অলকানন্দার নির্বাসন পর্ব ৭

0
651

#অলকানন্দার_নির্বাসন
#মম_সাহা

৭.

“বিহারিণী মহলের” ভেতর কবিরাজ ডাকানো হলো। গুমোট চেহারা নিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো একেকজন মানুষ। প্রায় বেশিরভাগ মানুষেরই ভয়- মেয়েটার ভেতর না আবার নতুন কোনো প্রাণ চলে আসে। কবিরাজ বিজ্ঞ হাতে পরীক্ষা নিরীক্ষা করেন। কতক্ষণ নিজের অভিজ্ঞতা নিয়ে অলকানন্দাকে পরখ করে নেন। অলকানন্দার ভেতরে কোনো ভাবাবেগে দেখা যায় না। বয়স্ক কবিরাজ তা দেখে ভ্রু কুঁচকায়। একই গ্রামের বিধায় সে অলকানন্দাকে ছোটো বেলা থেকেই চেনে। আর সেই সুবাদেই প্রশ্ন করলো,
“নন্দু, তুই ভয় পাচ্ছিস না?”

কবিরাজের প্রশ্নে ডানে-বামে মাথা নাড়ায় অলকানন্দা। যার অর্থ “না”। কবিরাজ অলকানন্দার এমন উত্তরে কুঁচকানো ভ্রু আরও কুঁচকে ফেলে। অবাক কণ্ঠে বলে,
“ভয় পাচ্ছিস না কেন? তোর বয়স কম। তার উপর তোর স্বামী নেই। এখন যদি নতুন একটা প্রাণ দেখা দেয় তোর ভেতরে কীভাবে বাঁচবি বল? তোর তো এখনো নিজেরই ঠিকানা হলো না।”

“দাদু, এমন কিছু যে আদৌও হয়নি তা তুমিও জানো, আমিও জানি। আমি বলেছিলামও ওদের যেন ডাক্তার বৈদ্য না ডাকে। তবুও ওদের মনের খুঁতখুঁত পরিষ্কার করতে তোমাকে এনেই ছাড়লো।”

“তুই কীভাবে বুঝলি এমন কিছু যে হবে না?”

অলকানন্দা এহেন প্রশ্নে একটু অস্বস্তিবোধ করলো। তার চোখে-মুখে দেখা দিলো সেই অস্বস্তির ছায়া। যা দেখে অভিজ্ঞ জহরলাল হয়তো বুঝে গেলেন কিছু। অতঃপর অলকানন্দার মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,
“তোর জীবন যুদ্ধ সহজ হোক, এই প্রার্থনাই করি। তোর ধারণাই ঠিক, তোর তেমন কিছুই হয়নি। খাবার দাবার সঠিক পাচ্ছিস না বলে শরীর দুর্বল হয়ে গেছে। সাবধানে থাকিস।”

জহরলালের কথায় ঘাড় নাড়ে অলকানন্দা। অতঃপর আরাম করে শরীর এলিয়ে দেয় মাটিতে বিছিয়ে রাখা শীতলপাটি খানায়। জহরলাল ততক্ষণে ঘর ছেড়ে বাহিরে চলে যায়। বাহির থেকে ভেসে আসে সকলের হরেক রকমের কণ্ঠ। তা শুনে হাসে অলকানন্দা। তার একটু শরীরের অসুস্থতাই যে সকলের ঘুম কেড়ে নিয়েছে তা আর বুঝতে বাকি রইলো না তার। অথচ এই চিন্তা শরীর নিয়ে না, এই চিন্তা সম্পত্তি নিয়ে। যদি সম্পত্তির ভাগীদার চলে আসে তবে তো সকলের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়তো। অলকানন্দা চোখ বন্ধ করে ফেলে আপনমনেই। চোখের উপর ভেসে উঠে তার বৈবাহিক জীবনের প্রথম রাতের কথা। যে রাতে ঘরে স্বামী প্রবেশ করার কথা সে রাতে তার ঘরে প্রবেশ করেছিল স্বামীর মনোরঞ্জন করা নারী- তরঙ্গিণী। মাখনের মতন দেহখানি দুলিয়ে দুলিয়ে এগিয়ে গিয়েছিল তার কাছে। অলকানন্দা তখন নতুন বউ। নির্বাক তার দৃষ্টিভঙ্গি। তাকে দেখেই তরঙ্গিণী মুখটা যেন কেমন বিকৃত করলো। এবং কেমন বাজে ইঙ্গিত করে বলল,
“রূপ তো আর দেহে ধরে না, কী আকর্ষণ শরীরে! আমার নাগর না আবার এই দেহেই আটকে যায়!”

