আমার হিয়ার মাঝে পর্ব ৯

0
800

#আমার_হিয়ার_মাঝে
লেখিকা: তাহসীন নাওয়ার রীতি
পর্ব:০৯

‘এতকিছুর পর এই মারিয়ার সাথে আশ্বিন ভাই কিভাবে যোগাযোগ রাখতে পারে?’
‘আর মারিয়া কিভাবে ভাইয়ের বাসা পর্যন্ত চলে গিয়েছে?’
জারিফ আর সাদমানের কথার উত্তর না দিয়ে নীরবে বসে থাকে অধরা। চারপাশে চোখ বুলিয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছে মারিয়ার উপস্থিতি।
‘অধরা, আমি নিশ্চিত মারিয়া আপু এতো সহজে এই বিয়ে মেনে নিবে না। হয়তো আগের বারের মতো কিছু একটা করবেই।’
‘আমি জানি ইশা। তাই তো এবার আমাদের চোখ কান খোলা রেখে চলতে হবে। আগের বারের মতো এবার আর কোনরূপ গাফিলতি করা যাবে না।’
অধরার কথায় সম্মতি প্রকাশ করে সবাই। তখনই গেট দিয়ে প্রবেশ করে মারিয়া। গটগট করে হেঁটে এসে অধরার পাশ কেটে চলে যায়। মুহূর্তেই কপালে ভাঁজ পড়লো অধরার। মারিয়া কি তাকে ইগনোর করলো? সে কি জানে না যে, আশ্বিনের সাথে তার বিয়ে হয়েছে? নাকি জেনেও না জানার ভান করছে?
‘মারিয়ার আচরণ রহস্য জনক।’
‘হুম। এই রহস্যের খুব শীঘ্রই উন্মোচন করতে হবে। এখন ক্লাসে চল সবাই।’
—————

আকাশ মেঘলা হয়ে আছে সকাল থেকেই। মাঝে মাঝে শোনা যাচ্ছে মেঘেদের ডাক। পাখি সব হন্য হয়ে ছুটে চলছে খাবারের সন্ধানে। হয়তো খানিক বাদেই আকাশ ভেঙ্গে শুরু হবে বর্ষণ। জানালার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে আকাশের পরিবেশ দেখছে অধরা। ঠিক পরিবেশ দেখছে বললে ভুল হবে, মূলত সে অপেক্ষা করছে আশ্বিনের। সে তো বলেছিলো বিকেলের মাঝে চলে আসবে, তাই তো আগে আগেই ব্যাগ পত্র সব গোছগাছ করে রেখেছে সে।
‘মনে হচ্ছে আশ্বিন ভাইয়ার সাথে যাওয়ার জন্য আর তড় সইছে না তোর?’
‘জি না, মোটেও এমন কিছু না। নেহাত দুই পরিবারের থেকে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে আমিও রাজি হয়েছি। নয়তো, তোকে একা রেখে চলে যাওয়ার বিন্দু মাত্র ইচ্ছে আমার নেই।’
দমে যায় ইশা। এতগুলো বছর ধরে দুজন মিলে সর্বক্ষণ একসাথে থেকেছে, কতো দুষ্টুমি, কতো সুখে দুঃখে একে অপরের ছায়া হয়ে থেকেছে তারা। এখন অধরার চলে যাওয়ায় একা হয়ে যাবে সে, অধরা যে তার ঢাল ছিলো।
তবুও অধরার জন্য ভালো লাগছে তার। একটা সময় আশ্বিন ভাইয়াকে কীভাবে পাগলের মতো চেয়েছে মেয়েটা, আজ সেই চাওয়ার পূর্ণতা হলো। সত্যিই ভাগ্যকে খন্ডন করা সম্ভব না। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ইশা।

