#অলকানন্দার_নির্বাসন
#মম_সাহা
২৩.
বাতায়নের কোল ঘেঁষে উঁকি দিয়েছে চাঁদ। সন্ধ্যার চাদর জড়ানো আকাশ এখন আঁধারে নিমজ্জিত হয়েছে। অলকানন্দা বসে আছে তার জানালার ধারে। চাঁদের আলো নিবিড় ওষ্ঠে চুম্বন এঁকে দিচ্ছে তার নাকে-মুখে। ছোটো ছোটো ঘাড় অব্দি চুল গুলো উড়ছে নিজের মন মতো। চাঁদের কিরণের সংস্পর্শে এসে শরীরের গহনা গুলো ঝলমল করে উঠছে। গভীর ভাবনায় মগ্ন অলকানন্দা। লক্ষ্মীদেবীর মৃত দেহ দেখে সে আর এক মুহূর্ত দাঁড়ায়নি বিহারিণী মহলে। যেমন দ্রুত গিয়েছিল ঠিক তেমন ভাবেই চলে এসেছিল। স্টিফেনও জোর করেনি। বরং অলকানন্দার সিদ্ধান্তকে সে নিবিড় ভাবে সম্মতি প্রদান করেছিল। কিন্তু লক্ষ্মীদেবীর বিয়োগ ব্যাথা বড়ো কষ্ট দিয়েছে অলকানন্দাকে। খারাপ হোক, ভালো হোক সে তো মানুষটাকে আপন ভেবেছিল।
আনমনে যখন গভীর ভাবনায় ব্যস্ত সে, তার নজর হুট করে জানালার বাহিরে যেতেই সে ভ্রু কুঞ্চিত করল। ভরা পূর্ণিমায় খুব পরিচিত মুখমন্ডল দৃষ্টিগোচর হতেই সে চমকে উঠল। সে আরও গভীর ভাবে খেয়াল করতেই দেখল যে তার দৃষ্টি ভ্রম দেখছে না, সত্যিই পরিচিত মুখ ওটা। অলকানন্দার বুক কেঁপে ওঠে। স্টিফেন লোকটাকে যতটুকু ধারণা করা যায়, লোকটা খুবই নিষ্ঠুর। যদি নবনীলকে এখানে একবার দেখতে পায় তবে তো হয়তো তাকে জীবিত রাখবে না। লোকটার মনেপ্রাণে কোনো মায়া নেই।
অলকানন্দা দ্রুত উঠে দাঁড়াল। সাবধানী চোখে আশপাশে তাকিয়ে খুব ধীরে বেরিয়ে গেল ঘর ছেড়ে। কর্মচারীর কেউ কেউ আড় দৃষ্টিতে দেখে নিয়েছে তাকে। কিন্তু সেদিকে হুঁশ নেই মেয়েটার। সে যেন নবনীলকে আড়াল করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠল।
বড়ো লোহার দ্বার ধরে দাঁড়িয়ে আছে দুটো প্রহরী। কোনো নড়চড় নেই, কথা নেই। স্তব্ধ যেন! অলকানন্দা বের হতে নিলেই তারা প্রথম কথা বলে,
“সাহেব বধূ, আপনি এত রাতে কোথায় যাচ্ছেন?”
