অলকানন্দার নির্বাসন পর্ব ৬

0
672

#অলকানন্দার_নির্বাসন
#মম_সাহা

৬.

“তুমি মানুষ হইতে চাইলে সমাজ তোমাকে স্মরণ করাবে, তুমি মেয়েমানুষ,
‘মেয়ে’ নামক বিশেষণে সমাজ দুর্বলতা খুঁজে পায়, যেন তারা মিছে ফানুস!”

কবিতা খানা গোপনে আওড়িয়ে আড়ালে আবডালে হাসে অলকানন্দা। শাশুড়ির উষ্ণ বক্ষে খুঁজে নেয় ঠাঁই। সুরবালা নিজের বাহু বন্ধনে সুন্দর ভাবে আঁকড়ে ধরে পুত্রবধূকে। পুত্র মারা যাওয়ার পর মেয়েটার মাঝেই যেন নিজের ছেলেকে দেখতে পায় সে। মেয়েটাকে বাড়ি থেকে বের হয়ে যেতে বলতেও তার বুক কাঁপছিল কিন্তু কী আর করার! সমাজে বাঁচতে হলে একেবারেই একরোখা হলে যে চলবে না। দিনশেষে সমাজেই তো থাকতে হবে। তাদের কিছু নিয়মকানুন না মেনে চললে তারা দূরে ছুড়ে মারবে আমাদের। অলকানন্দা শাশুড়িকে জড়িয়ে রেখেই বলল,
“মা, আপনি না চাইলে আমি রঙিন কাপড় আর পড়বো না। সাদাতেই আমি থাকবো। আমি অবশ্যই ভালো থাকতে চাই কিন্তু সেটা আপনাকে ছেড়ে না। আপনাকে নিয়েই আমি ভালো থাকবো। তার জন্য রঙিন কাপড় না হলেও হবে।”

সুরবালার চোখ থেকে এক ফোঁটা সুখের অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। কিন্তু তা অলকানন্দার অগোচরেই রইলো। শাশুড়ি তার কাছে সবসময় শক্ত-পোক্ত ভরসাস্থল। আর ভরসাস্থলকে কেউই দুর্বল হতে দেখতে পারে না।

_

স্যাঁতস্যাঁতে ঘরটায় আজ সুরবালার সপ্তাহ পূর্ণ হলো। অন্ধকারাচ্ছন্ন সবচেয়ে নোংরা, ছোটো ঘরখানায় সে মানিয়ে নিয়ে ছিল তার বৈধব্য নামক অসুখটিকে। কিন্তু আজ সকাল হতেই বিহারিণী মহলে নতুন উৎপাতের সৃষ্টি। যেহেতু সুদর্শন ছিলো বাড়ির কর্তা সেহেতু তার ঘরটা ছিল সবচেয়ে আলিশান। ঘরের প্রতি কোণায় যেন সুখ গড়িয়ে পড়ার চিহ্ন। তার ঘরের আসবাবপত্র হতে দেয়ালসহ সবটাই কারুকাজ সংবলিত। কোনো রাজপ্রাসাদের সাথে তুলনা করা যাবে নির্দ্বিধায়। অথচ আজ সেই রাজপ্রাসাদ শূণ্য। রাজার অভাবে সুখ গড়িয়ে পড়া ঘরটাও যেন খাঁ খাঁ করছে। আর সেই শূণ্য ঘরটাতে কে বাস করবে তা নিয়ে চলছে বাকবিতন্ডা। ঘরের অধিকার কেউ ছাড়তে রাজি না। পানকৌড়ি, মনময়ূরী, মনোহর সকলেই একটা রুম নিয়ে পড়েছে। রুম তো নয় তার আড়ালে এই বিরাট শাসনকার্যের ভার নেওয়াও যেন লক্ষ্য সকলের।

পানকৌড়ির স্বামী ধ্রুবলাল কিছুটা বিরক্ত হলো স্ত্রীর এমন স্বভাবে। কিছুটা কপাল কুঁচকেই বলল,
“ছেড়ে দেও না কৌড়ি। একটা ঘরই তো! সেটা নিয়ে আবার কিসের এত টানাটানি!”

“আপনার লজ্জা করলো নে অমন কথা কইতে? এমন একটা ঘর আপনি আমাকে কখনো দিতে পারবেন! অকর্মা পুরুষমানুষ যেহেতু হয়েছেন সেহেতু চুপ থাকবেন। যা বুঝেন না তা নিয়ে আবার এত কথা কিসের!”

স্ত্রী’র তীক্ষ্ণ বাক্যে চুপ হয়ে গেলো ধ্রুবলাল। লোকটা একটু সহজসরল ধরণের বলেই আজ শ্বশুর বাড়িতে ঘর জামাই হয়ে বউয়ের সকল বেমানান কথা সহ্য করে। ধ্রুবলাল চুপ থাকলেও চুপ থাকেনি অলকানন্দা। বাহিরের হৈচৈ শুনে ঘর ছেড়ে বেরুতেই নিজের ননদের এমন আচরণ তার চোখে লাগে। যা ছিল বড্ড অশোভনীয়। তাই সে-ই উত্তর দিলো,
“ঠাকুর জামাই অকর্মা না তুমি অকর্মা, ননদিনী?”

