আলোছায়া ৫

0
575

#আলোছায়া
কলমে:লাবণ‍্য ইয়াসমিন
পর্ব:৫

বিশাল ডাইনিং রুমে অনুষ্ঠান চলছে। এক এক জায়গাই ছোট ছোট জটলা নিয়ে সব আড্ডা দিচ্ছে। নীলু জুসের গ্লাস হাতে দাঁড়িয়ে সব কিছু অবাক চোখে দেখছে। শুধু ওর মনের মধ্যেই জড়তা রয়েছে তাছাড়া পোশাকের দিক থেকে এখানে সবার উপযুক্ত তাতে কোনো সন্দেহ নেই। জুনায়েদ ওর আশেপাশে খুব একটা ভিড়ছে না। দূর থেকে মাঝে মধ্যে আড়চোখে তাকিয়ে দেখছে। নীলু দাঁড়িয়ে সেসব পর্যবেক্ষণ করছিল এমন সময় পাশ থেকে একজন বলে উঠলো,

> আপনি বেশ সুন্দরী তবুও কেনো জুনায়েদ ভাই তোমাকে ইগনোর করে?

নীলু কিছু বুঝলো বলে মনে হলো না। ও পূর্বের মতোই তাকিয়ে থাকলো। ওকে এভাবে তাকাতে দেখে ছেলেটা জোরপূর্বক ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে বলল,

> আমি অরুণ জুনায়েদের বন্ধু। ভাবি চলুন,ওখানে সবাই মজা করছে। আপনি এখানে বসে আছেন দেখতে বেশ খারাপ লাগছে।

ছেলেটার কথায় নীলু কি বলবে ভেবে পেলো না। ও মলিন হেসে হাতের গ্লাসটা পাশে রেখে ওর সঙ্গে চলে গেলো। তরুণ নীলুকে নিয়ে জুনায়েদের পাশে গিয়ে দাড়ালো। জুনায়েদ পাশে তাকিয়ে ভ্রু কুচকে নীলুকে ফিসফিস করে বলল,

> তরুণের সঙ্গে বেশি কথা বলবে না। ওর চরিত্রের দোষ আছে। সুন্দরী মেয়ে দেখলে হুশ থাকে না।

নীলু এবারও অবাক হয়ে জুনায়েদের চোখের দিকে তাকিয়ে ঠোঁট নাড়িয়ে মনে মনে বিড়বিড় করে বলল, বিশ্বাসযোগ্য কেউ আছে নাকি?

জুনায়েদ ওর কথাগুলো শোনার চেষ্টা করতে চাইলো কিন্তু হলো না। পাশ থেকে পিউ ওকে ধাক্কা দিয়ে চলে গেলো। মেয়েটা ভীষণ ক্ষেপে আছে। জুনায়েদ নীলুকে সঙ্গে নিয়ে এসেছে তারপর আবার বন্ধু মহলে মেয়েটার প্রশংসা হচ্ছে। এভাবে চললে জুনায়েদ ওকে মুহুর্তের মধ্যে ভুলে যাবে। কথাগুলো ভেবে ও সোফায় গিয়ে ধপ করে বসে সামনে রাখা জুসের গ্লাস থেকে ঢকঢক করে জুসটা গলাই ঢেলে নিলো। জুনায়েদের ফোনটা অনবরত বেঁজে চলেছে। শব্দের জন্য প্রথমে বুঝতে পা পারলেও পরে ও বুঝতে পেরে রিসিভ করলো। ওপাশ থেকে চিন্তিত ভরাট কন্ঠে বলে উঠলো,

> জুনায়েদ ভাই পিউ আপা ঠিক আছে? আমি লতিফুর বলছি।

ছেলেটাকে চিনতে ওর সময় লাগলো না। ওষুধের দোকানদার লতিফুর। জুনায়েদের সঙ্গে বেশ ভালো পরিচয় আছে। জুনায়েদ কৌতূহলী হয়ে জিঙ্গাসা করলো,

> পিউয়ের কি হবে? কি হয়েছে বলবি?

> আজকে সকালবেলায় পিউ আপা এসেছিলেন। কিটনাশক নিয়ে গেছে। একবার পেটে পড়লে কিন্তু খুবই খারাপ হবে। প্রথমে ভেবেছিলাম আপা হয়তো এমনিই নিচ্ছেন।কিন্তু পরে জানতে পারলাম আপনার বিয়ে হয়ে গেছে। এটা হয়তো আপা মানতে পারছে না বলে সুইসাইড করতে চাইছে।আপনি একটু দেখবেন প্লিজ।

জুনায়েদ ফোনটা রেখে পিউকে খুঁজতে শুরু করলো। ওর ধারণা আছে পিউ এসব নিজের জন্য কিনবে না। মেয়েটা এতোটাও আবেগী না যে ভালোবাসার জন্য নিজের জীবন দিয়ে দিবে। ওর নীলুর জন্য হঠাৎ চিন্তা হচ্ছে। পিউ নীলুর ক্ষতি করতে চাইছে নাতো? কথাটা ভেবে ও তাড়াতাড়ি নীলুর কাছে চলে আসলো। নীলু এতক্ষণ ওর বন্ধুদের সঙ্গে দাঁড়িয়ে ছিল। জুনায়েদ ওকে পাশে টেনে নিয়ে ফিসফিস করে বলল,

> এখানে কোনো কিছু তুমি খাবে না ঠিক আছে?

> কেনো? আমার ক্ষুধা পেয়েছে।

> কুম্ভকর্ণের মতো খাওয়া আর ঘুমানো ছাড়া আর কিছু পারো? যা বলেছি তাই শুনবে নয়তো প্রাণে মেরে
ফেলবো। আমি আসছি।

জুনায়েদ ওকে সুযোগ না দিয়ে হন্তদন্ত হয়ে চলে আসলো। সারা বাড়িতে খোঁজা শেষ কোথাও পিউ নেই। মেয়েটা এক মূহুর্ত্তের মধ্যে কোথায় যেতে পারে ভাবতে ভাবতে ও ছাদের দিকে এগিয়ে গেল। সাউন্ড বক্সে মৃদু শব্দে হিন্দি গান বাঁজছে। এখনো কেক কাটা হয়নি। কিছুক্ষণের মধ্যেই কাটা হবে। যার জন্য এতো আয়োজন সে সাজুগুজু নিয়ে ব‍্যস্ত। জুনায়েদ ছাদের সিঁড়িতে পা ফেলে অবাক হলো। চাপ চাপ রক্ত পড়ে আছে। ওর গায়ে কাটা দিয়ে উঠলো। ও দ্রুতগতিতে ছাদে আসলো। এখানে এসে ওর চোখদুটো ছানাবড়া। পিউ অনবরত রক্ত বমি করছে। ওর সারা গায়ে রক্ত। জুনায়েদ দৌড়ে গিয়ে ওকে ধরে ফেলল। ওকে এভাবে দেখে ওর মাথা কাজ করছে না। জুনায়েদ চিৎকার করে উঠলো,

> এটা কি করেছো তুমি? আমার উপরে ভরসা নেই তোমার?

জুনায়েদ বারবার ওকে ডাকতে থাকলো কিন্তু মেয়েটার উত্তর দেওয়ার ক্ষমতা নেই। জুনায়েদ অপেক্ষা না করে মেয়েটাকে কোলে তুলে নিয়ে তরতর করে নিচে নেমে আসলো। এতক্ষণে সবার নজর ওদের দিকে পড়ে গেছে। সবাই ছুটে এসে কথা বলতে চাইলো কিন্তু জুনায়েদ কাউকে কিছুই না বলে গাড়ি নিয়ে হাসপাতালের দিকে ছুটে চলল। জুনায়েদের বন্ধু বান্ধবীরা সবাই ওদের পিছুপিছু হাসপাতালে। পারভীন বেগম ছেলেকে একা ছাড়তে নাজার। তাই বাধ্য হয়ে হাসপাতালে গেলেন। পিউকে ভেতরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। বাইরে জুনায়েদ অস্থির হয়ে হাটাহাটি করছে। ওর কিছু হলে নিজেকে সে ক্ষমা করতে পারবে না। বন্ধুরা সব মাথায় হাত রেখে বসে আছে। পারভীন বেগম ছেলের পাশে গিয়ে ফিসফিস করে বললেন,