‘সব ঠিকঠাক ভাবে নিয়েছো তো?’
আশ্বিন ব্যাগ গাড়িতে উঠিয়ে অধরার উত্তরের অপেক্ষায় থাকে। অধরা নিশ্চিন্ত হতে আর একবার সবটা পরখ করে নেয়। ইশা, রুমি ম্যাম সহ সবাই এসেছে গেট অবদি তাদের বিদায় জানাতে। অধরা সব ঠিকঠাক করে ইশার কাছে আসে।
‘আমার মাথায় একটা বুদ্ধি এসেছে, তুইও চল আমার সাথে। একসাথে থাকবো, তাহলে মারিয়ার বিপক্ষে প্ল্যান করতেও সুবিধা হবে। দাঁড়া আমি আশ্বিনকে গিয়ে বলছি।’
হেসে উঠলো ইশা। সব সময় অধরার ছেলেমানুষি। হুটহাট একটা বোকার মতো কথা বলা অধরার কখনও যাবে না।
‘থাম। নব দম্পতির সাথে গিয়ে কাবাবে হাড্ডি হওয়ার ইচ্ছে আমার নেই। তার চেয়ে বরং তুই একটা কাজ করে দিতে পারিস। জারিফকে বল যেন খুব শীঘ্রই আমাকে বিয়ে করে নেয়। তাহলে তোর মতো আমারও একটা সংসার থাকবে।’
‘এর জন্য জারিফকে আবার বলতে হবে নাকি? তুই শুধু বউ সেজে রেডি থাকবি, আমি জারিফকে উঠিয়ে হলেও নিয়ে আসবো। কথা ফাইনাল।’
হেসে ফেলে দুজন। ইশা দুচারটা কথা বলে অতঃপর জড়িয়ে ধরে বিদায় জানায় অধরাকে।

হোস্টেল সুপার রাগী রুমি ম্যমও আজ বিষন্ন মনে দাড়িয়ে আছেন।
‘আমি চলে যাচ্ছি ম্যাম।’
‘হুম। মনে হচ্ছে হোস্টেল থেকে কন্যা দান করছি আমি। আমার তো মেয়ে নেই, তোরাই আমার মেয়ে। পুরো হোস্টেল তো মাথায় তুলে রাখতি, অনেক রাগ দেখিয়েছি তোর উপর।মায়ের উপর রেগে থাকিস না।’
কেঁদে ওঠে অধরার মন। অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে নেয়, কারো সামনে নিজের দুর্বলতা প্রকাশ না করার প্রতিজ্ঞা বদ্ধ সে।
‘আপনি মায়ের মতোই আমার খেয়াল রেখেছেন ম্যাম। আমি একটু অসুস্থ হলে নিজে হাতে আমার সেবা যত্ন করেছেন। এই প্রতিদান আমি কীভাবে দিবো?’
‘দিতে হবে না। শুধু মাঝে মাঝে এসে দেখা করে যাবি।’
‘আমি তো প্রতিদিনই এসে বিরক্ত করে যাবো।’
হেসে উঠে রুমি ম্যাম। অধরার মাথায় হাত বুলিয়ে তাকে বিদায় জানায়। সবার থেকে বিদায় নিয়ে গাড়িতে বসে পড়ে অধরা।
স্বপ্নের মেডিকেলে ভর্তির পর বাবার হাত ধরে সে এসেছিলো এই হোস্টেলে, আর আজ ফিরে যাচ্ছে বরের সাথে। চলন্ত গাড়ির জানালা দিয়ে তাদের দিকে তাকিয়ে একটি দীর্ঘশ্বাস ফেললো অধরা।
—————-

সিঁড়ি বেয়ে নয় তালা উঠতে গিয়ে হাঁপিয়ে উঠেছে অধরা, তার উপর হাতে এতগুলো ব্যাগ পত্র। রাগী চোখে একবার আশ্বিনের দিকে ফিরে তাকায় সে। মহাশয় কি ফ্ল্যাট থেকে মহাকাশ দেখতে চেয়েছিলেন নাকি? যে এতো উঁচুতে ফ্ল্যাট নিতে হলো? আর কি ফ্ল্যাট ছিলো না?
‘জানি তো রেগে আমাকে দোষ দিচ্ছো। কিন্তু এখানে আমার কোন হাত নেই। গতকাল রাতে লিফট নষ্ট হয়ে গিয়েছে, সকালে দেখেছিলাম ঠিক করা হচ্ছে। তাই চিন্তার কিছু নেই..।’
মেজাজ খারাপ হচ্ছে অধরার। মহাশয়ের কোন জিনিসটা ঠিকঠাক ভাবে থাকে? আবার বলছেন চিন্তার কিছু নেই! অসহ্যকর!
তার সব রাগের মূল এই ছেলে।

