আলোছায়া ৩

0
690

#আলোছায়া
কলমে: লাবণ্য ইয়াসমিন
#পর্ব:৩

জুনায়েদ হন্তদন্ত হয়ে বাড়ির পথে রওনা দিয়েছে। পিউ বন্ধুদের সঙ্গে বসে আছে। মেজাজ চরম খারাপ। জুনায়েদের ভাবসাব বুঝতে পারছে না। কিছুদিন আগেও যে ওর জন্য পাগল ছিল হঠাৎ সে ওকে পাত্তা দিচ্ছে না। বিষয়টা হজম করতে বেশ কষ্ট হচ্ছে। তাছাড়া জুনায়েদ ওকে কথা দিয়েছে যেভাবেই হোক নীলুকে সরিয়ে ফেলবে কিন্তু এখন তো তার বউয়ের জন্য ভালোবাসা উপছে পড়ছে। পিউকে খাবার হাতে নাড়াচাড়া করতে দেখে পাশ থেকে আরিফ ফিসফিস করে বলল,
> খাবার সামনে রেখে কি ভাবছিস? জুনায়েদের বউকে দেখলাম পাশের টেবিলে বসে আছে। মারাত্মক সুন্দরী। ওমন সুন্দরী বউ রেখে তোর মতো পেত্নীর কাছে কে আসতে চাইবে? এতো ভাব নিয়ে লাভ হবে না। সরে যা তোর জন্য ভালো হবে।

আরিফের কথা শুনে ওর মনে হলো কাঁটা ঘাঁয়ে নুনের ছিঁটা পড়লো। ছেলেটা আস্ত একটা চামার। কখন কি বলতে হয় জানে না। পিউয়ের ইচ্ছা হলো থালার বার্গারটা নিয়ে ওর মুখের মধ্যে ঢুকিয়ে দিতে। তবুও নিজের রাগটা নিয়ন্ত্রণ করে দাঁতের সঙ্গে দাঁত লাগিয়েছ বলল,

> চুপ করবি? তুই মুখ খুললে চারদিকে গন্ধ ছড়িয়ে যায় বুঝতে পারিস না?

> উচিৎ কথার ভাত নেই জানতাম। যাইহোক আমি মিথ্যা বলছি না। পাশের টেবিলে ভাবিকে দেখে জুনায়েদ এভাবে চলে গেলো।

পিউয়ে এবার নড়েচড়ে বসলো। জুনায়েদ বলেছিল নীলু অশিক্ষিত পাতে নেওয়া যায় না টাইপ মেয়ে।আবার দেখতে আহামরি সুন্দরীও না। যদিও পিউ পরে দেখেছে নীলু বেশ সুন্দরী।কিন্তু সুন্দরী হলেই তো আর স্মার্ট হয়ে যাবে না। চলনে বলনে যদি মানুষকে আকৃষ্ট করতে নাই পারলাম তাহলে ওমন রূপ থেকে কি লাভ? কিন্তু এখন তো মনে হচ্ছে উল্টো। কথাগুলো ভেবে ও আরিফ কে বলল,

> ওটা নীলু ছিল তুই সিউর?

> আরে বাবা আমার চোখ না হয় ভূল করবে জুনায়েদের তো না। সত্যিই ছিল। তাইতো বলছি কেটে পড় মঙ্গল হবে।

> তোকে এতো কথা বলতে বলেছি আমি? ইডিয়েট।

পিউ রাগ নিয়ে টেবিল থেকে উঠে চলে আসলো। বাকিরা বিষয়টা বুঝতে পারলো না। আরিফ বিষয়টা সামলে নিলো। বন্ধুদের মধ্যে ওসব নিয়ে ঝামেলা করা ঠিক হবে না ভেবে। তাছাড়া বন্ধু হয়ে বন্ধুকে ভালো পরামর্শ দেওয়াটা দোষের না। অন‍্যদিকে জুনায়েদ বাড়িতে ফিরে সোজা নিজের রুমে এসে ঢুকলো। নীলু একটা বই বুকের সঙ্গে জড়িয়ে নিয়ে সোফায় হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে ছিল। জুনায়েদের পায়ের শব্দে ও চোখ খুলে কৌতূহল নিয়ে তাকালো। জুনায়েদ ওর পাশে গিয়ে কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে সোজাসাপ্টা প্রশ্ন করলো,

> কিছুক্ষণ আগে তুমি কোথায় ছিলে?

> এখানে ছিলাম। বইটা পড়লাম বেশ ভালো।

জুনায়েদ ওর বইয়ের দিকে তাকিয়ে অবাক। ওর ইচ্ছে হলো নিজের চুলগুলোকে একটা একটা করে উপড়ে দিতে। এই ধমড়ি মেয়েটা বাচ্চাদের কবিতার বই পড়ছে। ওর আরও ইচ্ছে হলো যেই লোকটা ওকে এই বইটা এনে দিয়েছে তাকে ইচ্ছে মতো ধোলাই করতে। রেস্টুরেন্টের কথা জুনায়েদ বেমালুম ভূলে গেলো। ওর মনে হলো রেস্টুরেন্টে যাকে দেখেছিল এই মেয়েটা সে কিছুতেই হতে পারেনা। কার সঙ্গে কিসের তুলনা করছে। ওকে এভাবে চুপচাপ ভাবতে দেখে নীলু মিষ্টি হেসে বলল,

> কিছু ভাবছেন? আম্মা বলেছেন আপনার উপযুক্ত হয়ে উঠতে। তাই জন্য বইখাতা এনে দিয়েছেন। দেখবেন আপনি?

জুনায়েদ ওর দিকে কটকট দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,

> তুই দেখ আমার এতো সখ নেই। বয়স কতো তোর?

> আপনি তুই তুকারি করছেন কেনো? আম্মা আম্মা….

নীলু কাঁদতে কাঁদতে বই হাতে ঝড়ের গতিতে বেরিয়ে গেলো ঘর থেকে। জুনায়েদ কিছুক্ষণ আহাম্মকের মতো চেয়ে ছিল। ঘটনাটা বুঝতে ওর বেশ সময় লাগলো। কিন্তু পরক্ষণেই তাড়াতাড়ি বাইরে বেরিয়ে পড়লো। গিয়ে দেখলো ডাইনিং রুমের সোফায় ওর মাকে জড়িয়ে ধরে নীলু ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছে। ছৈয়দ আহম্মেদ গম্ভীর মুখে বসে আছেন। জুনায়েদ ভয়ে ভয়ে সেখানে উপস্থিত হতেই উনি ভরাট কন্ঠে বলে উঠলেন,

> শিক্ষা দিক্ষা দিয়ে তোমাকে একটা অমানুষ তৈরী করেছি। লজ্জায় আমার মাথা কাটা যাচ্ছে। মেয়েটার সঙ্গে এসব করতে তোমার বিবেকে বাঁধেনি?

জুনায়েদ বেশ অবাক হলো। মেয়েটার সঙ্গে ও কি এমন করেছে মনে পড়লো না। সামান্য তুই করে কথা বলেছে তার জন্য এতোকিছু? ওকে এভাবে অবাক হতে দেখে পারভীন বেগম বললেন,

> মেয়েটার মনটা খুব নরম। তুই ওর সঙ্গে খারাপ ব‍্যবহার করেছিস কেনো? খুব তো বউ বউ করে বাড়িতে ফিরলি।

জুনায়েদ ওখানে আর অপেক্ষা করলো না। নিজের রুমে চলে আসলো। বাড়িতে শত্রুর অভাব নেই। নিজের বাবা মা প্রধান আসামী। ও ঘরে ফিরতেই ফোনটা বেজে উঠলো। জুনায়েদ ফোনটা হাতে নিয়ে ভ্রু কুচকে ঠোঁট নাড়লো। অনিক কল করেছে তিনদিন পরে। ও ধরবে না ভেবেও ফোন কানের কাছে নিয়ে হ‍্যালো বলতেই ওপাশ থেকে উত্তেজিত কন্ঠে বলল,

> অফিসের কাজে কক্সবাজার গিয়েছিলাম। তোর খোঁজ নিতে পারিনি। শুনেছিস কি হয়েছে?

