অলকানন্দার নির্বাসন পর্ব ২৬

0
585

#অলকানন্দার_নির্বাসন
#মম_সাহা

২৬.
হেমন্তের সমীরণে পাকা ধানের সুঘ্রাণ ভেসে আসছে। কৃষকদের তৃপ্তির হাসির আনন্দ যেন আকাশ জুড়ে। ঝলমলে তারাদের বসেছে মহোৎসব। কৃষদের ক্ষুধার্থ গৃহে যে লক্ষ্মী তার দু’হাত ভরে দান করেছে এবার। আর কয়েকদিন, তারপর চলবে ক্ষেত থেকে ধান উঠানোর মেলা। তা দিয়ে আবার নবান্ন উৎসব। ইংরেজদের নিল চাষ করতে গিয়ে যেখানে কৃষকদের জমি হারিয়েছে উর্বরতা সেখানে এ বছর দারুণ ফলনে কৃষক শ্রেণি আনন্দিত। বহুদিন পেট ভরে খাওয়া হয়নি। এইবার বোধহয় তৃপ্তি করে অন্তত খাওয়া যাবে।

অলকানন্দা সেই আনন্দ প্রকৃতিতে এক ধ্যানে তাকিয়ে আছে। স্নান করে এসেছে বিধায় চুল ভিজে সেখান থেকে ভোরের শিশির বিন্দুর ন্যায় জল গড়িয়ে পড়ছে। বাড়ির ভেতরের এত উচ্চশব্দের গান বাজনাটা তার কাছে অসহ্যকর ঠেকছে। তার স্বামী সুদর্শনও এসবে আসক্ত ছিল কিন্তু সেটা হতো তাদের কাছারি ঘরে। এখানে তো নিজেদের মহলেই এসব হচ্ছে। অলকানন্দা বিরক্ত হলো। স্টিফেনের মা কী শুনেনা এসব! উনিও কী কিছু বলে না?

অলকানন্দা ভেজা মাথায় ঘোমটা টানলো, দারুণ সজ্জিত সিঁড়ি গুলো অতিক্রম করে প্রথমে কাদম্বরী দেবী- স্টিফেনের মায়ের রুমে যেতে চাইলেও কি ভেবে যেন দাঁড়িয়ে গেল। সে সিঁড়ি বেয়ে নিচে না গিয়ে উপরের দিকে ওঠা শুরু করল। কয়েক ধাপ সিঁড়ি পেরুতেই বাড়ির ছাঁদ দৃষ্টিগোচর হলো। ভীষণ সুন্দর একটি ছাদ। সিমেন্ট এবং রঙিন পাথর দিয়ে নকশা করা ছাঁদটাকে বিশাল মাঠের মতন মনে হলো। তার এক কোণায় আরেকটি তালাবদ্ধ কক্ষও আছে, অন্ধকারে চাঁদের জোছনায় যতটুকু বুঝা গেল।

অলকানন্দার অবসাদগ্রস্ত মন এত সুন্দর জায়গাটা পেয়ে বোধহয় উৎফুল্ল হলো। সে উঠে গেল ছাঁদে। খালি পদযুগল ফেলে ছাঁদের দক্ষিণ দিকটায় গেলো। চাঁদ সেখানে হেলে পড়েছে রূপোর থালার ন্যায়। বড়ো বড়ো তালগাছ ছাপিয়ে কেমন মিঠে আকাশের দোলাচল। মুক্ত বাতাসে ভারী মনটা মুহূর্তেই শীতল হয়ে গেলো। সে চোখ বন্ধ করে এই সুন্দর প্রকৃতি অনুভব করা আরম্ভ করল। তার এই শীতলতা বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না। ছাঁদের কোল থেকে ভেসে এলো শ্রুতিমধুর কণ্ঠ। কী সুন্দর! মিহি সুরে কেউ গাইছে রবীন্দ্র সংগীত,

“যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে
আমি বাইব না..
আমি বাইব না মোর খেয়াতরী এই ঘাটে গো,
যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে।
চুকিয়ে দেব বেচা কেনা, মিটিয়ে দেব গো…
মিটিয়ে দেব লেনা দেনা
বন্ধ হবে আনাগোনা এই ঘাটে,
তখন আমায় নাইবা মনে রাখলে
তারার পানে চেয়ে চেয়ে,
নাইবা আমায় ডাকলে……

