কাঁটা মুকুট,পর্ব:৯

0
696

#কাঁটা_মুকুট ||শেষপর্ব||
-ঈপ্সিতা শিকদার
নিবিড় আনিসার নিকট সব শুনে বিপুল রেগে যায়। অর্কের দাদীর সামনে যেয়ে বলে,

“লিসেন, আমার বোন না আপনাদের ছেলেকে যেচে বিয়ে করেনি। আপনাদের ছেলে বাধ্য করেছে। অর্ক ভাই এখানে আসার পর হুট করেই মনকে বলে ও যদি বিয়েটা না করে তাহলে মোমিন ভাইকে চাকরি থেকে বের করে দিবে, এমন কী তরী আর তার বিয়েও ভেঙে দিবে। মন আমাদের আপন ভাইয়ের থেকেও বেশি ভালোবাসে, এজন্যই বাধ্য হয়ে ও বিয়ে করেছিল। এমন কী ওর সাথে সংসার করার জন্য আপনাদের ছেলেই পাগল।”

ময়নার সামনে যেয়ে,

“চাচী মায়ের চেয়ে ভালো না কি মেয়েকে কেউ চিনে না, আর আপনি! ছিঃ! ছিঃ! আপনার চেয়ে তো মনে হয় সৎমায়েরাও ভালো হয়। মাঝে মাঝে সন্দেহ হয় মন আসলেই আপনার পেটের সন্তান কি না…”

হাটুর বয়সী ছেলের তিরস্কার শুনে ময়নার অবস্থা করুণ। আসলেই তো তিনি মা হিসেবে ব্যর্থ, অযোগ্য। তিনি কাঁপা কাঁপা গতিতে শোবার ঘরে যেয়ে চোখের পানি ছেড়ে দেন। কিন্তু এতে কি কোনো লাভ আছে?

___

উপায়হীন হয়ে মৌনসম্মতি দেই অর্কের প্রস্তাবে সাথে শর্ত জুড়ে দেই যে আমরা আমার বাসায় থাকব এই পাঁচ মাস। সে স্মিত হেসে খাবার আনতে চলে যায়।

আমি পৈশাচিক হেসে বিড়বিড়াই,

“খুব সখ ময়না শিকদার আমাকে চড় মারার? এবার বুঝবেন কত ধানে কত চাল।”

অর্ক আসলে তার থাকে জানতে পারি এটা উত্তরায় অবস্থিত অর্কের নিজস্ব ফ্লাট।

অর্কের ফ্লাটে কয়েকদিন থেকে আমরা আমার বাসায় যাই। কলিংবেল বাজাতেই বাবা এসে দরজা খুলে। আমাদের মাথায় হাসি মুখে হাত বুলিয়ে দেন। আমি অবাক। কারণ এমন প্রতিক্রিয়া আশা করিনি। বরং, সে কটুবাক্য শুনাবে, নিচু করবে এটাই সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল।

“মা রে, আমি সবসময় চেয়েছি তুই সুখী হ, দুনিয়ার সব সুখ, আনন্দ আল্লাহ তোর থলিতে দিক। কিন্তু আমার ভুলের কারণে তোর… আমি যে কতটা অনুতপ্ত এর জন্য বলে বুঝাতে পারব না।

আমি তাই এরপর কখনো তোর কোনো কাজের মাঝে আসিনি, দখলদারি করিনি। আমি চেয়েছি তুই তোর মতো ভালো থাক, সুখে থাক।

কিন্তু তুই যে আমাকে এড়িয়ে চলিস, কতটা বছর ধরে কথা বলিস না, তা যে আমাকে কতটা কষ্ট দেয়। যেদিন তোর সন্তান হবে সেদিন বুঝবি।”

আমার মাথায় হাত রেখে কথাগুলো বলতে বলতে অলক্ষ্যে দু ফোঁটা জল ছেড়ে দেয়। আমিও কেঁদে দেই। আমি প্রতিশোধে মত্ত হয়ে অন্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। মানুষটা যেখানে হাতিয়ার ফেলে মমতার হাত এগিয়ে দিয়েছে সেখানে আমি কী করে… খাণিক দূরে মাও দাঁড়িয়ে, তার চোখজোড়া ছলছল করছে। এই চাহনি মানে জানি না, তবে তাকে ক্ষমা করতে আমি এখনো সক্ষম নেই। কারণ মুখে বললেই তো হয় না, মনের সায়ও লাগে।

“করোছটা কী হতচ্ছাড়া? নাতাজামাই আইছে, বাইরে দাঁড় কইরা রাখছোছ। আয়, আয় ঘরে ঢুক। ময়না ভালোমন্দ আনো জামাই রে দাও খাইতে। বুদ্ধিশুদ্ধিকে ঘাস কাটতে গেছেনি?”

