অরণ্যবহ্নি পর্ব-৬

0
703

#অরণ্যবহ্নি
||৬ষ্ঠ পর্ব||
– ঈপ্সিতা শিকদার
মাতব্ববাড়ি থেকে বের হয়ে ঠিক বা’পাশে কড়ায়-গণ্ডায় পনেরো কদম হাঁটলেই বিশালাকার গোয়ালঘর। যদিও গাভী-গরু তেমন নেই এখন, গুণে-গুণে পাঁচ-ছয়টি মাত্র।

গোয়ালঘরের সম্মুখে পৌঁছালেই দু’নয়নে ভেঁসে উঠলো চক্ষুশূল এক দৃ্শ্য। অভ্যন্তরে একটি মৃত গাভী মাটিতে পড়ে আছে। তার হাত-পা বিকৃতভাবে মুচড়ে দিয়েছে কেউ যেন, দীঘল দীঘল চোখ দু’খানা উল্টে আছে, সারা গায়ে আঁচড়ের দাগ।

“ইয়া আল্লাহ!” ভয়ে চিৎকার করে উঠে চোখ সরিয়ে নেয় সামায়া।

আবেগ ও মিহিরুন্নেসা বানুর নজর যায় তার দিকে। বড়ো বড়ো পা ফেলে এগিয়ে আসেন তারা।

“মায়াবালিকা তুই এখানে…? তুই এখানে কী করছিস?”

“হ্যা, বুড়িমা। তুমি এদিকে ক্যানো?”

সামায়া চোখ অন্যদিকে রেখেই জবাব দেয়,
“আমি তো তোমাদের খুঁজতে খুঁজতে এসেছিলাম। কিন্তু এই গরুটার এই অবস্থা কীভাবে? কে করেছে এমনটা?”

গোয়ালা মন্টু মিয়ার কথার মাঝে বা’হাত দেওয়ার পুরোনো অভ্যাস। তিনি আজও তা করা হতে বাদ যান না।

“জ্বে, আপামনি। আমিও তাই ভাবি, রাতের আঁধারে কেডায় জানি এ কাম করসে। আমি তো গতকাল ভালাই রাইখ্যা গেসি।”

“কোনো গায়ের লোক শত্রুতামি করে করেছে হবে হয়তো। যাকগে তুমি এসব নিয়ে ভেবো না, বুড়িমা। যাও, তুমি ঘরে যাও। আবেগ দাদু তুমি যাও।”

তাড়াহুড়ো করে বলেন মিহিরুন্নিসা বানু, যেন কিছু আড়াল করার প্রচেষ্টা। দিদার কথায় আবেগ সামায়ার হাত ধরে বাড়িতে ঢুকে। যুবতী কিংকর্তব্যবিমূঢ়, সে পুরোপুরি বোদজ করতে পারছে তার দিদা ইচ্ছেকৃত ভাবে মিথ্যা বলেছে কিছু আড়াল করতে।

কারণ গ্রাম এইখান হতে ভালো দূরে, রাতের বেলা কেউ নদী পাড় হয়ে এখানে আসবে না এ কাজ করতে। আর কোনো শত্রু করে থাকলে হাতে হাত রেখে বসে থাকার মানুষ কখনোই মিহিরুন্নিসা বানু নন।

“কী রে এতো চুপচাপ ক্যানো?”

ঘোর ভাঙে আবেগের প্রশ্নবাণে। ভ্রু জোড়া কুঁচকে তাকায় সে।

“এতো করুণ, বিভৎস দৃশ্য দেখার পর আপনি এতো সহজভাবে কীভাবে কথা বলছেন আবেগ ভাই?”

স্পষ্ট তপ্ত শ্বাস নির্গত হয় যুবকের শ্যাম দেহ খানা হতে। ম্লান হাসে।

বিড়বিড়ায়,
“দেখতে দেখতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি রে মায়াবালিকা! এখন এই দৃশ্যগুলোই হয়ে গিয়েছে স্বাভাবিক, সাধারণ, পরিচিত।”

অস্পষ্টভাবে হলেও কথাগুলো কর্ণগোচর হয় সামায়ার। কনফিউজ হয় সে। এই বাড়ি, এই বাড়িতে বসবাসকারী মানুষগুলো, তাদের আচার-আচারণ সবকিছুই যেন তার বোধগম্যতার বাহিরে।

