অলকানন্দার নির্বাসন পর্ব ২

0
992

#অলকানন্দার_নির্বাসন
#মম_সাহা

২.

‘বিহারিণী মহল’ এ বিচার বসেছে। বিচারের বিষয়বস্তু হলো অভদ্র মেয়েমানুষের চুল কাটা। অন্দরমহলে ছোটোখাটো একটা বৈঠক বসেছে। অন্দরমহলের এক কোণায় দাঁড়িয়ে আছে অলকানন্দা। তাকে নিয়েই এই বৈঠক আয়োজন। বাড়িতে পুরুষ মানুষ বলতে আছে অলকানন্দার কাকা শ্বশুর, খুড়তুতো দেবর, খুড়তুতো ননদদের স্বামীরা এবং তার বাবা। আর বাকিরা সবই মেয়ে। বিচার কার্যে সবচেয়ে অবদান বেশি লক্ষীদেবীর। তিনিই হৈহৈ করে রব তুলেছে বাড়ির বউ ‘বে শ্যা’। নাহয় স্বামী মারা যাওয়ার পরও কারো মনে রঙ থাকে? নিশ্চয় পর পুরুষের সাথে দেহ মিলানোর ধান্দা। রূপ না থাকলে পুরুষ মানুষ কী আর চেখে দেখবে? এমন আরও বিশ্রী বিশ্রী উদাহরণ দেখিয়েই এই বিচার কার্য সাজানো হয়।

অলকানন্দা চুপচাপ। যেন সুউচ্চ হিমালয় দাঁড়িয়ে আছে তার বিশালতা নিয়ে। মুখ খুললেন নন্দন মশাই। আপাতত বাড়িতে বড়ো বলতে সে-ই আছে তাই বিচারের ভার আজ তার কাঁধে। নন্দন মশাই আরাম কেদারা খানায় আয়েশি ভঙ্গিতে হেলান দিয়ে অলকানন্দার দিকে দৃষ্টি ফেলে বললেন,
“তা বউ, তুমি না-কি চুল কাটবে না জানিয়েছ? নিজেকে তুমি কী ভাবো? বিরাট কিছু? নাকি সব তোমার পড়াশোনা জানো বলো অহংকার? নাকি অন্যকিছু?”

শেষের ‘অন্যকিছু’ কথাটা যে ভীষণ বাজে কিছু উল্লেখ করেছে তা বুঝতে বাকি রইলো না কারো। তার উপর কথাটা বলার সময় নন্দন মশাইয়ের ঠোঁটের কোণে ক্ষুধার্থ হাসির এক রেখা দেখা গিয়েছিল। তা গোপন হয়নি অলকানন্দার দৃষ্টিতে। যা তাকে ভেতর থেকে আরেকটু কঠোর করলো। সে শক্ত কণ্ঠে বললো,
“আমি কেবল আমার পছন্দকে মূল্য দিচ্ছি। তাই আমি চুল কাটতে চাচ্ছি না।”

ভরা বৈঠকে মেয়েদের এমন শক্ত কণ্ঠ অবশ্যই বেমানান। পুরুষের গালে তা চ ড়ের ন্যায় লাগে। যা রাগিয়ে দিল নন্দন মশাইকে। সে বিরাট এক ধমক দিয়ে বলল,
“তোমার আবার কিসের পছন্দ হ্যাঁ? স্বামীর জন্য নারীরা সাজে। যেখানে স্বামী মরে গেছে সেখানে তোমার এমন শখের কারণ দেখছি না বউ।”

“কে বলেছে নারীরা স্বামীর জন্যই সবসময় সাজে? কখনো কখনো তারা নিজের জন্যও সাজে। আর আমি তো কেবল আমার চুল গুলোই রাখতে চাচ্ছি যা একান্তই আমার। তাতে এত সমস্যা কিসের কাকামশাই?”

অলকানন্দার কথাটা আগুনে ঘি ঢালার মতন কাজ করলো। তেড়ে এলেন লক্ষীদেবী। বেঠক খানার একদম মাঝামাঝি এসে সে যেন উৎপাত শুরু করলেন। জ্ব ল ন্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে অগ্নিঝড়া কণ্ঠে প্রায় চেঁচিয়ে বলল,
“এটা নিশ্চয় বে শ্যা হবে। অল্প বয়সে স্বামী মরেছে তো শরীরের জ্বালা মেটাতে হবে না, তাই এমন রূপ ধরে রাখতে চাচ্ছে। মা গী মেয়েমানুষ। তোর এত শোয়ার শখ?”