অলকানন্দার তখন লজ্জায়, ঘৃণায় শরীরে আলাদা শিহরণ বয়ে যায়। তরঙ্গিণী তখন খিলখিল করে হেসে বলে,
“কার জন্য এত সাজ তোমার? আমি অনুমতি না দিলে তোমার স্বামী নামক পুরুষ একটা পা-ও ফেলবে না এ-ঘরে। তোমার স্বামী আমায় ভালোবাসে।”

অলকানন্দা তখন মুখ-চোখ শক্ত করে রেখেছিল। তরঙ্গিণী তা দেখে কত হেসেই না লুটোপুটি খেলো। তারপর কোমড় দুলিয়ে বেরিয়ে গেলো ঘর ছেড়ে। কিন্তু তরঙ্গিণীর কথাই সেদিন সত্যি হতে যাচ্ছিলো। সত্যিই সুদর্শন নতুন বধূকে চির অপেক্ষায় রেখে আর পা দেয়নি নিজের ঘরে। রাত তখন মাঝামাঝি। লাজ লজ্জা জলাঞ্জলি দিয়ে অলকানন্দার ফুলে সজ্জিত ঘরে উপস্থিত হয় তার শাশুড়ি সুরবালা। এবং শক্ত কণ্ঠে আদেশ করেন যেন এক্ষুনি তার স্বামীকে নিজের ঘরে নিয়ে আসে।

নতুন বধূ শাশুড়ি আজ্ঞা ফেলতে না পেরে আধ হাত ঘোমটা টেনে বেরিয়ে যায় স্বামীর উদ্দেশ্যে। এই বিরাট বাড়ির একটা কোণার রুমেই নিজের স্বামীকে পায় তরঙ্গিণীর সাথে। যারা অপবিত্র সুখে নিমজ্জিত ছিল। অলকানন্দার তো চোখ দু’টো তখন অশ্রুতে টইটম্বুর। যে মানুষটাকে নিজের স্বামী হিসেবে পেয়েছে, তাকে অন্য কোনো নারীর সাথে কেই-বা সহ্য করতে পারে! সেদিন অলকানন্দার অশ্রু দেখে হেসেছিল তরঙ্গিণী। সুদর্শন তো নতুন বধূর ঘরে যেতেই নারাজ। অতঃপর তরঙ্গিণী গোপনে নিয়ে তাকে শর্ত দেয়, তার দেওয়া কিছু ওষুধ অলকানন্দাকে রোজ খেতে হবে। তবেই সে তার স্বামীকে পাবে। ছোটো অলকানন্দা সেই শর্তে রাজি হয় এবং তারপরই তরঙ্গিণীর ইচ্ছেতে সুদর্শন অলকানন্দার সাথে নিজেদের ঘরে যায়। তরঙ্গিণীর কাছ থেকে যে সুদর্শনকে এনেছিল, ঘরে প্রবেশ করতেই সেই সুদর্শনের চেহারা বদলে যায়। নারী দেহ পেতেই সে সিংহ হয়ে ওঠে। অলকানন্দা ভেবেছিল সুদর্শন হয়তো তরঙ্গিণীকে ভালোবাসে কিন্তু সেদিন রাতে সুদর্শনের করা আচরণই তাকে বুঝিয়ে দিয়েছিল, সুদর্শন নারী আত্মা না নারীদেহ ভালোবাসে। তার কাছে হয়তো দেহটাই মোক্ষ। হোক সেটা তরঙ্গিণী কিংবা অলকানন্দার।

সেসব কথা ভাবতে ভাবতে নিদ্রা চলে এলো অলকানন্দার চোখে। চোখের পাতা ভারি হয়ে লেগে আসতেই তার ঘরে পা ফেলল কেউ। অলকানন্দার ঘুম মুহূর্তেই উবে গেলো। চোখ মেলে তাকাতেই দেখলো তরঙ্গিণী দাঁড়িয়ে আছে তার ঘরে। তাকে দেখেই স্মিত হাসলো অলকানন্দা। হাসি নেই তরঙ্গিণীর মুখে। চোখ-মুখ কেমন ফ্যাকাসে রঙ ধারণ করে আছে!

তরঙ্গিণী’র ফ্যাকাসে বর্ণ দেখে অলকানন্দাই কথা বলল,
“কী ব্যাপার? আপনার চোখ-মুখের এ অবস্থা কেন?”

“যে ঘটনাটা আন্দাজ করেছিল সবাই সেটা সত্যি হলে বোধকরি মন্দ হতোনে।”

“আপনিও ভালো করে জানেন, আমিও জানি, সেটা সত্যি হওয়ার না।”

“আজ সুদর্শন নেই, কিন্তু তার দেওয়া একটা অস্তিত্ব যদি তোমার মাঝে থাকতো তবুও তো তাকে দেখে নিজের চোখ জুড়াতে পারতাম!”