উপরে উঠে দরজায় কলিং বেল বাজতেই একজন মহিলা এসে দরজা খুলে দেন।আশ্বিনের পিছু পিছু অধরাও ভেতরে প্রবেশ করে।
‘আরে! আমরার বউমণি চইলা আইছে নাকি?’
‘জি খালা। এই হলো আপনার বউমণি অধরা। অধরা পরিচিত হও রাশেদা খালার সাথে। ফ্ল্যাট দেখাশোনা, রান্না করে খাওয়ানো মানে ছোট বড় সব কাজে খালা আমাকে সাহায্য করেন। আর..টুসি। টুসি কোথায়?’
তখনই একটা আট নয় বছর বয়সী পিচ্চি দৌড়ে রুমে প্রবেশ করে ড্যাবড্যাব করে অধরার দিকে তাকিয়ে থাকে।
পিচ্চির এরূপ দৃষ্টি দেখে অধরা হেসে উঠে তার গালে হাত বুলিয়ে দেয়।
‘এই হলো টুসি, রাশেদা খালার নাতনি। আর টুসি, এইযে তোমার মামি। কাল থেকে মামি মামি করছিলে না, নাও এখন নিয়ে এসেছি।’
‘মামি মেলা পছন্দ হইছে, মামা। বহুত সুন্দরী মামি।’
হেসে উঠে আশ্বিন। অধরা একটা লাজুক হাসি দেয় পিচ্চির কথায়।
—————-

বাহিরে ঝড় বৃষ্টি। বৃষ্টির সাথে তাল মিলিয়ে বাসায় আজ রান্না হয়েছে খিচুড়ি আর মাংস। আপনমনে গরম গরম খিচুড়ি খেতে ব্যস্ত আশ্বিন। অধরার খেতে ইচ্ছে নেই, সবে মাত্র সে হোস্টেল থেকে খেয়ে এসেছে। তবুও নাছরবান্দা আশ্বিন। সে একা খাবে না, অধরাকেও তার সাথে খেতে হবে।
রাগ হচ্ছে অধরার। নেহাত পাশের ঘরে খালা আছেন, নয়তো এখনই একটা উত্তম মধ্যম দিয়ে দিতো আশ্বিনকে। তখনই পাশের ঘর থেকে শোনা যায় খালার কণ্ঠস্বর।
‘খাইয়া ফেলাও বউমণি। জামাইয়ের লগে খাইলে দুইজনের মাঝে প্রেম মহব্বত বাড়বো।’
দ্বিধা দ্বন্দ্বে পড়ে যায় অধরা। বড়দের কথা অগ্রাহ্য করা তার পক্ষে সম্ভব না, তাছাড়া খালার কাছ থেকে যদি তাদের দুজনের পরিবার কিছু জানতে পারে, তবে তারা কষ্ট পাবেন। তাই বাধ্য হয়ে খাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় সে।
আশ্বিন নিজ হাতে অধরার প্লেটে খাবার তুলে দিচ্ছে। অধরা চুপচাপ বসে আছে, তার দৃষ্টি যাচ্ছে তাদের মুখোমুখি চেয়ারে বসে থাকা টুসির দিকে। ছোট ছোট হাত দিয়ে মুঠো ভরে খাবার মুখে পুরে যাচ্ছে সে। মুখের সামনের দুই দাঁত নেই, তবুও কি স্নিগ্ধ ভরা মায়াবী মুখখানি!
সে আপনমনে খেতে খেতে বারবার আড়চোখে দেখছে অধরকে, যেন গভীর ভাবে কিছু পর্যবেক্ষণ করতে ব্যস্ত সে।
‘তোমার কাজ কর্ম দেইখ্যা আমি বহুত হতাশ হইছি মামা।’
আশ্বিন খাওয়া ছেড়ে ফিরে তাকায় টুসির দিকে। রাগ রাগ মুখ করে গাল দুটো ফুলিয়ে তাকিয়ে আছে সে।
‘কেনো? কি করেছি আমি?’
‘কি করছো মানে? কি করো নাই তুমি? জানো না তুমি, নতুন বউরে নিজে হাতে মুখে তুইলা খাওয়ায় দেওয়া লাগে?’

