আমার হিয়ার মাঝে শেষ পর্ব

0
1285

#আমার_হিয়ার_মাঝে
লেখিকা: তাহসীন নাওয়ার রীতি
পর্ব:২৯(শেষ)

মাথার উপর যেন আকাশ ভেঙে পড়ে অধরার। এতগুলো বছর সে এই কথাগুলো জানতেই না। অথচ সে এই কারণে আশ্বিনকে কতো কথাই বলেছিলো।
অধরার এসব চিন্তার মাঝে রাফিন ডেকে উঠে।
‘পুরনো কথাগুলো বলে আমি হয়তো তোমাকে কষ্ট দিচ্ছি। আসলে অধরা আমি চেয়েছিলাম বিষয়টা ক্লিয়ার করতে। আমি চাই না এই নিয়ে আর কোন ভুল বোঝাবুঝি থাকুক।’
‘জি রাফিন ভাইয়া। ভালোই হলো সবটা জানতে পেরে।’
দু’মিনিট নীরবতা বিরাজ করে দুজনের মাঝেই। হঠাত রাফিন একটি কার্ড বের করে তার ব্যাগ থেকে।
‘তোমাকে বলা হয়নি আমার দেশে আসার কারণ। আমার বিয়ে সামনের শুক্রবার।’
‘সত্যি?’
‘হ্যা। হাসান চাচার অনেক জোর ঝাপটার পর বিয়ের জন্য রাজি হয়েছি। তোমাকে আর আশ্বিনকে কিন্তু আসতেই হবে। আমি অনেক খুশি হবো তোমরা আসলে।’
‘অবশ্যই আসবো ইনশাআল্লাহ। বাই দ্য ওয়ে, কি নাম মেয়ের? নিশ্চয়ই খুব সুন্দরী..?’
হেসে উঠে দুজন। কথার ভীরে হারিয়ে যায় পুরনো দিনের স্মৃতি।
—————–

হাসপাতাল থেকে ডিউটি শেষ করে ফ্ল্যাটে ফিরছে আশ্বিন। সারাদিন ক্লান্তির মাঝে ব্যস্ত ঢাকা শহরের যানজট সহ্য হচ্ছে না তার। ক্লান্তিতে গাড়ির সিটে মাথা এলিয়ে দিয়ে আছে হঠাত কেউ একজন নক করে গাড়ির জানালার কাঁচে। কাঁচ নামাতেই চোখে পড়ে একটি ছোট্ট ছেলেকে।
‘স্যার, ফুল লাগবো? একদম তাজা গোলাপ ফুল। নিয়া যান, ভাবির লাইগ্যা।’
‘ভাবির জন্য নিবো? আচ্ছা সাদা গোলাপ গুলো দাও।’
‘এই নেন স্যার।’
ফুলগুলো হাতে নিয়ে তার দাম পরিশোধ করতেই ছেলেটি চলে যায়। আশ্বিন তাকিয়ে থাকে তার যাওয়ার পথে। এক গাড়ি থেকে অন্য গাড়ির দরবারে গিয়ে ফুল বিক্রি করছে। কতোই আর বয়স ছেলেটির? তবুও নেমে এসেছে পথে জীবিকার সন্ধানে।
এর মাঝে যানজট স্বাভাবিক হওয়ায় চলে আসে সে।

