অলকানন্দার নির্বাসন শেষ পর্ব

0
486

#অলকানন্দার_নির্বাসন
#মম_সাহা

অন্তিমকাল [শেষ খন্ড]

সময়ের নামতায় ভেসে গিয়েছে পনেরো বসন্ত। গাছের সজীবতা চির যৌবনা আজও, নদীর উচ্ছ্বাসিত তরঙ্গ- চিরস্থায়ী। সময়ের বদলে প্রকৃতি বদলে যায় না। কেবল বদলে যায় মানুষ, সভ্যতা এবং সংস্কৃতি।

ভারতবর্ষে তখন ইংরেজদের দিন শেষ। দু-একজন আনাচে-কানাচে রয়ে গেলেও তাদের নিয়ে আর কোনো ভয় নেই। দেশ এবার নিজের হাল ধরেছে শক্ত হাতে। তবে বহু কষ্ট পোহাতে হয়েছে এ বিচ্ছিন্ন হাল ধরতে। অভাব, অনটনও দেশে অভিশাপ হয়ে এসেছিল। সেটাও মানুষ কাটিয়ে উঠেছে। তার জন্য গুনতে হয়েছে বিরাট মাশুল। আপন মানুষ হারিয়ে, বহু ত্যাগ তিতিক্ষার পর আজকের দেশের চিত্র স্বস্তির। শান্তির।

গান বাজানো যন্ত্রটায় সকাল হতেই বাজছে ‘আমারও পরানে যাহা চায়, তুমি তাই, তুমি তাই গো…..’ গানের তালে-তালে নন্দার ঠোঁট নড়ছে। ব্যস্ত হাতে শাড়ির আঁচল সাজাচ্ছে আর অলস কণ্ঠে সুর মেলাচ্ছে গানের। হাঁটু অব্দি তার লম্বা চুল পিঠ জুড়ে দোল খাচ্ছে। চোখে গাঢ় কাজল। কপালে গাঢ় করে সিঁদুর লেপটানো। আজও তার রূপ আগের মতনই তেজস্বিনী। প্রাপ্তবয়স্ক মুখমন্ডলে এখন বোধ করি মুগ্ধতা আরও দ্বিগুণ হয়েছে।

“সাহেব বধু, আপনার জন্য নিচে লোক এসেছে। বোধহয় গ্রামে কোনো সমস্যা হয়েছে।”

দরজার বাহিরে দাঁড়ানো গৃহভৃত্যের কথায় নন্দার ভ্রু কুঁচকালো। ঘাড় ফিরিয়ে শুধাল,
“কারা এসেছে?”

“আপনার ইস্কুলের মাস্টারমশাই আসছে। তাড়াতাড়ি আসেন, সাহেব বধূ।”

নন্দ চমকে গেল। সাথে সাথে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। সিঁড়ি ভেঙ্গে নিচে নামতেই দেখল তাদের বিদ্যালয়ের নরেন্দ্রবাবু এবং তপন স্যার দাঁড়িয়ে আছে। নন্দা ভ্রু কুঁচকালো, বিনীত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,
“আপনারা এখানে! কোনো সমস্যা হয়েছে?”

“হ্যাঁ বিরাট সমস্যা হয়ে গিয়েছে। আমাদের স্কুলের একটা মেয়ের জীবন বিপন্ন। আপনি ছাড়া কেউ তাকে বাঁচাতে পারবে না। তাড়াতাড়ি চলুন।”

“কেন কি হয়েছে?”

“আপনি আসুন। আসলেই জানতে পারবেন।”

