কাঁটা মুকুট,পর্ব:৩

0
374

#কাঁটা_মুকুট ||৩য় পর্ব||
-ঈপ্সিতা শিকদার
“কোনো ডিভোর্সি মেয়েলোক আমি আমার ছেলের বউ হিসেবে মানব না! কখনোই না! তালাক দেওয়াব আমি, তালাক!”
হুংকার দিয়ে বলেন অর্কের বাবা ওমর আজাদ। এই আঁধার রাত্রিতেই কোনো এক গোপণ মাধ্যমে তার কানে খবর এসেছে অর্ক না কি মনকে বিয়ে করেছে।

এরপর থেকেই পরিবারের সকলের উপর দিয়ে ঝড় যাচ্ছে। বিশেষ করে অর্কের মা পেয়ারা বানুর মাথায় যেন বাজ পড়েছে।

প্রিয় বান্ধুবীর জন্য কী না করেছেন তিনি। তার মাশুল যে আজ এভাবে পাবেন স্বপ্নেও ভাবেননি। মনে মনেই ময়নাকে তিরস্কার করে বলল,

“ছিঃ! ছিঃ! ময়না রে তুই কি না আমার ভরা সংসারে নজর দিলি… তোর কলঙ্কিনী মেয়েটা রে গোছায় দিলি আমার ছেলে রে! এতদিন ধরে দুধ কলা দিয়ে আমি বান্ধুবী না স্বাপ পালছি।”

“কী হলো মূর্তির মতোন দাঁড়িয়ে আছো কেন? এসব কিছু তো তোমার জন্যই হয়েছে। ফোন দাও এখন তোমার প্রাণের বান্ধুবী রে।”

“হ-হ্যাঁ, হ্যাঁ, এখনই দিচ্ছি।”

হচকচিয়ে উঠে কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে উত্তর দেন পেয়ারা। তার হাত-পা সমানে কাঁপছে। কারণ তার স্বামী যেই পর্যায়ের রাশভারী, রূঢ়ভাষী মানুষ না জানি কী করে বসে রাগের মাথায়। শাশুড়ি জানলে তো তাকেই ঘর বিদায় দিবেন। তিনি কম্পিত হাতেই কল লাগালেন ময়নাকে।

ঘন বর্ষণের শব্দে, ভেজা মাটির গন্ধে মুখরিত পরিবেশ। ময়না স্বামীর পা কুসুম গরম সরিষার তেল দিয়ে মালিশ করছিলেন। মনের বাবা কাদের শিকদার বাতের রোগী, তার উপর আবহাওয়া এমন ঠাণ্ডা হলে ব্যথা আরও বেড়ে যায়। এর মাঝেই ফোন বেজে উঠে তাদের।

হাতে নিয়ে দেখেন পেয়ারা বানুর কল। এমন সময়ে কল দেখে বেশ অবাক হন, একটু চিন্তিতও। বলা তো যায় না বিপদ-আপদ হলো কি না…

“হ্যালো পেয়ারা। কেমন আছোস?

তার কণ্ঠ শুনেই যেন মধ্যবয়স্ক নারীটির মনে জমা সকল মেঘমালা যেন বৃষ্টি হয়ে নামতে শুরু করল। তার আহাজারিতে ভারী হলো পরিবেশ।

“ভালা আর থাকতে দিলি ময়না? আমার বিশ্বাস, ভালোবাসার প্রতিদান এমনে দিলি? আমার পোলার কপালটাই পুড়লি রে!”

“কী কইতাছোছ তুই? আমি তো কিছুই বুঝবার পারতাছি না।”

পেয়ারা বানু হেয়ালি করে বললেন,

“দাগী মাইয়াটা রে আমার পোলার গলায় ঝুলিয়ে দিয়ে এখন কিছু না বুঝার ভান করিস? তোর মেয়ে আমার অর্ক রে বিয়ে করসে তুই জানিস…?”

তার কথায় ব্যাঘাত ঘটিয়ে পাশ থেকে দেবরের মেয়ে নম্রতা জ্ঞানী জ্ঞানী ভাব নিয়ে বলে উঠে,

“কাকী, মেয়েরা বিয়ে করে না, ছেলেরা বিয়ে করে, মেয়েরা বিয়ে বসে। শেম অন ইউ কাকী! তুমি ওটুকু জানো এত আগে জন্ম নিয়ো!”