“আপনি তো রূপ ধরে রাখেননি, তবুও তো কত বিছানাতেই….”

বাকি কথা আর সম্পূর্ণ করলো না অলকানন্দা। বরং খিলখিল করে হেসেই বুঝিয়ে দিলো অসম্পূর্ণ বাক্যের বাকি অংশের গীতিকাব্য। সকলে হতভম্ব চোখে তাকিয়ে রইলো অলকানন্দার দিকে। এই মেয়েটা যে এমন জবাব দিতে পারে কেউ কল্পনাতেও বোধহয় ভাবেনি। সুরবালা বিস্ময় ভরা চোখ নিয়ে তাকিয়ে থাকে নিজের সদ্য বিধবা পুত্রবধূর দিকে। এইতো, সেদিন যখন মেয়েটাকে ঘরে তুলে আনলো, চারপাশে তুমুল শঙ্খধ্বনি, উলুধ্বনির শব্দে এক বিশাল আয়োজন যেন। মেয়েটা চোখ তুলে তাকালো না অব্দি। মাথা নত করে একহাত ঘোমটা টেনে কাচুমাচু ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে ছিলো। শুভরাত্রির পরেরদিন মেয়েটা দিন দুনিয়া ভুলে শাশুড়ির কাছে এসে বায়না জুড়লো, তাকে যেন তার বাবার বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হয়। কারণ স্বামীর সোহাগ নামক ব্যাপারটা তার কাছে ভীষণ অদ্ভুত আর যন্ত্রণাদায়ক লেগেছে। এমন সোহাগ তার চাই না। সুরবালা লাজ লজ্জার মাথা খেয়ে অবুঝ পুত্রবধূকে স্বামী সোহাগের তাৎপর্য বুঝালেন, স্বামীর মর্ম বুঝালেন। অথচ সেই অবুঝ মেয়েটা কেমন যেন বুঝদার হয়ে গেলো এক মাসে।

সুরবালার ভাবনার মাঝে খেঁকিয়ে উঠলের নন্দন মশাই। যতই হোক, তার সামনে তার বোনকে কেউ বিশ্রী ইঙ্গিত করলে সে কী আর চুপ থাকবে! লক্ষীদেবী হকচকিয়ে যান। দ্রুত প্রস্থান করেন সেখান থেকে। বৈঠক আয়োজন শেষ হয়ে যায়। বিচার কার্য সম্পন্ন হয়না। অলকানন্দার বাবা এগিয়ে এলেন। মেয়ের দিকে অগ্নি দৃষ্টি ফেলে ভয়ঙ্কর রকম ধমকে বললেন,
“শোন নন্দু, স্বামী মারা গেছে, বেধবা হইছিস, কথা হজম করতে শেখ।”

“বাবা, বিধবাই তো হয়েছি তাহলে মানুষ বে শ্যা বললে সে দায়ও কী মাথা পেতে নিবো? মুখের কালি ধুয়ে ফেলা যায়। চরিত্রে কালি লাগলে কী উপায়ে তা উঠাবো বলো?”

“তোকে কিন্তু তোর বাপের ভিটেতে ফেরত নেওয়া হবে না। ঘরে তোর আরও দুইটা বিয়ের উপযুক্ত বোন আছে, সে কথা ভুলে গেলে চলবে না। একে তো বিয়ের এক মাসের মাথায় স্বামীটা গেলো তার উপর তোর এমন বেহায়াপনার কথা শুনলে তোর বোন গুলার বিয়ে দেবো কীভাবে আমি? বেধবা মেয়েছেলের জন্য আমার ঘরের দোর বন্ধ। অলক্ষী মেয়েমানুষ।”

কথা শেষ করেই ভদ্রলোক বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান। অলকানন্দা বাবার যাওয়ার পানে তাকিয়ে রইলো। কারো মৃত্যু কী কারো হাতে লিখা থাকে? অথচ তার স্বামীর মৃত্যুর জন্য পুরো সমাজ তাকে দায়ী করছে।

সুরবালা এগিয়ে এলেন। পুত্রবধূর পিঠে হাত রেখে গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,
“তোমাকে চুল কাটতে হবেনা। আমার ছেলে মারা গেছে তাই বলে তোমার শখ তো আর গলা টিপে মারতে পারিনা।”

অলকানন্দা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে শাশুড়ির দিকে। বিয়ের পর শাশুড়ি তাকে দিয়ে মাছ কাটিয়েছে। অলকানন্দা মাছ কাটতে পটু ছিলো না তবুও ধমকে কাটিয়েছে মাছ। রান্না করিয়েছে। হাত পুড়ে গিয়েছে বলে দু চার কথাও শুনাতে ভুলেননি। অথচ সে মানুষ আজ হৃদয় পুড়ছে বলে মলম লেপে দিচ্ছে যেখানে নিজের বাবা অব্দি পুড়ানোর কাজ করেছে!

