অপরিচিত লেখিকাঃ তাহমিনা তমা পর্বঃ ২২

0
1227

#অপরিচিত
লেখিকাঃ তাহমিনা তমা
পর্বঃ ২২

মেহরাব কীভাবে হসপিটালে পৌঁছালো হয়তো সে নিজেও বলতে পারবে না। গাড়ি থেকে নেমে দৌড়ে ভেতরে চলে গেলো। লিফট না পেয়ে সিড়ি দিয়ে দৌড়ে গেলো। আরফার মা কেবিনের বাইরে বসে কান্না করছে। মেহরাব কোনো দিকে না তাকিয়ে ভেতরে চলে গেলো। আরফার হার্ট রেট ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে। কেউ ইনজেকশন দিচ্ছে আর কেউ ডি-ফিব্রিলেটর রেডি করছে হার্ট শক দেওয়ার জন্য। মেহরাবের পা মনে হয় জমে গেছে। সে এগোতে পারছে না।

হঠাৎ একজন নার্স মেহরাবকে দেখে বলে উঠলো, স্যার চলে এসেছেন।

ডক্টর মেহরাবের সামনে এসে বললো, স্যার তাড়াতাড়ি করুন, উনার হার্ট রেট একদম কমে গেছে। অক্সিজেন নিতে পারছে না। এতে ব্রেনে অক্সিজেন সাপ্লাই কমে যাবে তাতে উনি কোমায়ও চলে যেতে পারে আর মারাও,,,,।

ডক্টরের কথা শেষ হওয়ার আগেই তার দিকে অগ্নি দৃষ্টিতে তাকালো মেহরাব আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলো না দৌড়ে আরফার কাছে চলে গেলো। নার্স ডি-ফিব্রিলেটর রেডি করে মেহরাবের হাতে দিলে সে আরফাকে শক দিলো। শক খেয়ে আরফা জোরে শ্বাস নিয়ে বেড থেকে একটু উচু হয়ে উঠে আবার বেডে পরে গেলো। মেহরাব একদিকে আরফাকে শক দিচ্ছে আর ওর দুচোখ দিয়ে টপটপ পানি পড়ছে। এভাবে কয়েকবার দেওয়ার পর আরফার হার্ট রেট আস্তে আস্তে একটু স্বাভাবিক হয়ে এলো। সব ডক্টর যেনো হাফ ছেড়ে বাঁচলো। সবাই ধীরে ধীরে বের হয়ে গেলো আর মেহরাব বেড ঘেঁষে ফ্লোরে বসে পড়লো। আরফার ক্যানেলা লাগানো হাতটা ধরে নিরবে কাঁদতে লাগলো। মেহরাবের চোখের গরম নোনাজল আরফার হাত বেয়ে নিচে পড়ছে। মেহরাব আরফার হাতে একটা কিস করে হাতটা সাবধানে পেটের ওপর রাখলো। আরফা এমনই ধবধবে ফর্সা আর শরীরে রক্ত কমে যাওয়ায় মুখটা একদম ফ্যাকাসে লাগছে। মেহরাব কপালে একটা কিস করে বের হয়ে গেলো। এবারের মতো আরফার বিপদ কেটে গেছে। এখন জ্ঞান ফিরে এলে একদম বিপদমুক্ত হয়ে যাবে।

মেহরাব বের হতেই তাইয়েবা ওকে ধরে বললো, আ,,,আরফা আমার আরফা কেমন আছে ?

