অরণ্যবহ্নি পর্ব-১০

0
1114

#অরণ্যবহ্নি
||শেষ পর্ব|| (২)
– ঈপ্সিতা শিকদার
নাস্তার টেবিলে বসে আছে সবাই। পিনপতন নীরবতা বিদ্যমান। খাওয়ার মতো মন-মানসিকতা নেই কারোরই, ক্ষুধা মেটাতে শুধু বসা। গতকাল রাতে আবেগের শারীরিক অবস্থা খুব খারাপ হয়ে পড়েছিল। চোখ বারবার উলটে যাচ্ছিলো তার, মুখ খিঁচে যাচ্ছিলো, অসহ্য যন্ত্রণা বোধ হচ্ছিল।

সামায়াও তার দিদার সাথে কেঁদে উঠেছিল ভয়ে। তারপর দোয়া-কালাম পড়ে ফুঁ দিয়ে, রুকাইয়া শুনে কোনোরকম স্বাভাবিক হয় সে।

জোরালো শব্দে ফোন বেজে উঠায় ঘোর ভাঙে সবার। আবেগ পকেটে হাত দিয়ে নিজের ফোন বের করে দেখে তার নিয়োগ করা ডিটেক্টিভ কল করেছে। এক পলক নিজের দিদা ও স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে উঠে একটু দূরে যেয়ে দাঁড়ায়।

পিছনে বিবর্ণ হয়ে উঠে দুই নারীর চেহারা। না জানি নতুন কী দুঃসংবাদের আগমন হলো!

মিনিট দুয়েক না পেড়িয়ে যেতেই আবেগ ফেরত আসে। মুখে গম্ভীরতা স্থির রেখে জানায়,
“ডিটেক্টিভ এস.কে এর কল এসেছিল। তারা গ্রুপটির অবস্থান নিশ্চিত করতে পেরেছে। আমাদের যতো দ্রুতো সম্ভব ইউএসএ যেতে হবে।”

“আলহামদুলিল্লাহ্‌ দাদুভাই। তুই তাহলে আমাদের টিকেট বুক করে ফেল, যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব।”

“হ্যাঁ, কিন্তু ও… ওখানে অনেক বিপদাপদ অলহতে পারে। তাই…” সামায়ার দিকে ইশারা করে আবেগ।

সামায়া ভ্রুঁ কুঁচকে ফেলে। মনে মনে তেঁতে উঠে সে। ফট করে শুধায়,
“আমিও যাবো। আপনি মানেন আর না মানেন আবেগ ভাই আমি আপনার ওয়াইফ। এই মুহূর্তে আপনাকে আমি একা ছাড়বো না যতো যাই হোক।”

হনহন করে চলে যায়। মিহিরুন্নিসা বানু মৃদু হাসেন। নাতির জন্য বধূ আনতে কোনো ভুল হয়নি তাঁর, এ তিনি নিশ্চিত এখন।

“সবার জন্য টিকেটই বুক করো আর ভিসার ব্যবস্থা করো আবেগ। সামুর পাসপোর্ট আমি আনাচ্ছি।”

হৃদয়ে প্রশান্তির ঢেউ খেলছে আবেগের। সে ধারণা করেছিল সামায়া তাকে বর হিসেবে চায়নি বা এখনও চায় না। তবে মেয়েটা যখন অধিকার বোধ নিয়ে স্ত্রীর দাবী তুললো সব দুর্ভাবনা কর্পূরের মতো হাওয়ায় মিলিয়ে গেল।

___

এয়ারপোর্টে বসে আছেন মিহিরুন্নিসা বানু, সামায়া ও আবেগ দাঁড়িয়ে আছে কিছুটা দূরে। প্রায় ঘণ্টা দুইয়েক সময় বাকি ফ্লাইটের।

নার্ভাস বোধ করছে সামায়া। এই প্রথমবারের মতো নিজের মাতৃভূমি থেকে এতোটা দূরে যাচ্ছে সে, তাও এমন জটিল একটা কাজ সম্পূর্ণ করতে। মায়ের সাথে কথা হয় না অনেক দিন, কথা বলতে ইচ্ছে করছে অনেক।

আবেগদের বাড়িতে আসার পর একদিন রাতেই মুঠোফোন পানিতে পড়ে গিয়েছিল। সৌভাগ্যবশত মোবাইলের কিছু হয়নি, সিম কার্ড ও মেমরিকার্ড খুলে হেয়ারড্রাইয়ার দিয়ে শুকানোর পরই অন হয়ে গিয়েছিল।