নন্দা আর অপেক্ষা করলো না। সাথে সাথে ছুট লাগালো।

একটি বাড়ির সামনে এসে নন্দাদের গাড়ি থামলো। বাড়িটির চারপাশে আহাজারি। আপন মানুষ হারানোর শোক পালিত হচ্ছে প্রকৃতি জুড়ে। নন্দা থমকাল। বুকের মাঝে মোচড় দিয়ে উঠলো সুপ্ত ব্যাথা। সে ধীর পায়ে এগিয়ে গেল বাড়ির ভেতর। আগরবাতির ঘ্রাণে চারপাশের বাতাস কেমন ভারি ভারি ঠেকল নন্দার কাছে। তার কাছে আগরবাতির ঘ্রাণটা কেমন শোকের ঘ্রাণ মনেহয়। আদৌও শোকের কোনো ঘ্রাণ আছে? হয়তো আছে। সেজন্যই তো নন্দার বুক ভার হয় এই ঘ্রাণে। বুক কাঁপে মৃদু কম্পনে। হারিয়ে ফেলার ব্যাথা তীক্ষ্ণ ভাবে আঘাত করে তাকে।

নন্দা বাড়িটির ভেতরে প্রবেশ করতেই দেখল বাড়িটির উঠোন জুড়ে সাদা কাপড়ে একটি মানুষ চির নিদ্রায় নিদ্রায়মাণ হয়েছে। সেই মৃত ব্যাক্তির সামনেই একটি মধ্য বয়স্ক নারী কাঁদছেন। আহাজারি করছেন। বাড়িতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ইষ্টি-কুটুমেরা। হয়তো গত হওয়া মানুষটার শেষ যাত্রায় উপস্থিত হয়েছেন সকলে।

নন্দাকে দেখেই স্বাস্থ্যসম্মত একটি লোক এগিয়ে এলো। পড়নে তার সাদা পাঞ্জাবি। হাব-ভাবে বলা যায় তিনি বাড়ির কর্তা। বয়োজ্যেষ্ঠ একজন মানুষ। নন্দাকে দেখেই তিনি বিনীত কণ্ঠে হাত জোর করে বলল,
“নমস্কার, সাহেব বধূ। আপনি আমার বাড়িতে পদধূলি দিয়েছেন, আমার পরম সৌভাগ্য। আসুন, ভেতরের ঘরে আসুন। এমন একটা দিনে এলেন…..”

লোকটা কথা বাড়াতে পারলেন না। চোখের জল মুছলেন নিরবে নিভৃতে। নন্দা ধীর কণ্ঠে বলল,
“ব্যস্ত হবেন না। আপনাদের শোকের সময় এখন। আমাকে নিয়ে ব্যস্ত হতে হবে না।”

নন্দার কথা লোকটা তেমন গা করলেন না বোধহয়। তিনি ব্যস্ত হলেন। ব্যস্ত কণ্ঠে বাড়ির কয়েকজন মেয়ে-বউকে ডাকলেন। নন্দাকে অন্দরমহলে নিয়ে যাওয়ার আদেশ করলেন। নন্দাও অবশ্য অন্দরমহলে যাওয়ার জন্য মুখিয়ে ছিল। তপন স্যারের কথা অনুযায়ী এই বাড়ির লোকেরা একশ বছর আগের ভাবনাচিন্তা বহন করা মানুষ। তাদের বাড়ির ছেলে মারা গিয়েছে মানেই বধূর উপর অত্যাচার হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। সেই খোঁজ নিতেই নন্দার এখানে আসা।

অন্দরমহলে গিয়ে দাঁড়াতেই নন্দার কানে হৈচৈ ভেসে এলো। বাড়ির পূর্বদিকের একটি কক্ষ থেকেই এই হৈচৈ ভেসে আসছে। নন্দা ভ্রু কুঁচকালো। সেদিকে পা বাড়াতেই বাড়ির সম্ভবত বউ তাকে ডাকল, আমতা-আমতা করে বলল,
“সাহেব বধূ, ওখানে কিসের জন্য যাচ্ছেন?”

নন্দা কপালে ভাঁজ ফেলে সরু চোখে তাকাল বউটির দিকে। গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
“কে যেন চেঁচাচ্ছে মনে হলো!”

