#আরোহী [10]
#sharmin_akter_borsha
_______________
দেখতে দেখতে দুইদিন কেটে গেছে। দুদিন বাড়ি ভর্তি মানুষ ছিলো। একজন একজন করে সবাই চলে গেছে একা রয়ে গেছে আরোহী। হল রুমের দক্ষিণ দিকে বড় দেয়ালে তিনটা ছবি টানিয়ে রাখা হয়েছে। এক হচ্ছে আরোহীর বাবার ছবি, দুই আরোহীর মা’য়ের ছবি, তিন গতকাল আরাফের ছবি লাগানো হয়েছে। সকালে আরোহীর সাথে দেখা করতে এসেছিল আরোহীর ডাক্তার আঙ্কেল। সে চলে যাওয়ার পরে আরোহী ছবিগুলোর সামনে এসে দাড়ায়। আরাফের ছবির দিকে অশ্রুসিক্ত নয়নে তাকিয়ে জড়ানো কন্ঠে বলল, “ মিস ইউ ”
বলে মাথা নিচু করে দৃষ্টি ফ্লোরের উপর স্থির করলো। চোখের কার্নিশ বেয়ে এক ফোঁটা অশ্রু কণা গড়িয়ে পরল। আরোহী মাথা তুলে ছবিটার দিকে আবারও তাকালো। মুখ খুলেছে কিছু বলার জন্য কিন্তু তার আগেই আরোহী ছিটকে গিয়ে পরল উল্টো দিকের টেবিলের উপর। কিছুক্ষণের জন্য স্তব্ধ দাঁড়িয়ে রয় আরোহী। সব কিছু তার মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে পরিস্থিতি বুঝার জন্য পেছনে ঘুরে তাকালো। এক হাত দিয়ে আরোহী ওর কপাল চেপে ধরে আছে। কাঠের সাথে বাড়ি লেগে কপাল ফেটে রক্ত বের হচ্ছে।
আকস্মিক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল আরোহী। কিছুদূর দাঁড়িয়ে আছে আরোহীর ফুপু ও তার স্বামী। তাদের পেছনে দাড়িয়ে আছে চার থেকে পাঁচ জন লোক।আরোহীর ফুপি নিশা শাড়ির কুঁচি ধরে কিছুটা উপরে তুলে ধুপধাপ পা ফেলে আরোহীর সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। ওকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে তিনি সোজা আরোহীর খোলা চুল ধরে মুঠি বন্ধ করে টেনে তুললো। ব্যাথা ‘মা গো’ বলে চিৎকার দিয়ে উঠল আরোহী।
চুলে ধরে নিশা আরোহীকে নিজের সাথে দাঁড় করিয়ে সজোরে চড় বসালো আরোহীর গালে। সাথে সাথে আরোহী ফ্লোরে পরে গেলো। কান্না করতে করতে বলল, “ আমি কি করেছি ফুপি? মারছো কেনো আমাকে? আমার বাবা মা বেঁচে থাকলে তোমরা এমন করতে পারতে না। ”
নিশা আবারও আরোহীর চুলের মুঠি ধরে কর্কশকন্ঠে বলল, “ভাইয়া ভাবি ছিলো বলেই তো তোকে কিছু বলতে পারিনি। নয়তো তোর তেজ কবেই কমিয়ে ফেলতাম৷ আমাকে দেখে যখন কপাল কুঁচকাতিস তখন ইচ্ছে করতো ঠাসস করে গালে চড় বসিয়ে দেই। অনেক কষ্টে নিজেকে সংযত রেখেছি। আজ থেকে সব কিছুর হিসাব নিবো আমি। ভাইয়া চলে যাওয়ার পর ভেবেছিলাম এইবার তার সম্পত্তি ভোগ করবো