“কী বললেন আবেগ ভাই? বুঝতে পারলাম না।”

“কিছু না। আমি বলছিলাম, গোসল করে আয়। আজ দু’জন মিলে আবার আগের মতো লুডো খেলতে বসবো। আমি খেলার বোর্ড, গুটি নিয়ে রাখছি।”

মুহূর্তেই উৎফুল্ল হয়ে উঠলো সামায়া। আবেগের সাথে লুডু খেলায় খুব কমবারই জিততে পারে সে, লোকটা যে চিটিং করার মাহির। তবুও তার ছোটোবেলায় হতেই মানুষটার সাথে খেলতে ভালো লাগে।

“ঠিক আছে। তাহলে আমি তাড়াতাড়ি গোসল করে আসছি।”

___

মগ দিয়ে একটু একটু করে বরফ সম শীতল পানি গায়ে ঢালছে সামায়া। প্রতিবারই কম্পিত হচ্ছে শীতলতায়। এই গোসলখানাটি মোটামুটি আকারের। মাঝারি আকারের আয়না রাখা এক দেয়াল জুড়ে।

হুট করে তার মনে হলো আয়নাটিতে ভাসমান প্রতিবিম্বে সে কাউকে দ্রুতগতিতে চলে যেতে দেখলো। ভীষণ রকমের ভীতি জড়িয়ে ধরলো তাকে, মেরুদণ্ড বেয়ে গেল শীতল শিহরণ।

ভয়ে দ্রুতো গায়ে তোয়ালে জড়িয়ে, পরিধান করতে আনা কাপড় নিয়ে বেরিয়ে পড়লো। গোসলখানা হতে বের হয়ে দ্রুতো দরজা তালা দিয়ে পিছনে ঘুরতেই স্তম্ভিত হয় সে।

বিছানায় বসে লুডুর বোর্ড ও গুটি সহ অপেক্ষা করছিল আবেগ সামায়ার। হুট করে নারীটিকে তোয়ালে জড়ানো অবস্থায় বের হতে দেখে সে নিজেও নির্বাক ও স্তব্ধ। কয়েক মুহূর্ত দু’জন মূর্তিমান হয়েই দাঁড়িয়ে থাকে। অতঃপর আবেগ দৃষ্টি নত করে নীরবে বেরিয়ে যায়।

সামায়া জোরে জোরে শ্বাস-প্রশ্বাস নিচ্ছে। তার দুই গাল রক্তিম হয়ে উঠেছে লাজ ও অন্যরকম এক আবেশে। কামরার দরজা লক করে সাদা রঙের থ্রিপিস পরে তৈরি হয়ে নেয় সে। তার ‘আবেগ ভাই’ নামক ভালোবাসার মানুষটির প্রিয় রঙ যে শুভ্র, একরাশি ভারহীন মেঘের ন্যায় শুভ্র।

আবেগ নিজের রুমের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত পায়চারি করছে ছটফটে মনে। মেয়েটিকে এতো কাছে এনে কী করে দূরে রাখবে সে? এতোটা অসাধ্য সাধন করার ন্যায় ক্ষমতাধরও তো হয়নি সে।

“কী গো আবেগ ভাই? ছ্যাঁকা দিলো না কি প্রেমিকা? এমন উদ্ভ্রান্তের ন্যায় ঘুরছেন ক্যানো?”

আকস্মাৎ সামায়ার কণ্ঠ শুনে হচকচিয়ে তার পানে তাকায় যুবক। তার চাহনি যেন আর সরে না। নারীটিকে যে আজ সম্পূর্ণরূপে নির্মলা মনমোহিনী লাগছে। তার দৃষ্টি খানা যেন আটক করে রেখেছে নিজের দিকে।

আনমনেই উচ্চারণ করে,
“আমার প্রণয়ের সবটুকুতে, আমার হৃদস্পন্দনে, আমার দেহের রন্ধ্রে রন্ধ্রে তোর নাম লিখা, তবে উন্মাদনাতেও পিছনে নিশ্চয়ই তুই আছিস।”

অস্বস্তিতে পড়ে রমণী। তার দিকে কারো একদৃষ্টিতে তাকানো কোনোকালেই তার নিকট সহ্যক্ষমতার মধ্যে নয়। মা তাকালেও কেমন যেন লাগতো।