“মেয়েলি আচার-আচরণ হচ্ছে তো, তাই শোরগোল।”

নন্দা আর অপেক্ষা করল না এক মুহুর্ত। মেয়েটার কথা শেষ হতেই ছুটে গেল সেই ঘরটায়। দরজার সামনে আসতেই তার পা থেমে গেল। অপরূপ সৌন্দর্য্যের অধিকারী একটি সদ্য স্বামীহারা মেয়ে সাদা ধবধবে একটি কাপড় পড়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার রূপে খা খা করছে যেন সারাটা ঘর। কী সুন্দর সেই রূপ! মেয়েটিকে কেন্দ্র করেই আরও কয়েকজন সধবা মহিলা দাঁড়িয়ে আছেন। নন্দা বোঝার চেষ্টা করল, এখানে হচ্ছেটা কী! তন্মধ্যেই কক্ষে উপস্থিত একজন নারীর কণ্ঠ ভেসে এলো,
“তুই চুল কাটবি না কেন? চুলে কী আছে তোর? স্বামী মারা গেছে তোর। কোনো শোক তাপ তোর ভেতরে নাই। কেমন মেয়ে-ছেলে তুই!”

কথাটা নন্দার কানে বার বার প্রতিধ্বনিত হলো। চোখের সামনে ভেসে উঠল তার বহু পুরানো স্মৃতি। এই কথা গুলোর সাথে সে পরিচিত। এই ক্রোধ, ক্ষোভের সাথে তার বহু যুগ যাবত সম্পর্ক। এই অনুভূতি অচেনা নয় তার। চোখের সামনে নিজের বৈধব্যের কটুক্তি, ভয়ঙ্কর স্মৃতি জ্বলজ্বল করে উঠল। নন্দা তার সামনের মেয়েটির দিকে তাকাল। মেয়েটির বয়সও বেশি নয়। পনেরো কিংবা ষোলো হবে। তেমনই রূপ, তেমনই সাহস তার অঙ্গ জুড়ে। নন্দা থম মেরে দাঁড়িয়ে রইল। তন্মধ্যে মেয়েটির একরোখা জবাব ভেসে এলো,
“আমি কাটবো না আমার চুল। বড়ো শখের এগুলো।”

নন্দা মেয়েটির মাঝে যেন নিজেকে খুঁজে পেল। বহু পুরোনো সেই ছোট্ট নন্দাকে। যার চোখে ছিল সমুদ্রের উত্তাল ঢেউ। সাহসের অগ্নিসম দীপ্তি। এ যেন পুরোনো ইতিহাস নতুন করে খোদাই করার গল্প।

ঘরে আরও বাক-বিতন্ডা চলল। মেয়েটিকে শুনতে হলো কুরুচিপুর্ণ কথাও। গায়ে তকমা লাগল চরিত্রহীনার। তবুও মেয়েটি অটল। নন্দা মুখে ক্ষীণ হাসি। আরেকটি অলকানন্দার জন্ম যেন এখানেই।

এই শোরগোল ঠেলে, ভেসে এলো নন্দার কণ্ঠ,
“এখানে কী হচ্ছে?”

নন্দার বজ্রকণ্ঠে থেমে গেল সকল কণ্ঠ ধ্বনি। সকলে ড্যাব ড্যাব করে চাইল নন্দার পানে। নন্দাকে দেখেই যেন সকলে তটস্থ হয়ে গেলো। সেখানে উপস্থিত, সবার থেকে বয়স্ক মহিলাটি যেন উপস্থিত ঘটনাকে ঢাকতে চাইলেন। আমতা-আমতা করে বললেন,
“সাহেব বধূ যে! আপনি এঘরে কেন! দেখছেন কান্ড! বিনী আপনাকে বসার জায়গা দেয়নি? ছিঃ ছিঃ। বিনী, এই বিনী…..”

“বসার জায়গার কথা তো আমি এখানে জিজ্ঞেস করিনি। আমি জিজ্ঞেস করেছি, এখানে কী হচ্ছে?”