অলকানন্দার ভীতু হৃদয় আরেকটু কেঁপে ওঠল। আমতা-আমতা করে খুব সাজিয়ে মিথ্যে কথা বলল,
“আপনাদের সাহেব আমাকে যেতে বলেছিল এই সময়ে চন্দ্রমল্লিকার মাঠে। কিছু দেখাতে নিয়ে যাবেন বোধহয়। সেখানেই যাচ্ছি।”
প্রহরী দু’জন কথাটা খুব একটা বিশ্বাস করেছে বলে মনে হলো না। দু’জন দু’জনের মুখ চাওয়াচাওয়ি করল। তার মাঝে একজন বলল,
“আমরা তবে এগিয়ে দিচ্ছি আপনাকে। আর নাহয় গাড়ি নিয়ে যান। এই অন্ধকারে একা যেতে পারবেন না।”
অলকানন্দা পরে গেলে বিপাকে। তাও মিনমিন করে বলল,
“আমি একা যেতে পারব, আপনাদের যেতে হবে না।”
প্রহরী দু’জন আরও কিছু হয়তো বলতো কিন্তু তারা আর কোনো বাঁধা না দিয়ে চুপ করে গেল। অলকানন্দা ওদের দৃষ্টি অনুসরণ করে পিছনে তাকাতেই দেখল তাদের বাড়ির বয়োজ্যেষ্ঠ একজন নারী কর্মচারী দাঁড়িয়ে আছেন৷ অলকানন্দা তাকাতেই মহিলা চলে গেলেন। প্রহরীরাও আর কোনো বাঁধা দিলেন না। খুব সাধারণ ভাবেই গেইট খুলে দিয়ে আবার মূর্তির মতন দাঁড়িয়ে রইলেন। অলকানন্দার কেমন যেন খটকা লাগল ঘটনাটায়। কিন্তু তার মস্তিষ্ক জুড়ে তখন নবনীল এতটাই গ্রাস করে ছিল যে সে দ্রুতই ছুটে গেল সেদিকে।
উজ্জ্বল চাঁদের রূপসী জ্যোৎস্না ফুটেছিল অশ্বত্থ গাছের কোল ঘেষে। সেই জ্যোৎস্নায় স্নান করছে প্রকৃতি। বিরাট শিউলী গাছটার নিচে দাঁড়িয়ে আছে নবনীল ও অলকানন্দা। নবনীলের চোখ-মুখ মৃত প্রায়। চোখেদের আজ নিজস্ব কোনো ভাষা নেই, প্রাণ নেই। কেমন গা জুড়ে অসহায়ত্ব। অলকানন্দা ক্ষীণ স্বরে সেই নবনীলের পানে তাকিয়ে রইলো। এক, দুই করে ঠিক কতখানি মিনিট অতিক্রম হওয়ার পর নবনীল তার শব্দগুচ্ছ উচ্চারণ করল কণ্ঠে,
“আমার আর কেউ রইল না, নন্দা। না মা, না আপনি। পৃথিবীতে এত একা কেউ থাকতে পারে! পাখিরও বাঁধন প্রয়োজন হয়, শুকনও বাঁচতে চায়। আমার বেলা তবে কিছু নেই কেন?”
মায়া মায়া প্রকৃতিতে বড্ড করুণ শুনালো বাঁচতে চাওয়ার সে আকুতি। অলকানন্দা নিরীহ চোখে তাকিয়ে অসহায় কণ্ঠে বলল,
“সামলে উঠুন। সব ভালো হবে।”
“যে ভালোতে আপনি নেই সে ভালো আমার চাই না। যে ভালোর জন্য আপনাকে হারাতে হয় সে ভালোর কোনো প্রয়োজন নেই আমার।”
“কিন্তু কী করবেন বলুন? ভাগ্যের লিখা তো কেউ বদলাতে পারে না।”
“আপনি আপনার এমন ভাগ্যকে তবে মেনে নিলেন? আমি কী বোকা দেখুন! আমি আরও ভাবছিলাম আপনিও বোধহয় ভালো নেই।”
অলকানন্দা চুপ করে রইল। নবনীল আরেকটু কাছে এলো। অলকানন্দা থেকে এখন তার দূরত্ব ঠিক দু-হাত। সে কেমন রহস্য করে বলল,
“স্টিফেন নামক অত্যাচারী এক লোকের কাছে অলকানন্দা কী চির জীবন বাঁধা থাকবে?”
অলকানন্দা থতমত খেলো। নবনীলের কথায় তার আবার মনে পড়ল স্টিফেনের অত্যাচারী স্বত্বার কথা। নবনীল তখন তাচ্ছিল্য করে বলল,
“যে মানুষ আপনার বোনের এমন অবস্থা করেছে, সে মানুষকে আপনি আপনার এত সুন্দর জীবনটা সোপে দিচ্ছেন। এতটা স্বার্থপর তো আপনি ছিলেন না।”
অলকানন্দার ভিত্তি কেঁপে ওঠল। সত্যিই তো, যে মানুষটা তার বোনের ক্ষেত্রে এত নিষ্ঠুর ছিল, সে মানুষটাকে সে কি-না চোখ বন্ধ করে মেনে নিতে চাচ্ছে?
