অলকানন্দার নির্বাসন পর্ব ৩

0
829

#অলকানন্দার_নির্বাসন
#মম_সাহা

৩.
প্রকৃতিতে তখন ভারী বর্ষণ। গাছ, পাতা সব ভিজে একাকার। বৃষ্টির ফোঁটা যেন নৃত্য করছে দু’হাত তুলে। ঘন ঘন বজ্রপাতও হচ্ছে। কী বিকট শব্দ! কী বিকট ঝংকার সেই বজ্রপাতে! প্রকৃতি থেকে শুরু করে মানুষসহ ভীত হচ্ছে এমন হুঙ্কারে। মধ্য রাত্তিরে বিহারিণী মহলের বিরাট বৈঠকখানা জুড়ে আবার শুরু হয়েছে বিচারকার্য। এখন আর নন্দন মশাই আরাম করে আরাম কেদারায় বসে নেই, এখন তার কপালে চিন্তাদের গাঢ় ভাঁজ। বৈঠকখানার এদিক থেকে ওদিক হাঁটছে গুরুগম্ভীর ভাবে। দু-হাত পেছনে নিয়ে। সবাই দাঁড়িয়ে আছে নিশ্চুপ ভঙ্গিতে। যেন এখানে নীরবতায় শ্রেয়। নন্দন মশাই বোধহয় হাঁটতে হাঁটতে কিছু ভাবলেন, অতঃপর কণ্ঠ কঠিন করে বলল,
“বউ, তোমার অভিযোগ, আমার পুত্র মনোহর তোমার শয়নকক্ষে গিয়েছিল তাই তো?”

অলকানন্দা শক্ত কণ্ঠে জবাব দিলো, “হ্যাঁ।”

“তুমি তোমার কক্ষের দোর দেওনি কার আশাতে?”

এতক্ষণ দৃষ্টি নিচের দিকে সীমাবদ্ধ থাকলেও উক্ত কথা কর্ণগোচর হতেই চোখ তুলে তাকালো অলকানন্দা। এত বাজে রকমের প্রশ্ন তার পিতৃতুল্য শ্বশুর করতে পারে সে বোধকরি কল্পনাতেও ভাবেনি।

ভাইয়ের মোক্ষম সময়ে মোক্ষম প্রশ্নে খুশি হলেন লক্ষ্মী দেবী। মাথায় ঘোমটা টানা আঁচলটা দুলাতে দুলাতে বলল,
“পুরুষের ছোঁয়া পাওয়ারও শখ আবার ছুঁতে গেলে সমস্যা! তা বউ, নন্দনের প্রশ্নের জবাবটা দে। দোরটা খুলে রেখেছিলি কার জইন্য?”

অলকানন্দা শাশুড়ির পানে তাকালো। সুরবালার দৃষ্টিও কঠিন। অলকানন্দা চোখ ঘুরিয়ে চাইলো কৃষ্ণপ্রিয়ার দিকে। স্বামীর আচরণে মেয়েটাও যে ভীষণ কষ্ট পেয়েছে তা তার চোখে-মুখে স্পষ্ট। বাড়িতে রয়েছে ননদ-ননদাইরা। এমন ভরা সম্মানের বাজারে নিজের সম্মানহানিতা বড্ড গায়ে লাগলো অলকানন্দার। সে শক্ত চোখে নিজের পিসি শাশুড়ির দিকে তাকিয়ে বলল,
“যে যেমন, অন্যকে তেমন ভাবা মনুষ্য জাতির স্বভাব পিসিমা। তবে যাই বলুন, দুধ আর ঘোল যেমন এক জিনিস না তেমন আপনার চরিত্র আর আমার চরিত্রও এক নয়।”

লক্ষ্মীদেবী হজম করতে পারলেন না এমন চিরন্তন সত্য কথাটা। তেড়ে এলেন বউয়ের দিকে। বাহু খামচে ধরে বললেন,
“স্বামীটা মারা গেছে একটা দিনও কাটেনি এখনই এত কথা এ বেধবা মেয়েমানুষের, এই মেয়ে এ বাড়ি থাকলে ঘোর অনর্থ যে ঘটবে তা আর বলার অপেক্ষা রাখেনা নন্দন। খুব শীগ্রই এ মেয়েরে ওর বাপের বাড়ি পাঠানোর ব্যবস্থা কর।”

নন্দন মশাই বিজ্ঞ মানুষের মতন উপর-নীচ মাথা নাড়ালেন। যেন সে লক্ষ্মীদেবীর প্রস্তাবটাই এতক্ষণ ভাবছিলেন। অলকানন্দা শূন্য চোখে তাকালো পিসির দিকে। ক্ষীণ স্বরে বলল,
“এতক্ষণ তো আমার চুলের দোষ ছিলো, পিসিমা। চুল কেটেছি তবুও বিচার পাবোনা তা তো মানা যায় না।”

লক্ষ্মীদেবী ভ্রু কুঁচকালো এহেন কথায়। সন্দিহান কণ্ঠে বলল,
“তাহলে তুই কি চাস বউ?”