নন্দার কথা থামতেই কিশোরী, সদ্য স্বামীহারা মেয়েটা এগিয়ে এলো। নন্দার পায়ের উপর লুটিয়ে পড়ে আকুতি-মিনতি করতে করতে বলল,
“আমি চুল কাটবো না। আমি এসব করবো না। আপনি একটু ওদের বুঝিয়ে বলেন না।”

নন্দা যেন মেয়েটার ভেতর বর্ষ পুরোনো নিজেকে পেল। সেদিন নন্দাও তো এমন করেছিল! নন্দা কিছু বলার আগে সেই বয়স্ক মহিলার হুঙ্কার শোনা গেল,
“ওরে ধর তোরা। সাহেব বধূকে অশৌচ নিয়ে ধরল। ধূর। কী কান্ড! ধর। কেমন মেয়ে-ছেলে তুই বাপু! লজ্জা বলতে বস্তু নাই তোর। ছেহ্।”

মহিলার আদেশ পেতেই কয়েকজন এগিয়ে এলো। কিন্তু ছুঁতে পারল না মেয়েটাকে। তার আগেই তার সামনে ঢাল হলো নন্দা। গম্ভীর তবে শক্ত কণ্ঠে বলল,
“কেউ ওকে ধরবেন না। ভুল করেও ওর শরীরে কেউ হাত দিবে না।”

নন্দার শক্ত কণ্ঠে ছুটে এলেন বাড়ির কর্তা। থেমে গেল আহাজারিও। কর্তা যেন দিশেহারা হলেন। দিগবিদিক ভুলে বিনীত স্বরে শুধালেন,
“কী হয়েছে, সাহেব বধু? কী হয়েছে? কোনো সমস্যা হলে আমাকে বলুন।”

নন্দা তার সামনের মহিলাদের দিকে এক পলক চাইল। অতঃপর তার পায়ের কাছে বসা মেয়েটাকে আলতো হাতে তুলল। শান্ত অথচ ধারালো কণ্ঠে লোকটার উদ্দেশ্যে বলল,
“এই গ্রামের নিয়ম-নীতি আপনার নিশ্চয় অজানা নয়? তবে কেন সেই নিয়ম-নীতির এমন বিদ্রুপ হচ্ছে? এটা করছেন কীভাবে?”

কর্তা মাথা নত করলেন। হাত জোর করে বললেন,
“ক্ষমা করবেন, সাহেব বধূ। মেয়ে লোক অন্য মেয়ে লোকের ভালো সহ্য করতে পারেনা সেটাই স্বাভাবিক। আমি এই ব্যাপারে অবগত ছিলাম না। আমি না করে ছিলাম ওদের। ক্ষমা করবেন।”

নন্দার সাথে বিনীতভাবে কথা থামিয়েই ভদ্রলোক বাকি মহিলাদের উদ্দেশ্যে হুংকার দিয়ে উঠলেন। তার হুঙ্কারে ভীত হলো চারপাশ। ভদ্রলোক নিজের সদ্যবিধবা পুত্র বধূকে আগলে নিয়ে বললেন,
“ও আমার মেয়ের সমান। ওর সাথে অন্যায় কিছু যেন না হয়। ও যদি কোন নিয়ম-নীতি না মানতে চায় তাহলে না মানবে। ওকে কেউ জোর করবে না। আমার পুত্র মারা গিয়েছে, তাই বলে আমি এই মেয়েটার উপর কোন কিছু চাপিয়ে দিতে চাই না। মনে থাকবে সকলের?”

ভদ্রলোকের কথা থামতে উপস্থিত সকলে ঘাড় নাড়ালো। নন্দা বাঁকা হাসলো। সকলের উদ্দেশ্যে বলল,
“শুধু ও না, এই গ্রামের কোনো নারীর উপর যেন জোর জবরদস্তি না করা হয়। যদি কেউ আদেশ লঙ্ঘন করে তবে তার জন্য দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি অপেক্ষা করছে।”

সকলে নন্দার আদেশ মাথা নত করে মেনে নিল। আর যাই হোক, সাহেব বধূর উপরে কথা বলার ক্ষমতা কারো হয়নি। কারো না। যার নির্দেশে দু’টো গ্রাম চলে এমনকি বড়ো বড়ো মানুষও তার উপর কথা বলেনা তার সিদ্ধান্ত না মানার ক্ষমতা কারো নেই। নন্দা মেয়েটাকে ভরসা দিয়ে বেরিয়ে এলো সেই বাড়ি থেকে। যতবার তার শক্ত সিদ্ধান্ত মানুষ মেনে নেয় ততবার স্টিফেনের প্রতি কৃতজ্ঞতায় তার মাথা নুইয়ে আসে। চোখ বুজে আসে। আজকে নন্দার পেছনে সে মানুষটার অবদান বেশি।

_

নন্দা আরামকেদারায় শুয়ে আছে। চোখ বন্ধ তার অথচ মস্তিষ্ক সজাগ। পুরোনো ব্যাথার ক্ষত অন্তরে। ক্ষণে ক্ষণে তা জ্বালা করে।

“বৌঠান, আসবো?”

