আমার হিয়ার মাঝে পর্ব ৮

0
800

#আমার_হিয়ার_মাঝে
লেখিকা: তাহসীন নাওয়ার রীতি
পর্ব:০৮

‘মারিয়া আপু কি আপনার গার্লফেন্ড?’
অধরার কথায় চমকিত নয়নে আশ্বিন ফিরে তাকায় অধরার দিকে। আপনমনে পা দুলিয়ে আইসক্রিম খেতে ব্যস্ত অধরা। আশ্বিনের নজর যে তার দিকে সীমাবদ্ধ তা বুঝতে পেরে একবার ফিরে তাকায় সে। আশ্বিনের চোখ মুখে বিস্মিত ভাব!
‘কি হলো?’
‘কোন যুক্তিতে তোমার মনে হলো মারিয়া আমার গার্লফেন্ড? তুমি কি দেখোনি আমি তাকে কিভাবে ইগনোর করেছি?’
‘মানুষ অনেক সময় তার প্রাক্তনকে ইগনোর করে চলে। তাহলে কি আমি ধরে নিবো..।’
আর বলা হয়নি অধরার। আশ্বিনের ধমকে চুপ হয়ে যায় সে।
‘সবসময় এক ধাপ বেশি বোঝা কি তোমার জন্মগত কোন গুণ অধরা?’
‘না, ঠিক জন্মগত না। আসলে, আমি বুঝ ক্ষমতা হওয়ার পর থেকেই এক ধাপ বেশি করে বুঝে ফেলি। এটা আমার হিডেন ট্যালেন্ট।’
বিরক্ত হয় আশ্বিন। সব প্রশ্নেরই উত্তর থাকে এই মেয়ের কাছে। গত এক মাস এই বাচাল মেয়ের সাথে থেকে যত গল্প বা কাহিনী সে শুনেছে, আশ্বিন গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারবে বাংলার প্রাচীন লোক কথায়ও হয়তো এতো সব কাহিনী নেই।

‘কেনো পছন্দ করেন না মারিয়া আপুকে? উনি তো দেখতে শুনতে ভালোই। আপনাকেও পছন্দ করেন। তাছাড়া, উনার মতো সুন্দরী মেয়ে আপনি আর দুটো পাবেন নাকি?’
অধরার কথায় আশ্বিন হেসে উঠে। আবেগ দিয়ে যে জীবন চলে না। মারিয়ার প্রতি তার কোনরূপ টান নেই। সে তার এক সাধারণ জুনিয়র মাত্র।
‘বাহ্যিক সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে যদি প্রণয় ঘটে তবে সেখানে ভালোবাসা নয় বরং মোহ প্রকাশ পায় অধরা। ভালোবাসা মনের ব্যাপার, এ এক মায়ার বাঁধন। মোহ অচিরেই কেটে যায়, কিন্তু মায়া থেকে যায় সারাজীবন।’
‘প্রণয়ের সূচনায় মানুষ এতকিছু ভেবে ভালোবাসে নাকি?’
‘ভাবতে হয়। ভালোবাসা কোন ছেলেখেলা না, এটা মনের বন্ধন। মানুষ জীবনে এক বারই ভালোবাসে, মানে জীবন সে এক জনেরই মায়ায় নিজেকে জড়িয়ে ফেলে। আর সৌন্দর্যের ব্যাপারে যদি বলি, পৃথিবীর সব মানুষই সুন্দর। পার্থক্য কেবল দৃষ্টিভঙ্গীর।’
সায় দেয় অধরা। সবকিছু ছেলেমানুষি ভেবে উড়িয়ে দেওয়া অধরার মাথায় আবেগ অনুভূতি নিয়ে চিন্তা কখনোই আসেনি। তবে আজ এই কথাগুলো ভালো লাগলো তার।