অলকানন্দা যেন মোহগ্রস্ত হয়ে গেলো মুহূর্তেই। এত মায়া মাখা কণ্ঠ, এত লুকায়িত করুণ আকুতি নিয়ে গাইছে কে! কার কণ্ঠে বিধাতা তার সকল আশীর্বাদ ঢেলে দিয়েছে? কার হৃদয়ে বিধাতা ঢেলেছে এত বিষাদ! কার বিরহে এই নারীর কণ্ঠে এত হাহাকার? কোন হতভাগা পুরুষ এই মায়াবী নারী কণ্ঠ উপেক্ষা করে চলে যেতে পেরেছিল? অলকানন্দার চঞ্চল মস্তিষ্ক বিমুগ্ধ, চিত্ত স্থির হয়ে গেল নিমিষেই।

এই মুগ্ধ পরিবেশ কেমন বিষাদময় ঠেকল নন্দার কাছে। তারপর, থেমে গেল গানটা। থেমে গেল সকল মুগ্ধতা, সকল বিরহ। কেটে গেল ঘোর। নন্দা চারপাশে তাকাতে লাগল। বারংবার তাকাল। কই, কেউ তো নেই, তবে কে গাইলো এমন মহা গীতি! কে ছড়ালো এমন বিমোহিত সমীরণ! অলকানন্দা চারপাশে তাকাতে থাকল। যখন সে এই মেয়েলী মিঠে স্বর শোনার জন্য মরিয়া হয়ে উঠলো, ঠিক তখনই তার চোখ গেল ছাঁদের কোণার সেই ঘরটাতে। বাহির থেকে যাকে দারুণ দেখাচ্ছে। এ ঘর থেকেই কী কেউ গাইলো? এত সুন্দর করে! এত রাতে কেই-বা এই ঘরে আসবে? কেনই বা আসবে! তাছাড়া বাহিরে তালাবদ্ধ অবস্থায় ভেতরে কেইবা থাকবে?

অলকানন্দার মনে প্রশ্নের স্তূপ অথচ সবগুলো প্রশ্নই উত্তর বিহীন ক্ষণে ক্ষণে ছটফট ছটফট করছে। অলকানন্দা এগিয়ে গেল ধীর পায়ে। তার নুপুর তখন সুর তুলেছে মিহি, আকর্ষণীয়। সে দরজার কাছটাতে গিয়ে দাঁড়াল। কোনো শব্দ নেই সেখানে। দূর হতে ভেসে আসছে খেঁকশিয়ালের হাঁক। রাত হলেই এদের ডাক বেড়ে যায়। কিছুদিন আগেও একজন মানুষকে এরা ছিঁড়ে খেয়েছে। এত ভয়ঙ্কর প্রাণী। বাড়ির পাশের বিরাট বটগাছ যেন জ্যোৎস্নার আলোয় খেলছে অশরীরী খেলা। কেমন লোমকূপ দাঁড়িয়ে যায় গাছটার দিকে তাকালেই! মনেহয় কে যেন দু’হাত বাড়িয়ে আহ্বান জানাচ্ছে। অলকানন্দার শরীর শিরশির করে উঠছে। এতক্ষণ ভয় না পেলেও এখন সে ভয় পাচ্ছে। পায়ে দেখা দিয়েছে মৃদু কম্পন। বাড়ির প্রাচীর ঘিরে ভয়েরা কেমন হামাগুড়ি দিয়ে পড়ছে। অলকানন্দার শরীরে বাতাস গুলোও অসহ্যকর লাগছে। সে ভয়ার্ত চোখে আশা পাশে চোখ বুলাতেই খেয়াল করল ঘরটার ডানদিকে একটি কাঠের জানালা খোলা অবস্থায় আছে। অলকানন্দার ভীত মনে কৌতূহলের পরিমাণ বাড়ল। নিশ্চয় জানালা দিয়ে ঘরের ভেতরের অবস্থান বুঝা যাবে। এক বুক আশা নিয়ে সে জানালাটার সামনে যায়। জানালা ভেদ করে ভেতরে দৃষ্টি রাখতেই দেখে ঘরের এক কোণায় প্রদীপ জ্বলছে নিভু নিভু আলোয়। কিন্তু সে আলো বড়োই দুর্বল পুরো ঘরকে আলোকিত করতে। অলকানন্দা বেশ গাঢ় দৃষ্টিতে এদিক-ওদিক চাইলো। কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলল,

“কে আছো?”

অপর পাশ থেকে কোনো উত্তর এলো না। বাতাসের ঝাপটায় দুর্বল প্রদীপটা ক্ষানিক কেঁপে উঠল বোধহয়। অলকানন্দা আবার ডাকল,

“কেউ আছো?”