> কি হবে? ওই সুবাস লোকটা আমড়া কাঠের ঢেকি। বউ আমার কাধে চড়ে নিত্য করছে।

> আমার কথাগুলো শুনবি? সুবাসের লাশ পাওয়া গেছে বুড়িগঙ্গা নদীতে। সঙ্গে ওর চ‍্যালাও আছে।

জুনায়েদ চোখ বড়বড় করে তাকিয়ে বিস্ময়কর কন্ঠে বলল,

> কবে এমন হলো?

> কোথায় থাকিস তুই? গতকাল থেকে টিভিতে নিউজ চলছে। শহর জুড়ে আলোচনা হচ্ছে। সকালবেলায় দেখা কর। কাহিনী কি জানতে হচ্ছে।

জুনায়েদ ফোনটা রেখে চোখের উপরে হাতটা রেখে সোফায় গিয়ে শুয়ে পড়লো। সব কিছু মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। নীলুকে এই বাড়িতে সেদিন কেউ পৌঁছে দিয়ে লোকগুলোকে মেরেছে এটা ও সিউর কিন্তু কিভাবে জানবে মেয়েটা যে কিছুই বলে না। কিছু জিঞ্জাসা করলে ড‍্যাপ ড‍্যাপ করে তাকিয়ে থাকে। মনে হয় ভাজা মাছ উল্টে খেতে জানেনা। কথাগুলো ভেবে ওর মাথাটা ধপধপ করে জ্বলে উঠলো। এভাবে বেশ কিছুক্ষণ অতিবাহিত হলো। নীলু আস্তে করে টানা পা ফেলে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়লো। জুনায়েদ বুঝতে পেরে চট করে বসে ওর দিকে তাকিয়ে বলল,

> চোরের মতো করছো কেনো? তখন কি এমন বলেছিলাম যে বর মারা গেছে এমন কান্নাকাটি করলে? বাবা মায়ের কাছে আমাকে খারাপ প্রমাণ করতে উঠে পড়ে লেগেছো তাই না?

জুনায়েদের কথায় নীলু পিটপিট করে চোখের পাতা নাড়িয়ে বলল,

> তুই করে বললে আমার কান্না পাই।

ওর কথা শুনে জুনায়েদ ঠোঁট গোল করে বলল,

> ওও। এবার থেকে মহারানিকে সম্মান দিয়ে আপনি করে বলবো ঠিক আছে?

নীলু লজ্জা মাখা মুখে আচ্ছা বলে শুয়ে পড়লো। ওকে শুয়ে পড়তে দেখে জুনায়েদ নিজের চুলগুলো শক্ত করে ধরে সামনের ট্রি টেবিলে লাথি দিয়ে ধপ করে বসে বিড়বিড় করে বলল,এটাকে বউ বলে? আস্ত ড্রামা কুইন। ও আজ আর বিছানায় ঘুমানোর সাহস পেলো না। ভুলভাল কিছু হয়ে গেলে তখন আবার সমস্যা। ও খুব কষ্ট করে এক পাশ হয়ে সারারাত পার করলো। সকালবেলায় ঘুম থেকে উঠে মেজাজ গেলো বিগড়ে। ঘাড় লক হয়ে গেছে কিছুতেই ঘুরছে না। এক পাশ হয়ে তাকাতে হচ্ছে। ওকে দেখে নীলু মিটি মিটি হাসছে। জুনায়েদ ঘাড় বাকিয়ে গম্ভীর হয়ে বসে আছে। পারভীন বেগম পানি গরম করে নীলুর হতে ধরিয়ে দিয়ে গেলেন ওর কাধে দেওয়ার জন্য। পিউ চুপচাপ শাশুড়ির কথামতো জুনায়েদের কাধে গিয়ে গরম পানির ছ‍্যাকা দিতে লাগলো। জুনায়েদ ওকে সরিয়ে দিতে চেয়েছিল কিন্তু বেশ ভালো লাগছে তাই কিছু বলল না। ও কিছু একটা ভেবে বলল,

