অবন্তর আসক্তি পর্ব ২৩

0
440

#অবন্তর_আসক্তি
#পর্ব_২৩
#শারমিন_আক্তার_বর্ষা
______
অপ্রত্যাশিত দু’জনেই এক বড় ষড়যন্ত্রের শিকার হলো। যা কখনো ভাবেইনি তাদের সাথে এমনটা হবে। অনাকাঙ্ক্ষিত জায়গায় অনাচ্ছাদিত তাদের সাথে ঘটে যাওয়া দূর্ঘটনা ভুলে যেতে চায় অভ্র। আজকের রাত তার কাছে কাল রাত্রির মতো বিষাদ লাগছে। গ্রামের মধ্যে ছোট একটা মাটির ঘরে জানালা গেষে দাঁড়িয়ে আছে অভ্র। জানালা দিয়ে বাহিরে দূর আকাশের গোলাকার বৃত্তর মতো গোল চাঁদটার দিকে সরু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে অভ্র। ঘরটার মধ্যে জ্যোৎস্না রাতের আলো পস্ফুটিত হচ্ছে। অন্ধকার ঘরটা জ্যোৎস্নার আলোয় জ্বলজ্বল করছে। মাটিতে একটা পাটি বিছানো পাটির উপরে একটা চাদর মুড়ানো। চাঁদরের উপর নেশাগ্রস্ত হয়ে ঘুমিয়ে আছে বর্ষা।

জানালার সামনে একটা কুকুর অভ্রকে দেখে ঘেউঘেউ করা শুরু করেছে। চাঁদের দিকে তাকিয়ে গভীর চিন্তায় মগ্ন ছিল অভ্র। কুকুরের ডাকে ঘোর কেটে যায় তার। দৃষ্টি নিচে নামিয়ে কুকুরটার দিকে একনজর তাকিয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে মাটিতে শুয়ে থাকা মেয়েটা অর্থাৎ বর্ষার দিকে তাকালো। জানালার পাশ থেকে সরে আসল।

বর্ষার মাথার কাছে বসে চুলগুলো তে আলতো ভাবে বিলি কেটে দিতে লাগল। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল বর্ষার ঘুমন্ত মুখটার দিকে, আনমনে বলে উঠল,

‘ তোকে আমি চেয়েছি খুব করে চেয়েছি। নিজের থেকেও বেশি আমি তোকে চেয়েছি। কিন্তু এভাবে নয়। আজকের রাতের কথা হয়তো তোর মনেও থাকবে না। ভোরের আলো পস্ফরিত হওয়ার আগেই তুই সব ভুলে যাবি৷ আমিও চাই না তোর কিছু মনে থাকুক কেননা, আমি চাই না এমন একটা ভয়ংকর রাতে গা হিমহিম করা দূর্ঘটনার কথা তোর মনে থাকুক। খুব করে চাই যাতে তুই ভুলে যাস৷ যদি মনে রাখিস তাহলে হয়তো কখনো আমাকে ক্ষমা করতে পারবি না৷ কিন্তু বিশ্বাস করিস আমি যা করেছি তোর ভালোর জন্য করেছি। নিজের কথা ভেবে একদম করিনি। আমি যদি এই পদক্ষেপ না নিতাম তাহলে তোর যে বড় ক্ষতি হয়ে যেতো। না জানি গ্রামবাসীরা কি করতো? তবে কথা দিচ্ছি তোকে আজ আমি, আজ থেকে তুই সম্পূর্ণ আমার রেসপনসেবলিটি। তোর অগোচরে তোকে আগলে রাখার দায়িত্ব আজ থেকে আমার। তুই হয়তো ভুলে যাবি নেশা কেটে গেলে কিন্তু আমি? আমি কিভাবে ভুলবো? বলতে পারিস? উঁহু, বলতে পারবি না। কারণ আমি নিজেই ভুলেও ভুলতে চাই না। আজকের রাতটাকে স্মৃতির পাতায় খুব আদর ভালোবাসা ও যত্ন সহকারে তুলে রাখবো। লিখে রাখবো ইতিহাসের পাতায়। যখনই ইচ্ছে হবে পাতা উল্টিয়ে পড়ে নেবো। তবুও ভুলতে দেবো না নিজেকে। তোকে আবদ্ধ করে রাখবো আমার স্মৃতি চারণে।

