#অসময়ের_বৃষ্টিফোঁটা
#অষ্টম_পর্ব
#মাহজাবীন_তোহা
আজ আর ক্লাস হবে না বুঝতে পেরেছে তোহফা। সবেমাত্র এগারোটা বাজে। কি করা যায় ভাবতে ভাবতে লাইব্রেরীর দিকে গেল সে। এতো তাড়াতাড়ি বাসায় যেয়ে কোনো লাভ নেই। এর চেয়ে লাইব্রেরীতে বই পড়ে সময় কাটানো যাক। কম্পিউটার সাইন্স রিলেটেড কিছু বই বের করে পড়া যায়। সেই ভাবনা থেকেই লাইব্রেরীতে ঢুকল সে। লাইব্রেরীতে ঢুকেই সর্বপ্রথম যেই আফসোসটা হলো তোহফার সেটা হলো লাইব্রেরীর অবস্থা নিয়ে। লাইব্রেরী মানেই হলো শান্ত, নিস্তব্ধ পরিবেশ। যেখানে কেউ কথা বলবে না, চারপাশ চুপচাপ থাকবে আর মানুষ নিজেদের মতো করে বই পড়বে। কিন্তু অনেকেই সামনে বই নিয়ে বসলেও আড্ডা দিচ্ছে যা লাইব্রেরীর দৃশ্য হয় না সাধারণত। সে চাইলেও এখন এই পরিবেশ পাল্টাতে পারবে না। তাই হেঁটে পেছনে দিকটায় চলে গেলো। সেখানে কোলাহল নেই বললেই চলে। তারপর হেঁটে হেঁটে বই দেখতে লাগলো। হঠাৎ একটা বই চোখে পড়ল। ‘The Ware Tetralogy’ নামটা দেখেই বেশ ইন্টারেস্টিং লাগলো তোহফার। বইটা হাত দিয়ে টান দিতে গিয়ে খেয়াল করলো বইটা আসছে না।
“কি ব্যাপার? বইটা কিছুর সাথে আটকে আছে নাকি?” ভাবতে ভাবতে বইটা ছেড়ে পাশের বইটা টান দিতেই সেটা হাতে চলে আসলো। বইটা হাতে নিয়ে ফাঁকা জায়গা দিয়ে উকি মারল তোহফা আর দেখেই ধাক্কা খেল। সে যেই বইটা নিতে চেয়েছিলো তানভীরও একই বই টেনে ধরছিল। এতক্ষণে আসল কাহিনী বুঝে হাতে রাখা বইটা শেলফে রেখে অন্য বই দেখতে লাগল সে। প্রায় যখন শেলফের শেষ প্রান্তে গেলো তখনই পাশে এসে দাড়াল তানভীর। তোহফা একবার তাকিয়ে আবারও বই দেখায় মনোযোগ দিল।
তানভীর বুঝল তোহফা তাকে বিশেষ পাত্তা দিচ্ছে না। কিন্তু এই মুহূর্তে তোহফার সাথে কথা না বললে দুনিয়া উল্টে যাবে বলেই মনে হচ্ছে তানভীরের। তাই শুরু করল সে,
– “তোহফা?”
– “হু বলেন।”
– “তুমি কি সবাইকেই ইগনোর কর?”
ভ্রু কুঁচকে তাকালো তোহফা। সে কাকে ইগনোর করেছে ঠিক মনে করতে পারল না। তাই বলল,
– “কার কথা বলছেন?”
– “আমি আমার নিজের কথাই বলছি।”
– “আপনাকে আমি ইগনোর করতে যাব কেনো?” অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো তোহফা।
– “এড়িয়ে চলাটাই কি যথেষ্ট নয় ইগনোর কর সেটা বুঝানোর জন্য?”