_

সময়টা ঠিক গভীর রাত। দূর হতে বন্যপ্রাণীর গা ছমছমে ডাক রাতের বুকে কেমন রহস্যপট সৃষ্টি করছে! অলকানন্দা ছোটো, অগোছালো কাছারি ঘরটায় মাটিতে শুয়ে আছে। খিদেয় পেট মুচড়ে আসছে। মাটি থেকে ঠান্ডা উঠছে। অলকানন্দা গুটিশুটি মেরে শুয়ে আছে সেই ঠান্ডা ঘরটায়। পুরোপুরি ঘুমটা যখন লেগে এলো ভীষণ বিশ্রী রকমের একটা অনুভূতি হলো শরীর জুড়ে। ঘনিষ্ঠ এক অনুভূতি। অলকানন্দার ঘুমিয়ে থাকা মস্তিষ্ক সজাগ হয়ে উঠলো। এমন ঘনিষ্ঠ অনুভূতি সুদর্শন বেঁচে থাকাকালীন হতো। কিন্তু মানুষটা তো আর নেই, তবে এমন ছোঁয়া কার? তৎক্ষণাৎ চোখ খুলে ফেলল সে। চোখের সামনে আবছা আলোয় ভেসে উঠলো তার খুড়তুতো দেবর মনোহরের কামুক চেহারাটা।

অলকানন্দা দ্রুতগতিতে উঠে বসে। অবাক কণ্ঠে বলে,
“ঠাকুরপো, তুমি আমাকে এভাবে ছুঁয়েছো!”

মনোহর ক্ষুধার্থ বাঘের ন্যায় জাপটে ধরলো অলকানন্দাকে। যেন বহুদিন পর মনমতো শিকার করতে পারবে। অলকানন্দা তাজ্জব, ভীত। ঠিক এই সময়ে কেমন প্রতিক্রিয়া করা উচিৎ তা ভুলে গেছে অলকানন্দা। মনোহর ততক্ষণে হাত রেখেছে মেয়েটার আঁচলে। অলকানন্দার সম্বিত ফিরে এলো। তৎক্ষণাৎ সে চিৎকার দিয়ে উঠলো। মনোহর ভাবতেই পারেনি অলকানন্দা এত জোরে চিৎকার দিবে। ভেবেছিলো বিধবা হওয়ার সাথে সাথে হয়তো কণ্ঠ উঁচু করার ক্ষমতাও হারিয়েছে। অথচ মনোহরের ভাবনাটাকে মেয়েটা মুহূর্তেই মিছে করে দিয়েছে।

ঘুমিয়ে থাকা বাড়িটা মুহূর্তেই সজাগ হয়ে উঠলো। চারপাশে জ্বলে উঠলো কৃত্রিম আলোর রশ্মি। সকলে ছুটে এলো চিৎকারের আত্মকাহিনী জানতে। মনোহরের হাতে অলকানন্দার সাদা ধবধবে শাড়ির আঁচলটা। সকলের চক্ষু ছানাবড়া। রাত-বিরেতে এমন দৃশ্য দেখতে হবে কল্পনাও করেনি কেউ।

সুরবালা ছুটে এলো, মনোহরের হাত ঝাড়া দিয়ে ছাড়িয়ে নেয় শাড়ির আঁচল খানা। মনোহরের স্ত্রী কৃষ্ণপ্রিয়া নিজের স্বামীর দিকে তাকিয়ে থাকে মৃ ত চোখে। পুরুষের চরিত্র নারী দেখলেই বোধহয় গলে যাওয়া!

লক্ষীদেবী যেন মোক্ষম সুযোগটা পেলো। ছিঃ ছিঃ করে একদলা থুথু নিক্ষেপ করলো মাটিতে। যেন অলকানন্দার চরিত্র এটারই যোগ্য। অলকানন্দার চোখ জুড়ে উপচে আসে অশ্রুর স্রোত। শাশুড়ির গলা জড়িয়ে নবজাতক শিশুর ন্যায় অভিযোগ করে বলে,
“ও আমার সাথে খারাপ কাজ করেছে, মা। ও বাজে ভাবে আমার গায়ে ধরেছে।”