আশ্বিন নির্লিপ্ত ভাবে তাকিয়ে আছে অধরার দিকে। এক এক করে পুরো চারটা আইসক্রিম খেয়ে আর একটি খাওয়ার উপদ্রব করছে সে।
‘অনেক হয়েছে, আর খেও না। নয়তো পরে গলা ব্যথা হবে।’
আশ্বিন বিল মিটিয়ে দিয়ে চলে আসার উদ্যোগী হয়, কিন্তু অধরা নাছড়বান্দা। সে যাওয়ার আগে জোর করেই আর একটি আইসক্রিম কিনে নেয়। তার আচরণে আশ্বিন রাগ করলেও, কিছু বলেনি সে। অধরাও বাধ্য মেয়ের মতো আর কথা না বাড়িয়ে আশ্বিনের পাশাপাশি যেতে শুরু করে।

দূর থেকে তাদের একসাথে দেখে তেলে বেগুনে জ্বলে উঠেছে মারিয়া। কিভাবে তার চোখের সামনে দিয়ে আশ্বিনের হাত ধরে তাকে নিয়ে চলে গিয়েছে এই মেয়ে। খোঁজখবর নিয়ে আশ্বিনকে বলা হাসান স্যারের নির্দেশের কথা জেনেছে সে। এই মেয়ে সুযোগ বুঝেই যে আশ্বিনের কাছাকাছি থাকতে চাইছে তা নিয়ে কোন সন্দেহ নেই তার।
শান্তশিষ্ট, আর নম্র ভদ্র আশ্বিন যে প্রথম থেকেই তার মনে দাগ কেটে আছে। এখন আশ্বিনের উপর অন্য কারো আধিপত্য বিস্তার কোন মতে মেনে নিতে পারবে না সে।
যদিও প্রথম দিকে তাকে জুনিয়র ভেবে আশ্বিন ভালোমতো দুচারটা কথা বললেও, দিন দিন তার ব্যতিক্রমী আচরণ আশ্বিনের বিভ্রান্তের কারণ হচ্ছে। তবুও আশ্বিনের প্রতি নিজের এক অদৃশ্য অধিকার কাজ করে তার।
————-

দুদিনের জ্বরে হিমসিম খাচ্ছে অধরা। সেদিন ক্যাম্পাস থেকে হোস্টেলে ফিরেই শুরু হয়েছে ঠান্ডা গলা ব্যাথা। যা পরবর্তীতে বয়ে নিয়ে এসেছে জ্বর। ব্যাথায় কাতর হয়ে বারবার মনে পড়েছে তখন এতো আইসক্রিম খেতে আশ্বিনের বারণগুলো। আফসোস হচ্ছে অধরার। এজন্যই লোকে বলে বড়দের কথা শুনতে হয়।
সোমবার বিকেলে হঠাত করেই অধরার জ্বর বেড়ে যাওয়ায় শেষে বাধ্য হয়ে অধরাকে বাড়িতে পাঠিয়ে দেন হোস্টেল সুপার।
যার ফল স্বরূপ এখন নিজের ঘরে শুয়ে মায়ের সেবা নিচ্ছে অধরা।
‘তুমি কবে বড় হবে অধরা মা? জানো না ছোট থেকেই তোমার একটুতেই ঠান্ডা লেগে যায়? তাহলে কেনো খেয়েছো এতোগুলো আইসক্রিম?’
‘আমি আসলে ইচ্ছে করে খাইনি আম্মু।’
ফারজানা বেগম দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। জ্বর নিয়েও মানুষ হলো না মেয়েটা। ছোট থেকেই সে দুষ্টের সেরা মণি। মেয়ের এই চঞ্চল ভাব পুরো বাড়িকে উৎসব মুখর করে তোলে। তাই শত অভিযোগ শোনার পরেও কখনও মেয়েকে শান্ত নিরিহ হওয়ার জন্য জোর দেননি তিনি। থাক না তার মেয়ে একটু ব্যতিক্রম।