– “আপনি ভার্সিটির সিনিয়র। আমার দুই ব্যাচ সিনিয়র। আপনার সাথে যদি আমি বেশি কথা বলি তাহলে এটা নিয়ে অনেক সমালোচনা হতে পারে। এইজন্যই এড়িয়ে চলি।”
তোহফার এমন সরাসরি উত্তর শুনে কিছুটা অবাক হলো তানভীর। ভার্সিটিতে সিনিয়র জুনিয়র মিশলেই সেটাকে সবাই নেগেটিভ ভাবে এটা তানভীর তিন বছর ধরে পড়েও বুঝতে পারলো না অথচ তোহফা কদিনেই বুঝে গেলো। মেয়েটা পাগল নাকি। তারপরই হেসে উঠলো তানভীর।
আচমকা তানভীরের হাসিতে থতমত খেয়ে গেল তোহফা। হাসির মতো কিছু বলল বলে মনে পড়ল না তার। তবে যখনই সে তানভীরের দিকে তাকালো তখনই মুগ্ধ হয়ে গেলো। কি সুন্দর হাসি। সবসময় উপন্যাস, কবিতায় পড়ে এসেছে মেয়েরা হাসলে নাকি মুক্তো ঝড়ে। মেয়েদের হাসি তাই অনেক সুন্দর। কিন্তু তানভীরের হাসি দেখে তোহফার মনে হলো যদি উপন্যাসিক তানভীরের এই হাসি দেখত তাহলে মেয়েদের পাশাপশি ছেলেদের হাসির বর্ণনাও উপন্যাসের পাতায় তুলে ধরত। তানভীরকে আগে কখনো এভাবে দেখেনি তোহফা। তাই আগে নজরে পড়েনি। আজ হঠাৎ করেই চোখ গেল তার। আর দশটা সাধারণ ছেলের মতোই দেখতে। শক্তপোক্ত শরীর তানভীরের, একদম ডিফেন্স অফিসারদের মতো। মনে হয় নিয়মিত জিম করে। এছাড়া তেমন কোনো বিশেষত্ব নেই। চেহারাও গল্পের রাজকুমারের মতো না কিন্তু তবুও তোহফার মনে হলো তানভীরের মাঝে কিছু একটা আছে যার কারণে আর দশটা ছেলের মতো হলেও তানভীরকে আলাদা লাগছে তার। কিন্তু কিছুক্ষণ ভেবেও কিছু পেল না সে। লম্বা চওড়া ছেলে, গায়ের রং শ্যামলা। আর কিছু নেই। হয়তো চেহারায় কিছুটা মায়া আছে যার জন্য অন্যদের তুলনায় বেশি মায়াময় লাগছে। আচ্ছা, তানভীরের চেহারার মায়া কি শুধু তার চোখেই দেখা দিয়েছে নাকি তার মতো আরো অনেকেরই চোখে পড়েছে এটা??
তানভীর অনেকক্ষন যাবৎ বুঝতে পেরেছে তোহফা তার দিকে তাকিয়ে আছে। কিন্তু তানভীর একবারও তাকাল না। মেয়েটা আবার লজ্জা পেয়ে যাবে। কি দরকার শুধু শুধু লজ্জা দেওয়ার। কিন্তু হাসি থামিয়ে দিল সে। আগে তাকে দেখলেই রেগেমেগে অস্থির হয়ে যেতো মেয়েটা কিন্তু এখন আর তেমনটা দেখা যায় না। সিনিয়র বলেই হয়তো সম্মান করে। বেশি কিছু হবে না আর। হঠাৎই তোহফাকে বলল,
– “আজ আর ক্লাস আছে তোমার?”
– “না, কেনো?”
– “আমারও ক্লাস নেই। আজ কোনো ফ্রেন্ড আসেনি, জাহিদও চলে গেছে হলে। চলো কোথাও ঘুরে আসি। আপত্তি আছে?”