অ্যালেনের অনুমতি প্রত্যাশা নন্দার বন্ধ চোখ খুলে দিল। সে সাথে সাথে শাড়ির আঁচল ঠিক করে বলল,
“ঠাকুরপো, আসুন।”

অ্যালেন মাথা নত করে কক্ষে প্রবেশ করল। ক্ষীণ স্বরে বলল,
“ডাকিয়া ছিলেন?”

“হ্যাঁ। আজ তো মাসের শেষদিন। আর প্রতি মাসের শেষদিন আমি আপনাকে একটা জিনিস দেই। মনে আছে?”

অ্যালেন মাথা নাড়াল। জবাব দিল, “হ্যাঁ, মনে আছে। পত্র কী তৈরী?”

“হ্যাঁ, তৈরী। চিঠি গুলো টেবিলের উপর। কষ্ট করে নিয়ে যাবেন?”

অ্যালেন মাথা নাড়াল। টেবিল থেকে চিঠি গুলো তুলতেই নন্দা উঠে দাঁড়াল। নিবিড় কণ্ঠে শুধাল,
“উনি কবে আসবে ফিরে? অভিমান কবে শেষ হবে?”

অ্যালেন থেমে গেল। চমকে গেল কিঞ্চিৎ। নন্দার দিকে ফিরতে গিয়েও ফিরল না। মাথা নত করেই জবাব দিল,
“আসিবে হয়তো, খুব শীগ্রই।”

“খুব শীগ্রই হতে আর কত যুগ লাগবে? পনেরোটা রিক্ত শীত কী অল্প সময় ছিল!”

অ্যালেন স্তব্ধ হয়ে রইল নন্দার কাতর স্বরে। চারপাশ হাতড়ে উত্তর খুঁজে পেল না। নন্দা মিনতি করে বলল,
“একটিবার আপনি বলুন না আসতে। আমি আর কখনো তাকে ফেরাবো না। আপনি বললে সে শুনবে। একটু বলুন না। সেদিন তো আমি বাধ্য হয়ে ছিলাম। কিন্তু আমি আপনাকে আগেই জানিয়ে ছিলাম। তাকে জানাতে পারিনি। কীভাবে জানাবো বলুন! চক্ষু লজ্জাও তো আছে। উনাকে একটু বলুন না ফিরে আসতে। আমি আমার ভুল শুধরে নিব।”

অ্যালেন আর কথা বলল না। দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঘর ছেড়ে বেড়িয়ে গেল। নন্দার চোখ অভিযোগের অশ্রুতে ভারি হলো। একবার সে স্টিফেনকে পেলে আর ছাড়বে না। মানুষটাকে সে আগলে রাখবে বড়ো যত্ন করে। আর হারাতে দিবে না। একবার হারাতে দিয়ে পনেরোটা বছর যাবত অপেক্ষা করে যাচ্ছে। নিশ্চয় মানুষটার অনেক অভিমান হয়েছে। না-হয় সে নন্দাকে এভাবে কষ্ট দিত না।

_

নিস্তব্ধ বারান্দায় নিঃসঙ্গ দাঁড়িয়ে আছে অ্যালেন। তাকে পেছন থেকে কেউ ডাকল। অ্যালেন ঘুরে তাকাতেই অন্নপূর্ণার হাস্যোজ্জ্বল মুখশ্রী চোখে পড়ল। মেয়েটা ডায়রিতে লিখল,
“বড়দির আজ চিঠি দেওয়ার কথা, দিয়েছিল?”

অ্যালেন লিখাটি পড়ল। মেয়েটার জিহ্বা হারানোর ফলে এখন আর কথা বলতে পারে না। তাই এই পন্থা অবলম্বন করেছে। অ্যালেন হাসল, জবাব দিল,
“দিয়েছে। মায়েরটা এবং বৌঠানের আগের শাশুড়ি সুরবালা দেবীরটা পাঠানো হয়ে গিয়েছে।”

অন্নপূর্ণা ডায়েরিতে আবার লিখল, “আর বড়দির স্বামীরটা?”

অ্যালেন অম্বরে আলোকিত অর্ধচন্দ্রের দিকে তাকিয়ে কিঞ্চিৎ হাসল। জবাব দিল,
“একশত উনআশি নাম্বার চিঠি খানা জমিলো আমার ডাকবাক্সে। অথচ প্রাপকের ঠিকানায় কখনো এই চিঠি গুলো আমি প্রেরণ করিতে পারিব না। এই ভয়ঙ্কর যন্ত্রণা নিয়া বাঁচিয়া থাকা অনেক কষ্টের অন্নপূর্ণা।”

অন্নপূর্ণা আবার ডায়েরিতে লিখল,
“বড়দিকে বলে দিলেই তো হয়?”

“না, হইবে না অন্নপূর্ণা। হইবে না। সেইদিন গুলোর সাক্ষী আমি। আমি জানি আমার চোখ কী দেখিয়াছে। সেদিন ললিতা না এলে হয়তো আমিও আর এখানে থাকিতাম না। বৌঠানের জীবন বাঁচিতো কি-না সন্দেহ। ললিতা সেদিন স্টিফেনকে নিয়ে পৌছে দিবে বলিয়াছিল দেশের শেষ প্রান্তে। আমাকে পাঠাইয়া ছিল বৌঠানের কাছে। আমি আসিয়া দেখি এই নির্বাসন মহলে আগুন জ্বলিতেছে। দাউ দাউ করে পুড়িতেছে সব। ভাগ্যিস ছুটিয়া আসিয়া বৌঠানকে পাইয়া ছিলাম! মানুষটার জ্ঞান ছিল না। আরেকটু দেরি হইলে বাঁচিত না মানুষটা।”

অ্যালেন থামল। অন্নপূর্ণা এসব-ই জানে। তবুও শুনছে। অ্যালেনের মন খারাপ হলে সে এই স্মৃতিচারণ বার বার করে। করাটাই স্বাভাবিক। এমন স্মৃতি বুকে চেপে সবসময় বাঁচা যায় না। মাঝে মাঝে হাফ ছেড়ে বাঁচতে ইচ্ছে তো তারও হয়।

অ্যালেন খসে পড়া তারাটির দিকে তাকিয়ে কম্পনরত কণ্ঠে বলল,
“আমি এই সত্য বুকে লুকাইয়া বাঁচিতে পারিতেছি না, অন্নপূর্ণা। তবে আমার বাঁচিতে হইবে। আমি যে স্টিফেনকে কথা দিয়াছি, তার সানশাইনের ঢাল হইয়া থাকিব। সে কথা কীভাবে লঙ্ঘন করিব বলো! তবে আমার কষ্ট হয়। স্টিফেন বৌঠানকে বড়ো ভালোবাসিত। বৌঠান তখন তা বুঝেনি। ছেলেটার এত ভালোবাসাই তার জীবনের কাল হইল। সে বৌঠানের মন রাখতেই ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে গেল যার জন্য এই পৃথিবী হারাইয়া ফেলল একটি নিঃস্বার্থবান প্রেমিক। অথচ কেউ জানিল না তা, কেউ জানিল না। সেদিন ললিতা স্টিফেনকে নিয়া পালাইয়া যাইতে পারে নাই। তাদেরকে ব্রিটিশীয়ানরা ধরিয়া ফেলে এবং টানা এক সপ্তাহের নির্মম অত্যাচার করার পর তাদেরকে মৃত্যু ভিক্ষা দেয়। ললিতা মেয়েটাকে তো শেষ অব্দি জীবিত পাইনি তবে স্টিফেনকে পাইয়া ছিলাম। হয়তো ছেলেটা শেষ ইচ্ছা জানাইবার জন্যই বাঁচিয়া ছিল। যখন আমি তার এমন ক্ষত-বিক্ষত শরীর পাই, তার প্রাণ প্রায় আসে যায়। কথা বলিতে পারিতেছিল না ও, তবুও আমাকে বলে গিয়াছে ওর মৃত্যুর খবর যেন তার সানশাইন কখনো না জানিতে পারে। সানশাইনের নাকি লাল রঙ খুব প্রিয়। স্টিফেন চায়নি, যেই প্রিয় রঙ সে সানশাইনকে নতুন করিয়া উপহার দিয়াছিল, তা আবার দ্বিতীয়বার কাড়িয়া নিতে। শেষ নিঃশ্বাস অব্দি ছেলেটা ভালোবাসিয়া গিয়াছিল। অথচ তার ভালোবাসার মানুষ তার মৃত্যুর খবর অব্দি জানিতে পারিল না। কত দুর্ভাগা সে! আজকের দিনে পনেরো বছর হইল মানুষটা নাই অথচ কেউ শোক পালন করিবে না এই দুঃখে। কেউ কাঁদিবে না এই ব্যাথায়। হাহ্!”