পেয়ারা বানু বিরক্তিতে চোখ-মুখ কুঁচকে ফেলে। নিজের সন্তান হলে এতক্ষণ এক ঘা দিয়ে বসতেন, পরের সন্তানকে তো আর মারা যায় না। জায়ের বিগড়াতে থাকা মেজাজ থেকে মেয়েকে ধমক দিয়ে চুপ করান নম্রতার মা তথা বাড়ির ছোট বউ নদী।

এদিকে ময়না সখীর কথা শুনে নীরন হয়ে গিয়েছেন, বাকশক্তি হারালে যেমন হয় তেমনই তার দশা। কয়েক মুহূর্ত সেভাবেই কাটল।

তারপরই কানে আসলো ওমর আজাদের বাজখাঁই কণ্ঠ। তিনি নিজের মতোন যা তা শুনালেন। ময়না কোনো তর্কে জড়ালেন না। চোখমুখ শক্ত করে আঁকড়ে ধরলেন বিছানার চাদর।

“আমি জানি আমার মেয়ে কোনো ভুল কাজ করবার পারে না, এমন কিছু তো না-ই। যদি এমন কিছু হইয়া থাকে তাহলে আপনি যেই শাস্তি দিবেন সেই শাস্তিই মাথা পেতে নিব আমার মেয়ে।”

“আরে কীসের শাস্তি? তালাক হবে, তালাক। এমন সংসার ভাঙা মেয়ে হবে আজাদ বংশের বউ? কখনোই না।”

টুৎটুৎ শব্দ শুনা গেল তারপর কল কেটে গেছে। ময়নার সামনেই তার স্বামী গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন, তিনি তাকে কিছু জানাতে চান না। যে কথার কোনো ভিত্তিই নেই তা নিয়ে খোঁঁচাবেন কেন? তার বিশ্বাস মন এমন কাজ করেনি। তিনি নিজের অগোচরেই খুব করে প্রার্থণা করছেন তার কথার এবং বিশ্বাসের মান যেন থাকে, নয়তো যে তিনি বিশ্বাস হারিয়ে ফেলবেন নিজেত মাতৃত্ব থেকে।

তবে কি মাতৃত্বের উপর ভরসা হারাতে চলেছেন ময়না? আবারও বাবা-মায়ের সঙ্গ ছাড়া, আশ্রয় ছাড়া, সমর্থন ছাড়া হতে চলেছে ময়না? কারণ সত্যি যে এটাই মন এখন অর্কের স্ত্রী।
___

আনিসা গভীর নিদ্রায় মগ্ন। তবে আমার চোখজোড়ায় ঘুমের ছিটেফোঁটাও নেই। এর কারণ দুটো। প্রথমত আমি সন্দিহান এই বিয়ে, নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে। এর পরিণাম যে খুব ভয়ংকর এবং জঘন্য কিছু সে সম্পর্কে আমি পুরোপুরি অজ্ঞাত নই। দ্বিতীয় আনিসার নাক ডাকা। এই মেয়েটার বেশির ভাগ স্বভাবকেই বদভ্যাস বলে জ্ঞাত করা যায়।

আমিও না? নিজেই বদভ্যাসের কারখানা, আরেকজনের বদভ্যাস নিয়ে পড়ে আছি। ভেবেই এক চোট হেসে উঠলাম নীরবে।

“ঠক! ঠক! ঠক! ঠক!…”
অবিরাম করাঘাতের শব্দে হুড়মুড়িয়ে উঠে বসি আমি। পাশ ঘুরে তো আমি পুরোপুরি বিস্মিত।
“মাইয়া কী ঘুম দিসে রে! এত আওয়াজেও উঠে না। কী ঘুমকাতুরে মেয়ে রে বাবা!”