সারাজীবন আরামে বসে খাবো কিন্তু তুই তা করতে দিসনি। না, না, না তুই নোস। ছিলো তো তোর আরাফ ঘরের মধ্যে বেডা লইয়া থাকতি। আমারে কি মনে করছোস আমরা কিছু বুঝি না। ইজ্জত তো খুহাইছিস অনেক আগেই খালি বড় ঘরের মাইয়া বলে আড়ালে লুকায়ে করতে পারছিস সব। কোই কোই হাত দেয়নাই তোর ওই আরাফ পোলায় সতীত্ব ভোগ করছে ওই পোলা তোর। ”
মাত্রারিতিক্ত ক্ষোভে চোখ দুটো লাল হয়ে গেছে। নিশার দিকে তাকিয়ে হুংকার দিয়ে উঠল আরোহী, “ ফুপি মুখ সামলে কথা বলো। আমার চরিত্র নিয়ে কথা বলার তোমার কোনো অধিকার নেই। আর যে মানুষটা এই পৃথিবীতে নেই তাকে নিয়ে বাজে মন্তব্য না করলে কি হয় না তোমার? ”
‘কি বললি তুই? আমার সাথে উচ্চ স্বরে কথা বলার সাহস তুই কোথায় পেয়েছিস? ”
বলে আবারও আরোহীর চুলের মুঠি ধরল নিশা। আরোহী চুলের টানে ব্যাথায় কুঁকড়ে উঠছে অস্ফুটস্বরে বলছে, ‘ ফুপি ছাড়ো বলছি লাগছে আমার। ”
নিশা আরোহীকে ধাক্কা দিয়ে ছেড়ে দিলো। আরোহী গিয়ে ইটের দেয়ালের সাথে ধাক্কা খেলো কপাল ফাটা জায়গায় আঘাত লাগলো। আঘাতের জায়গায় আঘাত লাগায় রক্তক্ষরণ হতে লাগল। এক হাত দিয়ে কপাল চেপে ধরে ফ্লোরে উপড় হয়ে পরে আছে আরোহী। নিশা এলোপাথাড়ি পা ফেলে আরোহীর সামনে গেলো। ফ্লোরের উপর রাখা আরোহীর আরেক হাতের উপর পা রাখল নিশা। এবার আরোহী ‘বাবাগো’ বলে চিৎকার দিয়ে উঠল। নিশা আরোহীর দিকে কিছুটা ঝুঁকে চুল ধরে টেনে বলল, “ আজ কোই তোর নাগর, প্রেমিক? তোকে বাঁচাতে আইবো না? আইতে কো, আমরাও দেখি তোর নাগর রে। ওইদিন তো উকিল লইয়া বড় বাহাদুরি দেখাইছিলো। আমার ভাইয়ের বাড়ি আর আমরা থাকতে পারমু না। ইশশ তহন যে কত কষ্ট লাগছে আমার। ইচ্ছা করছিলো তোগো দুইডারে দা’উ দিয়া কু’পাই। ”
আরোহী শাণিত কন্ঠে বলল, ‘ ফুপি আমার হাতের উপর থেকে সরো ব্যাথা লাগছে আমার। ’
নিশা আরোহীর হাতের উপর আরও বেশি ভোড় দিয়ে দাঁড়ালো। ‘আহহ’ বলে চিৎকার করে উঠল আরোহী।
“আরো জোরে চিৎকার কর। তোর চিৎকারে পরান জুড়াবো আমার। আজ থেকে রোজ তোকপ চিৎকার করতে হবে। তোর চিৎকার আর তুই এই চার দেয়ালের মাঝেই বন্ধি থাকবি। তোকে তিলেতিলে মারবো। রোজ মৃত্যুর জন্য কান্না করবি কিন্তু মৃত্যু তোর নসিবে আসবে না। অনেক সহ্য করেছি আমি সময় এসেছে সব কিছু শোধবোধ করার। অনেক কিছু থেকে বঞ্চিত করেছে তোর বাবা আমাকে। সেসব কিছুর প্রতিশোধ আমি তোর উপর থেকে নিবো। আজ থেকে দিনগুনা শুরু কর আরোহী। তোর জীবনে তোর ফুপু কাল হয়ে ফিরে এসেছে। ”
নিশা পেছনে তার স্বামীর দিকে ঘুরে চোখ দিয়ে ভেতরে যেতে ইশারা করল। তারাও সিঁড়ি দিয়ে উঠে চলে গেলো। পেছন পেছন নিশা ও চলে গেলো। কিচেন থেকে উঁকি দিয়ে সবটা দেখছিলো এ্যানি তারা সকলে চলে যেতে ছুটে আসে সে আরোহীর কাছে। আরোহী বহু আগেই সেন্সলেস হয়ে গেছে। এ্যানি আরোহী কে ধরে বহু কষ্টে কিচেনে নিয়ে গেলো। ফ্লোরে চাদর বিছিয়ে আরোহীকে তার উপর শুইয়ে দিলো। আরোহীর ক্ষত স্থানে ঔষধ লাগিয়ে বেন্ডেজ করে দিয়ে পাশে বসে রইল। ঘন্টা খানেক পার হয়ে গেছে কিন্তু আরোহীর এখনো জ্ঞান ফিরেনি। এ্যানি খেয়াল করলো আরোহী কিছুক্ষণ পর পর কেঁপে কেঁপে উঠছে। ভ্রু কুঞ্চিত করে সিওর হয়ে নিলো এ্যানি। সত্যি সত্যি আরোহী কাঁপছে। উঠে গিয়ে আরোহীর কপালে হাত রাখলো। শরীর জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে। এ্যানি একটা বাটিতে জল নিয়ে আরোহীর মাথার পাশে বসল। একটা শুকনো কাপড়ের টুকনো পানিতে ভেজালো। হাল্কা চিপে কাপড়টা আরোগীর কপালের উপর রাখলো। বার কয়েক কাপড়া টা উল্টিয়ে পাল্টিয়ে দিলো। কিন্তু শরীর প্রচুর গরম দেখে এ্যানি ছুটে বাথরুমে চলে গেলো। তার একটা ওড়না ভিজিয়ে নিয়ে আসলো। আরোহীর হাত পা ভালো করে ভেজা ওড়না দিয়ে মুছে দিলো৷ শরীরের গরম হালকা কমেছে। মাথার জলপট্টি পানিতে ভিজিয়ে আবারও কপালে রাখল।
এ্যানি দেখতে পেলো আরোহীর ঠোঁট জোড়া কাপছ। এ্যানি ভাবে হয়তো আরোহী কিছু বলতে চাচ্ছে, সেজন্য আরোহীর ঠোঁটের কাছে কান পেতে শোনার চেষ্টা করতে লাগে সে কি বলতে যাচ্ছে। জ্বরের ঘোরে বিড়বিড় করে বলছে বলে তেমন বোঝা যাচ্ছে না। কিন্তু এ্যানিও সেখানে সেভাবে কান পেতে বসে রয়। কিছুক্ষণ পর স্পষ্ট বুঝতে পারে আরোহী, বিড়বিড় করে “আরাফের” নামটি উচ্চারণ করছে। সে বলছে, ‘ আরাফ কোথায় তুমি? আমি তোমাকে দেখতে কেন পাচ্ছি না আরাফ? প্লিজ যেখানেই থাকো ফিরে আসো। আমার যে আমার বন্ধুটাকে খুব প্রয়োজন।”
এ্যানি ভারী দীর্ঘ শ্বাস ফেলে আরোহীর মাথায় হাত বুলাতে লাগলো। এ্যানি নিজেকে সামলাতে ন পেরে নিজেও কেঁদে ফেলে। কান্না জড়ানো কন্ঠে বলে উঠে, “ ছোট সাহেব আপনি ছিলেন। আরোহী আপার একটা ঢাল ছিলো। আপনি নাই দেখেন নড়পশু গুলা আপার উপর কিরকম অত্যাচার করছে। আপনি কেন আপাকে ফেলে চলে গেলেন? আপার যে কি হবে একমাত্র আল্লাহ মালুম ”
চলবে?
[কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষেধ]