অসময়ের বৃষ্টিফোঁটা পর্ব ৪

0
844

#অসময়ের_বৃষ্টিফোঁটা
#চতুর্থ_পর্ব
#মাহজাবীন_তোহা

দেখতে দেখতে পেরিয়ে গেছে তিন মাস। তোহফার অ্যাডমিশনের রেজাল্ট দিয়েছে আজ। বুয়েটে চান্স পেয়েছে। CSE হয়ে গেছে। এতোটা সে আশা করেনি। আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করতেই দুই রাকাত নফল নামাজ পড়ে নিল। উঠে জায়নামাজ ভাঁজ করে তাকের উপরে রেখে রান্নাঘরের দিকে গেল। উদ্দেশ্য মামীকে হাতে হাতে সাহায্য করা।
রান্নাঘরে ঢুকতেই শাহনাজ পারভীন তোহফার কপালে চুমু খেলেন। তারপর বললেন,
– “তোর রেজাল্টে যে কি পরিমান খুশি হয়েছি বলে বুঝাতে পারবো না। একবারে পার্মানেন্টলি চলে আয় আমার কাছে। এখানে থেকেই ক্যাম্পাসে যাবি, ক্লাস করবি।”
– “না মামী। এই কদিন এমনিতেও তোমাদের অনেক জ্বালিয়েছি। এবার হোস্টেল ঠিক করে উঠে পড়ব। বাবাকে বলেছি, বাবা এসে ব্যবস্থা করে যাবে।”
– “দিবো এক থাপ্পর। আমার মুখের উপর কথা বলিস কোন সাহসে। তোকে শাসন করি না বলে মাথায় উঠে যাবি এটা তো হবে না।”
তোহফা আর কিছু বললো না। এখানে থাকার ইচ্ছে তার নেই । মামার নিজের সংসার আছে। একজন এক্সট্রা মানুষ থাকা বার্ডেন। তাই সে সিদ্ধান্ত নিলো যতো দ্রুত সম্ভব চলে যাবে হোস্টেলে।
এরই মাঝে ফোন আসলো তোহফার। রুমে এসে দেখলো ইরা কল করেছে। কল রিসিভ করলো সে।
– “আসসালামু আলাইকুম আপু। Congratulations। এবার আমাকেও ব্যবস্থা করে দাও চান্স পাওয়ার জন্য।”
– “ওয়ালাইকুম আসসালাম। ধন্যবাদ। ভালোমতো পড়াশুনা করো, এইচএসসি শেষ হলে তোমাকেও গাইডলাইন দিয়ে নিয়ে আসবো এখানে। তারপর দুজন একসাথে বুয়েট ক্যাম্পাস ঘুরবো।”
– “ইনশাল্লাহ আপু। আচ্ছা আপু একটা হেল্প করবে?”
– “হ্যাঁ বলো।”
– “সাহেল ভাইয়ার নাম্বারটা একটু দিবে?”
– “হুমমম হঠাৎ সাহেল ভাইয়ার নাম্বার কেনো??”
তোহফার কথায় লজ্জা পেলো ইরা। তারপর ঐদিনের রিকশার ঘটনা বললো। কাহিনী শুনে তোহফা হাসতে হাসতে শেষ। পরে সাহেলের নাম্বার দিয়ে দিলো। কথা বলে ফোন রেখে আবার মামীর কাজে সাহায্য করতে গেলো সে।

__________________________
দুপুরের দিকে নাম্বার ডায়াল করে বসে রইলো ইরা। এতদিন পরে ফোন দিলে কি ভাববে? তারই বা কি দোষ? হুট করে প্রী টেস্ট শুরু হয়ে গেলো কলেজে, তার উপর প্রাকটিক্যাল এক্সাম সব মিলিয়ে সময় পায়নি আর। ভাবতে ভাবতেই কল করলো। প্রথমবার রিসিভ হলো না। আবারো কল করলো কিন্তু রিসিভ হলো না। আর কল করলো না সে। হয়তো ব্যস্ত আছে।

ক্লাস থেকে বেরিয়ে ক্যান্টিনের দিকে যেতে যেতে ফোন চেক করল সাহেল। অপরিচিত নাম্বার থেকে দুবার কল এসেছে। ক্যান্টিনে বসে চা অর্ডার করে কল ব্যাক করল।

সবেমাত্র খেতে বসেছিলো ইরা। কল পেয়ে বারান্দায় চলে গেল। ডাইনিং এ কেউ ছিল না বিধায় খেয়াল করেনি তাকে। নাহয় এভাবে দৌঁড়ে যাওয়ার জন্য মা কিছুটা সন্দেহ করতেন। ফোন নিয়ে দেখে সাহেল ফোন করেছে। সাথে সাথে রিসিভ করলো।
ওপাশ থেকে গম্ভীর পুরুষালী কণ্ঠে ভেসে এলো,
– “হ্যালো।”
– “হহহহহহ্যালো। আআআআআমমমমমি ইরা।”
– “কোন ইরা?”
মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো ইরার। যেই ছেলের কাছে বিব্রত হলো এতদিন, ভাড়া আর সেদিনর জন্য থ্যাংকস বলতে ফোন করলো সেই তাকে চিনলো না। কাঠ কাঠ গলায় ইরা বললো,
– “কেউ না আমি। আপনি ঘুমান।”
বলেই কল কেটে দিল।

কল কাটার সাথে সাথেই হাসতে লাগলো সাহেল। মেয়েটার কাজে বেশ মজা পেয়েছে সে। বয়সের তুলনায় বড্ড ভীতু। একমাত্র বিয়াইন তার। জ্বালাতে তো ভালো লাগবেই। এসব ভেবে ভেবেই হাসছে সে। আশেপাশে অনেকেই সরু চোখে তাকে দেখছে কিন্তু সেদিকে তার কোনো ধ্যান নাই।

___________________________
যতো দ্রুত তোহফা যেতে চেয়েছিল তত দ্রুত সে হোস্টেলে যেতে পারলো না। এমনকি সে যেতেই পারলো না। মামা মামী জোর করে রেখে দিয়েছেন। তাদের একটাই কথা “আমরা থাকতে আমাদের একমাত্র ভাগ্নি হোস্টেলে থেকে পড়বে কেনো?” মা আর মামা দুই ভাই বোন। মামা বড় মা ছোট। মা মামার অনেক আদরের। একমাত্র বোনের একমাত্র মেয়ে হওয়ায় তোহফাও তার মামার বেশ আদরের। মামীও নিজের মেয়ের মতোই ভালোবাসেন। আফসোস করেন একটা মেয়ের জন্য। কিন্তু আল্লাহ হয়তো চাননি তাই উনার মেয়ের মা হয়ে উঠা হয়নি আর।

সবার জোরাজুরিতে শেষ পর্যন্ত মামার বাসায় থেকেই পড়াশুনা শুরু করতে হলো তোহফার। কাল নবীন বরণ। কাওকে তেমন চিনে না সে। তাই নবীন বরণে যাবে না বলেই সিদ্ধান্ত নিলো। কিন্তু বাধ সাধলেন শাহনাজ পারভীন। বুয়েটে চান্স পাওয়ার খুশিতেও মানুষ খুশিমনে অনুষ্ঠানে যায় সেখানে তোহফা যাবে না বলছে। তিনি বললেন,
– “কাওকে চেনা লাগবে না। আস্তে আস্তে পরিচিত হয়ে যাবি। কিন্তু কালকে যাবি এটাই শেষ কথা। আমার একটা শাড়ি দেব তোকে। সেটা পড়বি।”
– “ঠিক আছে মামী। তোমার আদেশ শিরোধার্য।”