পুরোটাই মিথ্যে কথা। ক্লাস নেই এটা সত্যি হলেও ফ্রেন্ডরা ক্লাসে আসেনি এটা মিথ্যে বলল তানভীর। বর্ষাকালের এই মেঘলা আবহাওয়ায় তোহফার সাথে টিএসসি ঘুরে বেড়ানোটা মিস করা কোনোভাবেই সম্ভব না তার পক্ষে। ভালো কিছু পেতে নাহয় একটু মিথ্যে বলল। সমস্যা কি??
ইচ্ছায় হোক আর অনিচ্ছায় হোক তানভীরের সাথে এর আগেও হাটাহাটি করেছে তোহফা। কিন্তু গন্ডি সর্বোচ্চ পলাশী পর্যন্ত ছিল। এর বাইরে যায়নি। তাও একবার গিয়েছিলো ইসিই ভবন ক্যাম্পাসের বাইরে। কিন্তু আজ মনে হচ্ছে তানভীর তাকে নিয়ে একবারেই বেরিয়ে যাবে এখান থেকে। কিন্তু কই যাবে সেটা জানে না সে। এভাবে একটা ছেলের সাথে একা যাওয়াটা ঠিক হবে কিনা বুঝতে পারছে না। তানভীরকে কখনো খারাপ ছেলে বলে মনে হয়নি তার কাছে। কিন্তু তবুও পুরুষ মানুষ কাছের আত্মীয় হলেও বিশ্বাস নেই। কিন্তু এই আবহাওয়ায় ঘুরাঘুরি করাটাও মিস করতে ইচ্ছে করছে না। খুব বেশি ঘোরাঘুরি করা হয় না তোহফার। তাই ঘুরতে ভালোই লাগে। কিন্তু যাবে কিনা সেটাই ভাবছে সে।
তোহফাকে হাজার ভাবনার মাঝে দেখে তানভীর ভাবলো হয়তো একা যেতে অস্বস্তি বোধ করছে। স্বাভাবিক এটা। অপরিচিত একজন ছেলের সাথে যাওয়াটাও ঠিক না। তাই বলল,
– “ঠিক আছে। খুব বেশি সমস্যা হলে দরকার নাই।”
তোহফা ছোট্ট করে জবাব দিল,
– “হু।”
তারপর বেরিয়ে গেলো লাইব্রেরী থেকে।
তানভীর আশা করেছিলো তোহফা যাবে। কিন্তু গেল না শেষপর্যন্ত। হয়তো তার সাথে ফ্রি হতে পারেনি এখনও। আর কিছু না ভেবে বই রেখে সেও বের হয়ে গেলো লাইব্রেরী থেকে। পড়ায় এখন আর কোনোভাবেই মন বসবে না। হলে যেয়ে ঘুমোনো ভালো। সিঙ্গেল মানুষদের আবহাওয়া উপভোগ করার একমাত্র মাধ্যম হচ্ছে কাথা মুড়ি দিয়ে ঘুমোনো। তানভীরেরও এখন উদ্দেশ্য এটাই। তাই বের হয়ে হলের দিকে রওনা হলো সে।
___________________
বাজার হাতে ফেরার সময় বৃষ্টিতে আটকা পড়লেন শাহনাজ পারভীন। সাইমুম রহমান (তোহফার মামা) প্রজেক্টের কাজে ঢাকার বাইরে গিয়েছেন। তাই বাধ্য হয়ে শাহনাজ পারভীনের বাজার করতে বের হতে হয়েছে। একে তো এতগুলো বাজার তার উপর এই বৃষ্টি রীতিমত বিরক্ত করে তুলেছে তাকে। তবুও অনেক কষ্টে একটা দোকানের ছাউনির নিচে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি। তখনই হুট করে আগমন ঘটলো তানভীরের। শাহনাজ পারভীনকে দেখে বলল,
– “ব্যাগগুলো আমাকে দিন আন্টি। আপনার কষ্ট হবে।”
– “না বাবা আমি ঠিক আছি। তুমি এখানে?”
– “সামিকে পড়াতেই যাচ্ছিলাম। আপনাদের বাসায়ই তো যাবো সমস্যা নেই। আমাকে দিন।”
মুখে দিন বললেও দেওয়ার আগেই এক প্রকার জোর করেই বাজারের ব্যাগগুলো নিয়ে নিলো তানভীর। চট্টগ্রামে থাকতে মাকে বাজারের ব্যাগ তুলে দিতো বাসায়। কখনো বা মায়ের সাথেই বাজার করতে যেতো। যখন স্কুলে পড়ত, স্কুল থেকে ফেরার পথে মা বিভিন্ন সবজির ভ্যানের সামনে দাড়িয়ে দরদাম করে সবজি কিনত। মায়ের সাথে স্কুল থেকে ফিরতে বিরক্ত লাগত তার। একে তো টায়ার্ড থাকত তার উপর মা আবার দাড়িয়ে বাজার করতো। সব মিলিয়ে তানভীর বিরক্ত হতো। তবুও মায়ের কাছ থেকে বাজারের ব্যাগ নিয়ে নিজেই বাসায় তুলতো। সেসব দিন এখন শুধুই স্মৃতি। মা মা রা গেছে প্রায় ছয় বছর হয়ে গেলো। এখন আর কাওকে বাজার তুলে দিতে হয় না, হাত ধরে কেউ স্কুল থেকে তানভীরকে নিয়েও আসে না।
হঠাৎ বৃষ্টি কমে আসায় শাহনাজ পারভীন বললেন,
– “চলো বাবা, এই বৃষ্টিতে চলে যাওয়া যাবে। আর সব ব্যাগ তুমি নিয়ে নিলে কেনো? আমাকে দাও দুইটা।”
– “আমি পারবো আন্টি। আসুন আপনি।”
তারপর হেঁটে বাসার দিকে রওনা হলো।
কলিং বেলের শব্দ পেয়ে দরজা খুললো তোহফা। শাহনাজ পারভীনকে দেখে মৃদু হেসে ঢুকতে দিল। ঘরে ঢুকেই তানভীরের হাত থেকে ব্যাগগুলো নিয়ে নিলেন শাহনাজ পারভীন। তারপর তোহফাকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
– “তানভীরকে ঠাণ্ডা পানি দে তো। ফ্রিজে আছে দেখ।”
দরজা খুলে দিয়ে রুমে চলে যাচ্ছিল তোহফা। তানভীরের নাম শুনেই দাড়িয়ে পড়লো। পেছনে তাকিয়ে দেখলো তানভীর দাড়িয়ে আছে। গায়ে থাকা কালো টি শার্ট কিছুটা ভিজে গেছে।
“বাজারের ব্যাগ কি এই ছেলে তুললো নাকি?”
এসব ভাবতে ভাবতেই পানি আনতে গেলো তোহফা।
শাহনাজ পারভীন তানভীরকে বললেন,
– “সামি রুমেই আছে, যাও বাবা।”
তানভীর সম্মতি জানিয়ে সেদিকে গেলো।
সামির পূর্ণ মনোযোগ পড়ায় থাকলেও তানভীর মনোযোগ দিতে পারছে না পড়ানোতে। তোহফার মুখটা ভেসে উঠছে বারবার। একটু আগে পানি টেবিলে রেখে এক প্রকার পালিয়ে গেলো মেয়েটা। তাকে এতো ইগনোর করে কেনো বুঝে না তানভীর। যতবার কথা বলেছে তানভীর নিজ থেকেই যেয়ে কথা বলেছে, ঘুরে দেখিয়েছে ক্যাম্পাস। মেয়েটা কখনো নিজ ইচ্ছায় তানভীর কেমন আছে সেটা পর্যন্ত জিজ্ঞেস করে না।
এসব ভাবনা সাইডে রেখে পড়ানোতে মনোযোগ দিলো তানভীর। সামির প্রি টেস্ট সামনে। এখন বেখেয়ালি হওয়াটা ঠিক হবে না।
চলবে??
বি দ্রঃ ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন