#উত্তরণ
পর্ব-৮
পরের দিন হিয়া অফিসে পৌঁছে জানতে পারে সোনালের ক্যাপ্টেন চ্যাটার্জীর সাথে ডিউটির পেছনে ১০০% হাত নিকুঞ্জেরই আছে. কেউই বুঝতে পারেনা নিকুঞ্জের এই পরিবর্তনের কারন কি.
কারণটা অবশ্য মাস খানেকের মধ্যেই সবাই বুঝতে পারে. ক্যাপ্টেন উজান একজন সম্পূর্ণ আলাদা চরিত্রের মানুষ. মাঝে মাঝে মনে হয় অনুভূতি বিহীন একটা মেশিন অথচ মনুষ্যত্ববোধ, মানবিকতার জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত. জুনিয়ররা তো বটেই সিনিয়ররাও উজানকে সমঝে চলে আবার সম্মানও করে. যেন নিজের কাজ ব্যাতিত কিছুই বোঝেনা সে.
আরও কয়েকটা বিষয় যা উজানকে ভীষণ ভাবে জনপ্রিয় করে তুলেছে…
প্রথমত: তার কাছে “সহকর্মী”র কোনো লিঙ্গ বৈষম্য নেই. কাজেই কর্মক্ষেত্রে না সে মহিলা সহকর্মীদের থেকে কোনো প্রকার সুবিধা নেয় আর না তাদের নিতে দেয়, যেটা অনেকেরই কাছেই খুব সস্তির বিষয়.
দ্বিতীয়ত: উজান ভীষণ ঠান্ডা মাথার মানুষ. কঠিন পরিস্থিতিতে যখন সবাই বিহ্বল হয়ে পড়ে তখন সে ঠিক পরিস্থিতি সামলে তা থেকে বেরিয়ে আসে. সব সমস্যার কিছু না কিছু সমাধান তার কাছে থাকে যার জন্য অনেকেই উজানকে আড়ালে মুশকিল-আসান বলে ডাকে.
তৃতীয়ত: উজানের চোখ۔۔ ওর চোখের দিকে সোজাসুজি তাকিয়ে কথা বলতে অস্বস্তি হয়. কি যেন আছে ওর চোখে সেটা কেউ ঠিক জানেনা. এই মানুষটা যখন রেগে যায় তখন তার চোখের দিকে তাকালেই সামনের মানুষটার অন্তরাত্মা শুকিয়ে যায়.
কিছু মানুষের ধারণা উজান ভালো, তো কিছু মানুষের ধারণা ও খারাপ, আর বাকিরা এখনো ঠিক বুঝে উঠতে পারেনি. সব মিলিয়ে উজান অপ্রতিদ্বন্দী, অপ্রতিরোধ্য, অপ্রত্যাশিত, অলঙ্ঘনীয় এবং দুর্বোধ্য…
এতো কিছুর মাঝেও উজানের মহিলা ফ্যান ফলোয়ার্সের সংখ্যা উত্তরোত্তর বেড়েই চলেছে, যদিও তা নিয়ে উজানের কোনো মাথা ব্যাথা নেই. ওর লক্ষ্য শুধুই হিয়া যে ওকে সতর্কতার সাথে এড়িয়ে চলে. উজান হিয়ার আসেপাশে থাকলেও হিয়ার অস্বস্তি হয় কিন্তু কারণটা হিয়ার বোধগম্য হয়না. শুধু হিয়া এইটুকু বোঝে যে ও উজানের থেকে দূরে থাকলে স্বস্তিতে থাকে.
এই দুমাসের মধ্যে হিয়ার একটাই ডিউটি পড়েছে উজানের সাথে. কলকাতা-দিল্লি-মুম্বাই-কোচিন-কলকাতা. অনেক লম্বা জার্নি, দুটো ওভারনাইট লেওভার আছে. পরশু ওরা ফ্লাই করবে তাই কাল ওদের ছুটি. হিয়া ওর যাবতীয় কাজ গুছিয়ে নেয়.
কাজ শেষে ও বেরিয়ে পড়ে অফিস থেকে. গ্রাউন্ডে থাকাকালীন ডিউটি আওয়ার্সের বেশি কোনোদিনই থাকতে হয়না যদি না কোনো কাজ থাকে.
হিয়া পার্কিং এ এসে গাড়িতে বসে. গাড়িটা স্টার্ট দিতে গিয়েই থেমে যায়. গাড়ির ভেতর একটা অজানা গন্ধ, কোনো পার্ফিউমের. এটা তো হওয়ার কথা নয়. তাহলে কি۔۔۔? আর ভাবতে পারেনা হিয়া. ওর মেরুদন্ড দিয়ে শীতল স্রোত বয়ে যায়. তাড়াতাড়ি দরজা খুলে নেমে পরে গাড়ি থেকে. ঠিক করে অফিসের গাড়িতে ড্রপ নেবে আজ.
অ্যাডমিনে ড্রপের কথা বলে বেরিয়ে আসার সময় নিকুঞ্জকে উজানের সাথে কথা বলতে দেখে. হিয়া এগিয়ে যায় ওদের দিকে. এমন সময় ওর ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় জানান দেয় বিপদ ধারে কাছেই ওঁৎ পেতে আছে. ও পেছনে ফিরে তাকায়. একটা কালো গাড়ি এগিয়ে আসছে. সেদিন এক ঝলক দেখেছিলো গাড়িটা কে, ওটাও কি কালো ছিল?