তবে সিমটা কোথায় যে পড়ে যায়, টের পায়নি। তারপর থেকেই যোগাযোগ চ্যুত হয়। আর ঝামেলা-জঞ্জালে অনলাইনে কল করা তো দূরে থাক, সোশ্যাল মিডিয়ায় লগ ইনও করা হয়নি।

“আবেগ ভাই, আপনার ফোনটা একটু দিবেন? আম্মুর সাথে কথা বলবো।”

“এমন করে বলার কী আছে? ফোনটা দেও বললেই তো হয়। এই নে, এয়ারবাডটাও নে, কানেক্ট করা।”

আলতো হেসে সে আবেগের খুলে দেওয়া ডান কানের এয়ারবাডটা হাতে নেয়। ফোন নিয়ে মাকে কল লাগায়। ভালো লাগা ভর করে যখন নিজের মায়ের নম্বরটা মানুষটার ফোনে ‘আম্মু’ দিয়ে সেভ করা দেখে।

বার কয়েক রিং হতেই কল রিসিভ করে আলিমা বেগম।
“হ্যালো। কে?”

“আম্মু, আমি। এটা আবেগ ভাইয়ের ফোন।”

“তুই! তুই আমাকে কল করসোস কেন? তোর সাথে তো তো আমাদের কথা থাকতে পারে না।”

সচকিত হয়ে বিস্মিত গলায় প্রশ্ন করে,
“আম্মু এভাবে কথা বলছো ক্যানো?”

“তো কীভাবে বলবো? নিজের বাপের কথা শুনে এতো বড়ো একটা সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে একবার আমাদের কথা তোর মাথায় আসলো না? একা একা বিয়ে করে ফেললি! তুই জানিস ঐ ছেলে কেমন নরপিশাচ! পুরো গায়ের লোক বলাবলি করে ঐ ছেলেকে দেখেছে মেয়েদের খুন করতে! প্রমাণের অভাব বড়োলোকের ব্যাটা বলে! তোকেও মেরে ফেলবে!”

দীর্ঘশ্বাস ফেলে সামায়া। তবে তার মা সঠিক ভাবে কিছুই জানেন না। শান্ত কণ্ঠে জবাব দেয়,
“ব্যাপারটা সেভাবে না মা। আমি এয়ারপোর্টে, ইউএসএ যাচ্ছি আবেগ ভাইয়ের সাথে। এসে কথা বলবো।”

“না, তুই কোথাও যাবি না ঐ ছেলের সাথে বুঝেছিস? তোকেও মেরে ফেলবে ঐ ছেলে একা পেয়ে। আর তোর মোবাইল কই ছিল এতোদিন? একটা কলে অবধি পাইনি। নিশ্চয়ই ঐ ছেলে নিয়ে নিয়েছিল।”

“মা, তুমি শোনো…”

“কোনো কিছু শুনছি না আমি। আমি ভালোই বুঝেছি ঐ ছেলে তোর মতিভ্রষ্ট করেছে, তাই জীবন নষ্ট হচ্ছে তাও তোর চোখে পারছে না। তুই এই মুহূর্তে আমার বাসায় আসবি, নাহলে তোর সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই।”

টুট করে কল কাটার শব্দ শোনা যায়। অস্থির চাহনি সামায়ার, থমথমে চেহারা। কী করা উচিত তার এমন পরিস্থিতিতে? চোখ ঘুরাতেই আবেগের বিবর্ণমুখ দেখে। খেয়াল হয় একটি এয়ারবাড তো আবেগের বা’কানেই লাগানো। তবে কি সব শুনে ফেলেছে সে?

“মায়াবালিকা! তুই তোদের বাসায় চলে যা, আমি গাড়ি করে দিচ্ছি। আর পারলে আমাকে ক্ষমা করে দিস।”

মানুষটির চোখজোড়া টকটকে লাল। ঠোঁট ভিজিয়ে নেয় সে।
“আবেগ ভাই, মা এগুলো বুঝায়নি। এমন পরিস্থিতি তাই সে ভুল বুঝেছে…”

“তুই চল মায়াবালিকা! আমার জন্য আন্টির সাথে তোর সম্পর্ক নষ্ট হোক আমি চাই না।”

হাত ধরে সামায়াকে নিয়ে এয়ারপোর্টের বাইরে নিয়ে যেতে লাগলো সে। একটি ট্যাক্সি ডেকে সামায়ার ব্যাগ গাড়িতে ঢুকিয়ে দেয়।

“ভালো থাকিস। কপালে থাকলে আবার দেখা হবে।” ব্যথিত কণ্ঠ যুবকের। কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে চলে যায়।

___

এনাউন্সমেন্ট হয়ে গিয়েছে প্লেনে উঠার। মিহিরুন্নিসা বানু সিট থেকে উঠে এগিয়ে যেয়ে আবেগকে একা দেখে ভ্রু কুঁচকে ফেলেন।

“সামায়া কোথায়? যাওয়ার তো সময় হলো।”

“ও চলে গিয়েছে। ও যাবে না দিদা।”

“কে বলেছে যাবে না? একটু ওয়াশরুমে গিয়েছিলাম বলে আপনি এ কথা বললেন আবেগ ভাই?”