মেহরাব তাকালো আরফার মায়ের দিকে। একদিনে কী অবস্থা হয়েছে তার। সবাই চলে গেলেও উনি কোথাও যায়নি। মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছে না। কাঁদতে কাঁদতে বেহাল অবস্থা। মেহরাব কিছু বলবে তার আগেই তাইয়েবা ঢলে পড়লো মাটিতে। এই বয়সে এতো প্রেসার নিতে পারেনি সেন্সলেস হয়ে গেছে। মেহরাব তাড়াতাড়ি একটা কেবিনে নেওয়ার ব্যবস্থা করলো। চেক করে বুঝতে পারলো বিপি লো হয়ে গেছে। একটা স্যালাইন লাগিয়ে বের হয়ে এলো। মেহরাবের নিজেকে কেমন ছন্নছাড়া লাগছে। চারপাশে এতো মানুষ তবু মনে হচ্ছে কোনো নিস্তব্ধ জনমানবহীন জায়গায় আছে সে। তার মনের ভেতরের চিৎকার কারো কানে যাচ্ছে না। আরফার কিছু হলে সে শেষ হয়ে যাবে আর সয্য করার ক্ষমতা নেই তার। মেহেক কেমন পাথর হয়ে গেছে। তার ভেতরে অনুশোচনা হচ্ছে কেনো একবার খোঁজ নিলো না বাংলাদেশে। তাহলে হয়তো আজকের দিন দেখতে হতো না। নাতির সাথে ভালো সময় কাটাতে পারতো সে। মেহেকের মনে হচ্ছে সে মুজাহিদ খানকে এই নিষ্ঠুর জীবনে একা ফেলে গিয়েছে। মেহেক যেমন স্বামী হারিয়েছিলো সেও তো নিজের একমাত্র সন্তানকে হারিয়েছিলো। একটা বাবার কাঁধে সন্তানের লাশ যে কতটা যন্ত্রণাদায়ক তা বুঝার ক্ষমতা হয়তো মেহেকের নেই। এসব ভেবেই সে স্তব্ধ হয়ে আছে৷ তার ভালোবাসার মানুষ তাকে ছেড়ে যায়নি তার থেকে কেড়ে নেওয়া হয়েছে এটাও যেনো সয্য করতে পারছে না। সবার জীবনে কেমন অন্ধকার নেমে এসেছে এক ঝলকে। মেহরাব নিজের কেবিনে বসে ছিলো টেবিলে মাথা রেখে হঠাৎ কিছু মনে হতেই মাথা তুলে তাকালো। রাগে মুখ লাল হয়ে উঠলো মুহুর্তে, কিছু না ভেবেই বের হয়ে এলো হসপিটাল থেকে আর সোজা চলে গেলো থানায়। হাসান আর ইশতিয়াক দুজনকে আলাদা আলাদা হাজতে রাখা হয়েছে। গতকাল শুক্রবার ছিলো আর আজ শনিবার কোর্ট বন্ধ থাকায় কোর্টে চালান করা হয়নি। আজও থানাতেই থাকবে আগামীকাল সকালে কোর্টে চালান করা হবে। মেহরাব ইশতিয়াকের হাজতের চাবি চাইতেই বিনা বাক্য দিয়ে দিলো থানার ডিউটি অফিসার কারণ সে মেহরাবকে ভালো করেই চিনতে পেরেছে। গত কিছুদিনে যা যা হয়েছে তাতে শুধু থানার ডিউটি অফিসার না, সারাদেশের মানুষ চিনে গেছে আরফা আর মেহরাবকে। গতরাতে আরফা যখন মেহরাবকে ধাক্কা দেওয়ায় নিজের গুলি লাগে সেই ভিডিও রীতিমতো ভাইরাল হয়ে গেছে। সবাই ভালোবাসার নতুন ইতিহাস মনে করছে। মেহরাব দরজা খোলে ভেতরে গিয়ে দেখলো উল্টো লটকে রাখা হয়েছে ইশতিয়াককে। মেহরাবের কথায় ভালোই আদর আপ্যায়ন করা হয়েছে সেটা দেখেই বুঝা যাচ্ছে।

তবু মেহরাবকে দেখে বিশ্রি হেঁসে বললো, কী রে বিলাতী কুকুর, বউ কী পটল তুলছে ?

মেহরাব কিছু বলছে না রাগে শুধু ফোসফাস করছে আর রক্ত লাল চোখে ইশতিয়াককে দেখছে।

ইশতিয়াক আবার বললো, ইশ তোর কপালটা ভালো একটুর জন্য বেঁচে গেলি। সব হয়েছে ঐ মেয়েটার জন্য তবে তার শাস্তিও পেয়েছে(আবার ব্রিশি হেঁসে উঠলো) তবে তোর জন্য আফসোসও হচ্ছে এতো হট একটা বউ মাত্র একরাতের জন্য পেলি এটা কোনো কথা হলো (মন খারাপ করার ভান করে) তোকে তো একটা কথা বলাই হয়নি। সেটা কী জানিস ?

মেহরাব এখনো কিছু বলছে না। তবে মেহরাবের দিকে এখন কেউ তাকালে ভয় পেয়ে যাবে। ফর্সা মানুষ সম্পূর্ণ লাল রং ধারণ করেছে।

ইশতিয়াক মেহরাবের উত্তরের অপেক্ষা না করে আবার বললো, না তুই কীভাবে জানবি আমি তো তোকে বলিই নি। তাহলে এখন বলছি শোন। আরফাকে সেদিন কেনো কিডন্যাপ করেছিলাম বল তো ? থাক এটাও আমিই বলছি। আরফা যেদিন প্রথম হসপিটালে জয়েন করে ওকে দেখে পুরো মাথা ঘুরে গিয়েছিলো। কিন্তু ড্যাড বলেছিলো প্রোপার্টি হাতে না পাওয়া পর্যন্ত কোনো গন্ডগোল না করতে। তাই দাঁতে দাঁত চেপে বসেছিলাম সময়ে অপেক্ষায়। কিন্তু যেদিন আরফার জন্য ড্যাডের কাছে বকা শুনলাম আর মাথা ঠিক ছিলো না। ভেবেছিলাম কিডন্যাপ করে ওর আগুন ঝরা রুপ ভিডিও করে সারাদেশের মানুষকে দেখাবো আর ওর নরম তুলতুলে শরীরটাকে,,,,,,,

আর বলতে পারলো না তার আগেই সজোরে একটা পাঞ্চ করলো মেহরাব ইশতিয়াকের মুখে। সেটা করে শান্তি হলো না পাশে রাখা পুলিশের লাঠি দিয়ে ইচ্ছে মতো পেটাতে লাগলো। তাতেও রাগ কমছে না মেহরাবের। ভয়ে কেউ মেহরাবকে আটকানোর সাহসও পাচ্ছে না। ডিউটি অফিসার তাড়াতাড়ি রিয়ানকে ফোন করে জানিয়ে দিলো। মার সয্য করতে না পেরে ইশতিয়াক একসময় অজ্ঞান হয়ে গেলে পাশেই পানির বালতি ছিলো সেটা ছুঁড়ে মারলো মুখে আবার জ্ঞান ফিরতেই মারা শুরু করলো। ইশতিয়াকের এখন একটা শব্দ করার শক্তিও নেই। মেহরাব সামনে দাঁড়ানো পুলিশের কাছে একটা লাইটার চাইছে সে ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে বের করে দেয়।

মেহরাব ইশতিয়াকের বাঁধা হাতদুটো একত্রে ধরে বলে, এই হাত দিয়ে তুই আরফাকে স্পর্শ করার কথা ভেবেছিলি তাই না ?

ইশতিয়াক কিছু বলার মতো অবস্থায় নেই। তবু মাথা দিয়ে না বুঝানোর আর ছেড়ে দিয়ার জন্য বুঝানোর চেষ্টা করলো।

কিন্তু মেহরাব লাইটার জ্বালিয়ে বললো, এই হাতের আমি এমন অবস্থা করবো জীবনে কারো দিকে লালসার হাত বাড়ানোর আগে তোর রুহ কেঁপে উঠবে ভয়ে।

কথা শেষ হতে না হতেই মেহরাব ইশতিয়াকের হাতে লাইটার জ্বালিয়ে ধরলো। আগুনের তাপ হাতে লাগতেই ইশতিয়াক চিৎকার করে উঠলো। ইশতিয়াকের যন্ত্রণায় ছটফট করে চিৎকারগুলো মনে হচ্ছে মেহরাবের মনের আগুন ঠান্ডা করছে।

মেহরাব বললো, আগুন ধরিয়ে দিলে তাড়াতাড়ি পুড়ে যেতো কিন্তু এই আগুন তোকে একটু একটু পুড়বে আর তিলে তিলে যন্ত্রণা দিবে। মেহরাব একটু একটু করে ইশতিয়াকের দু’হাত পুড়ছে আর ইশতিয়াক যন্ত্রণায় ছটফট করছে। আর ছেলের যন্ত্রণা নিজের চোখের সামনে দেখে ছটফট করছে হাসান। বারবার মেহরাবকে বলছে ছেড়ে দিতে। কিন্তু মেহরাবের মাথায় খুন চেপে গেছে। এমনই রেগে ছিলো তারওপর ইশতিয়াকের আরফাকে নিয়ে বলা নোংরা কথা আগুনে ঘি এর কাজ করেছে। ইশতিয়াকের হাত পুড়ে ঝলছে গেছে। প্রায় বিশ মিনিট পর রিয়ান এসে উপস্থিত হলো আর মেহরাবকে জোর করে সরিয়ে আনলো।

রিয়ান রেগে বললো, মেহরাব তুমি কী পাগল হয়ে গেছো ? এ যদি এখানে মরে যায় তুমিও ফেঁসে যাবে আর আমিও।