“বিচার করুন। ঠাকুরপো ঘরে স্ত্রী রেখে কোন কারণে আমার ঘরে এসেছিল সেই কৈফিয়ত নিন। তাহলে আপনাদের সংশয় ঘুচবে।”

মনোহর এগিয়ে এলো। ব্যস্ত কণ্ঠে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করার জন্য বলে উঠলো,
“আমি মোটেও আপনার ঘরে যেতে চাইনি বউরাণী। আপনিই তো আমাকে ডাকলেন। কৃষ্ণপ্রিয়াও শুনেছে সে ডাক। তাই না গিন্নী?”

শেষের প্রশ্নখানা সে নিজের স্ত্রী কৃষ্ণপ্রিয়ার দিকে তাকিয়েই করলো। মেয়েটা আকস্মিক প্রশ্নে হতবিহ্বল হলো। চারপাশ হাতড়ে খুঁজে বেড়ালো উত্তর। অথচ শূন্য হাতে তাকে ফিরিয়ে দিয়েছে নিয়তি। সে উত্তর না পেয়ে নিস্তব্ধ চোখে কেবল চেয়ে রইলো।

উত্তর দিলো অলকানন্দা,
“আমি তোমাকে ডাকিনি, ঠাকুরপো। কৃষ্ণপ্রিয়ার মুখই সেই উত্তর দিচ্ছে। মিছে কথা বলার কোনো প্রয়োজনই নেই।”

“ডেকে ছিলে তো দিদি, তুমি.. তুমি তো ডাকলে। ঝড় আসছে তাই ভয় করছে বলে ডাকলে। সেজন্যই তো উঠে এসেছিলেন তিনি।”

বাহিরের ভয়ঙ্কর বজ্রপাতের চেয়েও নির্মম ছিলো কৃষ্ণপ্রিয়ার মিছে এই স্বীকারোক্তি। বিস্ফোরিত নয়নে অলকানন্দা তার জা’র পানে চাইলো। এই একমাসে মেয়েটার সাথে তার দারুণ সক্ষতা গড়ে উঠেছিল। তার বয়সের চেয়ে দু বছরের ছোটো কৃষ্ণপ্রিয়া হয়ে উঠেছিল তার গল্পের ঝুলি। অথচ মেয়েটা কি-না এতটাই স্বামী ভক্ত যে আরেকটা মেয়েকে মুহূর্তেই চরিত্রহীন প্রমাণ করতে এক মুহূর্তও ভাবলো না!

লক্ষ্মীদেবীর মুখে দেখা দিলো আনন্দ উৎসব। সাথে পানকৌড়ি আর মনময়ূরীও বেজায় খুশি হলো। পানকৌড়ি তো বলেই উঠলো,
“বউরাণী! শরীরের এত খিদে, বললেই তো পারতে।”

“বললে কী তুমি তোমার স্বামীকে পাঠাতে শালিকা?”

পানকৌড়ির কথায় হাস্যরসিক ভাবে মারাত্মক উত্তরটা দিলেন মনময়ূরীর স্বামী প্রসাদ। পানকৌড়ির ঠাট্টা যেন মাঠেই মারা গেল। মনময়ূরী নিজের স্বামীকে কিছু বলতেও পারলো না। কারণ মানুষটা বড্ড গম্ভীর এবং রাগী। তার বাড়ির এমন তামাশা যে মানুষটার মোটেও পছন্দ হচ্ছেনা তা সে জানে। তাই তো স্বামীর সামনে দু’টো কটু কথা বলতে চেয়েও বলতে পারলো না।

“তুমি মিথ্যে কথা বলে স্বামীকে লুকাচ্ছো ছোটোজা? তোমার চেয়ে ভালো আর কেউ কী জানে তার চরিত্রের কথা?”