এদিকে,
পরপর দুদিন অধরার অনুপস্থিতি এখন চিন্তার কারণ হয়ে উঠতে আশ্বিনের। বিগত একমাস অধরার অনবরত কথায় এখন সে অভ্যস্থ। তাই অধরার এই অনুপস্থিতি যেন পুরো ক্যাম্পাস জুড়ে নিস্তব্ধতা ডেকে এনেছে। অস্থির লাগছে তার। ক্লাসে বসেও বারবার জানালা বরাবর দৃষ্টি চলে যাচ্ছে।
কে জানে, হয়তো অধরা আসবে এখনই!
‘কি হয়েছে তোর? ক্লাসে মনোযোগ নেই কেন?’
‘এমন বোরিং ক্লাসে কার মনোযোগ থাকবে?’
হেসে উঠে রোদ্দুর। ক্লাস নিয়ে তারও কোন আগ্রহ নেই, নিতান্তই ভদ্রতার খাতিরে চুপচাপ বসে আছে সে।
‘দুদিন ধরে অধরা আসছে না। পিচ্চিটার সব ছেলেমানুষি কথাবার্তায় একটু বিনোদন পাই। নয়তো লাইফটা বিরক্তিকর হয়ে যেতো।’
‘তোর না ছোট বোনের মতো অধরা? তোর তো জানার কথা সে কেনো ক্লাসে আসছে না।’
‘হুম, জানি তো আমি। কিছুক্ষণ আগে জারিফের সাথে দেখা হলো। তার কাছে শুনেছি, অধরা অসুস্থ। ঠান্ডা জ্বরে সোমবার জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলো, অবস্থা খারাপের দিকে যাচ্ছে দেখে হোস্টেল সুপার বাসায় পাঠিয়ে দিয়েছেন।’
‘কিহ? আর এই কথা তুই এখন আমাকে বলিস?’
রাগ হচ্ছে আশ্বিনের। এতকিছু হয়ে যাওয়ার পর এখন সে খবর পেলো অধরার অসুস্থতার।

ক্লাস শেষে বেরিয়ে খানিক দ্বিধা দ্বন্দ্বে ভুগেই অধরারকে ফোন করে আশ্বিন। কিছুদিন আগে অধরা নিজেই তার ফোনে নম্বর দিয়েছিলো। আজ প্রয়োজনে কাজে লাগছে তার। কিন্তু অধরা কি ফোন রিসিভ করবে? আপনমনে নিজেকেই প্রশ্নটি করার সাথে সাথেই শোনা যায় ফোনের বিপরীত পাশ থেকে অধরার কণ্ঠস্বর।
‘আসসালামু আলাইকুম, আশ্বিন ভাইয়া! কেমন আছেন? আমার কথা তাহলে আপনার মনে আছে!’
নিরবে হেসে উঠে আশ্বিন। দুদিন পর এই কণ্ঠ যেন প্রশান্তি এনে দিচ্ছে তার মনে।
‘ওয়া আলাইকুমুস সালাম। কেমন আছো অধরা?’
‘আমি সবসময়ই ভালো থাকি।’
‘কিন্তু আমি শুনেছি তুমি অসুস্থ?’
‘ঠিকই শুনেছেন। আপনি সেদিন আমাকে আইসক্রিম খেতে নিষেধ করলেন না? তারপর তো আমি আপনার কথা শুনিনি, এখন আমার ঠান্ডা জ্বর। এখন বুঝতে পারছি, মুরুব্বীদের কথা সবসময় শুনতে হয়।’
‘এখন কেমন আছো? ঔষধ নিয়মিত নিচ্ছো তো?’
‘হুম, ভালো। আশ্বিন ভাইয়া, জানেন কি গতকাল হয়েছে..?’
শুরু হয় অধরার অফুরন্ত কথা। আশ্বিন তা নিরবেই শুনে যায়।
এই কণ্ঠস্বর, কথা বলার ভঙ্গি যে তার স্বস্তির কারণ। দিন দিন এ কোন অদ্ভুত অভ্যাস গড়ে উঠছে তার? আত্মনির্ভর আশ্বিন কি তবে অধরার মাঝে নিজেকে হারিয়ে ফেলছে? নিজের আচরণে নিজেই বিস্মিত আশ্বিন!
তবে কি সে অধরাকে…!
কথার পূর্ণতার আগেই থমকে উঠে সে। কি ভাবছে সে এসব..?
————