*

অফিসের কাজে হিমশিম খাচ্ছে অভ্র৷ লাইফে প্রথম আজ বাবা ও চাচাদের সাথে অফিসে এসেছে। সব সময়ই সে খোঁটা দিয়ে বলতো,’ তোমরা সারাদিন তো বসে বসে কাজ করো। তাতে আবার এত কিসের কষ্ট হুহহ? ‘

অভ্রর এমন কথায় বিরক্ত হয়ে তাকে আজ অফিসের কঠিন কঠিন কাজ দেওয়া হয়েছে। সে সব দিক সামলাতে সামলাতে আজ বেহাল অবস্থা অভ্রর। এদিকে সে খেয়াল করেছিল বর্ষার ফোনের লোকেশন কোণ্থেকে কোণ্থায় গিয়েছিল। ভেবেছিল বন্ধুদের সাথে ঘুরতে গিয়েছে। তাই সে ওতো গুরুত্ব দেয়নি। অফিসের কাজে নিজেকে ব্যস্ত করে নেয়।

রাত বাজে ৯টা অথচ বর্ষা এখনো বাড়ি ফিরেনি। বাড়িতে সকলে টেনশনে মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে। বর্ষার মা অফিসে তার স্বামী বর্ষার বাবা-র কাছে কল দেন। তাকে বিস্তারিত জানালে তারাহুরো করে অফিস থেকে বাড়িতে ছুটে আসে তারা সকলে সাথে অভ্র ও আসে।

বাড়িতে এসে অভ্র রিয়ার সাথে কথা বলে। রিয়া কান্নার জন্য সঠিক ভাবে কথাও বলতে পারছিল না। অভ্র জোরেসোরে ধমক দিলে অভ্রকে সব কিছু বলে দেয় রিয়া। অভ্র ছুটে বাড়ি থেকে বের হয়। বের হওয়ার পূর্বে সকলকে বলে যায়। তারা জেনো কেউ টেনশন না করে যেখান থেকেই হোক বর্ষাকে খুঁজে নিয়ে আসবেই৷
বাইক নিয়ে বের হয়। বর্ষার ফোনের লাস্ট লোকেশন চেক করে সেদিকেই যাচ্ছে।
_______
কানের কাছে ভো ভো করছে মশা ও মাছি। আশ পাশ থেকে কুকুর ও শিয়ালের ডাক ভেসে আসছে। মশার ভোভো ও শিয়ালের ডাকে ঘুম ভেঙে যায় বর্ষার। হাত দিয়ে চোখ ঢলতে ঢলতে উঠে বসে। চারপাশে তাকিয়ে দেখল শুধু অন্ধকার। তবে আকাশের চাঁদের আলোয় কিছুটা আবছা আবছা দেখা যাচ্ছে।