______________________
রাতে ফোন হাতে নিয়ে সকালে আসা নাম্বারে ডায়াল করলো সাহেল। দুবার রিং হতেই রিসিভ হলো। কিন্তু ওপাশের ব্যক্তি কথা বলবে না এমন পণ করেছে যেনো। সাহেলই শুরু করলো,
– “কেমন আছেন বিয়াইন আপা?”
– “ভভভভভালো আআছছছছি।”
– “আপনার কি তোতলানোর সমস্যা আছে নাকি? শেষ পর্যন্ত কিনা একটা তোতলা মেয়ে আমার বউ হবে? আয়হায়, বন্ধুদের সামনে মুখ দেখাবো কেমনে?”
সাহেলের কথায় ইরা রেগে গেলো। তাকে তোতলা বললো কোন সাহসে এই ছেলে? আর সেদিন তো ওই কথাটা মজার ছলে বলেছে। যদিও সেটার জন্য এখনও লজ্জায় সাহেলের মুখোমুখি হতে চায়না সে। কিন্তু তোতলা যেহেতু বলেছে এর একটা বিহিত করতে হবেই। মনের ভেতরের সব তেজ গলায় ঢেলে ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলল ইরা,
– “এক্সকিউজ মি? আপনি কাকে তোতলা বলছেন হ্যাঁ? আমাকে কি বিকারগ্রস্ত মনে হয় আপনার? ফাজলামো করেন?”
– “আরেহ বাহ। আমার এমন কথায় আপনার তোতলামি বন্ধ হয়ে যাবে জানলে আমি কবেই এসব বলতাম। ইশ!! আগে জানলে ভালো হতো।”
সাহেল ফোনের এপাশ থেকে বুঝতে পারছে রাগে ফুঁসে উঠছে ইরা। একই তেজ নিয়ে বলল,
– “আমি মোটেও তোতলা না।”
সাহেল অনেক কষ্টে হাসি থামিয়ে বলল,
– “আচ্ছা ধরে নিলাম আপনি তোতলা না তাহলে কককক এভাবে কথা বলেন কেনো?”
এবার কোনো উত্তর খুঁজে পেলো না ইরা। সত্যিই এভাবে কথা বলে কেনো সে সাহেলের সাথে?
ইরার কোনো উত্তর না পেয়ে সাহেল বলল,
– “আপনি কি আমাকে ভয় পান?”
এবার সত্যি সত্যি চটে গেলো ইরা। সাহেলের সামনে গেলেই লজ্জায় পারলে মাটির সাথে মিশে যায় সে। এখানে ভয় পাওয়ার প্রশ্ন আসছে কেনো? আবারো ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলল,
– “আপনি কি বাঘ নাকি ভাল্লুক যে আপনাকে ভয় পাব?”
– “আপনি কি সবসময় এমন ঝগড়া করেন? কোথায় আরো ভাবলাম মিষ্টি কণ্ঠের অধিকারী কোনো নারীকে বিয়ে করে সংসার করবো। আমার বোধহয় আর সেটা হলো না। ঝগড়ুটে মেয়েই বোধহয় কপালে লেখা ছিল।”
কথাটা যে তাকে ইঙ্গিত করেই বলা হয়েছে বেশ বুঝতে পারছে ইরা। এবার মিইয়ে যাওয়া গলায় বললো,
– “আসলে সেদিন ওসব আমি তোহফা আপুকে মজার ছলে বলেছি। আপনি যে এভাবে সিরিয়াসলি নিবেন বুঝিনি। আমাকে আর এসব বলে লজ্জা দেবেন না প্লিজ। আপনি যেমনটা ভাবছেন তেমন কোনো উদ্দেশ্য আমার নেই। আর আপনি যাকে ইচ্ছে বিয়ে করে নিন। ঝগড়ুটে মেয়ে বিয়ে করতে হবে না।”
ইরার কণ্ঠ শুনে কষ্ট পেলো সাহেল। তার কষ্ট পাওয়ার মূল কারণ ইরার কথা বলার ধরণ। এমনভাবে কথা বললো যে আর চাইলেও সে ইরাকে রাগিয়ে দিতে পারছে না। নিজের জন্য বড্ড আফসোস হচ্ছে সাহেলের। কিন্তু ইরাকে রাগিয়ে দেওয়াটাই এখন সাহেলের উদ্দেশ্য। তাই আবারও বলল,
– “যাকে ইচ্ছা তাকেই বিয়ে করে নেব?”
– “জ্বি অবশ্যই। আপনি বিয়ে করবেন কি অন্যের ইচ্ছায় আজব!!”
– “যদি বলি আপনাকে বিয়ে করবো?”
দমে গেলো ইরা। সাহেলকে তার একটু একটু পছন্দ। কিন্তু সাহেল কি তাকে সরাসরি বিয়ের প্রস্তাব দিলো? এসব কি ভাবছে সে। ধুর!! আবারো সোজা হয়ে বসে বলল,
– “আমি এখন রাখছি। আমার পড়া আছে।”
– “গুড নাইট।”
সাহেল ফোন রেখে দিয়ে আবারও হাসতে লাগলো। এই মেয়েটাকে রাগানোর মাঝে একটা শান্তি শান্তি ভাব আছে। বাচ্চাদের রাগানোর মাঝে যেমন থাকে ঠিক তেমন।

ফোন রেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস নিলো ইরা। সাহেল তার সাথে এমন মজা করে যেগুলো গা জ্বালা ধরার মতো মনে হয়। কিন্তু এমন একটা চকলেট বয় যদি তাকে সত্যিই বিয়ে করতে চায় তাহলে অবশ্যই বিনা বাক্যব্যয়ে মেনে নিবে সে। কারণ সাহেলকে ভালো না বাসলেও পছন্দ করে। কিন্তু সাহেল কি সত্যি সত্যি তাকে বিয়ের কথা বলল নাকি মজা করল??

চলবে??

বি দ্রঃ ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here