আলোছায়া ৪

0
628

#আলোছায়া
কলমে: লাবন্য ইয়াসমিন
পর্ব:৪

জুনায়েদ অনিকের সঙ্গে থানায় এসে বসলো। সামনে আবু জাফর হক বসে আছেন, যে সুবাদে অনিকের বড় চাচা। দারোগা হিসেবে উনি বড়ই কড়া একজন মানুষ। তবুও সামনে নিজের ভাতিজাকে দেখে মুখে হাসি ফুটিয়ে বললেন,

>” কি ব‍্যাপার তোমরা এই সময়? সব ঠিক আছে?

> আলহামদুলিল্লাহ্ সব ঠিকঠাক। আঙ্কেল সামনে অনিমার জন্মদিন। আম্মু বলেছিল তোমাকে বলতে।

অনিক মুখে হাসিটা ধরে রাখার যথাযথ চেষ্টা করে যাচ্ছে। একটু এদিক ওদিক হলে ঝামেলা লেগে যাবে। জুনায়েদ চুপচাপ ওর হাসিকে অনুকরণ করে হাসছে। সামনের ভদ্রলোক ভ্রু কুচকে বলল,

> গতকাল তোমার বাবা এসে বলে গেছেন। তাছাড়া তোমার মায়ের সঙ্গেও তোমার বড় মায়ের কথা হয়েছে তাহলে হঠাৎ তুমি? এই তোমাদের উন‍্যকোনো উদ্দেশ্য নেইতো?

অনিক জানতো এমন একটা কথায় বলবেন উনি। তবুও মুখের হাসিটা আরও দীর্ঘ করে ব‍লল,

> কি যে বলো না তুমি। আব্বু এখানে এসেছেন আমাকে বলেননি। তাছাড়া সামনে দিয়ে যাচ্ছিলাম তাই ভাবলাম তোমাকে বলে যায়।

> আচ্ছা তোমরা বসো আমি একটু আসছি। একটু ব‍্যস্ত আছি।

ভদ্রলোক ওদেরকে বসিয়ে রেখে চলে যেতেই জুনায়েদ অনিকের গায়ে চিমটি দিয়ে ফিসফিস করে বলল,

> তোর চাচা কি জন্ম থেকেই এমন সন্দেহ বাতিকে ভুগছেন নাকি পুলিশ হবার পর থেকে হয়েছে? এখুনি তো চৌদ্দ সিকের ভাত খাওয়ানো ব‍্যবস্থা করে দিতো। এখানে এসে লাভের লাভ কি হচ্ছে?

> বাল মুখটা বন্ধ কর। আমি দেখছি।

অনিক কিছু একটা ভেবে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা একটা পুলিশ কনেস্টেবলকে ডেকে আলাপ করলো। ছেলেটা অনিকের পূর্বপরিচিত কথা শুনেই বোঝা যাচ্ছে। অনিক খুব চতুরতার সঙ্গে বলল,

> আচ্ছা দুদিন আগে সুবাস নামের যে ভদ্রলোকের লাশ পাওয়া গেছে ঘটনা কি? শহর জুড়ে এতো হৈচৈ?

> ওকে ভদ্রলোকের সঙ্গে তুলনা করলে ভদ্রলোকগুলোকে অপমান করা হবে। ওই বেটা সঙ্গ পঙ্গ নিয়ে নদীতে গিয়েছিল। উদ্দেশ্যে কি জানিনা। তবে নদীর এপাশ থেকে ওপাশে একটা কাজের জন্য বিদ‍্যুৎ সংযোগ নেওয়া হয়েছিল। তার কিছুটা ঝুলে পানির কাছাকাছি চলে আসে। ওরা রাতের আধারে বুঝতে না পেরে নৌকা চালিয়ে যাবার সময় চার কেটে যায়।ফলে এই দুর্ঘটনা। সুবাসের হাত ঝলসে গেছে।

> কি মৃত্যু,শুনেই ভয় পাচ্ছি।

> আরে দূর খুব ভালো হয়েছে। খুব বেড়েছিল। যাইহোক আমাদের একটু ঝামেলা হচ্ছে। অবৈধ বিদ‍্যুৎ সংযোগের জন্য। ওটা সরকার দেখে নিবে।

জুনায়েদ হাফ ছেড়ে বাঁচলো। বারবার মনে হয়েছিল সেদিন ওর সঙ্গে দেখা হয়েছিল বিষয়টা জেনে গেলে সমস্যা হতে পারে। অনিকের সঙ্গে এই বিষয়ে কথা হয়নি। অনিক এসেছে কৌতূহলী হয়ে। জুনায়েদ ওকে নিয়ে বাইরে চলে আসলো। দুদিন পরে অনিকের বোনের জন্মদিন। যদিও সেটা খুব ঘরোয়া ভাবে হচ্ছে তবুও বন্ধ বান্ধবীরা থাকছে। অনিক নীলুকে সঙ্গে নেবার জন্য রিকুয়েস্ট করে চলে গেলো। জুনায়েদ কিছুক্ষণ এদিক ওদিকে ঘুরাঘুরি করে বাড়ির পথে পা বাড়ালো। মনটা বেশ শান্ত আছে। সুবাসের সঙ্গে যা হয়েছে ওসব ভেবে সময় নষ্ট করলে চলবে না। নতুন বুদ্ধি ভেবে নিয়েছে। পড়ন্ত বিকেলে হন্তদন্ত হয়ে এলোমেলো পা ফেলে বাড়িতে ফিরলো জুনায়েদ। বেলকনিতে নীলু তখন প্রকৃতি দেখতে ব‍্যস্ত। হঠাৎ ঘরের মধ্যে শব্দ হতেই ও বেরিয়ে আসলো। জুনায়েদ একবার নীলুর দিকে তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নিলো। মেয়েটার শাড়ি পড়ার ধরণ দেখলে জুনায়েদের মেজাজ খারাপ হয়। মনে হচ্ছে কলাগাছ পেচিয়ে রেখেছে। জুনায়েদ ঠোঁটটা গোল করে বিড়বিড় করে বলল, “উফফফফ অসহ‍্য। পড়ে গিয়ে ঠ‍্যাং কেনো ভাঙেনা আল্লাহ্ জানেন। ” নীলু সরল মুখে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। জুনায়েদ ওকে পাত্তা না দিয়ে বাথরুম থেকে ফ্রেস হয়ে বিছানায় সাট হয়ে শুয়ে পড়লো। নীলু ওকে কিছু বলতে গিয়ে থমকে গেলো কারণ দরজায় কেউ খটখট শব্দ করছে। ও তাড়াতাড়ি দরজা খুলে দিলো। কাজের মেয়েটা বলল নিচে দুজন নীলুর সঙ্গে দেখা করতে এসেছে। নীলু আর অপেক্ষা করলো না চলে আসলো। জুনায়েদ ভেবেছিল ঘুমাবে কিন্তু বাইরে কে এসেছে এটা দেখার জন্য ওর বিছানায় মন বসলো না। ও গুটিগুটি পায়ে বাইরে বেরিয়ে পড়লো। ডাইনিং রুমের সোফায় নীলু দুজন মেয়ের সঙ্গে বেশ হাসিমুখে কথা বলছে। জুনায়েদ ভালো করে লক্ষ্য করলো। না এরা ওর পরিচিত কেউ না। তবে মেয়ে দুটোর চেহারার বেশ মিল আছে। ও হাটতে হাটতে সোফায় গিয়ে বসলো। নীলু কিছুক্ষণ কথা বলে ওদেরকে বিদায় জানিয়ে উঠে আসলো। জুনায়েদ ওর দিকে ঘুরেফিরে দেখছে। মেয়েটা খারাপ না। দেখতে খুবই সুন্দরী কিন্তু সমস্যা হচ্ছে উঠতে বসতে পিউয়ের কথার খোঁচা। মেয়েটা একটার পর একটা টেক্সট দিচ্ছে। নীলুকে নিয়ে খারাপ খারাপ মন্তব্য করছে। ও বিরক্ত হয়ে ফোন বন্ধ রেখেছে। রাতে নীলু কবিতার বই থেকে কবিতা পড়ছে। জুনায়েদ বিছানায় কিছুক্ষণ বসে থেকে গম্ভীর মুখে বলল,

> এই সব ফালতু কবিতা পড়ে তুমি আমার উপযুক্ত হবে উঠবে এসব গল্প তোমাকে কে শুনিয়েছে বলবে?