বিশাল বাকবিতন্ডা মুহূর্তেই শিথিল হয়ে গেলো। কৌড়ি উঠলো খেপে। কিছুটা হামলে পড়ে বলল,
“বউরাণী, মুখ সামলে কথা বলবে।”

“তুমি মুখ সামলে কথা বলো, ঠাকুরঝি। বয়সে তুমি আমার বড়ো হলেও সম্পর্কে আমি তোমার গুরুজন। তাই তোমার এমন আচরণ মোটেও আমি মানবো না। আর আমি ঠাকুর জামাইয়ের মতন অত ভালোও না যে তোমার এমন নির্মম আচরণও সহ্য করবো। ঠাকুর জামাই তোমাকে বড়ো ভালোবাসে আর শ্রদ্ধা করে বলেই এমন ভরা সভায় অপমানিত হয়েও জবাব দেয়নি৷ কিন্তু যে সম্মান বুঝেনা তাকে আদৌও সম্মান দেওয়া যায়?”

“বউরাণী!”

“এই বাড়িতে কণ্ঠ এত উঁচুতে উঠিয়ে কথা বলবেনা ঠাকুরঝি। কণ্ঠ উঁচু করতে হলে নিজের শ্বশুর বাড়িতে গিয়ে করবে। মেয়ে মানুষদের বিয়ের পর সেটাই নিজের বাড়ি। বুঝেছ?”

অলকানন্দার শব্দের তীক্ষ্ণ বাণে বিদ্ধ হয় পানকৌড়ি। উঁচু মাথা ঝুঁকে যায় অবলীলায়। কথা বাড়ানোর সাহস পায়না বাড়ির দুই মেয়ে। তা দেখে বিজয়ীর হাসি হাসে মনোহর। ঘরটা বোধহয় এবার তার ভাগ্যেই এলো। কিন্তু তার এই হাসি দীর্ঘ স্থায়িত্ব হলো না। অলকানন্দা এর আগেই প্রশ্নবিদ্ধ করলো তাকে,
“তা ঠাকুরপো, ঘরখানা কি তুমি নিতে চাও?”

মনোহর সাথে সাথে মাথা উপর-নীচ করলো। আহ্লাদে আটখানা হয়ে বলল,
“হ্যাঁ বউ ঠাকুরণ, এ বাড়িতে ছেলে বলতে তো আমিই আছি। এটাতে তো আমার অধিকার তাই না বলুন?”

মনোহরের গদোগদো কণ্ঠে হাসলো অলকানন্দা। মাথা উপর-নীচ করে বলল,
“তা জীবনেও তো দেখলাম না বাড়ির কোনো কাজ করতে আর এখন অধিকার নিয়ে এত হৈচৈ ঠাকুরপো? এই ঘরে কেউ থাকতে পারবেনা। আমার স্বামী বেঁচে থাকাকালীন অনেক পরিশ্রম করেছে। তার পরিশ্রমেই তাে তার এই শখের ঘর। মৃত্যুর পর এটাকেও ছাড়বেনা তা তো হতে পারেনা। এই রুমে কেউ থাকতে পারবেনা। মানুষটা তার অল্প জীবনে অনেক শ্রম দিয়েছে। তার এই শ্রম এমন মিছে হতে পারেনা।”

অলকানন্দার কথায় চোখ বড়ো বড়ো করে তাকালো সকালে। সুরবালার ঠোঁটের কোণে খুব সুক্ষ্ণ হাসির রেখা দেখা দিল। সে বরাবরই বুঝে এসেছে তার পুত্রবধূর মনে তার পুত্র সম্পর্কিত কোনো অনুভূতি নেই অথচ আজকের কথায় তা মনে হলোনা মোটেও।

মনোহরের চোখে-মুখে কিছুটা রাগ দেখা গেল, রাগ দেখা দিল নন্দন মশাইয়ের মুখমন্ডলেও। সে তো প্রায় খেঁকিয়েই বলে উঠলেন,
“তোমার কথায় কী এখন সব হবে নাকি? কোন মুখে কথা বলো তুমি?”

“কথা বলার অধিকার আমার আছে। সেটা আমার স্বামী তো তার সাথে চিতায় নিয়ে যায়নি। সেই অধিকারেই বলছি।”

“মা গী মেয়েমানুষ বলেই এত কথা বলে। লাজ লজ্জা মোটেও নেই।”

পিসিমার বিশ্রী গালিতেও হাসলো অলকানন্দা। মাথার ঘোমটাটা আরেকটু টেনে বলল,
“শুনেছি রতনেই রতন চেনে। আমি যে ওসব মেয়েমানুষ আপনি চিনলেন কীভাবে? তাহলে কী….”

