওয়ার ব্যবস্থা করুন আগামীকালের মধ্যে। নাহলে কেস রিওপেন করাতে দেরি হবে না। বুড়ো বয়সে জেলে যাবেন তারপর আপনার মান-সম্মান…”

মাহিনের বিস্ময়ে বিস্মিত। তাদের আরও অবাক করা বাকি, পোড়ানো বাকি।

বর্তমানে,
অতীতের কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই চোখে জল এসে পড়ল আমার। দুটো বছর সংসারে কত কিছুই না দেখেছে। অনেক বাঙালি মেয়েদের খুব নির্মম ভাগ্য, বড় হয় রাজরানির মতোন ভবিষ্যতে চাকরানি হতে।

তবে হ্যাঁ স্বস্তি একটাই সুধে-আসলে সবকিছুর শোধ নিচ্ছি। সেদিন বাবার সকল কিছু নিজের অধীনে নিয়ে নিয়েছি। আর মাহিন? সে বিশলাখ টাকা পুরোটা দিতে পারেনি তার মাছের ব্যবসায় বিনিয়োগের ফলে, তাই সেই ব্যবসায়ও আমার শেয়ারই অধিক। তার কাজ করা এডভারটাইজমেন্ট কোম্পানির সবচেয়ে বড় ক্লাইন্ট আমার বুটিক্স। তবে এখনও মাহিন আর রুমেলার জীবনে একদম অভাবটা আনতে পারিনি। তবে আনব, খুব শিঘ্রই!
সফলও হয়েছি জীবনে। একজন সফল উদ্যোক্তা, এক সুনামধন্য বুটিক্সের মালিক, একজন ফেসবুক ভিত্তিক বই বিক্রেতাও।

তবে এতকিছু পাওয়ার পরও ফেরাতে পারিনি সমাজের সেই অনাকাঙ্ক্ষিত দৃষ্টি। আমার ললাটে অদৃশ্য এক কালিমা লেগেই আছে ডিভোর্সীর। আজও সবাই বাঁকা দৃষ্টিতেই দেখে, আমার মাঝেই ত্রুটি খোঁজে, আমাকেই দায়ী করে তালাকের জন্য।

আমি এমন মানুষ যে কারো করা ছোট থেকে ছোট অন্যায়ের হিসাব রাখি। সেখানে অর্কের জন্য মাহিন আমায় ভরা মজলিসে অপমান করার সুযোগ পেয়েছিল। এখন চরিত্রহীনাও যোগ হয়েছে আমার সাথে তার জন্য। এরহিসেব কী করে ভুলি? শোধটাও তো তেমন তুলিনি, তার বাপ-মায়ের প্রতি কৃতজ্ঞতা বোধ থেকে। যেখানে আমি নিজের বাপ-মাকেই বিশ্বাস করি না আজ, সেখানে ও… তাকে আপন করে নেওয়া অসম্ভব। বরং, আমার সাথে থাকলে আমার বিষাক্ত কাঁটায় রক্তাক্ত হবে সে প্রতি ক্ষণে ক্ষণে।

অর্ক আপন মনেই ভাবছে,
“যত যাই হোক আমার #কাঁটা মুকুটকে আমি কখনোই ত্যাগ করব না। যতই তার কাঁটায় রক্তাক্ত হই। কাঁটার মাঝেই তো তার সৌন্দর্যবর্ধন হয়, তার মোহনীয় পুষ্পের মান থাকে।”

___

ফজরের আজানের শব্দে ঘুম ভাঙে মনের। ঘর থেকে বেরিয়ে বাথরুমের সামনে যেতেই দেখে বাথরুম থেকে পাঞ্জাবি-পায়জামা পরিহিত অর্ক বেড়ুচ্ছে ওজু করে। ছেলেটা ভিন দেশে সেই সুদূর ইউরোপে থাকলে কী হয়েছে ইবাদতে, ভদ্রতায় বাঙালি মুসলিম।

ওজু শেষ করে ফজরেত নামাজ পড়ে নেই। ঘুম আসছে না দেখে তসবিহ পড়তে পড়তে ঘরে হাঁটাচলা করছিলাম, ঠিক তখনই ঝড়ের গতিতে অর্ক এসে জড়িয়ে ধরে। প্রথমে ঘটনার আকস্মিকতায় খাণিক জমে গেলেও পরমুহূর্তেই ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেই অর্ককে। চলে যেতে নেই ঘর থেকে।

অর্ক আমার ওড়না দিয়ে কোনোরকম বাধা হিজাবের কোণ ধরে ফেলে। আমি ভ্রু কুঁচকে তাকাই তার দিকে। সে হ্যাঁচকা টান দিয়ে হিজাব খুলে ফেলে। আমি বিচলিত হই নিজেকে ওড়না ছাড়া হতে দেখে, সাথে সাথেই ঘুরে দাঁড়াই।

সে আলতো কদমে আমার কাছে এসে খোপা মুক্ত ঘাড়ে পড়ে থাকা চুলগুলো সরাতে সরাতে বলে,
“এত ইবাদত করো, পর্দা করো এটা জানো না অধিকাংশ নারীর জাহান্নামি হওয়ার কারণ কী? একদিন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মহিলাদেরকে উদ্দেশ্য করে বলেন:

يَا مَعْشَرَ النِّسَاءِ! تَصَدَّقْنَ، فَإِنِّيْ أُرِيْتُكُنَّ أَكْثَرَ أَهْلِ النَّارِ، فَقُلْنَ: وَبِمَ يَا رَسُوْلَ اللهِ!؟ قَالَ: تُكْثِرْنَ اللَّعْنَ وَتَكْفُرْنَ الْعَشِيْرَ.

‘‘হে মহিলারা! তোমরা (বেশি বেশি) সাদাকা করো। কারণ, আমি তোমাদেরকেই জাহান্নামের অধিকাংশ অধিবাসী রূপে দেখেছি। মহিলারা বললো: কেন হে আল্লাহ্’র রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন: তোমরা বেশি লা’নত করে থাকো এবং স্বামীর কৃতজ্ঞতা আদায় করো না’’। (বুখারী ৩০৪)

এছাড়াও আবূ হুরাইরাহ্ (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন:

إِذَا دَعَا الرَّجُلُ امْرَأَتَهُ إِلَى فِرَاشِهِ فَأَبَتْ، فَبَاتَ غَضْبَانَ عَلَيْهَا، لَعَنَتْهَا الْـمَلَائِكَةُ حَتَّى تُصْبِحَ.

‘‘কোন পুরুষ নিজ স্ত্রীকে তার শয্যার দিকে ডাকলে সে যদি তাতে সাড়া না দেয় অতঃপর সে তার উপর রাগান্বিত হয়ে রাত্রি যাপন করে তা হলে ফিরিশ্তারা তার উপর লা’নত করতে থাকে যতক্ষণ না সে সকালে উপনীত হয়’’। (বুখারী ৩২৩৭; মুসলিম ১৪৩৬)।”

অর্কের মুখে হাদিস শুনে আমি চোখ গোল গোল করে তাকিয়ে আছি। এই বিলেতির এত জ্ঞান ধর্মে! বাব্বাহ্!

সে পুনরায় মুখ খুলল,
“গতকাল থেকে আমি তোমার স্বামী। তিন কবুল করে বিয়ে বসেছেন, সুতরাং সহ্য করতে হবে আমার ছোঁটা কাঁটা লাগলেও।”

আমি কী জবাব দিব বুঝতে পারছিলাম না। এই ছেলেটাও না! কথায় হারানো বড়োই মুশকিল।

চলবে…
শব্দ সংখ্যাঃ ২০০০+

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here