নবনীল হয়তো আরও কিছু বলতো কিন্তু দূর থেকে ভেসে আসা গাড়ির ইঞ্জিন তাদের সতর্ক বার্তা শোনালো। অলকানন্দা ভীতু চোখে আশপাশ চাইলো। স্টিফেন চলে এসেছে। আর এক মুহূর্ত বাহিরে থাকলে কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে। অলকানন্দা ব্যস্ত হযে পা বাড়াল। যেতে যেতে বলল,
“আপনি এখানে এভাবে আর আসবেন না নবনীল। উনি দেখলে হয়তো আপনার সাথেও খারাপ কিছু করে ফেলবে।”
নবনীল হয়তো আর কিছু বলতো কিন্তু সেই সুযোগ অব্দি পেল না, তার আগেই অলকানন্দা ছুট লাগাল। নবনীল হতাশার শ্বাস ফেলল, আফসোস করে বলল,
“আপনি আর আমার নেই।”
_
স্টিফেন বসে আছে তার ঘরের আরামকেদারায়। অলকানন্দা ভীতু ভীতু পায়ে ঘরে ঢুকল। স্টিফেনের চোখ বন্ধ। ফর্সা গায়ের রঙ লোকটার, চোখের মনিতে কেমন নীলাভ ভাব। দেখতে ভারী সুপুরুষ মনে হয়। দু’বার তাকে ফিরে দেখতেই হবে।
অলকানন্দা ধীর পায়ে ঘরে ঢুকতেই স্টিফেন স্মিত হাসল। ফিসফিস করে বলল,
“আমার ঘরের নারী আজকাল কী পরের কাছে যাচ্ছে?”
অলকানন্দার পা থেমে গেল। বুক দুরুদুরু করছে তার। লোকটা কী কিছু জেনে ফেলল। স্টিফেন উত্তরের আশা করল না। নিজের মতন দুলতে দুলতে বললেন,
“তোমার আশেপাশে কোনো পুরুষের ছায়াও কিন্তু আমি সহ্য করবো না সানশাইন।”
অলকানন্দা বিমূঢ় চিত্তে দাঁড়িয়ে রইল। স্টিফেন তার দিকে এগিয়ে এলো। খুব নিকটে, খুব কাছে চলে এলো। অলকানন্দার বুকের কম্পন দূঢ় হলো। স্টিফেন আলগোছে অলকানন্দার মাথা থেকে শিউলী ফুলটা ছাড়িয়ে নিল। ফিসফিস করে বলল,
“সানশাইন, বেঁচে গেছ। তোমার শরীর থেকে ঝরা শিউলীর সুবাস আসছে। কোনো পুরুষের নয়।”
অলকানন্দা শ্বাস বন্ধ করে রাখল। স্টিফেন খুব নিবিড় ভাবে ছুঁয়ে দিল অলকানন্দার কোমড়। অতি ঘনিষ্ঠ হয়ে ঘোর লাগা কণ্ঠে বলল,
“তুমি প্রেম নিয়ে করোনা ছলনা। স্টিফেন সব কিছুর ভাগ দিলেও সানশাইনের এক ফোঁটা ভাগও কিন্তু কাউকে দিবে না।”
_
সকাল হতেই স্টিফেনের তাড়নায় অলকানন্দাকে বেরুতে হলো। কোথায় যেন গাড়ি দিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। ঘুম ঘুম চোখ নিয়ে প্রায় অনেকক্ষণ পর গাড়ি থেকে নামল অলকানন্দা। স্টিফেনের পেছন পেছন যেতেই নন্দা চমকে উঠল। তারা হসপিটালে এসেছে। অন্নপূর্ণা তাদের দেখে হাসছে।
#চলবে