পরিচিত নারী কণ্ঠ শ্রবণগোচর হলে আবেগ বিচলিত হয়ে পিছন ঘুরে। লাগেজ সমেত সামায়া দাঁড়িয়ে। মুখে একরাশ বিরক্তি।

“তুই এখানে মায়াবালিকা?”

বিরক্তিতে ‘চ’ বোধক শব্দ করে এগিয়ে আসে। লাগেজ খানা নিতে ইশারা করে।

“দিদা, তোমার নাতিটা না প্রচুর খারাপ। একটু ওয়াশরুমে কি গিয়েছিলাম। আমার লাগেজ ফেলে রেখে চলে আসলো।”

মিহিরুন্নিসা বানু ক্ষিপ্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন নাতির দিকে।

“আর একবারও যেন এমন দুষ্টুমি না দেখি আবেগ। বুড়িমা তুমি চলো আমার সাথে।”

মিহিরুন্নিসা বানু সামায়ার হাত ধরে এগিয়ে যায়। অগত্যা আবেগও পিছন পিছন হাঁটে।

___

উড়োজাহাজ টেক অফ করছে। আবেগের হাতটা শক্ত করে আঁকড়ে ধরে সামায়া ভয়ে।

“তোমার আমাদের সাথে আসা উচিত হয়নি মায়াবালিকা! তোমার নিজের বাসায় ফেরা দরকার ছিল।”

গম্ভীরমুখো মানুষটির কথা পছন্দ হলো না সামায়ার। একবার ভাবলো উত্তর দিবে, পরক্ষণেই মত বদলায়।

“আমি একদম ঠিক কাজটাই করেছি আবেগ ভাই। এই মুহূর্তে আপনার নিকট থাকা প্রয়োজন, যুদ্ধ জিতে ফিরে এসে মাকে বোঝাতে পারবো। আর হাত ছেড়ে দেওয়ার জন্য ভালোবাসিনি।”

জানালার দিকে তাকালো সে। এলোমেলো মেঘরাশির দেখা পাচ্ছে। কী সুন্দর দৃশ্য! জীবনটা যদি এতো সুন্দর হতো!

আবেগ বিস্মিত। সে কি সত্যি শুনলো? তার বাস্তবতা জানার পরও মেয়েটা তাকে ভালোবাসে!

“ভালোবাসি।” কানের কাছে যেয়ে হিসহিসিয়ে বলল আবেগ। সামায়া হাসলো, তবুও না শোনার ভান করে জানালার দিকেই তাকিয়ে থাকলো। আবেগেরও তাতে কিছু যায় আসে না। সে মানুষটির হাতটি যতন করে আঁকড়ে ধরে সুমধুর এক ঘুম দিল।

___

দীর্ঘ সময়ের জার্নির পর আমেরিকান এয়ারপোর্টে ল্যান্ড করে তাদের উড়োজাহাজ। এয়ারপোর্ট থেকে বের হয়ে একটি ক্যাব ভাড়া করে আবেগ।

তিনজন চড়ে বসে। ড্রাইভার লোকটি আইরিশ, বেশ বন্ধুসুলভ। আবেগ খুব সাধারণভাবেই ড্রাইভারের সাথে কথোপকথনে মেতে উঠে।

দেখতে দেখতে পৌঁছে যায় তারা একটি ডুপ্লেক্স বাসার সামনে। নেমে যায় তিনজন। বেইল বাজালে একজন বাঙালি নারী দরজা খুলে।

“আসসালামু আলাইকুম, কাকী। কেমন আছেন?”

“আলহামদুলিল্লাহ, ভালো।”

কথাবার্তায় সামায়া বুঝতে পারে এই নারীটি আবেগের দুঃসম্পর্কের ফুপু। তাঁরই এই বাড়িটি। যা বছরের প্রায়সময়ই ভাড়া দিয়ে থাকেন বিভিন্ন মানুষদের, বর্তমানে তারা ভাড়া নিয়েছে।

সবাইকে যার যার কামরা দেখিয়ে দিলে ক্লান্তিতে বিছানায়া গা ঠেকাতেই ঘুমিয়ে যায় সামায়া। মিহিরুন্নিসা বানুও তাই। আবেগ জাগ্রত, ডিটেক্টিভ এস.কে এর এপয়নমেন্ট নেয় কল করে। অতঃপর বড়ো রাক্বী সাহেবকে কল করে।

___

দুপুরের দিকে বাহির থেকে অর্ডার করে লাঞ্চ আনিয়ে আবেগ ও সামায়া ক্যাব ভাড়া করে গোয়েন্দার দপ্তরের জন্য রওনা হয়। দপ্তরের দালানে প্রবেশ করতে কোনো অজানা কারণে কেমন একটা ভার, অস্বস্তি অনুভব হয় আবেগ ও সামায়ার। যেন কিছু ঠিক নেই।

প্রথম ফ্লোরে বার, দ্বিতীয় ফ্লোরে অফিস। গানের বিটে গোটা দালানটিই যেন কম্পিত হচ্ছে। এলিভেটর থেকে বের হতেই কাচের দরজা, কার্ড প্রেস করে খুলতে হয়।

আবেগ নিজের কার্ডটি ব্যবহার করে সামায়াকে নিয়ে অভ্যন্তরে প্রবেশ করে। অস্বস্তি একটু কাটে সবকিছু স্বাভাবিক দেখে।

তাদের স্বাগতম জানাতে ডিটেক্টিভ এস.কে. এর এ্যাসিস্ট্যান্ট মিস এলিনা এগিয়ে আসে। আবেগের সাথে হ্যান্ডশেক করে ও আলতো ভাবে জড়িয়ে ধরে।

“Hello Mr. Abeg! Welcome!”

“Thank you Ms. Elina.”

“I must say Mr. Abeg, You are getting more and more handsome day by day.”

“Thank you dear.”

সামায়া বিরক্ত বোধ করে। নারীটির গায়ে পড়া স্বভাব আর ভীষণ রকমের সৌন্দর্য তাকে পোড়াচ্ছে ঈর্ষার আগুনে। আপনমনেই সে বিড়বিড়ায়,
“bloody bitch!”

আবেগ একদম কাছাকাছি থাকায়, একদম স্পষ্টই শুনতে পায় কথাটি। মৃদু হাসে সে। প্রেয়সীর হৃদয় দশা সহজেই বোধ করতে পারে৷

আবেগ ও সামায়া মিস. এলিনার সাথে পায়ে পা মিলিয়ে এগিয়ে যায় ডিটেকটিভ এস.কে এর কেবিনের দিকে।

কেবিনটির দেয়াল ও দরজা সবই কাঠের। দু’বার নক করে দরজা খুলতেই কালো ছায়া বা ধোঁয়া জাতীয় কিছু ছুটে বেরিয়ে গেল যেন তাদের ছুঁয়ে। চমকে উঠলো তিন জন মানব।

পুরো কামরায় যেন ঝড় বয়ে গিয়েছে। সম্মুখে ক্ষত-বিক্ষত অবস্থায় কেবিনের সোফায় পড়ে আছেন ডিটেক্টিভ এস.কে.। তার গোটা মুখে আঁচড়ের দাগ, গায়ের শার্ট-প্যান্টও এলোমেলো, ছেঁড়াখোঁড়া। দ্রুতো পা চালিয়ে যায় সকলে তার নিকট।

মিস এলিনা বিলম্ব না করে এম্বুলেন্সের জন্য কল করে। আবেগ জিজ্ঞেস করে,
“Are you okay? What happened to you? Who did this?”

শ্বেতাঙ্গ ভদ্রলোক জোরে জোরে শ্বাস নিতে নিতে বহু কষ্টে অনেকটা সময় নিয়ে উত্তর দেয়,
“I don’t know how it all happened. But I strongly felt some demonic force. I believe it was happening because of helping you.”

কথা সমাপ্ত হতে না হতেই স্ট্রেচার নিয়ে দরজা ঠেলে প্রবেশ করে নিয়োজিত কর্মীরা। ডিটেকটিভ এস.কে.-কে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিলো, তবে পথিমধ্যেই সে কোনোরকম অক্সিজেন মাস্ক নামিয়ে আবেগকে ডাক দিয়ে তার হাতে একটি পেন্ড্রাইভ ধরিয়ে দেয়।

___

বিকেল নেমেছে আমেরিকার আকাশ। কী অদ্ভুৎ না! ধরা-ছোঁয়া যাওয়া ভূমি কিংবা জলাশয়ের মতোন অসীম আকাশটাও ভাগাভাগি করে নিয়েছে মানব।

গাড়ির কাচের দেয়ালে মাথা ঠেকিয়ে এসব অহেতুক কথাগুলো খেলা করছে সামায়ার মনে। হয়তো জটিল পরিস্থিতিকে এড়িয়ে যাওয়ার গোপন পরিকল্পনা মস্তিষ্কের। আবেগ চিন্তিত ভাবে পেন্ড্রাইভটা বারবার দেখছে।

হুট করেই ড্রাইভার জোরে ব্রেক কষে। ঘোর ভাঙে দু’জনের। আবেগ কিঞ্চিৎ রাগ নিয়েই তাকায় ড্রাইভারের দিকে।

“What happened!”