> চিন্তা করোনা সব ঠিক হয়ে যাবে। ওর চিকিৎসার দায়িত্ব আমার।

মায়ের এমন কথা শুনে জুনায়েদের মেজাজ বিগড়ে গেলো। গাছ কেটে দিয়ে এখন পানি ঢালা হচ্ছে। কি দরকার ছিল সেদিন ওকে ধরে বেধে বিয়েটা দেওয়ার। এখন মেয়েটার যদি কিছু হয়েছে তবে ও কিছুতেই নীলুকে আর নিজের জীবনে রাখবে না। দরকার হলে বাবা মায়ের বিরুদ্ধে যাবে। ফাজলামির একটা সীমা থাকা দরকার। টাকা পয়সা লাগবে না। কথাগুলো ভেবে ও মুখটা কঠিন করে বলল,

> যা চেয়েছিলে সেটাই তো হচ্ছে। এখানে থেকে তামাশা না করে বাড়িতে যাও। আমাকে একটু শান্তি দাও।

পারভীন বেগম কিছু বলতে চেয়েছিল কিন্তু পারলো না। পাশ থেকে সৈয়দ সাহেব তাঁকে থামিয়ে দিলো। ছেলেটার মাথা ঠিক নেই। যা ইচ্ছা তাই বলে বসবে। তাছাড়া জুনায়েদের কথাবার্তার ভালো না। অপমান করে বসবে। নীলু সোফায় বসে ঠকঠক করে কাঁপছে। মুখটা বেশ মলিন। ওপাশ থেকে তরুণ উঠে এসে ওর পাশে বসে পড়লো। তারপর কিছু একটা ভেবে ফিসফিস করে বলল,

> ভয় পাচ্ছেন? ভয় পাবেন না। মেয়েটা এমন করবে ঠিক হজম হচ্ছে না। আচ্ছা জুনায়েদের সঙ্গে আপনার সম্পর্ক কেমন ?

নীলু কি বলবে বুঝতে পারছে না। ও চুপচাপ থেকে আস্তে করে বলল,

> ভালো।

> কেমন ভালো?
ছেলেটার কথা শুনে নীলুর রাগ হলো। তবুও ও চুপচাপ। এর মধ্যেই ডাক্তার ওটি থেকে বেরিয়ে এসেছে। জুনায়েদ দ্রুত গিয়ে ডাক্তারকে ধরলো,

> পিউ ঠিক আছে?

> চিন্তার কিছু নেই। আর একটু সময় থাকলে খারাপ কিছু হতো। অচেতন হয়ে আছে। আশাকরি দ্রুতই জ্ঞান ফিরবে। তোমরা এখানে ভিড় করোনা। হাসপাতালে অন‍্য রোগীদের অসুবিধা হবে। রুগীর মা ইচ্ছে করলে থাকতে পারে।

ডাক্তার কথাটা বলে চলে আসলো। জুনায়েদ হাফ ছেড়ে বাঁচলো। মনে হলো মাথার উপর থেকে আস্ত একটা বোঝা নেমে গেছে। ও ক্লান্ত মুখে সোফায় গিয়ে চোখ বন্ধ করলো। উপস্থিত সবাই আলোচনা করে বাড়িতে ফিরে গেলো। জুনায়েদ বাবা মায়ের সঙ্গে বাড়িতে চলে আসলো। ওর ইচ্ছা ছিল পিউয়ের সঙ্গে থাকার কিন্তু থাকা হলো না। নীলু বাড়িতে ফিরে চুপচাপ হয়ে গেছে। জুনায়েদ রক্তমাখা কাপড় চেঞ্জ করে ফ্রেস হয়ে শুয়ে পড়লো। খুব ক্লান্ত লাগছে। নীলুর সঙ্গে আজ আর কথা হলো না। নীলুও সাহস পেলো না। ও মোটামুটি বুঝতে পেরেছে ওর জন‍্যই এদের মধ্যে ঝামেলা চলছে। ভোরবেলা জুনায়েদ হাসপাতালের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লো। নীলু তখনও ঘুমিয়ে। হাসপাতালে ঢুকতে হলে ছয়টা পযর্ন্ত অপেক্ষা করতে হবে তাই ও গাড়িতে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করলো। সারারাত তেমন ঘুম হয়নি। চোখটা বন্ধ হয়ে আসছে কিন্তু ও ঘুমাতে পারলো না। বাইরে থেকে ওর নাম ধরে কেউ একজন ডেকে উঠলো। জুনায়েদ সেদিকে তাঁকিয়ে দেখলো পিউয়ের বাবা দাঁড়িয়ে আছে। জুনায়েদ তাড়াতাড়ি গাড়ির দরজা খুলে বেরিয়ে আসতেই উনি মলিন হেসে বললেন,