মাথা নত করে সে। মাথায় দিয়ে রাখা ঘোমটা, পুনরায় গোছাতে গোছাতে বলে উঠে,
“এভাবে তাকিয়ে আছেন কেন আবেগ ভাই? চলেন, লুডু খেলি। আপনি তো চলে এলেন, তাই আমি বোর্ড নিয়ে চলে এলাম।”

আবেগের মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি কাজ করে। এই কন্যা কি তবে লজ্জা পাচ্ছে? পাওয়াও উচিত। এক পা এক পা করে এগিয়ে যায় সে সামায়ার দিকে।

আর সামায়া? সে লজ্জা ও আবেগের এক মিষ্টি অনুভূতির মিশ্রণে সটান হয়ে দাঁড়িয়ে রয়। আবেগ এক ইঞ্চি দূরত্ব রেখে স্থির হয়।

তার ডান কানের দিকে ঝুঁকে মৃদু কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে,
“তবে কি তুই চাইছিলি আমি ঐখানে দাঁড়িয়ে থাকি?”

দুই হাতের দ্বারা ধাক্কা দিয়ে তাকে সরিয়ে বিছানায় যেয়ে বড়সড় এক শ্বাস ফেলে রমণী, যেন বাঘের গুহা হতে রক্ষা পেয়ে এসেছে।

“আজাইরা কথা বলবেন না তো আবেগ ভাই। লুডু খেলতে বসেন। না কি আমার থেকে হারবেন বলে সম্মানের ভয় পাচ্ছেন?”

“কী! এই কথা! তোকে যদি আজকে গো-হারা না হারিয়েছি, তখন কথা বলিস!”

“আচ্ছা। দেখা যাবে।”

দু’জনের খেলা শুরু। আর কোনোদিকে হুশ নেই তাদের।

___

বিকেল নেমেছে। খেলা শেষ করে দুপুরের খাবার খেয়ে একটু ঘুমিয়েছিল সামায়া। সৌভাগ্যবশত আজ আর কোনো বাজে স্বপ্ন দেখেনি সে। তবে নিদ্রা ভঙ্গ হওয়ার পর হতে দিদা কিংবা আবেগকে দেখেনি সে। তাদের খোঁজেই ঘুরে বেড়াচ্ছে গোটা মাতব্বরবাড়ি।

করিডর পাড় হওয়ার সময় পরলোকগত দাদার তৈরি গ্রন্থাগার হতে দিদার কণ্ঠ ধোনা যাচ্ছে। কী একটা মনে করে দরজায় করাঘাত করতে যেয়েও করে না সে। দরজায় কান রাখে।

“আবেগ, ফাদারের নিশ্চিত করা সবকিছুই ধীরে ধীরে সত্য হচ্ছে। দেখতে পাচ্ছো তুমি? এই গাভীটার এমন মৃত্যুটার কারণ অন্যকিছু নয়, এটাই। সামু এসবের সাথে জড়িয়ে যাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে।”

“তা তো আমিও বুঝতে পারছি দিদা। কিন্তু কী করবো? ফাদার এবং আমার নিয়োগ করা গুপ্তচর তো খোঁজ করছে তাদের। তাদের না পাওয়া অবধি কিছুই সম্ভব নয়। আমি তোমাকে বলেছিলাম দিদা সামুকে এসবে জড়িয়ো না আমার জীবন বাঁচাতে। ওর ক্ষতি হয়ে যাবে। তুমি শুনলে না।”

ঝরঝরিয়ে অশ্রু পতন হয় বৃদ্ধার আঁখি দুটো হতে। দু’হাতে পরম মমতায় জড়িয়ে নেন নাতিকে।

“দাদুভাই, তুমি আমার মানিক-রতন। তোকে বাঁচানোর একটি মাত্র আশার কিরণ দেখতে পেয়ে কী করে আটকাতাম নিজেকে!”

সামায়া বিস্মিত, আবেগের জীবনের ঝুঁকি রয়েছে! বিস্ময়ে তার পা লেগে পাশে রাখা বড় কাঠের ফুলদানীটা পড়ে যায়। নীরবতা ভাঙে এ আওয়াজে, আবেগ ও দিদা…
||৭ম পর্ব||
https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=349502893844470&id=100063542867943
চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here