“আপনার মাঝে সে-ই অস্তিত্ব এলোও খারাপ হয়না বলুন?”

অলকানন্দার কণ্ঠে কেমন বিদ্রুপের ছোঁয়া। তা দেখে তরঙ্গিণী মুখ পাংশুটে বর্ণ করলো। কঠিণ কণ্ঠে বললো,
“তা সম্ভব না তুমিও জানো, আমিও জানি।”

“কেন সম্ভব না? তিনি তো নাকি আপনাকে ভালোবাসতো?”

“হ্যাঁ বাসতো।”

“কতটা বাসতো?”

“যতটা ভালোবাসা থাকলে নতুন বধূর কাছে আমার অনুমতি না পেলে যায় না ঠিক ততটা।”

কথাটা বলার সময় অহংকারে যেন বুক ফুলে উঠলো তরঙ্গিণীর। তা দেখে বেশ কিছুটা উচ্চস্বরেই হাসলো অলকানন্দা। হাসতে হাসতেই বলল,
“আপনাকে তিনি ততটাই ভালোবাসতো যতটা ভালোবাসলে রাত কাটানো যায় কিন্তু বিয়ে করা যায় না। ঠিক ততটাই ভালোবাসতো, যতটা ভালোবাসলে আপনার শরীর ছেড়ে এসে আরেকজনের শরীরে আটকাতে তার দুই দন্ডও লাগেনি। ঠিক ততটাই ভালোবাসতো, যতটা ভালোবাসলে তার সন্তান গর্ভে ধারণ করার অধিকার আপনার নেই।”

তরঙ্গিণী আর কোনো কথা বললো না। চির সত্যি মানতে সবারই কষ্ট হয়। তরঙ্গিণীরও হয়েছে। সত্যি হজম করার চেয়ে কষ্টের বোধহয় কিছু নেই। আর একটা নারীর কাছে এটা মানা খুবই বেদনাদায়ক যে তার প্রেমিক তার মনকে না কেবল আর কেবল মাত্র তার দেহকে ভালোবেসেছিল।

”শুনুন?”

তরঙ্গিণী অলকানন্দার ডাকে ফিরে তাকালো। চোখেমুখে প্রশ্নের ছড়াছড়ি। যা দেখে অলকানন্দাই প্রশ্ন করলো,
“আপনি বিয়ে করেননি কেন?”

“যে মানুষ বিয়ে করবে বলে কথা দিয়েছিল, সে কথা রাখেনি।”

কথা শেষ করেই তরঙ্গিণী বেরিয়ে গেলো। অলকানন্দার বুক চিরে বেরিয়ে এলো দীর্ঘশ্বাস। পুরুষ মানুষকে চেনা বড়ো দায়!

_

গভীর রাতে অলকানন্দার ঘরে জ্বলছে লন্ঠন। আগামীকাল তার স্কুলের পরীক্ষা শুরু। লন্ঠনের আলো নিভু নিভু হয়ে আসছে বাতায়নের কোল ঘেঁষে আসা বাতাসের জন্য। হুট করে বাহির থেকে অদ্ভুত শব্দ ভেসে আসতেই অলকানন্দার কান খাড়া হয়ে উঠলো। কৌতুহলী সত্তাটা সে দমিয়ে রাখতে না পেরে ঘরের দরজা খুললো। কোমল পায়ে বেরিয়ে এলো ঘর ছেড়ে। পুরো বাড়িতে আধো আধো ঝিমিয়ে থাকা আলো জ্বলছে। অলকানন্দা পা টিপে বাড়ির অন্দরমহল ছেড়ে চলে এলো বিশাল বাড়িটার পেছনের দিকটায়। হাঁটতে হাঁটতে বাঁশঝাড় পেরিয়ে বাড়ির পেছনের একটা পরিত্যক্ত পুকুরপাড় চলে এলো। গাছের আড়ালে দাঁড়াতেই তার চক্ষু চড়কগাছ। পুকুরপাড়ে চলছে বিরাট আয়োজন। কেউ মারা গেলে দাহ্য করার জন্য যেমন আয়োজন করা হয় তেমন আয়োজন চলছে। আর অলকানন্দাকে অবাক করে দিয়ে নন্দন মশাইয়ের হাসি ভেসে এলো। সাথে দেখা দিল লক্ষ্মী দেবীকেও। তাদের মুখে বিশ্ব জয় করা হাসি।

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here