অলকানন্দার প্রশ্নের উত্তর দিলো না কৃষ্ণপ্রিয়া। মাথা নত করে রাখলো কেবল। নন্দন মশাই বিজয়ী হাসি হেসে বললেন,
“তোমার চরিত্র ঠিক করো বউ। তোমার জন্য পুরুষ মানুষ খারাপ হচ্ছে। স্বামী মরেছে, এখন এক মনে ধ্যান করো স্বামীর জন্য। এসব কেচ্ছা কাহিনী করো না।”

অলকানন্দা উত্তর দিলো না সে কথার। ধীর গতিতে এক-পা দু’পা করে এগিয়ে গেলো মনোহরের কাছে। মনোহরের চোখে-মুখে তখনও দেখা মিলেনি অনুশোচনার। সে রাজার ন্যায় গোঁফ গুলো ঘুরচ্ছিল। অলকানন্দা স্থান, কাল, পাত্র বিচার না করেই তার চেয়ে বারো বছরের বড়ো পুরুষটার গালে বসিয়ে দিলো সপাটে চ ড়। একটা চ ড়েই ক্ষান্ত রইলো না সে। পর পর আরও একটা চ ড় বসিয়ে তবেই নিরব হলো।

উপস্থিত সকলে স্তব্ধ হয়ে গেলো মুহূর্তেই। তুমুল বৃষ্টির শব্দ ছাপিয়ে চ ড়ের শব্দটা ভয়াবহ শুনালো। লক্ষ্মীদেবী যে-ই না তেড়ে আসতে নিলেন, অলকানন্দার সামনে ঢাল হয়ে দাঁড়ালো সুরবালা। বিধবার সাদা আস্তরণে ঘেরা শক্ত খোলশের নারীটা থামিয়ে দিলো তার ননাসকে। অতঃপর তার দেবর নন্দন মশাইয়ের দিকে তাকিয়ে রুক্ষ কণ্ঠে বললেন,
“ঠাকুরপো, এই বিচার কার্য এখানেই সমাপ্তি টানলে সকলের মঙ্গল হবে। আশাকরি কি বলতে চেয়েছি বুঝতে পেরেছ?”

“বউ ঠাকুরণ, আপনি আপনার চরিত্রহীনা পুত্রবধূরই পক্ষ ধরছেন!”

“আমি সত্যের পক্ষ ধরছি। আর তুমিও জানো আমার সত্যিটাই রত্ন?”

নন্দন মশাই আর কথা আগানোর সাহস পেলেন না। হাত গুটিয়ে চলে গেলেন নিজের ঘরে। একে একে বিদায় নিলো সকলে। বিশাল ঘরটাতে কেবল দাঁড়িয়ে রইলো অলকানন্দা ও সুরবালা। সকলে প্রস্থান নিতেই শক্ত পাহাড়ের ন্যায় অলকানন্দা ভেঙে পড়লো। শাশুড়ির পা জড়িয়ে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো। বাঁচতে চাওয়ার তুমুল তৃষ্ণা নিয়ে বলল,
“মা, আমি কিন্তু সত্যিই ঠাকুরপোকে ডাকিনি। আমাকে বাঁচান। ওরা বাঁচতে দিবেনা আমায়।”

সুরবালা পুত্রবধূর মুখ চেপে ধরে। শক্ত কণ্ঠে বলে,
“কান্নার শব্দ যেন বাহিরে না যায়। ওদেরকে বুঝতে দেওয়া যাবেনা তোমারও কান্না পায়। তাহলে কিন্তু তোমাকে ওরা আর হাসতে দিবেনা। আর আমি জানি তুমি সত্যি বলছো। মনে রেখো তুমিই সত্যি, তুমিই সুন্দর। আর সত্যির সৌন্দর্যতা তোমার ভেতর আছে যা এ বাড়ির বাকিদের ভেতর তেমন দেখা যায় না।”

_

বিহারিণী মহলটার সাথেই লাগোয়া ঘাট। রাজকীয় সেই ঘাট কারুকার্য শোভিত মনোমুগ্ধকর। সেই ঘাটের শেষ সিঁড়িটায় পা ডুবিয়ে বসে আছে অলকানন্দা। সাদা শাড়িটা কাঁধ গলিয়ে টলটলে জলে ভাসছে। মনে হচ্ছে সাদা পদ্ম! অথচ এই সাদা শাড়িরই এত শক্তি যে একটা নারীর শখের চুল অব্দি বিসর্জন দিতে হয়েছে। মনে হয় যেন জীবিত মানুষের কাফন এ শাড়ি!

