অলকানন্দার নির্বাসন পর্ব ২৪

2
971

#অলকানন্দার_নির্বাসন
#মম_সাহা

২৪.

বাহিরে বৃষ্টি পড়ছে, ঘরে কী যেন একটি বাদ্যযন্ত্রে বাজছে কোমল স্বরে গান। আকাশে ঘন কালো মেঘের স্তূপ। থেকে থেকে বজ্রপাত হচ্ছে। প্রকৃতি অজানা তান্ডবে মত্ত। বিরাট বিরাট গাছপালা গুলো তান্ডবীয় বাতাসের কারণে হেলেদুলে পড়ছে।

অলকানন্দা দাঁড়িয়ে আছে তার রুমের জানালার কোল ঘেঁষে। লাল টকটকে একটি শাড়ি জড়ানো শরীরে। মোটা জড়োয়া গহনা সারা অঙ্গে। মেয়েটাকে শহরের কলেজে ভর্তি করিয়ে দিয়েছে স্টিফেন। সেদিন অন্নপূর্ণাকে দেখে আসার সময়ই ভর্তি করিয়ে এসেছে। লোকটাকে দেখে সে অবাকই হচ্ছে। ঠিক বুঝে ওঠতে পারছে না মানুষটা চাচ্ছে কী? কেন এত রূপ প্রদর্শন! কেন ক্ষণে ক্ষণে প্রেম দিচ্ছে কখনো বা কঠোরতা! চাচ্ছে কী সে? কথাখানা ভাবতে ভাবতেই তার নজর বাগানটার দিকে গেল। বিদ্যুৎ চমকানোর ফলে রহস্যজনক মনে হলো এই বাগান নামক গোলকধাঁধা। অলকানন্দার মনে পড়লো বিয়ের প্রথম দিন যে মেয়েটাকে দেখেছে, আজকাল সে মেয়েটাকে আর সে দেখেনা। কেন দেখেনা? কই মানুষটা?

মেয়েটার ভাবনা উদয় হতেই তার ভ্রু কুঁচকে এলো। এতদিনে তার মেয়েটার কথা মনে পড়লো। কোথায় মেয়েটা! অলকানন্দা ধীর পায়ে বেরিয়ে গেলো ঘর থেকে। সুন্দর, রাজকীয় সিঁড়ি গুলো পায়ে মারিয়ে সে বেড়িয়ে গেলো বাড়িটা থেকে। বাহিরে তখন তুমুল বৃষ্টি। মেঘেদের গর্জনও লোমহর্ষক। গমগমে স্বরে ডাকছে আকাশ। অলকানন্দা এই বৃষ্টি মাথায় নিয়েই বাগনটার পেছনে দাঁড়াল। বৃষ্টির এত বিরতিহীন ধারায় নিমিষেই ভিজে একাকার সে। তবুও সিক্ত শরীরটা নিয়ে এগিয়ে গেল বাগানের এক কোণায় সরু রাস্তাটার দিকে। সিমেন্টে বাঁধাই করা রাস্তা। খুব সরু রাস্তা। এবং বাঁশের কঞ্চি দিয়ে দু’পাশে সুন্দর লাইন করা। এবং সেই কঞ্চি বেয়ে কতগুলো লতাপাতা ডালপালা ছড়িয়ে আয়েশী ভঙ্গিতে যেন বসে আছে। দুই এক হাত পর পর বিশাল কৃষ্ণচূড়া গাছ। লাল টকটকে কৃষ্ণচূড়া, সাদা কৃষ্ণচূড়ায় পরিপূর্ণ গাছগুলো। এক মুহূর্তের জন্য নন্দার মনে হলো সে স্বর্গের কোনো এক দ্বারে এসে যেন উপস্থিত হয়েছে। এত সুন্দর, এত মোহনীয়তা বাগানটা জুড়ে! কতটা যত্নেই না জায়গাটা তৈরী করা হয়েছিল? সরু রাস্তাটা পেরুতে পেরুতেই একবারে শেষ মাথায় চলে এলো নন্দা। শেষের মাথাটা আরও বেশি সুন্দর। মাঝারি আকারের ছোটো একটি জায়গা আছে এখানে খোলামেলা। জায়গাটার চারপাশে কেবল কৃষ্ণচূড়ায় আচ্ছাদিত। কিছু কৃষ্ণচূড়া গাছের ডালে কিছুবা মাটিতে খাচ্ছে গড়াগড়ি। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন জায়গা। তার সামনেই মাঝারি আকারের সুন্দর ঘাট করে একটা পুকুর। পুকুরের জল গুলো একটু আলাদা যা নন্দা কখনো দেখেনি এর আগে। একদম নীলাভ। মনে হচ্ছে নীল আকাশের এক টুকরো রঙ এসে মিশে গেছে এই বারির শুধায়। অলকানন্দা মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। চোখ-মুখে তার প্রগাঢ় মুগ্ধতা। এত সুন্দর একটা জায়গা সে কখনো খেয়াল করেনি! আর কেউ কখনো বলেওনি এখানে এত সুন্দর একটা জায়গা আছে। তাছাড়া গাছপালার ঘনঘটার কারণে কখনো বুঝাও যায়নি এখানে কিছু থাকতে পারে এত অসাধারণ। অলকানন্দা যেন মোহগ্রস্ত হয়ে গেল। ঘোর লাগা দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো জলে। টলমল করছে জলটা। সে এক পা, দু’পা করে এগিয়ে যায় পুকুরের সিঁড়ির দিকে। অসাধারণ এক ঘ্রাণ ভেসে আসে প্রকৃতি থেকে। কী সুন্দর ঘ্রাণ। মাথা ঝিমঝিম করে শরীরটা কেমন ভার হয়ে আসে। সিঁড়ির শেষ ধাপে পা রাখতেই মুগ্ধ নন্দার বাহু কেউ টেনে ধরে। এত গম্ভীর মোহ কেউ যেন মুহূর্তেই নষ্ট করে দিল। সাথে ভেসে এলো চিৎকার,
“তুমি এখানে কেন এসেছো? কেন হ্যাঁ?”

আকাশের ভয়ানক গর্জনকে ছাপিয়ে গেলো সেই চিৎকার। অলকানন্দার চিত্ত অশান্ত হলো, সাথে ভীতও হলো ভীষণ। কেঁপে উঠল তার সর্বাঙ্গ। ঘোরগ্রস্তের মতন বার কয়েক আওড়ালো,
“কে? কে?”

তন্দ্রাচ্ছন্ন আধো আলো মাখানো প্রকৃতির এক চিমটি আলোর কল্যাণে দেখা গেল স্টিফেনের সুন্দর মুখখানি। যা এখন ভয়ঙ্কর রকমের লাল হয়ে আছে। বৃষ্টিতে ভিজে গেছে মানুষটা। হঠাৎ স্টিফেনের বৃষ্টি ভেজা শরীরটা দেখে অলকানন্দার খেয়াল হলো সেও ভিজে শরীর নিয়ে এখানে এসেছে। তবে তার শরীরে বৃষ্টি লাগছে না কেন! চারপাশে চোখ মেলে তাকাতেই বুঝল, অতিরিক্ত গাছের জন্য বৃষ্টির ছাঁট তেমন জায়গাটাকে স্পর্শ করতে পারছে না। তার মানে উত্তপ্ত রোদ্দুরও ছুঁতে পারে না নিশ্চয় এই মোহনীয় স্থানটা! এত সুন্দর একটি জায়গা অথচ কেউ তাকে দেখালো না? কেন!

অলকানন্দার ভাবনার মাঝে স্টিফেনের আবার রাশভারী কণ্ঠ ভেসে এলো,
“এখানে কী করিতে আসছো?”

অলকানন্দার ধ্যান ফিরলো। স্টিফেনের দিকে তাকাল সে গাঢ় চোখে। লোকটার পড়ণে এখনও সাহেবী পোশাক। সাদা, ফর্সা দেহ। নীলাভ চোখ জোড়ায় রাজ্যের মায়া, টান, আবেগ। অথচ সেগুলো ছুঁতে পারল না অলকানন্দাকে। সে স্টিফেনের চেয়েও দ্বিগুণ শক্ত কণ্ঠে উত্তর দিল,
“আমার ইচ্ছে, আমি এসেছি। আমি কৈফিয়ত দিতে বাধ্য নই।”

“তোমার এমন ইচ্ছের জন্য তুমি শাস্তিও পেতে পারো, সানশাইন। বেশি ইচ্ছে কিন্তু মোটেও ভালো নয়।”

অলকানন্দা হাসলো। বহুদিন পর বোধহয় তার চোখে-মুখে দেখা দিল সেই একরোখা ভাব। সে হাসতে হাসতে তাচ্ছিল্য করে বলল,
“শাস্তি! কী শাস্তি দিবেন আমায়! যার জীবনে আপনার মতন একজন মানুষ আছে, তার বোধহয় আর শাস্তির প্রয়োজন নেই।”

অলকানন্দা ভেবেছিল তার কথা শুনে হয়তো স্টিফেন বেজায় রেগে যাবে। তার জন্য ধার্য করা শাস্তিটা বোধহয় দ্বিগুণ করে দিবে মানুষটা। কিন্তু তেমন কিছুই হলোনা। বরং অলকানন্দাকে অবাক করে দিয়ে স্টিফেন হাসল। মানুষটার হাসি বড়ো অমায়িক। সীমাহীন আকাশ থেকে বৃষ্টি ঝরে পড়ার দৃশ্যটা যেমন সুন্দর ঠিক তেমন সুন্দর এই হাসি। অথচ এমন একটা কথা শোনার পর মানুষটার তো হাসার কথা না।

অলকানন্দা চোখ-মুখ কুঁচকালো। বিরক্ত কণ্ঠে বলল,
“আমি কী ভুল বলেছি কিছু?”

“সানশাইন, তবে তুমি স্বীকার করছো আমি তোমার জীবনেরই একটা অংশ? যাক, অবশেষে ভালোবাসায় না থাকি, তোমার ঘৃণাতে আমার ঠাঁই হয়েছে সেটাই বা কম কিসে!”

অলকানন্দা বিমূঢ়। লোকটা এমন একটা সময়ে এমন একটা উত্তর দিবে তা যে ভাবনাতীত ছিল। তাকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকতে দেখে স্টিফেন বলল,
“সানশাইন, তুমি কী জানো, তুমি অসাধারণ সুন্দরী? যাকে দেখলে যেকোনো মানুষের চোখ ঝলসে যায়।”

অলকানন্দা চোখ বড়ো বড়ো করে তাকাল। স্টিফেন পাঁজা কোলে তুলে নিলো তাকে। নরম, মিষ্টি আবহাওয়ায় খুব গোপনে অলকানন্দার শিরদাঁড়া বেয়ে কম্পন বইয়ে দিয়ে স্টিফেন করে ফেললো খুব ঘনিষ্ঠ একটি কাজ। লজ্জায় লাল হলো আকাশ। ভয়ঙ্কর রাগ করা অলকানন্দাও যেন লজ্জায় মূর্ছা গেল। ঐ যে কথায় আছে, ‘নারী আর কিছুতে আটকায় না, নারী আটকায় ভালোবাসায়।’

_

শরীরে খুব পাতলা, স্লিক বলা হয় যাকে, সেই স্লিকের শাড়ি পরে তৈরী অলকানন্দা। তাকে তৈরী করে দিয়েছে একজন নারী কর্মচারী, তাও স্টিফেনের আদেশে। সোনালী রঙের শাড়িটা জ্বলজ্বল করছে মেয়েটার শরীরে। মনে হচ্ছে বিধাতার কী অপরুপ চিত্র যেন! সে এই শাড়িটা পড়ে তৈরী হয়েছে শহরের কলেজে যাওয়ার জন্য। মহাবিদ্যালয়ে তার প্রথম যাত্রা। বুকে দুরুদুরু কম্পন।