দুজনের কথা শুনতে শুনতে খাবার হাতে তুলে মুখের কাছে নিয়ে এসে থমকে যায় অধরা। এসব কি বলছে এই পিচ্চি? আশ্বিন তাকে খাইয়ে দিবে?
‘তোমার মামি নিজে হাতে খেতে পারে টুসি।’
‘তো কি হইছে? তোমারে যে আমি কালকে এতো টেরেনিং দিলাম, তুমি কি সব ভুলে গেলা মামা? কালকে যে এতো করে বলছিলাম, মামির জন্য কি কি উপহার কিনবা, মামিকে কেমনে নিজে হাতে খাওয়ায় দিবা, কোন কোন রুমান্টিক ডায়লগ কইবা সব কিন্তু বুঝাই দিছিলাম আমি। তখন তো দেখলাম সবই ঠিকঠাক কইতে পারো, তাইলে এখন কও না কেন? মামির সামনে কও, শরমের কি আছে? তোমারই তো বউ লাগে।’

চোখ বড় বড় করে থমকে তাকিয়ে আছে অধরা। কি বললো টুসি? কালকে আশ্বিন বউ বিষয়ক ট্রেনিং নিয়েছে? দৃষ্টি স্থির রেখে অধরা ফিরে তাকায় আশ্বিনের দিকে। মাথা নামিয়ে দৃষ্টি প্লেটের দিকে করে রেখেছে আশ্বিন। কান দুটো লাল হয়ে আসছে তার, কার সামনে কিসব কথা বলছে এসব এই পিচ্চি? মান সম্মান আজ তার যাবে বলে।
‘টুসি, খাওয়া শেষ করো। এসব কথা নাহয় পরে বলবো।’
নিজেকে সামলে নিয়ে খুব কষ্টে কথাগুলো বললো আশ্বিন। অধরার থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে রেখেছে সে। এই মেয়ে কখন জানি আবার কি বলে বসে সেই ভয়ে দ্রুত খাওয়া শেষ করছে আশ্বিন। কিন্তু অধরা এখনও স্তব্ধ। কানে কি এতক্ষণ ভুল শুনছিলো নাকি সে?

এদিকে টুসি বড় বিরক্ত আশ্বিনের কথায়। তার মামা যে এতটা পানসে কেনো হলো? মামির সামনে কি দারুন লজ্জায় পড়তে হলো তাকে।
‘মামি কিছু মনে নিও না। আমার মামা একটু হাবা আরকি। আসলে প্রথম বিয়া হইছে তো, তাই কিছু বুঝতাছে না।’
আতকে উঠে আশ্বিন। টুসির শেষ কথায় খাবার তালুতে উঠে গিয়েছে তার। খুক খুক করে কেঁশে যাচ্ছে সে।
অধরা পাথর হয়ে বসে আছে। কি শুনলো এটা? আশ্বিনের প্রথম বিয়ে বলে..!
কাঁশির শব্দে আশ্বিনের দিকে ফিরে দ্রুত পানির গ্লাস এগিয়ে দেয় অধরা। পাশের ঘর থেকে ছুটে এসেছেন রাশেদা খালা।
‘টুসি ঘরে যা তো, বাজানরে বিরক্ত করিস না। শান্তিতে খাইতে দে।’
‘আমি কই বিরক্ত করলাম নানি? তোমার বাজান এইরম লাজুক হইলে জীবনে কিছুই করবার পাইবো না। আমি সিনেমায় দেখছি হাবা হইয়া জীবন চলে না। বুঝাও মামারে। এখনও সময় আছে।’

উঠে চলে যায় টুসি। অধরা তাকিয়ে থাকে তার যাওয়ার দিকেই। এ তো পুরাই সাংঘাতিক পিচ্চি!
তবে আশ্বিনের দিকে তাকিয়ে প্রচুর হাসি আসছে তার। বেশ জব্দ হয়েছে মহাশয়। হেসে উঠে আপনমনে খেতে শুরু করে অধরা।

–চলবে(ইনশাআল্লাহ)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here