অলকানন্দা চোখ বন্ধ করে শ্বাস নিলো। চোখের সামনে ভেসে উঠলো তার বৈবাহিক রঙিন জীবন। রঙিন জীবনটা নাম-ডাকেই রঙিন ছিলো, বাস্তবিক অর্থে সেখানেও ঠাঁই মিলেছিল বিষণ্ণতার। প্রথম যেদিন স্বামীর ঘরে এলো, বাবার নড়বড়ে কুঁড়েঘর রেখে যেন মনে হলো রাজপ্রাসাদে এসেছে। চারপাশে কতো আলোকসজ্জা! সেই আলো দেখেই ভেবেছিল তার জীবন বোধহয় আলোকিত হয়ে গেছে। কিন্তু তার ভাবনা বেশিক্ষণ স্থায়ীত্ব পেলো না। স্বামী তাকে কেবল ভোগ্যবস্তু ছাড়া কিছুই ভাবেনি। সারাদিন নতুন বধূর কোনো খোঁজ না নিলেও রাতে সোহাগের নামে করেছে নির্মমতা। সবটাই মুখ বুজে নিয়েছে সে। কিন্তু তবুও তো সে থাকতে চেয়েছিল সে যন্ত্রণা নিয়েই। কিন্তু ভাগ্য তার বেলাতেই নিষ্ঠুর।

অপরাহ্নের শেষ ভাগ সময়টা। আবারও আবহাওয়া জানান দিচ্ছে বৃষ্টি আসবে বোধহয়। বাড়ির অন্দরমহলে জ্বলে উঠেছে কৃত্রিম আলোর রশ্মি। অলকানন্দার দৃষ্টি স্থির জলের পানে। হঠাৎই তার পিঠে শীতল হাতের ছোঁয়া পেলো। অলকানন্দার শরীর কেঁপে উঠলো অপরিচিত ছোঁয়ায়। সে তড়িৎ গতিতে উঠে দাঁড়ালো। পেছনে ফিরতেই হালাকা আলো আঁধারের রঙ মিশেলে দেখতে পেলো মনোহরের কামুক চেহারাখানা। কী বিশ্রী তার হাসি। অলকানন্দার লতার মতন অঙ্গখানা কেঁপে উঠলো সেই দৃষ্টিতে।

মনোহর অলকানন্দার ডান হাতের বাহুটা শক্ত মুঠে ধরলো। অলকানন্দার বাহু গলে পড়ে থাকা আঁচলে দৃষ্টি দিয়ে মিষ্টি কণ্ঠে বললো,
“বউ ঠাকুরণ, দাদা চলে গিয়েছে তিনদিন তো হলো, তোমার তৃষ্ণা জাগে না সোহাগ পাওয়ার?”

“ঠাকুরপো, তোমার দুঃসাহস দেখে আমি হতভম্ব। সেদিন চ ড়ের কথা ভুলে গিয়েছো?”

অলকানন্দার অগ্নি ঝড়া কথার বিনিময়ে মনোহর শীতল। অলকানন্দার ভিজে আঁচলটা তুলে নিজের নাকের সামনে ধরলো। বেশ জোরে শ্বাস নিলো, যেন আঁচল থেকে নিংড়ে নিলো সকল অমৃত। অলকানন্দা প্রতিবাদ করলো না। মুচকি হেসে জিজ্ঞেস করলো,
“আঁচলে কিসের ঘ্রাণ পাচ্ছো, ঠাকুরপো?”

মনোহর বড্ড অবাক হলো। এত নিবিড় তো অলকানন্দার আচরণ হওয়ার কথা ছিলো না! মনোহরকে চুপ থাকতে দেখে অলকানন্দা আবারও বললো,
“কিসের ঘ্রাণ পেলে ঠাকুরপো? আমার মৃত স্বামীর অস্তিত্বই এই আঁচল জুড়ে। আমার শখের মৃত্যুর শ্মশান এখানে। পাচ্ছো আমার অস্তিত্ব পুড়ে যাওয়ার ঘ্রাণ?”

মনোহর তৎক্ষণাৎ ছেড়ে দিলো আঁচলটা। তন্মধ্যেই ঘাটে উপস্থিত হলো কৃষ্ণপ্রিয়া। আঁচল ছাড়ার দৃশ্য দৃষ্টিগোচর হয়নি তার। তাই তো ভীষণ অবাক কণ্ঠে বললো,
“দিদি! তোমরা! এখানে?”

অলকানন্দার দৃষ্টি শীতল। খিলখিল করে হেসে বললো,
“তোমার স্বামী তো আমার দেহের তৃষ্ণা মেটায়। সেদিন তো তুমিই বললে ভরা সভায়, আমিই তোমার স্বামীকে ডাকি। দোষ না করে দোষের ভাগিদার হলাম তাই ভেবেছি আজ ডেকেই ফেলি। তোমার তো আর সমস্যা নেই তোমার স্বামী কোথায় গেলো না গেলো তা নিয়ে। তাই ভাবলাম আমার তৃষ্ণাও মিটিয়ে ফেলি। কী বলো?”

কথা শেষ করে মনোমুগ্ধকর ভাবে হাসলো অলকানন্দা। সে যেন কোনো গভীর রহস্য! কোমল কিন্তু ভয়ঙ্কর।

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here