> চলো হাটি, তোমার সঙ্গে কিছু কথা আছে।

> জ্বী আঙ্কেল।

ভদ্রলোক ভনিতা ছাড়াই বলে উঠলেন,

> বিয়ে করেছো ভালো কথা তাকে ডিভোর্স দিতে তো মানা নেই। পিউ তোমাকে ছাড়া বাঁচবে না।

> আঙ্কেল আমি ওকে বুঝিয়ে বলেছি তবুও এমন কেনো করলো জানিনা। বাবা মা জোর করে হঠাৎ আমার বিয়ে করিয়ে দিলেন। বিশ্বাস করেন আমি চাইনি।

> তোমাকে বিশ্বাস করছি বলেই কথা বলছি। শুনলাম তোমার স্ত্রী খুব গরীব ঘরের মেয়ে। পড়াশোনা ভালো জানেনা। চেহারা মাশাল্লাহ্ সুন্দরী। তুমি ওকে ছেড়ে দিলে আমি ওর বিয়ের ব‍্যবস্থা করে দিবো চিন্তা করোনা। আমার হাতে ভালো ছেলে আছে। আশাকরি এতে তোমার অসুবিধা হবে না।

জুনায়েদ ভদ্রলোকের কথা শুনে থতমত খেয়ে গেলো। কি জঘন্য শোনালো কথাগুলো। স্বামীর সঙ্গে বউয়ের আরেকটা বিয়ের আলোচনা হচ্ছে। পৃথিবীর প্রথম পুরুষ মনে হচ্ছে ও নিজেই। মেরে ফেললে তো মরে যাবে প্রতিদ্বন্দ্বি আসবে না। ওকে ভাবতে দেখে ভদ্রলোক আবারও বলল,

> তুমি রাজি থাকলে তোমার বাবা মায়ের সঙ্গে কথা বলবো। উনারা আমাকে মানা করতে পারবেন না। এসব নিয়ে ভেবোনা। তুমি পিউয়ের কাছে যাও আমি আসছি।

ভদ্রলোক যেমন এসেছিল তেমনিভাবে চলে গেলো। পূর্ব আকাশে সূর্যের রশ্মি দেখা যাচ্ছে। হয়তো কিছুক্ষণের মধ্যেই পৃথিবী আলোকিত হয়ে উঠবে। চারদিকে নির্জন হয়ে আছে। রাস্তার পাশের গাছ থেকে কাক ডাকছে। কাকের কা কা ডাক জুনায়েদের মাথার মধ্যে ঢুকে যাচ্ছে। সব কিছু অসহ‍্য লাগছে। ও কথাগুলো বিড়বিড় করতে করতে হাসপাতালের মধ্যে প্রবেশ করলো। এখন ওর মনে হলো আঙ্কেল খারাপ কিছুতো বলছেন না। ওদের ভালোর জন‍্যই বলছেন। কথাটা ভেবে ও নিজের মনকে সান্ত্বনা দিলো। পিউ এখনো ঘুমিয়ে আছে। জুনায়েদ সেখানে যেতেই পিউয়ের মা ওকে রেখে বাড়িতে ফিরে আসলো। উনার রাতে ঘুম হয়নি। জুনায়েদ পিউয়ের হাত ধরে বসে আছে। মেয়েটার ঠোঁটে এখনো রক্ত লেগে আছে। যা শুকিয়ে কালচে বর্ণ ধারণ করছে। মেয়েটা ওর জন্য এমন করতে পারে ওর ধারণার বাইরে ছিল। মনে হলো মেয়েটা ওকে কতই না ভালোবাসে। এমন একজনকে হারিয়ে ও ভালো থাকবে না।

(চলবে)

ভুলত্রুটি মার্জনা করবেন। সবাইকে নীলুর বিয়ের নিমন্ত্রণ।

আসুন নামাজ ও কোরআন পড়ি।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here