> আম্মা বইগুলো এনেছেন। আমি নিজে থেকে পড়ছি। তাছাড়া আমি রিডিং পড়তে জানি।

> পড়াশোনা কতদূর করেছো?

> সে আপনার না জানলেও চলবে।

জুনায়েদের বেশ রাগ হচ্ছে। মেয়েটা ওকে এড়িয়ে চলছে। কথাটা ভেবে ও রেগে বলল,

> আগামীকাল বন্ধুর বোনের জন্মদিন। দয়াকরে এরকম এলোমেলো শাড়ি জড়িয়ে সেখানে গিয়ে আমার নাক কেটো না।

> আবারও?

জুনায়েদের এতগুলো কথার উত্তরে মেয়েটা আবারও বলাতে ও ভ্রু কুচকে বলল,

> সেদিন কি হয়েছিল? ওদের সঙ্গে কি হয়েছে?

> কোনদিন?

নীলু সরল মুখে প্রশ্ন করলো। জুনায়েদ কিছুটা ভেবে থতমত মুখে কিছুনা বলে চোখের উপরে হাত রেখে আবারও শুয়ে পড়লো। নীলু বইটা পাশে রেখে লাইট বন্ধ করে চুপচাপ জুনায়েদ পাশে গিয়ে বসলো।

দীর্ঘ রাস্তা জনশূন‍্য প্রান্তর। জুনায়েদ দৌড়ে চলেছে। পেছনে পাগলা ঘোড়া ওকে তাড়া করেছে। থামলেই মনে হচ্ছে এখুনি ওকে মেরে ফেলবে। এদিকে ওর পায়ে একটুও বল নেই। শরীর বেয়ে তরতর করে ঘাম বেয়ে আসছে। বুকের মধ্যে ঢিপঢিপ করছে। জুনায়েদ থামছে না। থামলেই যেনো সব শেষ। কিছুদূরে এসে ও একটা ব্রিজ দেখতে পেলো। জুনায়েদ দেখলো ব্রিজটা নেহায়েত ছোট না। অনেক দীর্ঘ। তবে ব্রিজের উপরে একটা পরিচিত মুখ দেখে জুনায়েদের মুখে হাসি ফুটলো। নীলু এলোমেলো শাড়িতে না খুব সুন্দর একটা সাদা গাউন পড়ে দাঁড়িয়ে আছে। জুনায়েদ ওর খুব কাছে এসে দাঁড়িয়ে ওর হাতটা নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে বলল,

> তুমি এখানে কেনো? তাড়াতাড়ি চলো।

জুনায়েদ সামনে পেছনে তাকিয়ে কথাটা বলতেই লক্ষ্য করলো পেছনের সাদা ঘোড়াটা নীলুর হাতের ইশারা পেয়ে থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছে। মেয়েটা জুনায়েদের হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে হুঙ্কার দিয়ে বলল,

> তুমি অপরাধ করেছো। তোমার ক্ষমা নেই।

কথাটা বলেই ও ঝড়ের গতিতে জুনায়েদকে ধাক্কা দিয়ে নদীতে ফেলে দিলো। কি ভয়ঙ্কর দৃশ্য। জুনায়েদের বুকটা কেঁপে উঠলো। বাঁচার জন্য অনেক আকুতি জানালো কিন্তু নীলু ওকে উপরে তুললো না। একটু একটু করে শরীরের শক্তি কমে গিয়ে জুনায়েদ গভীর পানিতে তলিয়ে গেলো। নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে।

ভোররাতে ভয়ানক স্বপ্ন দেখে জুনায়েদের ঘুম ভাঙলো। ও তাড়াতাড়ি উঠে বসলো। নিজের হাতটা এতক্ষণ নীলুর কোমরের উপরে ছিল। ও তাড়াতাড়ি সরিয়ে নিয়ে ভাবলো বারবার মেয়েটাকে মারার জন্য পরিকল্পনা করার জন‍্যই বুঝি এমন স্বপ্ন দেখলাম। না না এই মেয়েকে আর খুন টুন করা যাবে না। যেমন চলছে চলুক। কথাটা ভেবে ও চুপচাপ উঠে পড়লো। ঘেমেঘেটে একাকার অবস্থা। জুনায়েদ ফ্রেস হয়ে রুমে এসে দেখলো নীলু থমথমে মুখে বসে আছে। ঘুমে ঢুলুঢুলু অবস্থা। ওকে এভাবে বসতে দেখে জুনায়েদ ভ্রু কুচকে বলল,

> কি হলো না ঘুমিয়ে বসে কেনো?