> তোদের বাসা, সরি তোমাদের বাসা কোথায়? গ্রামের নাম কি?

পিউ স্বাভাবিক ভাবে উত্তর দিলো,
> রূপনগর।

> এটা কোন বিভাগের মধ্যে পড়েছে? তোমাদের জেলা শহর কোথায়?

> জ্বী?

জুনায়েদের কথা শুনে মেয়েটা অবাক হলো। মনে হলো এসব সে কিছুই জানেনা। জুনায়েদ বিষয়টা বুঝতে পেরে বলল,

> হঠাৎ কি এমন হয়েছিল বলবে যে হঠাৎ সেদিন বাবা মাকে নিয়ে আমাদের বাড়িতে উপস্থিত হয়ে আমার জীবনটা নরক বানিয়ে দিলে?

> আপনার বাবা ডেকেছিলেন আমরা নিজে আসিনি। আমার বাবা বাধ্য ছিল আপনার বাবার কথা শুনতে।

> মানে?

> আমি কিছুই জানিনা। শুধু এইটুকু শুনেছি। আচ্ছা পছন্দ না হলে আপনারা বুঝি মানুষকে হত্যা করেন?

নীলুর কথা শুনে জুনায়েদ ফ্রিজ হয়ে গেলো। মেয়ে দেখি সব জানে। যদি বাবা মাকে বলে বিষয়টা তখন কি হবে? বাবা তো ওকে একটুও দেখতে পারেনা। শুনলেই গুলি করবে। না না এমন হতে দেওয়া চলবে না। জুনায়েদ থতমত খেয়ে বলল,

>বাজে কথা ওমন কেউ করে নাকি।

জুনায়েদ তাড়াতাড়ি করে ওকে সরিয়ে বাইরে চলে আসলো। ও আজকে আর ফিরবে না। অনিকের সঙ্গে দেখা করবে। বিস্তারিত না জানলে মনে শান্তি ফিরছে না। অনিক বাড়িতে বসে খুব আরাম করে টিভি দেখছিল হঠাৎ জুনায়েদকে দেখে উঠে বসতে বসতে বলল,

> হঠাৎ তুই?
জুনায়েদ ঘাড় শক্ত করে বসতে বসতে বলল,

> তোর বাড়িতে আসতে কি আমার অনুমতির জন্য আবেদন করতে হবে?

> ফোন করে আসতি কিছু রান্না করতাম। আম্মু বাড়িতে নেই। আর আম্মু না থাকলে সেদিন কাজের মহিলাটা আসে না। কি অদ্ভুত। যাইহোক তোকে দেখতে রোবট রোবট লাগছে।

> বিরক্ত না করে সুবাসের কথা বল। পাতি গুন্ডা নিজেকে হীরো দাবি করে। আমি নিশ্চিত কোন খদ্দের বেটাকে খালাস করে দিয়েছে কাজ না করে ভাব নেবার জন্য।

> ছি তোর কথাবার্তা কেমন নোংরা হয়ে গেছে। চল ঘুরে আসি বিস্তারিত জানতে।

> কোথায়?

> থানায়।

(চলবে)

ভুলত্রুটি মার্জনা করবেন।

আসুন নামাজ ও কোরআন পড়ি।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here