অলকানন্দা তৈরী হয়ে দাঁড়াতেই স্টিফেন ঘরে প্রবেশ করল। সাহেবিয়ানার পুরো ভাব মানুষটার ভেতর। চালচলন, ভাব-গাম্ভীর্যে সুপুরুষ বটে। তাকে দু’বার ফিরে দেখবে না এমন মানুষ কমই পাওয়া যাবে বোধহয়। অলকানন্দা অবশ্য তাকায়নি। সে নিজের মতন একমনে বাহিরে তাকিয়ে আছে। স্টিফেন ব্যস্ত কণ্ঠে তাড়া দিলেন,
“সানশাইন, বের হও দ্রুত, সময় চলে যাচ্ছে।”

অলকানন্দা ভাবলেশহীন ভাবে দাঁড়িয়ে রইলো, যেন সে শুনতে পায়নি কিছু। স্টিফেন দাঁড়াল, ভ্রু কুঁচকে বলল,
“আজকে থেকে তোমার কলেজ। যাবে না?”

অলকানন্দা নিরুত্তর। স্টিফেন বাঁকা হাসলো, অলকানন্দার কাছে গিয়ে জড়িয়ে ধরলো তার মসৃণ কোমড়। সুগন্ধির তীব্র ঘ্রাণটা স্টিফনের মাথা ধরিয়ে ফেলছে। তার পুরুষ স্বত্তাটা বেসামাল হয়ে ওঠেছে। স্টিফেন আরেকটু ঘনিষ্ঠ হলো, প্রায় ফিসফিস করে বলল,
“সানশাইন, তোমার এত কাছে আসতে কেন মন চায়? আমি জানি, তুমি নারী নও সামান্য। হয়তো কোনো একদিন এই তুমিই আমার প্রাণনাশের কারণ হবে, তবুও কেন তোমার প্রতি আমার ঝোঁক! তোমাকে না পেলে আমি জানতামই না, কারো মৃত্যুও এত প্রিয় হতে পারে।”

অলকানন্দা মুখ ঘুরিয়ে নিল। তাচ্ছিল্য করে বলল,
“সত্যিই, হয়তো একদিন আপনার প্রাণ আমার হাতেই নিঃশেষ হবে।”

অলকানন্দা কথাটা বলতে দেরি অথচ স্টিফেনের ছাড়তে দেরি নেই। সে নন্দাকে প্রায় ছুড়ে ফেলে কেমন অভিযোগ মাখা কণ্ঠে বলল,
“আমার মৃত্যু তোমার চিরস্থায়ী নির্বাসনের কারণ হবে, সানশাইন। মিলিয়ে নিও।”

_

শহুরের চঞ্চল আবহাওয়ায় সাহেবী গাড়িটা এসে থামলো কলেজের সামনে। অলকানন্দার বুকে কেমন অস্বাভাবিক ওঠা-নামা। তা নিয়েই সে নেমে দাঁড়াল। স্টিফেন আসবে বলেও শেষ মুহূর্তে একটি কাজের জন্য আসতে পারেনি। তাই এই নতুন জীবনে তাকে একাই পা রাখতে হলো। অলকানন্দা গাড়ি থেকে নেমে কলেজ ঢুকতেই তার চোখ ছানাবড়া হয়ে গেলো। চারপাশে ছেলে-মেয়েদের ছড়াছড়ি। দলে দলে তাদের কথা চলছে। কলেজের সামনে বিরাট গাড়ি দাঁড় করানো। ছেলেমেয়েদের মাঝে কেমন অস্থিতিশীল পরিস্থিতি। অলকানন্দা কাছে যেতে যেতে কানাঘুষাই শুনলো এখন নাকি মিছিল বের হবে। দেশে ব্রিটিশের যে রাজত্ব, তা থেকে পরিত্রাণ পেতেই দলে দলে শহুরে মানুষ লুকিয়ে লুকিয়ে মিছিল মিটিংয়ের আয়োজন করছে। অলকানন্দার বুক কাঁপলো বোধহয়। ব্রিটিশদের বিতাড়িত করার জন্য এসব! তবে কী স্টিফেনও চলে যাবে?

#চলবে

2 COMMENTS

  1. Er porer porbo gulo kobe deben????? Khub sundor ho66e golpo ta…. golpota wait kr6i… vaiya golpo r notun porbo plss post korun…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here