বর্ষা চোখ বুলিয়ে সামনে তাকাতে দেখল কয়েকটা শেয়াল ডাকতে ডাকতে এদিকেই আসছে। বর্ষা ভয়ে ধান ক্ষেতের মধ্যে লুকিয়ে পরে। হাত পা লাগাতার কাঁপছে। একবার শেয়ালের নজরে পরলে সকলে মিলে আজ ওকে দিয়েই ডিনার সারবে। কোন আক্কেলে যে ঘুমিয়েছিল? সব কিছু ওই চিঠিবাজের জন্য ইচ্ছে করছে নিজের মাথার চুল নিজেরই ছিড়ে ফেলতে। শেয়ালের ডাক বন্ধ হয়ে গেলে বর্ষা ধান ক্ষেতের মধ্য থেকে বের হয়। সেই সকালে খেয়েছিল আর সারাদিন কিছুই খাওয়া হয়নি। খিদে পেটের মধ্যে ইঁদুর ছুঁইছুঁই করছে।
রাস্তায় তাকিয়ে আছে। কোন দিকে যাবে বুঝতে পারছে না। কোন দিক দিয়ে এসেছিল সেটাও ভুলে গেছে। এদিকে প্রচুর পানি পিপাসা লেগেছে গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আসছে। বর্ষা ব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে হাঁটতে লাগল। কিছুদূর সামনে যেতেই দেখল একটা লোক বসে আছে সাথে একটা পানির বোতল।
বর্ষা কোনো কিছু না ভেবেই ছুটে গেলো মধ্য বয়স্ক লোকটার কাছে। অচেনা লোকটার সামনে দাড়িয়ে হাত বাড়িয়ে বলল,’ আমার অনেক পানি তৃষ্ণা পেয়েছে। আঙ্কেল পানির বোতল টা আমাকে একটু দিবেন। ‘

লোকটা মাথা তুলে নেশালো দৃষ্টিতে বর্ষার দিকে তাকিয়ে বলল,’ পানি খাবে? ‘

বর্ষা মাথা উপর নিচ নাড়িয়ে মুখ দিয়ে বলল,’ হুম ‘

লোকটা ঠোঁট বাঁকা করে হাসল, বোতলটা বর্ষার দিকে বাড়িয়ে দিলো। বর্ষা হাত বাড়িয়ে বোতলটা নিয়ে খেতে শুরু করল। লোকটা হাত উপরে তুলে হাসতে হাসতে চলে গেলো। বর্ষা একঢোক খেতেই তার মাথা চক্কর দিয়ে উঠল। সে সাথে সাথে মাটিতে বসে পরল।
তবুও বর্ষা একঢোক একঢোক করে পুরোটা বোতলের পানি পেটে চালান দিয়ে দিলো। মিনিটের মধ্যেই বর্ষার নেশা হয়ে যায়। রাস্তায় বসে বসে মুরগির বাচ্চার মতো ঝিমাচ্ছে তখনই বাইক এসে থামলো বর্ষার সামনে৷ বাইক থেকে নেমে ছুটে আসছে অভ্র, বর্ষাকে ধরে দাঁড় করিয়ে পাগলের মতো গালে হাত রেখে জিজ্ঞেস করছে, ‘ কি হয়েছে? এখানে কিভাবে এলো? বাংলা মদ কোণ্থেকে পেয়েছিস? ‘

বর্ষা অভ্রর মুখের দিকে নেশালো দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, ‘ এই অভ্র তুমি আমাকে সব সময় বিরক্ত কেন কোরো? তুমি জানো আমার খুব খারাপ লাগে। ইচ্ছে করে তোমার চুলগুলো টেনে ছিঁড়ে দেই। ‘

বলেই বর্ষা অভ্রর চুল টেনে ধরল। অভ্র বর্ষার দুই হাত শক্ত করে চেপে ধরে অস্ফুটস্বরে বলল,’ বর্ষা লাগছে। তোর নেশা হয়ে গেছে চল বাড়িতে চল। ‘

‘ উঁহু আমি যাবো না। ‘ মাতাল কন্ঠে বলল।

‘ কেন যাবি না শুনি। জানিস বাড়ির সকলে কত টেনশন করছে? ‘

‘ আমি যামু না। আমি এখানেই থাকমু বাতাসে বাতাসে উড়ে বেড়াবো আকাশে। ‘

বলে বর্ষা অন্য দিকে চলে যাচ্ছিল। অভ্র ফট করে হাত ধরে নেয়। বাড়িতে মেসেজ দিয়ে সকলকে জানিয়ে দেয়, ‘ ও বর্ষাকে পেয়ে গেছে সকলে জেনো টেনশন না করে। ওরা এখনই আসছে। ‘

ফোন থেকে মাথা তুলে সামনে তাকাতে দেখে বর্ষা অন্য দিকে দৌঁড় লাগিয়েছে। অভ্র ও পেছন পেছন ছুটে গেলো। বেশ অনেকটা দূরে চলে গেলো। গ্রামের কিছু মুরব্বিরা দেখতে পায়। একটা মেয়ের পেছনে একটা ছেলে ছুটে যাচ্ছে। তার পরই তারা এসে দুজনের পথ আটকে দাঁড়ায়। দু’জনকে সাথে নিয়ে চলে যায় গ্রামের মাতব্বরের কাছে। গ্রামের মাতব্বর ফজল মিয়া তার মতামত পেশ করে। অভ্র বর্ষাকে এক হাতে বুকের সাথে ধরে রেখেছে। গ্রামের কিছু মানুষ ক্ষিপ্ত চোখে তাকিয়ে আছে তাদের দিকে।

মাতব্বরের কথার বিরুদ্ধে কথা বলে অভ্র। এদিকে বর্ষা মাতলামি করছে। অভ্রর কথায় গ্রামবাসিরা নারাজ হয়ে যায়। বর্ষাকে টান দিয়ে অভ্রর কাছ থেকে আলাদা করতে চাইলো। বর্ষাকে শক্ত হাতে ধরে অভ্র অনেক ভেবে মাতব্বরের প্রস্তাবে রাজি হয়।

কিছুক্ষণের মধ্যে বর্ষা সেন্সলেস হয়ে যায়। বর্ষাকে দুইহাতে আগলে নেয় অভ্র দুই হাতে বুকের সাথে জড়িয়ে নেয়। তাদের দু’জনকে একটা ঘরে রেখে বাহির থেকে দরজা বন্ধ করে দিয়ে সকলে চলে যায়৷ বর্ষাকে পাটিতে শুইয়ে দিয়ে সেই থেকে জানালায় গিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল।

*

সকালের এক চিলতে রোদ জানালা দিয়ে এসে বর্ষার মুখের উপর উপচে পরে। ঘুমে নড়েচড়ে উঠে বর্ষা৷ পিটপিট করে চোখ খুলে তাকিয়ে নিজেকে উপস্থাপন করল একটা মাটির ঘরে। উঠে বসে ঘরটায় চোখ বুলাতেই দেখল একটু দূরে অভ্র মাটির দেওয়ালের সাথে হেলান দিয়ে বসে ঘুমিয়ে আছে। বর্ষা উঠে অভ্রর পাশে গিয়ে বসে শীতলাকন্ঠে অভ্রকে ডাকতে লাগল।

অভ্র চোখ খুলে বর্ষাকে দেখে কর্কশকন্ঠে চেচিয়ে বলে উঠে,’ তুই আমার এত কাছে কি করছিস দূরে সর। ‘

বলে অভ্র উঠে দাঁড়ালো। আঁড়চোখে তাকিয়ে আছে বর্ষার দিকে। একহাত দিয়ে মাথা শক্ত করে চেপে ধরেছে। মাথাটা এখনো ঝিম মেরে আসছে মাথাটা ঘুরাচ্ছে। মাথায় হাত দিয়ে ঘুরে পরে যাচ্ছে বর্ষা। অভ্র ‘বর্ষাহহ’ বলে চিৎকার দিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে। বর্ষা আবারও সেন্সলেস হয়েগেছে। তাকে মাটিতে শুয়ে দিয়ে দরজায় দাঁড়িয়ে কাউকে দরজা খোলার জন্য ডাকতে থাকে।

তৎপর কয়েক জন এসে দরজা খুলে দেয়। অভ্র সকলকে বর্ষার অবস্থা জানালে সকলে তাদেরকে যেতে বলে। অভ্র বর্ষাকে নিয়ে গ্রাম ত্যাগ করে।

বর্ষা বাইকের পেছন থেকে অভ্রর গলা চেপে ধরে বলল, ‘ কেমন দিলাম। ‘

অভ্র হাসতে হাসতে বলল,’ তোকে তো এক্টিং এর এওয়ার্ড দেওয়া উচিত রে ‘

চলবে?

(কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষেধ)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here