বিপরীত দিক তবুও নীরব। অলকানন্দার হৃদপিন্ডের গতি অস্বাভাবিক। হাত-পাও কাঁপছে আগের তুলনায় বেশি। তার মনে হলো তার পেছনে কেউ দাঁড়িয়ে আছে, এই বুঝি কেউ তাকে ধরে ফেলল। মনের এই আকুলিবিকুলি ভয়কে প্রাধান্য দিয়েই সে পিছু ঘুরল। না, তেমন কেউ তো নেই। অলকানন্দার ভ্রু কুঁচকে এলো। মনের ভ্রান্তি ভেবে যেই আবার জানালায় দৃষ্টি দিল ঠিক তখনই ভেতর থেকে একজন আচমকা নন্দার সামনে এসে খিলখিল করে হেসে উঠল। নন্দা তৎক্ষণাৎ চমকে গেল। দৃষ্টির মাঝে ঘোলা হয়ে উঠল সেই অদ্ভুত মুখশ্রী। কপালে সিঁদুরের বড়ো ফোঁটা আঁকানো, মাঝ সিঁথিতে ভরাট করে সিঁদুর লেপা, শরীরে চকচকে শাড়ি ও ঝলমলে গহনা। অলকানন্দা দু কদম ছিটকে পেছনে চলে গেলো। চিৎকার করতে গিয়েও বেশ জোর করেই নিজের হাত দিয়ে নিজের মুখ চেপে ধরল। তার পা কাঁপছে। মৃদু কম্পন ধারণ করেছে ভয়াবহ রূপ। সে দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না আর। ছাঁদের মেঝেতেই বসে পড়ল। শরীর থেকে অস্বাভাবিক ভাবে ঘাম বেয়ে পড়ছে শিরদাঁড়া দিয়ে। অপ্রত্যাশিত উত্তেজনায় তার হৃৎপিণ্ডের কম্পন যেন আকাশ ছুঁয়েছে। সে ঘন ঘন শ্বাস নিতে লাগল। মনে হচ্ছে কেউ যেন তার শ্বাসনালী ধরে রেখেছে। শ্বাস নিতেও সে কী কষ্ট! তার এই ভীত, উন্মাদিত শরীরটা যখন ভয়ে কাহিল ঠিক তখন আবারও মেয়েলি রিনরিনে হাসি ভেসে এলো। সাথে মিষ্টি স্বরের কণ্ঠ,

“ভয় পেয়েছিস নাকি?”

অলকানন্দা চমকালো। এই মেয়েলি কণ্ঠে কিছুতো একটা আছেই, নাহয় এত শ্রুতিমধুর শোনাবে কেন? সে চোখ ঘুরিয়ে আবারও দৃষ্টি রাখল বন্ধ ঘরের মুক্ত জানালার দিকে। অপরিচিত মিষ্টি মেয়েটা হাসছে। অবশ্য পুরোপুরি অপরিচিত নয় এই মুখমন্ডল। যেদিন প্রথম সে এই বাড়িতে এলো, সেইদিনই এই নারীর সাথে তার ভয়ঙ্কর সাক্ষাৎ পর্ব সমাপ্ত হয়েছিল। এরপর আর দেখেনি তাকে। সেদিনের মুখমন্ডলে যেই হিংস্রতাটা ছিল আজ তার ছিটেফোঁটাও নেই। নন্দা এবার বসা থেকে উঠে দাঁড়াল। কিছুটা ভয়, সংকোচ নিয়েই মেয়েটার কাছে গেল। মেয়েটা জানালা দিয়ে হাত বাড়িয়ে আছে। অলকানন্দা সামনে যেতেই মেয়েটা নিজের দু’হাতের আদলে অলকানন্দার মুখটা নেয়। হাসি হাসি কণ্ঠে বলে,

“তুই তো ভীষণ সুন্দর! ”

অলকানন্দা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। অস্ফুটস্বরে বলে,

“তুমিও তো ভারী মিষ্টি!”

“তাই? অনেক মিষ্টি রে আমি?”

অলকানন্দা মাথা নাড়ায়। ধীর স্বরে জবাব দেয়,

“সত্যিই অনেক মিষ্টি।”

মেয়েটা আবার হাসে। মেয়েটার বোধহয় কারণে-অকারণে হাসার অভ্যাস। হাসলে তাকে দারুণ লাগে অবশ্য। এই কথা বোধহয় এই নারী জানে, তাই মুগ্ধতা ছড়াতেই বুঝি সে এমন কিশোরীর ন্যায় হাসতে থাকে।

“তোর নাম কী রে?”

মেয়েটার প্রশ্নে নন্দা মিহি স্বরে উত্তর দেয়,

“অলকানন্দা। তুমি তো বিহারিণী?”

অলকানন্দা নাম জিজ্ঞেস করতেই মেয়েটা নন্দার মুখ চেপে ধরে। হুশিয়ারি কণ্ঠে বলে,

“চুপ, চুপ। কেউ যেন না শুনতে পায়।”

নন্দা মাথা নাড়ায়। ফিসফিসিয়ে বলে,

”আচ্ছা, শুনবে না।”

“আমাকে এখান থেকে বের কর না, পুষ্প।”

মেয়েটার এমন সম্বোধনে অবাক হয় নন্দা, সেই বিস্মিত ভাব কণ্ঠেও ধরে রেখে শুধায়,

“পুষ্প কেন ডাকছো? আমার নাম তো অলকানন্দা।”

মেয়েটা বোধহয় ভারী মজা পায় নন্দার এমন বোকা প্রশ্নে। তাই তো সে হেসে হয় খু ন। হাসতে হাসতে বলে,

“তুই কী জানিস না? অলকানন্দা হলো একটি ফুলের নাম। যে ফুল সচারাচর পাওয়া যায় না। তবে নামের মতন তত সুন্দর না ফুলটা কিন্তু তুই তোর নামের মতনই সুন্দর। যেহেতু তোর নাম ফুলের নামের সাথে মিলিয়ে রাখা তাই তোকে আমি পুষ্প ডাকবো। তুই জানিস নে? পুষ্প- ফুলেরই আরেকটা মৈত্রীয় শব্দ।”

অলকানন্দার অবাকের সীমা বাড়ে। মেয়েটাকে দেখে যদিও মনে হয় মানসিক ভারসাম্যহীন কিন্তু অত্যন্ত বুদ্ধিমতী এই নারী। কথাবার্তায় শিক্ষিতের ছোঁয়া। নিশ্চয় সে পড়াশোনা জানা। এমন একটা মেয়ের এ দশার কারণ কী? আর তার নামের সাথে বিহারিণী মহলেরই বা এত মিল কেন? জিজ্ঞেস করবে কী মেয়েটাকে? পরে যদি মেয়েটা আবার রেগে যায়! নন্দা জিজ্ঞেস করতে গিয়েও থেমে যায়। সে বুঝতে পারছে, মেয়েটার সাথে ভাব জমালেই বোধহয় সব প্রশ্নের উত্তর পাবে। ভাবনা অনুযায়ীই সে ভাব জমানো শুরু করে। নানান রকমের কথাবার্তা বলে। কথা বলতে গিয়ে নন্দা অনুভব করে যে, মেয়েটা অনেক কিছু সম্পর্কে অবগত। এমনকি রবী ঠাকুরের এত দারুণ দারুণ গান সে জানে! বিভিন্ন উপন্যাসের নামও বলে দিচ্ছে অকপটে।

_

হেমন্তের আকাশে উড়ে বেড়াচ্ছে কয়েক ঝাঁক খন্ড-বিখন্ড মেঘের দল। মনে হচ্ছে সাদা তুলো। পাখিদের কিচিরমিচির শব্দে প্রকৃতি মুখরিত। নন্দা তৈরী হয়েছে কলেজ যাওয়ার উদ্দেশ্যে। রাতে অনেক দেরি করে ঘুমানোর ফলে তার চোখ জ্বালা করছে। মাথাটাও যন্ত্রণায় ভার হয়ে আছে। তবে, এত খারাপের মাঝে একটা ভালো হয়েছে, স্টিফেন নামক লোকটা কাল ঘরে আসেনি। নন্দা বেশ স্বস্তি নিয়েই ঘুমুতে পেরেছে। লোকটার সান্নিধ্য তার পছন্দ নয়। কেমন অস্বস্তি লাগে! এতদিন একসাথে থেকেও অপরিচিত লাগে মানুষটাকে। মনেহয় তাকে নন্দার জানা হয়নি আদৌও। একটা অপরিচিত মানুষ সে। একই বাড়িতে থেকেই দু’জন দুই প্রান্তের মানুষ।

নন্দার ভাবনার মাঝে তার কক্ষে উপস্থিত হয় কাদম্বরী দেবী। মহিলার মুখে সুপরিচিত মিষ্টি হাসি। এসেই নন্দার মাথায় হাত বুলিয়ে আন্তরিকতার সঙ্গে শুধায়,

“ভালো আছো, মা?”

নন্দা তাকায় মহিলাটার দিকে। কালো রঙের এই নারীকে হাসলে ফর্সা রঙের মানুষের থেকেও বেশি সুন্দর দেখায়। টান টান চোখ-মুখ। তবে গায়ের রঙের জন্য তার এই অকৃত্রিম সৌন্দর্য প্রকাশ পেতে পারেনি। সমাজের প্রচলিত নিয়মই তো এটা, গায়ের রঙ দুধে-আলতা না হলে সেই মানুষটাকে কিংবা তার আর কোনো অঙ্গভঙ্গিকেই সুন্দরের আওতায় আনা যাবে না। তার সব সুন্দর কেবল কালো রঙের জন্য অসুন্দর নামক স্বীকৃতি পাবে।

নন্দাকে চুপ থাকতে দেখে কাদম্বরী দেবীই বলল,

“তোমাকে ভীষণ মনে পড়েছে, জানো?”

নন্দা ভ্রু কুঁচকায়। অবাক কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,

“মনে পড়েছে!”

“হ্যাঁ, কয়েকদিন যাবত তোমাদের দেখিনা, মনে পড়বে না?”

নন্দা যেন মহিলার কথার আগাগোড়া খুঁজে পায় না। চোখে-মুখে তার সেই ভাব স্পষ্ট। তা দেখে হাসেন কাদম্বরী দেবী। বলেন,

“কয়েকদিন যাবত আমি তো বাড়িতে ছিলাম না, জানো না নিশ্চয় সেটা?”

নন্দা বিস্মিত হয়। হতভম্ব কণ্ঠে বলে,

“আপনি বাড়ি ছিলেন না!”

“না। একটু তীর্থক্ষেত্র দর্শন করতে বের হয়ে ছিলাম। তুমি জানতে না?”

মহিলার প্রশ্নে নন্দা ডানে-বামে মাথা নাড়ায়, অস্ফুটস্বরে বলে,
“না।”

“জানতে হবে তো সংসারের খবর তাই না? বিয়ে তো হয়েছেই, এবার কষ্ট করে নাহয় মানিয়ে নিলে। আমার ছেলে নিশ্চয় ততটাও খারাপ না।”

মহিলার কথায় নন্দা ভেতরটা তাচ্ছিল্য করে উঠল। উনার ছেলে খারাপ না! তাই বলেই কী কাল সারারাত বাইজিদের সাথে পড়ে ছিল! কিন্তু মুখ ফুটে সে আর কথাটা বলেনা। মহিলাটি আন্তরিক, তার ছেলের জন্য এই নারীকে মোটেও শক্ত কথা বলা তার সাজে না। বেমানান লাগবে।

_

নন্দা কলেজ যাওয়ার জন্য বাড়ি থেকে বের হলেও শেষ পর্যন্ত সে কলেজ গেল না। গেল নিজের আগের শ্বশুর বাড়ি- বিহারিণী মহলে। বাড়ির গেইটে পা রাখতেই তার শরীরে শীতল স্রোত বয়ে গেল। এত সাহস নিয়ে তো চলে এসেছে এখানে কিন্তু আদৌও কী উচিত কাজ হয়েছে! নিশ্চয় বাড়ির মানুষ তার সাথে বাজে ব্যবহার করবে!

নন্দা তবুও সাহস করে পা বাড়ায়। অন্দরমহলে ঢুকতেই বাড়ির কর্মচারীদের চোখে পড়ে সে। তারপর কর্মচারীরাই খবর পাঠায় সবাইকে। মিনিট কয়েক পেরুতেই বাড়ির সকলে এসেই উপস্থিত হয়ে গেলো। সবার চোখে মুখেই অবাক ভাব। বিস্মিত নয়ন যুগল। নন্দা এগিয়ে যায় সুরবালার দিকে। মানুষটার মুখশ্রী শুকিয়ে গিয়েছে। অলকানন্দা মাথা নত করে প্রণাম করে। সুরবালা দেবীর মুখশ্রী আগের মতনই কঠোর। নন্দা তা দেখে শুধায়,

“আশীর্বাদও করবেন না, মা?”

সুরবালা দেবী মুখ ঘুরায়, শক্ত কণ্ঠে বলে,

“বেঁচে থাকো, আশীর্বাদ করি, স্বামী সোহাগি হও।”

“বেঁচে থাকবো! যেখানে মৃত্যুর পথে আমাকে একা ফেলে চলে এসেছিলেন, সেখানে বেঁচে থাকার আশীর্বাদটা হাস্যকর হলো না, মা?”

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here