সুরবালা নিজের সন্তানের ন্যায় দেবরের ছেলের দিকে তাকিয়ে থাকে। ছেলেটার চরিত্র একদম বাপের মতন হয়েছে। বাপেরও যেমন এই বয়সে ছুঁকছুঁক স্বভাব ছেলেটারও তা-ই।

সুরবালা কিছু বলার আগে হামলে পড়ে লক্ষীদেবী। মুখ ঝামটি মেরে বলে,
“আমার ভাইপোর তো খেয়েদেয়ে কাজ নেই রাত বিরাতে সধবা বউ ফেলে বেধবার কাছে আসবে। নিশ্চয় তুই ডেকেছিস, বউ। এই জন্যই তো চুল কাটতে চাসনি, রূপ ধরে রেখেছিস। পুরুষ মানুষকে সুযোগ দিয়েছিস তাই এসেছে। এখন অত ন্যাকামো করছিস কেন, বাছা?”

নারী হয়েও পিসি মা’র এহেন কথা নিত্যান্তই হাস্যকর। একজন নারী কত সহজেই আরেকজন নারীর গায়ে কালি ছেঁটা করছে! অলকানন্দা বিস্মিত ভঙ্গিতে তাকালো পিসি মা’র দিকে। অবাক কণ্ঠে বলল,
“আজ চুল কাটিনি বলে আমার সাথে ঠাকুরপো’র করা অন্যায়ের বিচার হবেনা পিসিমা?”

“না বউ, হবেনা।”

মনোহর বিজয়ী ভঙ্গিতে বাঁকা হাসলেন। যেন কোনো রাজ্য জয় করে এসেছে। কৃষ্ণপ্রিয়া স্বামীর সে হাসির দিকে তাকায় ঘৃণাভরা দৃষ্টি নিয়ে। একজন মানুষকে ঠিক কতটা ঘৃণা করা উচিৎ তা জানা নেই ওর। কিন্তু ও পৃথিবী সমান ঘৃণা ঢেলে দিয়েছে স্বামীর নামে। একজন স্ত্রীই জানে তার স্বামীর চরিত্র কেমন।

সুরবালাও কিছু বলতে পারলেন না। কিছু বললে, হৈচৈ হলে ঘরের কথা বাহিরে যাবে। বদনামটা লেখা হবে বিধবা মেয়েটার নামেই। কারণ এই মাটিটা নরম। আর মানুষ নরম মাটি খামচে ধরতে পছন্দ করে।

অলকানন্দা শাশুড়ির পানে তাকায় বিচারের আশায় অথচ মানুষটা নির্জীব। অলকানন্দার ভেতর কেমন কঠোর একটা সত্তা জেগে উঠে। নরম, কোমল মেয়েটা কঠোর হয়ে উঠে নিমিষেই। কেমন শক্ত কণ্ঠে আবার জিজ্ঞেস করে,
“ঠাকুরপো’র বিচার হবেনা, তাই তো পিসিমা?”

“না।” লক্ষীদেবীর তৎক্ষণাৎ উত্তর।

লক্ষীদেবীর উত্তর দিতে দেরি, অলকানন্দা ছুটে বেড়ালো ঘর জুড়ে। কেউ কিছু বুঝে উঠার আগেই কোথা থেকে একটা মাঝারি আকারের কেঁচি এনে কেটে ফেললো গভীর রহস্য মাখা বিরাট চুলের গোছাটা। ঘাড় অব্দি চলে এলো অসম্ভব সুন্দর সেই চুল গুলো। যেই চুলের ভাঁজে একসময় মুগ্ধ হতো কতশত পুরুষ এমনকি নারীও, সে চুল আজ ভীষণ অবহেলায় গড়াগড়ি খাচ্ছে মাটিতে। সবাই হতভম্ব দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো মেয়েটার দিকে।

সব গুলো চুল ঘাড় অব্দি করে শান্ত হলো মেয়েটা। দূরে ছুঁড়ে মারলো হাতের ধারালো কেঁচিটা। যা মাটিতে পড়ে বিরাট শব্দ তুললো। অলকানন্দার চোখে তখন আগুন ঝরে পড়ছে। পিসিমা’র দিকে র ক্তচক্ষু নিয়ে তাকালো। কণ্ঠ প্রয়োজনের তুলনায় শীতল করে বললো,
“এবার বিচার হবে তো, পিসিমা?”

লক্ষীদেবীর গলা যেন শুকিয়ে এলো। অলকানন্দার শীতল কণ্ঠ কাঁপিয়ে দিলো তার শিকড়। ভুল করেও মুখ ফুটে সে ‘না’ শব্দটা উচ্চারণ করতে পারলো না।

#চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here