বাড়িতে টুসি নেই আর নেই রাশেদা খালা। দুজন মিলে গিয়েছেন তাদের এক দূর সম্পর্কে আত্মীয়ের বাড়িতে, হুট করেই বিকেলে। যাওয়ার ইচ্ছেটা ছিলো রাশেদা খালার, টুসি বেচারি হয়েছে ভুক্তভোগী।
কলিং বেল এর শব্দ শুনে অধরা দ্রুত এসে দরজা খুলে দিতেই আশ্বিন প্রবেশ করে। মলিন তার মুখখানী, হাতে এক গুচ্ছ সাদা গোলাপ।
‘তোমার জন্য ফুল। নাও।’
খুশি হয় অধরা। আশ্বিনের কাছে উপহার হিসেবে ফুল পাওয়া তার সবচেয়ে বেশি পছন্দের।
‘ধন্যবাদ।’
কোন কথা না বাড়িয়ে রুম চলে যায় আশ্বিন। কপালে ভাঁজ টেনে অধরাও পিছু নেয় তার।
‘কি হয়েছে আপনার? কোন সমস্যা?’
‘না। কিছু হয়নি।’
‘কিছু একটা তো হয়েছেই। বলুন আমাকে। ওই মারিয়া আবার বিরক্ত করেছে, তাই না?’
‘মারিয়া কোথা থেকে আসলো এখানে? তাছাড়া মারিয়া তো গতমাসেই ঢাকা থেকে বদলি হয়ে গিয়েছে।’
চুপ হয়ে যায় অধরা। আশ্বিনের আকস্মিক মনমরা ভাবের কারণ জানতে পারছে না সে।
‘তাহলে কি এমন হয়েছে?’
কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকে আশ্বিন। বুক থেকে বেরিয়ে আসে এক দীর্ঘশ্বাস।

‘অধরা, আমরা ডাক্তাররা যখন একজন মুমূর্ষু রোগীর চিকিৎসা করি, তখন কীভাবে যেন তারা আমাদের এতটা আপন হয়ে যায় যে তাদের চিকিৎসার জন্য আমরা নিজের পরিবারকে সময় দিতে ভুলে যাই। রাত দুটো হোক কি তিনটে যখনই হাসপাতাল থেকে কল আসে ছুটে চলে যাই সেখানে, ভুলে যাই সারাদিনের ব্যস্ততার পর আমাদের একটু বিশ্রাম প্রয়োজন।
যদি আমাদের হাতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় কারো মৃ/ত্যু হয়, আমাদেরও কষ্ট হয়। হয়তো তাদের পরিবারের কষ্টের সামনে তা নগন্য। দিন শেষে আমরাও মানুষ, মন আমাদেরও আছে।’
কথাগুলো বলে থেমে যায় আশ্বিন। আর কোন উত্তর দেওয়ার ভাষা নেই তার। বুঝতে আর বাকি নেই, হাসপাতালে কোন এক খারাপ কিছু হয়েছে। কথা না বাড়িয়ে উঠে ওয়াশরুমে চলে যায় আশ্বিন। থম মেরে বসে আছে অধরা। আশ্বিন খুব সহজেই মন খারাপ করার ছেলে না। মূহুর্তেই মন খারাপ হয়ে গেলো অধরার। তাই আশ্বিনের মন ভালো করার চেষ্টায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে সে।
—————-

‘আশ্বিন, ছাদে যাবেন আমার সাথে?’
‘এই রাতের বেলা তোমার ছাদে যেতে ইচ্ছে হলো?’
‘হুম। চলুন না যাই।’
আর কথা বাড়ানোর সুযোগ পেলো না মহাশয়। আশ্বিনের হাত টেনে তাকে ছাদে নিয়ে আসে সে।
রাতের আকাশে মেঘ নেই, তবুও বইছে শীতল ঠান্ডা বাতাস। ছাদের রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছে দুজন, বাতাসে চুল এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে।
‘আমাকে কেমন লাগছে বললেন না তো।’
অধরার কথায় আশ্বিন তার দিকে তাকিয়ে অধরার পা থেকে মাথা পর্যন্ত চোখ বুলিয়ে নেয়।
‘তুমি শাড়ি পড়লে কখন? আমি তো খেয়ালই করিনি।’
‘হুম, এখন আর আমাকে খেয়াল করার সময় কোথায় আপনার?’
‘কি বললে?’
‘ঠিকই তো বলেছি। সারাদিন হাসপাতালে ডিউটি করেন, আর রাতে এসে মনমরা হয়ে আছেন। কোথায় আমার পরীক্ষা শেষ, একটু ঘুরতে নিয়ে যাবেন। না হলেও তো একটু কথা বার্তা গল্প করবেন, তাও না।’
মুখ ফিরিয়ে নেয় অধরা। কপালে ভাঁজ পড়ে আশ্বিনের।
‘তুমি কবে থেকে কথা বলার জন্য সুযোগ খুঁজছো? আমি যে অধরাকে চিনি, মাশাল্লাহ উনার কথা বলার জন্য নির্দিষ্ট বিষয় প্রয়োজন হয়না, কেউ উনার কথ শুনুক আর না শুনুক উনি অনবরত কথা বলতেই থাকেন।’
‘আপনি কি আমার অপমান করছেন আশ্বিন?’
‘মোটেও না। তোমাকে আমি কীভাবে অপমান করতে পারি অধরা? স্ত্রীকে অপমান করা নিজেকে অপমান করার সমান।’
আর কথা না বলে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে দুজন। বাতাসের শীতল স্পর্শ এসে গায়ে লাগছে তাদের।

‘আজ গিয়েছিলে না রাফিনের সাথে কথা বলার জন্য? কি বললো সে?’
‘অনেক কথাই বলেছেন। স্পেশালি সেগুলো যা আমি জানতাম না।’
আশ্বিন মুখ ঘুরিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে।
‘আপনি আমার জন্য কেনো সেদিন রাফিন ভাইয়ার কেইস অফ করেছিলেন?’
‘কারণ আমি চাইনি তোমার একটি বোকামির জন্য তোমার সারাজীবন নষ্ট হোক।’
‘বোকামি?’
‘হ্যা। অধরা তুমি কেবল ফার্স্ট ইয়ারে ছিলে। একজন সিরিয়াস রোগীর সেবা যত্ন করার জ্ঞান তোমার ছিলো না। তুমি তো বুঝতেই পারোনি ইমোশনাল হয়ে কতো বড় ভুল করতে যাচ্ছিলে।’
‘আমি যা কিছু করেছিলাম, সবটা হাসান স্যারের কথায়। উনি আমার উপর বিশ্বাস করেছিলেন।’
‘অধরা, হাসান স্যার সেদিন তোমাকে এই দায়িত্ব দিয়েছিলেন কেবল মাত্র রাফিনের কথা চিন্তা করে। তোমার তো উচিত ছিল নিজের কথা একবার ভেবে দেখার। আচ্ছা যাও মানলাম তুমি এই দায়িত্ব নিয়েছিলে, কিন্তু সেটা আমাকে কেনো বললে না? একটুও বিশ্বাস ছিলো না আমার প্রতি তোমার?’
চুপ হয়ে থাকে অধরা। সত্যি যদি সেদিন সে আশ্বিনকে কথাগুলো বলতো তবে এতসব কিছু হতো না।
‘আমি ভুল করেছিলাম। অনেক বড় ভুল। আর সেই ভুল করার পরেও আমি আপনার উপর রাগ দেখিয়েছি।’

কথাগুলোর মাঝেই চোখ বেয়ে পানি পড়তে থাকে অধরার। একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে আশ্বিন পেছন থেকে অধরাকে জড়িয়ে ধরে।
‘কেঁদো না। যা হওয়ার হয়েছে। এখন সব ভুলে যাওয়ার সময়।’
‘হুম।’
হাতের পিঠ দিয়ে চোখ মুছে অধরা মাথা ঘুরিয়ে ফিরে তাকায় মহাশয়ের দিকে।
‘আপনি জানেন রাফিন ভাইয়ার বিয়ে এই শুক্রবার। আমাদের কিন্তু যেতে বলেছে।’
কথাগুলো শুনে অধরাকে ছেড়ে পাশে দাঁড়ায় সে।
‘কি হলো? প্লিজ বলবেন না যে শুক্রবার আপনি ব্যস্ত আছেন। আমরা বিয়েতে যাচ্ছি মানে যাচ্ছি।’
‘যদিও আমি সেদিন একটু ব্যস্ত, তবুও যাবো। কি করার? বিবি সাহেবা হুকুম যেহেতু করলেন।’
হেসে উঠলো অধরা। তার খিলখিল হাসির পানে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে আশ্বিন।

আচমকা হাত টেনে তাকে কাছে নিয়ে অধরার দু গালে আলতো করে নিজের হাত রাখে।
‘অধরা, একটা কথা সবসময় মনে রেখো। আশ্বিন সবসময় তোমার পাশে ছিল, আছে আর ভবিষ্যতেও থাকবে ইনশাআল্লাহ। তোমাকে আমি অনেক ভালোবাসি অধরা। নিজেকে কখনো এতোটা ভালোবাসতে পেরেছি কিনা জানি না। তোমার কাছে শুধু আমার একটাই অনুরোধ, প্লিজ কখনো আমার উপর রাগ করে কথা বলা বন্ধ করবে না। রেগে থাকলে, আমাকে বকবে, কেনো রেগে আছো বলবে, তোমার রাগ ভাঙার সুযোগ করে দিবে। তবুও আমার কাছেই তুমি থাকবে।
আমি তোমার কথা শোনার অভ্যাসে আসক্ত।
আমি তোমার ভালোবাসার নেশায় নেশাক্ত।’

কথাগুলো বলে আলতো করে চুমু খায় অধরার কপালে। একটা লাজুক হাসি দিয়ে অধরা চোখ নামিয়ে নেয়। ঠিক তখনই,
‘মামা, এতরাতে ঘরে তালা দিয়ে তোমরা ছাদে কি করো?’
টুসি কথাটা বলে ছাদে আসতেই আশ্বিন অধরাকে ছেড়ে পাশে এসে দাঁড়ায়। এদিকে টুসি দুজনকে একসাথে দেখে কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে মুখ টিপে হাসে।
‘টুসি কখন এসেছো তোমরা? আমাকে বললে না কেনো?’
‘মামা কুল ডাউন। চলে এসেছি তো নাকি? তুমি বরং এক কাজ করো, আমার জন্য একটা ভাই/বোন নিয়ে এসো। ঠিক আছে?’
কথাটা বলেই এক দৌড়ে পালায় টুসি। অধরা থম মেরে দাঁড়িয়ে আছে। আশ্বিন টুসির তাড়া করতে গিয়েও থেমে যায়।
‘তোমার সাথে থেকে এখন বেশি কথা বলে। আর বেশি পাঁকা পাঁকা কথা বলে।’
‘ইস, টুসির মতো যদি আপনিও আমার থেকে কথা বলা শিখতে পারতেন। তাহলে আজ ব্যাপারটা অন্য কিছু হতো।’
‘কি হতো?’
অধরা কথাটা বলেই চলে যাচ্ছিল হঠাত আশ্বিনের কথা শুনে পিছু ফিরে তাকায়।
‘তবে এখন আপনি দুই বাচ্চার বাবা থাকতেন।’
অধরা কথাটা বলেই এক দৌড় দেয়। পিছু নেয় আশ্বিন।
‘অধরা, দাঁড়াও। আজ খবর আছে তোমার।’
ফিরে তাকায় না অধরা। দৌড়ে ছাদ থেকে যেতে শুরু করে দুজন। অধরার হাসির শব্দ প্রতিধ্বনি হয়ে শোনা যাচ্ছে চারদিক থেকে। যা স্বাক্ষী করে যাচ্ছে তাদের ভালোবাসার নতুন পথে।

@@@সমাপ্ত@@@
((আসসালামু আলাইকুম। কেমন আছেন সবাই? যারা এতোদিন গল্পের সাথে ছিলেন তাদের অনেক ধন্যবাদ। ধন্যবাদ গল্পে সাপোর্ট করার জন্য। আমাকে এতো ভালোবাসা দেওয়ার জন্য। যদিও শেষ দিকে আমার কিছু সমস্যার কারণে গল্প দিতে দেরী হয়েছে, তাই এই বিষয়ে আমি আন্তরিক ভাবে দুঃখিত। সবাই ভালো থাকবেন, আল্লাহ হাফেজ।❤))

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here