পা অবশ হয়ে আসছিলো হিয়ার, এমন সময় কেউ ওর হাত ধরে টানে আর ও গিয়ে আছড়ে পরে কারোর বলিষ্ঠ বুকে. মুহূর্তের জন্য সব কিছু অন্ধকার হয়ে আসে, যদিও নিজেকে সামলে নেয় হিয়া. কয়েক সেকেন্ডের বিরতি, তারপর চোখ খুলে সামনে উজানকে দেখে ও সোজা হয়ে দাঁড়াবার চেষ্টা করে. একটু টলে গেলো কি ওর পা? উজান তখনও ওর হাত ছাড়েনি.
উজানের গলা শুনে নিকুঞ্জ এতক্ষনে একটু ধাতস্ত হয়. উজান ওর সাথে কথা বলতে বলতে হঠাৎই সামনের দিকে তীর বেগে ছুটে যায়. তারপর যা কিছু ঘটলো সেটা সময়ের বিচারে কয়েক সেকেন্ডের ব্যাপার হলেও নিকুঞ্জের কাছে সময়টা ওখানেই থমকে যায়. এখনো ও ঠিক বুঝে উঠতে পারেনি পুরো ঘটনাটা.
নিকুঞ্জ হিয়াকে ধরে নিয়ে গিয়ে একটা চেয়ারে বসায়. উজান পেছন পেছন আসে. উজান বিরক্ত۔۔
উজান: ঠিক আছেন?
হিয়া এখন অনেকটা ধাতস্ত হয়েছে. মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলে.
উজান : পরশু আপনি ফ্লাই করতে পারবেন?
হিয়া আবারো মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বলে.
উজান: আমার মনে হয়না. তাছাড়া যে নিজেকে বাঁচানোর ক্ষমতা রাখেনা, সে এতোগুলো মানুষের দায়িত্ব কি নেবে? আপনার হাতে আমি এতো গুলো প্রান ছাড়তে পারবোনা ফার্স্ট অফিসার হিয়া মিত্র.
উজানের কথাগুলো তীরের মতো ছুটে গিয়ে আঘাত করে হিয়াকে. হিয়া কাঁপতে থাকে. এতোক্ষনের সমস্ত ভয়, দুশ্চিন্তা রাগ হয়ে ঝরে পরে উজানের উপর. স্থান,কাল, পাত্রের জ্ঞান হারায় হিয়া.
হিয়া: আমি যতদূর জানি সেদিনের ফ্লাইটের ক্যাপ্টেন আপনি, আর একটা ফ্লাইটের যাবতীয় দায়িত্ব একজন ক্যাপ্টেন-ইন-কমান্ডের হয়. আপনার পারমিশন ছাড়া একটা কাজ তো দূরের, একটা কথাও বলার এক্তিয়ার নেই কারোর. আমারও নেই. কাজেই এতক্ষন যে প্রানগুলোর কথা বলছিলেন সেগুলোর দায়িত্ব আপনার. এমনকি আমার প্রাণের দায়িত্বও আপনার. কাজেই আমাকে বাঁচিয়ে আপনি কোনো উপকার করেননি, আপনার কর্তব্য টুকুই করেছেন.
উজান হতবম্ব হয়ে যায় কিছুক্ষনের জন্য. ও হিয়ার থেকে এই ধরণের প্রতিক্রিয়া আশা করেনি.
বড়োজোর একটা “সরি” আশা করেছিল. আর শেষ কথাটা কি বললো হিয়া? ওকে বাঁচিয়ে কর্তব্য করেছে? হ্যাঁ তাই তো…হিয়ার প্রানের রক্ষনাবেক্ষন ততদিন করতে হবে উজানকে যতদিন না ওর কাজ সম্পন্ন হচ্ছে. কিন্তু তাই বলে এরকম মুখের উপর উত্তর দেবে, তাও আবার নিকুঞ্জের সামনে?
উজানের প্রচন্ড রাগ হয় হিয়ার উপর. হাতের মুঠো শক্ত হয়ে আসে, চোখ লাল হয়ে যায়. দু পা এগিয়ে যায় ও হিয়ার দিকে. অন্যদিন হলে আলাদা কথা ছিল, কিন্তু আজ আর হিয়া ভয় পায়না উজানের চোখের দিকে তাকিয়ে. ও বুঝে গেছে ওর দিন ফুরিয়ে আসছে, আর কোনো আশা নেই. যে ভাবে হিয়ার পেছনে পরে গেছে ওরা তাতে আর খুব কম দিন আছে হিয়ার হাতে. এই অবস্থায় আর কাকে ভয় পাবে ও?
দেখা যাক হিয়ার পেছনে কারাই বা ছুটছে আর উজানের ব্যবহারে এমন হঠাৎ পরিবর্তন কেন….!
NB:অনেকেই পেজের ইনবক্সে বলছেন #উত্তরণ এ উজান চরিত্রটাকে দেখতে বড্ড বেমানান দেখাচ্ছে—আমি লেখার আগেই আপনাদের বলেছিলাম এই গল্পটা একদম ভিন্নধর্মী ছকভাঙ্গা কাহিনি…চরিত্র গুলোর নাম ছাড়া বাকি পুরোটাই আমার কল্পনা– তাই এই গল্পে দয়া করে কেউ সিরিয়ালের গল্প না খুঁজবেন না…তাই পাঠকগণ এ বিষয়ে কমেন্ট বক্সে নিজেদের মতামত জানাবেন–
“একটু ধৈর্য্য ধরুন, আশাহত হবেন না”আর আজকের পর্বটা আপনাদের কেমন লাগলো সেটাও জানাবেন??।