দাদীর তোরজোরে মা আঁচলে চোখ মুছে রান্নাঘরে চলে গেলেন। শুরু হলো দাদীর রাজ্যের গল্প। একপর্যায়ে বললেন,

“এবার বছরটা ঘুরতেই একখান নাদুসনুদুস পাইলেই হইতো খেলবার লিগা।”

আমি দৃষ্টি নত করে ফেললাম। বলে কী দাদী! অর্ক বজ্জাত দাঁত কেলিয়ে হাসছে।

“আরে দাদী সুইটু আমি তো চাচ্ছিই, তোমার নাতনিই…”

আমি তাড়াতাড়ি সেখান থেকে চলে গেলাম। এবার নির্ঘাত দাদী লেকচার শুনাবে বাচ্চা নিয়ে।

___

পাঁচ মাসে কেটে গিয়েছে। মন্দ কাটেনি। প্রতিটা দিন কেটেছে অর্কের সাথে এই ঐ বিষয়ে কথা কাটাকাটিতে কিংবা রোমাঞ্চকর কিছু মুহূর্ত। তবে মানুষটাকে ভালোবাসতে পেরেছি কি না জানি না।

তাছাড়া অর্কের পরিবারও আমাদের মেনে নেয়নি। এই নিয়েও বেশ সংকীর্ণতা কাজ করে। রুমেলার জন্য মাহিনের আজ এত পরিবর্তন, আমার পরিবার সন্তান হারিয়েছে, আমি হারিয়েছি বৃক্ষছায়া বড় ভাই। আমিও কি তেমন অর্ককে দূর করে দিচ্ছি তার পরিবার থেকে?

বিছানায় শুয়ে এসব আওড়াচ্ছিলাম তখনই অর্ক পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে ঘাড়ে চুমু খায়। বিড়বিড় করে বলে,

“আই নিড আ লিল প্রিন্সেস, সুইটি। আওয়ার প্রিন্সেস।”

বলেই আমাকে তার দিকে ফিরাতে নিলে। আমি হাত সরিয়ে দেই। নিচু গলায় বলি,

“আমি রেডি না এখনো এসবের জন্য।”

কথাটা বলার পর কথা কয়েক মুহূর্ত অর্ক স্থির হয়ে থাকে। অতঃপর বিছানা ছেড়ে উঠে চলে যায়। আমিও শব্দ করে এক শ্বাস ফেলি।

অর্ক চোখজোড়া অপমানে, ভীরুতায় রক্তিম হয়ে উঠেছে। যেকোনো স্বামীর কাছেই এটা অপমানকর। আনমনেই ভাবছে,

” তবে কি পাঁচ মাসের তীব্র প্রচেষ্টায়ও আমি সক্ষম হইনি তাকে নিজের করতে? তাহলে আমার দূরে চলে যাওয়াই শ্রেয়, আমি তো কথা দিয়েছিলাম।”

পরদিনই অর্ক ব্যাগপত্র গুছিয়ে এই বাড়ি ছেড়ে চলে যায়। আমার প্রচণ্ড কষ্ট হয়, এতটা কষ্ট বোধহয় ঐ বিয়ে থেকেও হয়নি। বাবা, দাদী জানতে চাইলেও আমি এড়িয়ে যাই। তারা হয়তো বুঝতে পেরেছে কিছু।

একদিন বিকেল বেলা একাকি বসে বাংলার ইতিহাস বিষয়ক একটা বই পড়ছি, তখনই দরজায় খাণিক করাঘাত করে মা প্রবেশ করেন। আমি অবাক, এতদিনে না আমি মায়ের সাথে কথা বলার প্রচেষ্টা করেছি, না তিনি আমার সাথে। তিনি এসেই আমার হাত থেকে বই খানা সরিয়ে বলেন,