বলতে বলতেই গাড়ির সামনে দেখতে পায় মূর্তিমান এক কালো পোশাকধারী লোককে। অদ্ভুৎ ভাবে বসে আছে রাস্তার মাঝখানে, লম্বাটে মানুষটি, গায়ের পোশাক ময়লাটে, পাগল বা ভিক্ষুক মনে হচ্ছে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে। নতুন এক ঝামেলার উদয়।

ড্রাইভারের উদ্দেশ্যে শুধায়,
“You stay. I am going out to see what’s happening.”

“No, please don’t go sir.” আতঙ্কিত কণ্ঠে বলতে বলতে গাড়ি স্টার্ট দেয় গাড়িচালক। লোকটিকে পাশ কাটিয়ে শা করে চলে যায় গাড়িটি সামনের দিকে।

হতবাক আবেগ ও সামায়া, রাগান্বিতও হয়।

“What are you doing man? Didn’t you see that guy? Maybe he was hit by our car! Maybe he needed help!”

“Sir, forgive me. But that… ঐটা মনে হয় মানুষ ছিল না।” আতঙ্কে নিজের মাতৃভাষায় উত্তর দিয়ে ফেলে লোকটি।

চমকে উঠে তারা। সচকিত হয়ে পিছন ঘুরে তাকায়। রাস্তাটি জনমানবশূন্য। গায়ে শীতল শিহরণ বয়ে যায় দু’জনের। একে অপরের দিকে তাকায়। জানালার বাহিরে খেয়াল করতেই ভয় ও আতঙ্কে আবেগের হাত আঁকড়ে ধরে মুঠিতে।

তার দৃষ্টি অনুসরণ করে আবেগ সেদিকে তাকায়। আঁতকে উঠে সেই কালো পোশাকধারী জীবটি তাদের গাড়ির সাথে সাথে চলছে। সূক্ষ্ম ঘাম বেয়ে পড়ে ললাট হতে। ড্রাইভার বুঝতে পেরে গাড়ির স্পিড আরও বাড়িয়ে দেয়। মনে মনে সবাই সূরা আল নাস ও আয়াতুল কুরসি পড়তে শুরু করে। হাওয়ায় মিলিয়ে যায় অশুভ শক্তিটি।

স্বস্তির শ্বাস ফেলে সকলে। আর কিছুটা পথ বাকি, আশা করা যায় অক্ষতদেহে পৌঁছে যাবে। তবুও সূরা-কালাম পরা ছাড়ে না কেউ।

___

ক্রিং! ক্রিং!
বেল বেজে উঠে। মিহিরুন্নিসা বানু তখন রাক্বী আনওয়ার সাহেব এবং তাঁর অন্যান্য সঙ্গীদের সাথে আলোচনায় ব্যস্ত। ঘোর ভঙ্গ হয় তাঁর।

কিছুক্ষণ পূর্বেই রাক্বী সাহেব গোটা বাড়িকে বদ্ধ করে দিয়েছেন আল্লাহর পবিত্র বাণীর সহায়তায়। তিনি এও উপদেশ দিয়েছেন এমতাবস্থায় কারো বাড়ি থেকে না বের হওয়াই উত্তম। বদজ্বীনেরা নানাভাবে ধোঁকা দিয়ে তাঁদের বের করার প্রচেষ্টা করতে পারে।

তাঁর আতঙ্কগ্রস্ত আঁখিদুটি দেখে রাক্বী সাহেব তাঁকে বসে থাকতে ইশারা করে নিজের একজন সহকারীকে পাঠান। তিনি কী-হোলে দেখে ও জিজ্ঞাসাবাদ করে দরজা খুলেন।

বিচলিত হয় আবেগ ও সামায়া এমন আচারণে। অভ্যন্তরে প্রবেশ করে। সাথে সাথেই দরজা লাগিয়ে দেন মানুষটি।

“এখানে কী হচ্ছে? আমি কিছু বুঝতে পারছি না।”

রাক্বী আনওয়ার সাহেব তাকে শান্ত গলায় বোঝায়। আবেগ কৃতজ্ঞ দৃষ্টিতে তাকায়।

“আপনাকে যে কী বলে ধন্যবাদ দিব বুঝতে পারছি না চাচাজান। আপনারা যদি সাহায্য না করতেন। ”

“এতে ধন্যবাদ দেওয়ার কিছু নেই। যদি কারো সাহায্যেই না আসে তবে এই জ্ঞান-বিদ্যা থেকে লাভ কী? তা তোমরা কি ঠিকানাটা আনতে পেরেছো?”