অলকানন্দার কথা সম্পূর্ণ হওয়ায় আগেই একটা সুরেলা মেয়েলী কণ্ঠ ভেসে এলো,
“তাহলে বলা যায়, মা গীই তবে মা গী চিনেছে তাইনা?”

সুরেলা মেয়ে কণ্ঠে চমকে উঠলো উপস্থিত সকলে। কণ্ঠের মালকিনের দিকে তাকাতেই একটা সুন্দর নারীমূর্তির মুখমন্ডল দৃষ্টিগোচর হলো। লক্ষ্মী দেবী হতভম্ব চোখে চেয়ে অবাক কণ্ঠে বললো,
“তরঙ্গিণী, তুই আমারে অমন কথা কইতে পারলি?”

তরঙ্গিণী নামের মেয়েটির লতার মতন অঙ্গখানি হাসিতে লুটোপুটি খেলো। নীল রঙের চকচকে শাড়িখানার আঁচল দুলাতে দুলাতে বলল,
“তোমারে আমি অমন কথা কইতে পারি জেঠি? তুমি হলে গিয়ে সতীসাবিত্রী নারী।”

কথাটায় যেন ঠাট্টার ছোঁয়া ছিল। লক্ষ্মী দেবী মনে মনে বড্ড নারাজ হলেন বোধহয়। কথা না বাড়িয়ে চলে গেলেন নিজ ঘরে। বিরাট কথোপকথনের ভাঁটা পড়ে সেখানেই। তরঙ্গিণী নামক নারীটিকে দেখে বাকি সকলে খুশি হলেও খুশি হলোনা সুরবালা। তার চোখেমুখে একটা বিরক্ত ভাব যেন লেপটেই ছিল।

যে যার মতন চলে গেলেও দাঁড়িয়ে রইলো অলকানন্দা। তরঙ্গিণী দেহ দুলিয়ে দুলিয়ে আয়েশি ভঙ্গিতে এগিয়ে এলো অলকানন্দার দিকে। অলকানন্দার পায়ের নখ থেকে মাথার চুল অব্দি পরখ করে আপনমনেই বলল,
“তোমার রূপ কমানোর চেষ্টা চলেছিল নাকি, নন্দা? কিন্তু স্বয়ং ঈশ্বর যারে রূপ ঢেলে দেয় তার রূপ কমানোর সাধ্যি কারো আছে বলো?”

“তোমার তো রূপ বাড়লো আরও। প্রেমিক পুরুষ মরলেও কী রূপ বাড়ে না-কি?”

অলকানন্দার কথায় উচ্চস্বরে হেসে উঠলো তরঙ্গিণী। অলকানন্দার থুঁতনি ধরে বলল,
“তোমারও তো দেখলাম ভালোবাসা বেড়েছে। স্বামী মরলে কী প্রেম বাড়ে? নাকি শরীরের ক্ষুধা প্রেম বাড়ায়?”

“অমন ক্ষুধা তরঙ্গিণীর থাকে, অলকানন্দার না।”

তরঙ্গিণী এবার অবাক হলো। অলকানন্দা যে কথার উত্তরে দারুণ কথা বলতে শিখেছে তা সে হয়তো ভাবতেও পারেনি।

_

দিন পেরিয়ে রাত হলো। প্রকৃতি তখন ঝিমিয়ে এলো দারুণ ক্লান্তিতে। অলকানন্দা শুয়ে ছিল তার বিছানায়। তন্মধ্যেই ঘরে উপস্থিত হলো প্রসাদ। এসেই বরাবরের মতন দরজায় শব্দ তুললো। তার উপস্থিতি জানান দিলো। অলকানন্দা ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল। প্রসাদকে দেখেই তৎক্ষণাৎ উঠে বসলো। ব্যতিব্যস্ত কণ্ঠে বলল,
“আসুন, আসুন।”

প্রসাদ গম্ভীর মুখে ভেতরে প্রবেশ করলো। রাশভারী কণ্ঠে বলল,
“পড়াশোনার ব্যাপারে কিছু তো জানালেন না। আগামী বুধবার আপনার পরীক্ষা। হাতে আর চারদিন অবশিষ্ট আছে।”

অলকানন্দা মাথা উঁচু করতেই মুহূর্তেই মাথা ঘুরে উঠলো তার। হড়বড়িয়ে বমি করে ভাসিয়ে ফেলল জমিন। আকস্মিক ঘটনায় হতভম্ব প্রসাদ। অলকানন্দার অসুস্থ কণ্ঠে ছুটে এলো তরঙ্গিণী, সুরবালাসহ বাকি রমনীগণ। কৃষ্ণপ্রিয়া গিয়ে জড়িয়ে ধরলো মেয়েটাকে। আর্তনাদ করে উঠলো লক্ষ্মী দেবী,
“এমা বউ, তুই কী পোয়াতি হলি নাকি?”

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here