কথাগুলো বিড়বিড়াতে বিড়বিড়াতে উঠে যেয়ে দরজা খুলে দিলাম। সামনের মানুষটিকে দেখে ভেঙচি কেটে কটমট দৃষ্টিতে তাকালাম। সে ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে ধাক্কা মেরে সরিয়ে ভিতরে চলে গেল।

তার পিছন পিছন ঢুকল নিবিড়ও ঢুকেই সোজা ডাকতে শুরু করল আনিসাকে। তাতে মেয়ের কোনো হেলদোল নেই। হুট করেই অর্ক সাহেব ভাব নিয়ে “ওয়াচ দিস” বলেই ওয়ারড্রবের উপর রাখা গ্লাসটির সব পানি ঢেলে দিল আনিসার মুখে।

“হোয়াদ্দা হেল!”
আনিসা হুড়মুড়িয়ে উঠে রেগে চিৎকার করে উঠে। কোনো প্রতিক্রিয়া নেই অর্কের। শান্ত গলায় সুতীক্ষ্ণ দৃষ্টির সহিত আদেশ করলেন,

“এই মুহূর্তেই ঘর থেকে বেড়িয়ে যা নিবিড়ের সাথে।”

চোখের পলকে নিবিড়, আনিসা দুজনেই গায়েব। আমি ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছি অর্কের দিকে। সে চুলগুলো হাত দ্বারা স্লাইড করতে করতে বলল,

“আমি জানি আমি দেখতে সুন্দর, এখন বেহায়ার মতোন তাকায় থাকার দরকার নেই।”

“চুলগুলো জাস্ট ছেঁটেছিলাম, এবার ছেঁচে দিব, এত ভাব নেওয়ার কিছু নেই।”

বাঁকা হেসে বাক্যটুকু অকপটে বলে ফেললাম। সে চোখ পাকিয়ে তাকালো আমার দিকে। “আমি মনে হয় ভয় পাই! হাহ!” আনমনেই বিড়বিড়ালাম। নিজের ভাবনায় ডুবে খেয়ালই করিনি মানুষটা আমার এতটা কাছে এসে দাঁড়িয়েছে যে আমার নাকটা তার বুকের একটু নিচে যেয়ে ঠেকেছে। তার উষ্ণ প্রতিটি শ্বাস এসে মিশে যাচ্ছে আমার মুখশ্রীর সাথে। চোখ উঠিয়ে তার দিকে তাকাতেই চোখ ঝলসে গেল তার গাঢ় সেই মায়াবি দৃষ্টিতে।

জীবনের প্রথম কোনো পুরুষের এতটা কাছে আসায় এই বাঘিনী আমি শুধু অপ্রস্তুতই হইনি, স্বভাবের বাইরে যেয়ে কোনো এক ঘটনা আমাকে কম্পিত করছে, ভয় পায়িয়ে দিচ্ছে, লজ্জাবোধ হচ্ছে। ভয় আমি পেয়েছি অনেক তবে তা নিরাপত্তাহীনতার, লজ্জাও পেয়েছি তবে তা অপমানের। কিন্তু আজকের লজ্জাবোধ, ভয় অন্যরকম যা আগে বোধ করিনি। সাথে অন্যরকম অনুভূতিও হচ্ছে মনে, যা ছাব্বিশটি বসন্তে পেড়িয়েও অনুভব করিনি, পুরো মাত্রায় নতুন।

কয়েক মুহূর্ত নীরবতায় কাটিয়ে সে কোমর আঁকড়ে ধরে আমার কানের দিকে ঝুঁকে হিসহিসিয়ে বলে,

“জানো আমার সামনে কেউ টুঁ শব্দ করতেও ভয় পায়, তুমি কি না… আই নো দিস ইজ ক্রেজি বাট আই লাইক ইট হোয়েন ইউ ডু সো। কিন্তু সবসময় মুখে মুখে তর্ক আমার পছন্দ না। রিমেম্বার দিস। অন্যথায়…”

যদিও আমি দুর্বল বোধ করছি। তবুও সামনের মানুষটিকে তো বুঝতে দেওয়া যাবে না। তাই কপট খাপছাড়া ভাব নিয়ে সাহস দেখিয়ে শুধালাম,
“অন্যথায় কী?”

“এই যে সুন্দর দুই জোড়া ঠোঁট আছে না, যা দিয়ে সারাক্ষণ পকপক করে। এদের গায়েব করে দিব। একদম ফুলস্টপ…”

পরমুহূর্তেই নিশ্চুপ অধরজোড়া সত্যিই হারিয়ে গেল অর্কের মাঝে, হাজের খাণেক বিষ পিপড়া যেন একসাথে কামড়াচ্ছে। আমি তো মুহূর্তেই জমে মূর্তি হয়ে গেলাম।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here