আবেগ ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে। কোনোরকম মাথা দুলিয়ে নিজের ঘরের দিকে অগ্রসর হয়। সামায়া রাক্বী আনওয়ার সাহেবকে সালাম দিয়ে জানায় ডিটেকটিভের দপ্তরে কী হয়েছিল।

“চিন্তা কোরো না, মা। ইনশা আল্লাহ, আল্লাহর রহমে সব ঠিক হয়ে যাবে।”

সামায়া মলিন হেসে বিদায় নিয়ে কামরায়। আবেগ তখন সবে পেনড্রাইভটা ল্যাপটপে ঢুকিয়েছে।

পেনড্রাইভে রাখা ফাইলটি খুলতেই বুঝতে পারে ক্যানো ঐ দল গোয়েন্দাকে বিরক্ত করে। বস্তুত, গোয়েন্দা সংস্থাটি গ্রুপটির অবস্থান সহ, খুটিনাটি অনেক বিষয় সম্পর্কেই জেনে ফেলেছিল।

___

ট্রেইনে বসে আছে সকলে। গন্তব্য আলাস্কা। আলাস্কা ঠান্ডা, খুব ঠান্ডা। আলাস্কা আমেরিকার বৃহত্তম জাতীয় বন, টঙ্গাস জাতীয় বনের আবাসস্থল। শীতলতার প্রায় সকল পরিমাপ দিয়ে আলাস্কা নিম্ন ৪৮ রাজ্যের (সংলগ্ন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র) যেকোনো অংশকে ছাড়িয়ে গিয়েছে। আলাস্কায় আছে সবচেয়ে ঠান্ডা শীতকাল, সবচেয়ে শীতল গ্রীষ্মকাল, দীর্ঘতম শীত, সবচেয়ে বেশি হিমাঙ্কের দিন।

এক সঙ্গে বসে আছে সামায়া ও আবেগ। একটু দূরেই অবস্থান রাক্বী আনওয়ার সাহেব ও তার সঙ্গীদের এবং ফাদার মাইকেলের। মিহিরুন্নিসা বানুকে ইচ্ছাকৃত ভাবেই আনেনি আবেগ, বয়স্ক মানুষ। কতো কী না দেখতে হবে, পাড় করতে হবে কে জানে!

আবেগের হৃদয় আজ মানছে না কোনো সমাজ বা মানব সৃষ্ট নিয়ম। চোখ জোড়া অশ্রুতে টইটম্বুর। আনমনেই ভাবছে,

– তার কি আর দেখা হবে দিদার সাথে? এখন কি শেষ মুহূর্তগুলো কাটাচ্ছে সামায়ার সাথে? এই অভিশাপ হতে কি আদৌ মুক্তি পাবে না কি চিরসমাপ্তি হবে সবকিছুর তার অন্ততে?

নির্নিমেষ চাহনি তার দিকে সামায়ার। জানে না তার অশ্রুসিক্ত চোখের কারণ, তবু্ও অসহ্যকর এই অশ্রু। কিছু না বলেই যুবকের ডান হাতটি হাতের মুঠোয় নিয়ে বুকে মাথা রাখে সে৷ নিমিষেই ঠোঁটের কোণে হাসি এসে যায়। এ যেন আশ্বস্ত করার এক অঘোষিত প্রক্রিয়া।

___

আজ তিন দিন হলো আলাস্কায়। এখানের একটি গেস্ট হাউজে উঠেছে সকলে। এখানে আসার পর প্রায় দশ-বারো বার আক্রমণ হয়েছে তাদের উপর, ঠিক আক্রমণ নয় ফিরে যাওয়ার জন্য ভয় দেখানোর প্রচেষ্টা। সামায়া তিনদিন ধরে নির্দিষ্ট ঠিকানা চিহ্নিত করতে পারছে না, চেষ্টা করছে। অবশেষে আজ সে সফল।

আবেগ রুমে আসতেই তাকে লাফাতে লাফাতে জড়িয়ে ধরে সে। উত্তেজনা সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে।

“Yeah! Yeah! I did it! I did it!”