অন্নপূর্ণার চোখের কোণে অশ্রুর মেলা। যতবার অ্যালেন এই স্মৃতি কাতরতায় কাঁদে, তার সঙ্গী হয় অন্নপূর্ণা। তার বড়ো আফসোস হয় নন্দার জন্য। ইশ্, বড়দিটা কত বোকাই না ছিল! স্বর্গ পেয়েও সে পায়ে ঠেলে দিয়েছে।

_

রাত হতেই নন্দার তুমুল জ্বর বাড়ল। জ্বরের ঘোরেই সে উঠে স্নান করল। কেবল আজ নয়, প্রতিবছর এই দিনটায় তার জ্বর উঠে, ভীষণ জ্বর। সেই জ্বরে সে আবোল-তাবোল কাজ করে। আজও তার ব্যাতিক্রম হলো না। সেই মাঝ রাতে উঠে নন্দা স্নান করল। লাল টুকটুকে শাড়ি জড়িয়ে চুল ছড়িয়ে দিল কোমড় অব্দি। চোখে কাঁজল, পায়ে আলতা লেপে নেমে গেল সিঁড়ি বেয়ে। হাঁটতে হাঁটতে বাগানটার পেছনে গিয়ে বসল। তার কিয়ৎক্ষণ পরই লম্বাচওড়া, সুঠাম দেহী শুভ্র রঙের একটি পুরুষ উপস্থিত হলো সেখানে। নন্দাকে ফিসফিস করে বলল,
“সানশাইন, ভালোবাসার দাবী ছাড়িয়া দেওয়ার পর তোমার নির্বাসন কেমন কাটিতেছে? অলকানন্দার নির্বাসন, স্টিফেন বিহীন নিশ্চয় দারুণ কাটিতেছে?”

নন্দা উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করল। শরীরের তাপমাত্রা তার তড়তড় করে বাড়ছে। চোখ ঝাপসা হতেই সুঠাম দেহী পুরুষ মিলিয়ে গেল অন্ধকারে। নন্দার চোখ বেয়ে মুক্তোর মতো অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। সে কেমন ঘোর লাগা কণ্ঠে বলল,
“একদিন নির্বাসিত জনম আমার শেষ হবে। আপনাকে ভালো না বাসার জন্য আমার এই কঠোর নির্বাসন শেষ হবে একদিন। সেদিন আপনি আমার হবেন। আমার হবেন।”

পরপরই তার কণ্ঠে গান ভেসে এলো,
“আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলে,
দেখতে আমি পাইনি তোমায়,
দেখতে আমি পাইনি….”

(সমাপ্ত)

[অলকানন্দার নির্বাসনে কেমন কাটালেন? জানাতে ভুলবেন না। সবাই মন্তব্য করবেন। আর রি-চেক করিনি। বানান ভুল হবে, জানিয়ে দিবেন। ভালোবাসা সবশেষে।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here