“মা, জীবনকে প্রতি মুহূর্তে সুযোগ দিতে হয় নাহলে বেঁচে থাকা গেলেও ভালো থাকা যায় না। আশা, ভরসা, স্বপ্ন প্রতি ক্ষণে ক্ষণে মরবে আবার প্রতি ক্ষণে জন্ম নিবে এটাই স্বাভাবিক। এমন নাহলে ক্ষতি বটে, কারণ সর্বক্ষণ দুঃখ ছায়ায়, আশাহীন আঁধারে থাকলে মনের মৃত্যু ঘটে। মনের মৃত্যু হলে দেহের বেঁচে থাকাটা বহু কঠিন সাধ্য।।

একবার নাহয় জীবনটা আঁধারে ছিল। এখন তো ভালো আছিস, দেখ জীবনে কতটা এগিয়েছিস। যদি জীবন একবারে আঁধারে গিয়েছে বলে হাতে হাত রেখে বাড়িতে বসে থাকতি, তবে কি এতটা সফল হতে পারতি? ঠিক তেমনই সংসারটা একবার ত্রুটিময় ছিল, প্রতিবার যে হবে এমন কথা নেই।

তুই বল তোর ইচ্ছে নেই যে তোর একটা সংসার হোক? ছোট ছোট হাত তোকে আঁকড়ে ধরে মা বলুক? দিনশেষে স্বস্তি পাওয়ার মতোন একটা কাঁধ হোক? তুই যতোই মুখে না বলিস, সত্যি তুইও জানিস। তুই যে চাস। প্রতিটি পুরুষ-নারী সবাই চায়। মানুষের চেয়ে ভদ্র-অভদ্র বহু চাওয়া আছে যা শুধুমাত্র তার জীবনসাথীই পূরণ করতে পারে।

ছেলেটা তোকে বড় বেশি ভালোবাসে। সবার কপালে এমন সুযোগ আসে না। সুখ তোর দোয়ারে নিজে এসেছে তাকে গা ধাক্কা দিয়ে বের করে দিস না। যদি আমার কথা একটুও যথাযথ মনে হয়। তবে এই রেখে গেলাম টিকেট, আজ বিকেলের ফ্লাইট, চলে যা অর্কের কাছে।”

আমি ভাবলাম সত্যিই তো শোধ-প্রতিশোধের নেশায় নিজের সাধারণ চাহিদাগুলোও ভুলতে বসেছি। আমি তো সবসময় এমনটাই কামনা করে এসেছি। কিন্তু ঐ যে রুমেলা হওয়ার সংকীর্ণতা।

“কিন্তু অর্কের পরিবার তো আমাদের…”

“শোন মেয়ে তুই না গেলেও অর্ক কোনো দিন দেশে ফিরবে না। বরং নাতির মুখ দেখলে কেউ আর রাগ রাখতে পারবে না বটে।”

মুখ টিপে হেসে দিলেন মা। আমি লজ্জায় লাল হয়ে গেলাম। সত্যি কি আমার যাওয়া উচিত অর্কের কাছে?

___

কানাডার শীতল আবহাওয়ায় সকাল সকাল শান্তির ঘুম দিচ্ছে অর্ক। হুট করেই তার মনে হলো ব্লাঙ্কেটের মধ্যে নরম একখানা কোলবালিশ তাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে জড়িয়ে ধরেছে। সে তন্দ্রবেশে চোখ খুলে যাকে দেখল তাতেই তার ঘুমের রেশ কেটে গেছো।

“তুমি?”

“হুম, আমি। অন্যকাউকে এক্সপেক্ট করছিলেন বুঝি?”

অর্ক উত্তর দিল না, ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইল।

“আরে ভাবলাম আপনার তো প্রিন্সেস চাই, তাই চলে এলাম আপনার বড় ভাই অলিন্দ থেকে ফ্লাটের এক্সট্রা কি নিয়ে। তাছাড়া প্রথম কিছু চেয়েছেন, না দিলে তো বলবেন আমার বউ কিপটে।”

অর্ক রাগী দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে হেসে দিল।

“আচ্ছা, সবার নাহয় বাসর রাত হয়, আমার বাসর দিন হলো।”

বলেই শক্ত বাহুর বন্ধনে আটকে নিল আমাকে। আজ বোধহয় আর রক্ষে নেই।”

___

“তুমি ভার্জিন?”