“আরে কী হয়েছে তা তো আগে বল! এভাবে লাফাচ্ছিস ক্যানো?”

“আমি পেয়ে গিয়েছি ঐ গ্রুপের ঠিকানা। জঙ্গলের দিকে থাকে তারা। আমাদের এখান থেকে প্রায় ঘণ্টা চারেকের দূরত্বে।”

আনন্দিত হয় আবেগ। রাক্বী আনওয়ার সাহেবকে যেয়ে জানায়। আনওয়ার সাহেব বলেন,
“আজ যাওয়া ঠিক হবে না। আগামীকাল থেকে রমজান শুরু। রমজানে আল্লাহর রহমত বেশি হয়। আমরা আগামীকাল রোজা রেখে ফজরের নামাজ পড়ে যাবো।”

“ঠিক আছে, চাচাজান। আপনি যা বলেন।”

দিনটি কোনোরকম কাটায় দুশ্চিন্তায় সকলে। সন্ধ্যা নামতেই আবেগের ফোনে বাংলাদেশী এক নম্বর থেকে কল আসে, নম্বরটি আবেগের চেনা। সামায়ার ভাইয়ের নম্বর। অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু শুনতে হবে জেনেও রিসিভ করে।

“আসসালামু আলাইকুম ভাইয়া।”

অপরপাশ হতে ভাঙা গলায় চাপা রাগের সহিত ভেসে আসে,
“আমি তোমার কথা বলতে চাই না ছেলে, আমার বোনকে ফোন দাও।”

আবেগও তাই করে। সামায়া এতো দুশ্চিন্তার মাঝেও খুশি হয় পরিবারের কারো কল পেয়ে। ম্লান হেসে ফোন কানে ধরে। তবে যা শুনে তাতে কান্নায় ভেঙে পড়ে। হাত থেকে ফোন পড়ে যায় মেঝেতে।

সচকিত হয়ে সামায়াকে আঁকড়ে ধরে সে।
“কী হয়েছে কান্না করছো ক্যানো? কী বলেছে ভাইয়া?”

“আ-আবেগ ভাই, আম্মু… আম্মু ভালো নেই। আম্মু হার্ট এ্যাটাক করেছে হাসপাতালে ভর্তি করেছে একটু আগেই। ওটিতে ঢুকার আগেও না কি আমার নাম নিচ্ছিল৷ ভাইয়া আমাকে যেতে বলছে। আল্লাহ এ কেমন পরীক্ষায় ফেললো আমায়, আমি তোমাকে ছেড়ে কীভাব…”

আরও ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে সে। আবেগের মুখ হুট করেই কাঠিন্য রূপ ধারণ করে।

“তুমি আজকেই রওনা হবে। আমি এখনই তোমার যাওয়ার ব্যবস্থা করছি।”

“আমি এ অবস্থায় আপনাকে ছেড়…”

❝তোমার এখানে কোনো কাজ বা প্রয়োজন নেই সামায়া, দোয়া করা ছাড়ে। বর্তমানে আমার সঙ্গী হওয়ার চেয়ে তোমার মায়ের নিকট যাওয়া প্রয়োজন।”

“কিন্তু”

“আমি কিচ্ছু শুনতে চাই না।”

ঐ রাতেই একজন বিশ্বস্ত রাক্বীর সাথে নিউইয়র্কের উদ্দেশ্যে রওনা দেয় সামায়া। সেখান থেকেই বাংলাদেশে ফিরবে। যাওয়ার পূর্বে পূর্বে বারবার পিছন ঘুরে আবেগকে দেখছিল সে। কে জানে যদি এটাই হয় শেষ সাক্ষাৎ!

___

প্রায় তিন মাস ধরে বিষাদময় জীবন যাপন করছে সামায়া। বৈরাগী হয়েছে যেন। আলিমা বেগম এখন সম্পূর্ণ সুস্থ। সুযোগ বুঝে সামায়া ও তার বাবা সকল ঘটনা খুলে বলেছে গোটা পরিবারকে। তবে আবেগ ও মিহিরুন্নিসা বানুর কোনো খবর নেই আসার পর হতে। দেশেও ফিরেনি তাঁরা।

প্রতি নিয়ত সে দোয়া করে আল্লাহর নিকট প্রিয়তমেত সুস্থতার। প্রতিটি মোনাজাতে তার এই একটিই চাওয়া। আশা, কোনো না কোনো দিন তো ফিরে তাকাবে আল্লাহ তায়ালা, কবুল করবে তার দোয়া, সাক্ষাৎ হবে প্রিয় মানুষটির সাথে।