> আপনার সঙ্গে ঘুমানো বেশ কঠিন। আপনি বারবার পা তুলেছিলেন আমার উপরে। আম্মাকে বলে দিব।

জুনায়েদ থতমত খেয়ে গেলো। কিসের মধ্যে কি? ওর ঘুমানো খারাপ না। পা তুলবে এমন কাজ জীবনে করেনি। কতবার অনিকের সঙ্গে ঘুমিয়েছে তখন তো এমন করেনি। এই মেয়েটা মিথ্যা বলে ওর সম্মান নষ্ট করতে চাইছে। আম্মা জানলে কি হবে ভেবেই ও ঢোক গিলে ধমক দিয়ে বলল,

> বাজে কথা বলবে না। নিজে নাক ডেকে আমাকে অতিষ্ঠ করো তারবেলা কিছু না? শুনো মেয়ে আমি তোমাকে বিরক্ত করবো না আর তুমিও আমাকে বিরক্ত করবে না।

জুনায়েদের কঠিন কথাগুলো নীলুর মধ্যে কোনো প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করলো বলে মনে হলো না। সে আবারও দুম করে শুয়ে ঘুমিয়ে গেলো। জুনায়েদ হতাশ হয়ে বিড়বিড় করে বলল, ” আম্মা বিয়ে দিয়ে বউ না এনে এলিয়েন আনলে ঘরে?” বাকী রাত ওর আর ঘুম হলো না। ল‍্যাপটপ নিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসলো। সকাল হতেই জুনায়েদ পারভীন বেগমের সঙ্গে শপিং করতে বের হলো। সারাদিনব্যাপী মায়ের হুকুম শুনে দিনটা পার হলো। সন্ধ্যায় অনিকের বাড়িতে অনুষ্ঠান আছে। সেখানে ওরা স্বপরিবারে আমন্ত্রিত। পারভীন বেগম নীলুর জন্য সুন্দর একটা ড্রেস এনেছেন। মেয়েটা শাড়ি পড়তে জানেনা তবুও চেষ্টা করে কিন্তু বাইরে গিয়ে যদি কোনো ঝামেলা হয়। এমনিতেও ছেলের মতিগতি ভালো না। বউয়ের দোষ পেলে ছাড়বে না। নীলু শাশুড়ির দেওয়া পোশাকে নিজেকে সুন্দর করে গুছিয়ে নিয়ে সন্ধ্যায় সবাই মিলে বের হলো। অনিক ওদের জন্য অপেক্ষা করছিল। বাকিরা চলে এসেছে। ওরা বাড়ির সামনে নামতেই অনিক ওদেরকে নিয়ে আসলো। পিউ খুব জ্বলছে জুনায়েদের ব‍্যবহার দেখে। ও সবাইকে নিয়ে নীলুকে নিজেদের মধ্যে নিয়ে আসলো। জুনায়েদ যেটা ভেবেছিল অন‍্যরা সেগুলোকে পাত্তা দিচ্ছে না। মেয়েটার এমন সুন্দর মুখটা দেখেই সাত খুন মাফ এমন অবস্থা। কিন্তু পিউ সাবধানে ব‍্যাগ থেকে নীল রঙের একটা ওষুধ বের করে জুসের গ্লাসে মিশিয়ে নীলুর হাতে ধরিয়ে দিয়ে আসলো। জুনায়েদ যেটা পারেনি ও সেটা ঠিক করে ফেলবে। কাজটা করে ও দ্রুত সরে পড়লো। জুস একবার পেটে পড়লেই সব শেষ। জীবনে কখনও আর চোখ তুলে তাকাতে পারবে না। এখানেই শরীর সমাধী।

(চলবে)

ভুলত্রুটি মার্জনা করবেন।

আসুস নামাজ ও কোরআন পড়ি।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here