বেশ উচ্ছ্বাসিত হয়ে বলল অর্ক। আমার অবস্থা বেহাল, পেইন কিলার খেয়েও স্বস্তি পাচ্ছি না, আর এই ছেলে… তার চুল মুঠিতে নিয়ে টেনে বললাম,

“কেলা? আমি ভার্জিন না হইলে বুঝি আমার সাথে আর সংসার করতি না?”

সে আমার হাত সরিয়ে বলল,

“আরে না মনপাখি। আমাকে তো নিবিড় বলেছিল তোমার ভাই তোমাকে টাকার বিনিময়ে এক অর্ধবয়স্ক লোকের কাছে বিয়ে দিয়েছিল, আর তারা খুব টর্চার করত, পরে তোমাদের তালাক হয়ে যায়। সো জানা বিষয়টা ভুল প্রমাণিত হওয়ায় এক্সাইটেড হয়ে গিয়েছিলাম একটু।”

“না, তার সাথে আমার বিয়ে টিকেছিল দুই বছর, দুই বছরে একবারও সে দেশে আসেনি। আর তাছাড়া এখানে এক্সাইটেড হওয়ার কী আছে?”

সে অনেকটা কাছে এসে,

“আরে এক্সাইটিং না কী বলো! জাস্ট চিন্তা কোরো একবার তোমার ছাব্বিশটা বছর ধরে অতি যত্নে, কষ্টে আগলে রাখা যৌবন আমি আজ লুট করেছি বালিকা।”

আমি লজ্জা লুকিয়ে কপট রাগ দেখিয়ে শুধালাম,

“আজাইরা কথা না বলে যান, তো যান। যেয়ে এক গ্লাস গরম দুধ নিয়ে আসুন আমার জন্য। আর আজকে থেকে এক বছর অবধি আপনি আমার ধারের কাছেও আসবেন না বললাম।”

সে অসহায় মুখ করে কিছু বলতে যেয়েও বলল না।চুপচাপ চলে গেল।

___

অনেকটা সময় পেড়িয়ে গেছে এই ভিন দেশে। আজ খবর পেলাম মাহিনের না কি মেয়ে হয়েছে। তারও এখন দুই সন্তান, সাত বছরের ছেলে এবং নবজাতক মেয়ে। বেশ খুশি হলাম। মাহিনকে কল করলাম। রিসিভ হতেই কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে বললাম,

“আল্লাহ এবার আপনাকেও মেয়ে দিয়েছে। ছেলেও আছে। আপনার ছেলের বউ যে রুমেলা হবে না, আর ছেলে যে বড় হয়ে মাহিন হবে না তার কোনো গ্যারান্টি নেই। আমার সাথে করা অকর্মের ফল তো আপনার মেয়েও ভোগ করতে পারে। আপনার ছেলেও আপনার চোখের সামনে মেয়েকে বিক্রি করতে পারে। তার গায়েও লাগতে পারে তালাকের তকমা।”

আমি শোধ-প্রতিশোধের চিন্তা এখন বাদ দিয়েছি। অর্কের অংশ আমার মাঝে, তার উপর এসবের ছায়াও ফেলতে চাই না। আমার ব্যবসাগুলো অস্থায়ী ভাবে বাবা আর বেস্টু সামলাচ্ছে। আমাদের সন্তান ভূমিষ্ঠ হলে আমরাও দেশে চলে যাব।

নাতির সন্তানকে দেখে রমরমা বুড়ি কীভাবে মুখ ফিরায় আমিও দেখব। ভেবেই হাসলাম। ঠিক তখনই অর্ক এসে পাশে দাঁড়ায়, তার হাতে এক কাপ কফি। তার বুকে মাথা ঠেকিয়ে উষ্ণ কফির স্বাদ নিতে থাকি। হুট করে দেখি আমার আনা কাঁটা মুকুট গাছটায় এই প্রথম ফুল ফুটেছে। ঠিক তখনই প্রসব বেদনা অনুভব হয় আমার। অর্ক তাড়াতাড়ি আমাকে নিয়ে হাসপাতালে যাওয়ার জন্য রওনা হয়। আমি ব্যথা, আর্তনাদের মাঝেই ভাবি,

“অবশেষে পূর্ণতা পেল আমাদের কাঁটা মুকুট প্রণয়। পূর্ণতার ফুল ফুটতে চলেছে আমাদের এই কাঁটাময় সংসারে।”

__সমাপ্ত__

ভুল-ত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। ছোটগল্প ছিল, তাই তাড়াতাড়িই শেষ হয়ে গেল।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here