গোটা পরিবার একমাত্র কন্যার এমন আচারণে আশাহত। মেয়েকে বোঝায় জীবনে আগাতে। আলিমা বেগম তো প্রায়শয়ই অর্ধরাত্রিতে কেঁদে উঠেন, স্বামীকে দোষারোপ করে মেয়ের দশার জন্য।

আজ কুরবানী ঈদের দিন। সারা বাড়িতে অন্যরকম আমেজ। বাসার নিচে জবাই চলছে, বালতি করে গরুর গোশতো আসছে, ভাগাভাগি চলছে গরীব, আত্মীয়স্বজন ও নিজেদের জন্য।

মনে আনন্দ নেই শুধু সামায়ার। নিজের ঘরে বসে আছে সে তসবিহ হাতে। হুট করেই বাহির হইহট্টগোলের শব্দ। সবাই চমকিত হলেও হয় না সে৷ নির্বিকার চিত্তে বসে থাকে। তবুও কোনো এক অজানা কারণে হৃদস্পন্দন বেড়ে চলেছে তার, অশান্ত হৃদয় ছটফট করছে যাওয়ার জন্য। কোনো এক অজানা ঘোরেই সামায়া ধীর পায়ে বারান্দায় চলে গেল।

চোখ যেন জুড়িয়ে যাচ্ছে তার! এ যে আবেগ গাড়িতে গা ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে, বাঁকা চাহনি এদিকে। অস্পষ্ট ভাবে শুনতে পেল কেউ বলছে,
“আল্লাহর রহমতে রাক্বী সাহেব কাবু করতে পেরেছে বদ জ্বীনদের। আর ঐ কালুজাদুকরও মৃত। মুক্তি হলো বেচারার।”

অবিশ্বাস্য বোধ হচ্ছে সামায়ার। আদৌ মানুষটি কি সত্যি এসেছে যুদ্ধ জয় করে না কি শুধুই এক মিষ্টি কল্পনা!

___

এখানে সমাপ্ত হলো অরণ্যবহ্নি গল্পটি। ঠিক তখনই পিঠে এসে ঠেকলো কারো উত্তপ্ত নিঃশ্বাস। হেসে উঠলো লেখিকা। না তাকিয়েই মিথ্যে রেগে বলল,
“সবসময় দুষ্টুমি ভালো লাগে না, আবেগ ভাই।”

“সবসময় আমাকে রেখে গল্পকে সময় দেওয়ায় ভালো লাগে না রে মায়াবালিকা! যাই হোক তোর গল্প কি অবশেষে শেষ হলো?”

“হুম, হলো তো শেষ। পড়বে?”

“উহু! আমার এতো সময় নেই।”

❝হু, তাই তো লুকিয়ে লুকিয়ে পড়ো। ইগোস্টিক কোথাকার!”

“আচ্ছা, একটা কথা বল তো মেয়ে। তোর সব গল্প নায়ক আমি, তবে নায়িকার চরিত্রে অন্যের নাম কেন? ঈর্ষা হয় না?”

“উহু, লাগে না। তবুও স্বস্তি লাগে, গল্পে তোমাকে পেয়েও মেয়েগুলো পায় না। আর আমি তোমাকে একবিন্দুও না পাওয়ার কল্পনাও করতে পারি না। তাছাড়া ভয় হয় তোমার আমার সম্পর্কে যদি কারো নজর লেগে যায়! তার চেয়ে বরং অবাস্তব ভালোবাসার গল্পগুলো পড়ুক সবাই, নজর লাগলেও সেই নকল ভালোবাসা বা সম্পর্কে উপরই লাগুক, আমাদের নয়।”

আরও গভীর হয় মানুষটির স্পর্শ। ঘোর মাখা কণ্ঠে শুধায়,
❝ মায়াবালিকা, তুই আমার অরণ্যবহ্নি । আমার হৃদয় অরণ্য প্রেমের অগ্নিতে পুড়িয়ে ছারখার করে ফেলে যে।”

__সমাপ্ত__
বিঃদ্রঃ এমন ইন্ডিং দেওয়ার কোনো রূপ পরিকল্পনা ছিল না। অনেক কিছু বাদ দিয়েছি, পরিবর্তন করেছি গল্প তাড়াতাড়ি শেষ করতে। আমি কনফিউজও ছিলাম এ নিয়ে তাই এতোদিন দেরি করলাম শেষ করতে। যাই হোক আমি দুঃখিত কারো ভালো না লাগলে, আমি নিজেও স্যাটিসফাই না যেমনটা চন্দ্রপুকুর বা অন্যান্য গল্প লিখে ছিলাম।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here