মেহরাব আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলো না। চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে বললো, হ্যাঁ আমি পাগল হয়ে গিয়েছি। এই রাস্কেলদের জন্য আমার দাদাজান চলে গেলো। একটু আগে আরফাও চলে যেতে চেয়েছিলো, আমার মম শোকে পাথর হয়ে গেছে। আমার জীবনটা পুরো এলোমেলো করে দিয়েছে এরা ভাইয়া। আমি আর পারছি না, এদের কেটে হান্ড্রেড মিলিয়ন টুকরো করলেও আমার কষ্ট কমবে না ভাইয়া। একটুও কমবে না।

মেহরাব কাঁদতে কাঁদতে বসে পড়লে রিয়ান তাকে ধরে উঠিয়ে ওসির রুমে নিয়ে বসিয়ে জোর করে পানি খাওয়ালো তারপর বললো, চিন্তা করো না এদের নামে এমন কেস ফাইল করেছি ফাঁসি ছাড়া আর কোনো পথ পাবে না। আর সাধারণ পাবলিকও এদের বিরুদ্ধে ক্ষেপে গেছে তোমার আর আরফার ভাইরাল হওয়া ভিডিও দেখে। সবাই ফাঁসি চাইছে এদের দুজনের। এখন তুমি মাথা গরম করে সব ভেস্তে দিয়ো না।

এতোক্ষণে মেহরাবের মাথা একটু ঠান্ডা হলো। নিজেকে সামলে বললো, ভাইয়া আমি একজন ডক্টর, মানুষের কোথায় আঘাত করলে মারা যায় সেটা আপনাদের থেকে অনেক বেশি আমি জানি। যে আঘাত যন্ত্রণা দেয় কিন্তু মৃত্যু না সেই আঘাত আমি ঐ জানোয়ারকে করেছি। নিজের হাতে মারার হলে আগেই মারতাম আপনাদের হাতে তোলে দিতাম না। নিজের মনে জ্বলতে থাকা আগুন ঠান্ডা করতে এসেছিলাম। হয়ে গেছে এখন আসছি।

মেহরার রিয়ানের উত্তরের অপেক্ষা না করে থানা থেকে বের হয়ে হসপিটালের দিকে যেতে লাগলো।

১৭

ফোনে ফেসবুকিং করছিলো সিনথিয়া একটা ভিডিও দেখে থেমে গেলো। ক্যাপশনটা দেখে নিলো ভালো করে। নামটা ভুল পড়েছে ভেবে বারবার পড়তে লাগলে, না ঠিকই পড়েছে। বাংলাদেশের বিশিষ্ট শিল্পপতি মুজাহিদ খানের নাতি মেহরাব খানের বৌভাত অনুষ্ঠানে ঘটলো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা। ভিডিও প্লে করতেই এতো বছর পরও মেহরাবকে দেখে চিনতে কষ্ট হলো না সিনথিয়ার, বুকের বা পাশে চিনচিনে ব্যাথা অনুভব হলো মেহরাবের বিয়ের কথা শুনে। আরফাকে দেখে মুগ্ধ না হয়ে পারলো না সিনথিয়া। মনে মনে স্বীকার করতেও বাধ্য হলো আরফা সিনথিয়ার থেকে কয়েক গুন বেশি সুন্দরী। পুরো ভিডিও দেখে সিনথিয়া কী রিয়াকশন দিবে ভুলে গেলো। পুরো ঘটনা বুঝতে পারলো না শুধু দেখলো আরফা আর মেহরাব পাশাপাশি দাঁড়িয়ে ছিলো তবে কথা বুঝা যাচ্ছে না। হঠাৎ আরফা মেহরাবকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলো আর পরক্ষণেই নিজের বুক চেপে ধরলো যা মুহূর্তে লাল হয়ে উঠলো। মেহরাব উঠে দৌড়ে এসে তাকে ধরতেই ঢলে পড়লো আরফা মেহরাবের বুকে। ভিডিও এটুকুই তবে সিনথিয়ার চোখ থেকে পানি ঝড়াতে বাধ্য করলো।

সিনথিয়া বিড়বিড় করে বললো, আমি তোমার যোগ্য ছিলাম না৷ যে তোমার যোগ্য তাকে পেয়ে গেছো তুমি, শুধু হারিয়ে যেতে দিও না।

চলবে,,,,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here