বর্তমান,

‘ভাবি কি ভাবছো তুমি?’
‘হুম? না, কিছু না।’

আরশির কথায় বাস্তবে ফিরে আসে অধরা। আবারও সে হারিয়ে গিয়েছিল অতীতের স্মৃতিতে! কতোই না ভালো ছিলো সেই অতীত। আবেগ আর অনুভূতির মিশ্রণ ছিলো এতে। অথচ তারপর..? কিভাবে সব এক নিমিষেই থমকে যায়।
একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে অধরা। এখন তার মাঝে আগের সেই চাঞ্চল্য ভাব নেই।
মায়া বড় কঠিন জিনিস। একবার মায়ার টানে পড়ে, জীবনের বড় ভুল করেছে সে। স্তব্ধ হয়ে তুলেছে তাকে, ভুলে গিয়েছে সে আসল অধরাকে।

সবার থেকে বিদায় নিয়ে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছে দুজন। অধরা বসে আছে নিরবে। অধরাকে এভাবে দেখে ভালো লেগছে না আশ্বিনের। নীরব থাকার গুণ, অধরার সাথে যায় না। সে যে অধরা বলতে সেই চঞ্চল অধরাকেই চেনে।
যাকে হাজার চেষ্টা করেও শান্ত করতে পারেনি কেউ। এক হাতে পুরো ক্যাম্পাস মাতিয়ে তুলতো সে। যার অনুপস্থিতি করে তুলতো সবকিছু বিস্বাদময়।
‘মন খারাপ?’
চমকে উঠে অধরা। গতকাল রাতের পর এই প্রথম কথা বললো আশ্বিন।
‘না, মন খারাপ হবে কেনো? হোস্টেল ফিরে যাচ্ছি, বন্ধুদের মাঝে। মন ভালো।’
‘হুম। আগামীকাল বিকেলে আমি তোমার হোস্টেলে আসবো, ব্যাগ পত্র সব গুছিয়ে রাখবে। আমার নতুন ফ্ল্যাট ক্যাম্পাস থেকে খুব বেশি দূর নয়। আশা করি তোমার সমস্যা হবে না।’
প্রতিউত্তর দেয় না অধরা। এখন মাথায় শুধু মারিয়ার কথাই ঘুরপাক খাচ্ছে। বন্ধুমহলের সাহায্য নিয়ে খুব শীঘ্রই এর একটি শিক্ষা দিতে হবে। তবে তার আগে জানতে হবে কিছু অজানা তথ্য।

হোস্টেলের সামনে গাড়ি থামতেই অধরা ব্যাগ হাতে নিয়ে নেমে পড়ে। গেটের কাছে হোস্টেল সুপার রুমি ম্যাম দাঁড়িয়ে। আশ্বিন গাড়ি থেকে নেমে ম্যামের সাথে দুচারটা কথা বলে অধরাকে বিদায় জানিয়ে চলে যায়। অধরা চেয়ে থাকে আশ্বিনের যাওয়ার পথে।
গেটে প্রবেশ করতেই ইশা দৌড়ে এসে অধরাকে জড়িয়ে ধরে। প্রিয় বান্ধবীকে ছেড়ে একা থাকতে থাকতে এক প্রকার বিরক্ত সে। তাই অধরার ফিরে আসায় সে বেজায় খুশি।
‘ভাইয়া চলে গিয়েছে? দেখা করতে পারলাম না। যাই হোক, রুমে চল অনেক কথা আছে।’
অধরা হাত টেনে রুমে নিয়ে যায় ইশা। অধরা ভালো করেই জানে কি নিয়ে কথা বলবে তারা। তাই সব কথা আগে থেকেই গোছগাছ করে রেখেছে সে। এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা।

–চলবে(ইনশাআল্লাহ)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here